Alapon

কুরআন শিক্ষা দিয়ে যিনি দুনিয়া বদলাতে চান -তিনি নোমান আলী খান !



নোমান আলী খান একজন কুরআনের শিক্ষক। যিনি কুরআন শিক্ষা দেনি তিনি হাদীসের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ । কোরআনের চমৎকার শৈল্পিক সৌন্দর্য উপস্থাপনার জন্যে তিনি বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের মুসলিম তরুণ প্রজন্মের কাছে এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। । কোরআনের শব্দচয়ন কতটা সৃজনশীল, ভাষা কতটা মনোমুগ্ধকর, অর্থ কতটা যৌক্তিক – এগুলোই নোমান আলী খানের চিন্তাভাবনা ও আলোচনার বিষয়। তাঁর বক্তব্যে কোরআনের অন্তর্গত সৌন্দর্য ও মুজিযা মানুষের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার ও অনলাইনে তাঁর বক্তব্য শুনে অসংখ্য মানুষ ইসলামের দিকে ফিরে আসছে এবং ইসলাম গ্রহণ করছে। তিনি প্রায় ২০টিরও অধিক তাফসীর গ্রন্থ পাঠ করেছেন। ফলে কোরআন নাযিলের ইতিহাস, শব্দচয়নের কারণ, ভাষার অলঙ্কার, অর্থের গভীরতা, যুক্তির প্রখরতা এবং ব্যাকরণগত শুদ্ধতার বিষয়গুলো তাঁর আলোচনায় ফুটে উঠে।অনেক ইসলামিক স্কলারগন তাকে ভাষাবিজ্ঞানী বলে সম্ভোদন করেছেন। ইসলামী ব্যক্তিত্বগণের জীবনীভিত্তিক অভিধান "দ্য ফাইভ হান্ড্রেড মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মুসলিমস" এটির পঞ্চম সংষ্করণে নোমান আলী খানকে কোন র‍্যাঙ্কিং ছাড়াই বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিমদের মধ্যে একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
উস্তাদ নোমান আলী খান হলেন একজন পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত আমেরিকান মুসলিম বক্তা। তবে তিনি জন্মগ্রহন করেন, জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহরে। তাঁর মাতৃভাষা জার্মানি। কিন্তু শিশু নোমান সেখানে ছয় মাসও থাকেননি। তাঁর বাবা পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করতেন বলে পরিবারসহ ছয় মাস বয়সে তাঁকে পাকিস্তানে চলে আসতে হয়। এখানেও তাঁর পরিবার দু’মাসের বেশি থাকেননি; চলে যান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় রিয়াদে, একটি পাকিস্তানি উর্দু মিডিয়াম স্কুলে।১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছয় বছর তাঁর পরিবার রিয়াদে অবস্থান করেন।এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি এতটা ধার্মিক ছিলেন না। এমনকি কলেজে তিনি ফিলোসফি ক্লাস নেওয়ার পর তিনি ২ বছর নাস্তিক ছিলেন।কাহিনীটা এইরকম যে , তিনি খ্রিষ্টানদের পরিচালিত একটি হাইস্কুলে ভর্তি হন। ফলে সবকিছুই তাঁর কাছে ভিন্ন মনে হলো। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পরিবেশ। বন্ধুরা সব ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন সংস্কৃতি লালন করে এবং চলেফিরে ভিন্নভাবে। এতে তাঁর কাছে অনেক অসহায় লেগেছিল তখন। প্রায় দু’বছর পর্যন্ত তিনি কোনো মুসলিমের দেখা পাননি। শুক্রবারে ক্লাস থাকায় দু’বছর তিনি জুমার সালাতও পড়তে পারেননি। অথচ তখন তিনি হাইস্কুলের ছাত্র। তাঁর বন্ধুদের আচার-আচরণের মধ্যে নৈতিকতা ও ধর্মের কোনো ছোঁয়া ছিল না। ফলে তিনিও ধীরে ধীরে তাঁদের আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে বাধা দেয়ার কেউ ছিল না; এমনকি তাঁর পরিবারও না। একসময় তাঁর মাঝে প্রবল অপরাধবোধ জেগে উঠে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। হয় তাঁকে ধর্ম ত্যাগ করতে হবে, না হয় স্কুল ত্যাগ করতে হবে। দুর্ভাগ্য, অন্য কোথাও ভালো স্কুল নেই বলে পরিবার তাঁকে স্কুল ত্যাগ করতে দিল না। স্কুল শেষে তিনি কলেজে ভর্তি হলেন। আগের মতই বন্ধুদের সাথে চলাফেরা, সবকিছু। এবার তিনি আস্ত নাস্তিক হয়ে গেলেন। প্রায় দু’বছর তিনি নাস্তিকতার চর্চা করেন। এইভাবে ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যাকে ইসলামের হিদায়াত দিবেন তাকে কি এইভাবে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। তারপর সময় হলো ফিরে আসার,ফিরে আসার গল্পটা এইরকম যে , একদিন আমেরিকান মুসলিম স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের দু’জন সদস্যের সাথে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কোরআনের আলোচনা করছিলেন; তিনি তা শুনছিলেন। যদিও এসব ধর্ম-কর্মের আলাপ তাঁর কাছে তখন ভালো লাগত না। তাঁরা নিজেরাই নোমান আলী খানের সাথে পরিচিত হলেন এবং ছায়ার মতো তাঁর সাথে চলাফেরা শুরু করলেন। তবে তাঁরা কখনো সরাসরি নোমান আলী খানকে কোরআন পড়তে কিংবা সালাত আদায় করতে বলেননি। এমনকি কখনো ইসলামের দাওয়াতও দেননি। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন তাঁরা নোমান আলী খানের সাথে সময় কাটাতে লাগলেন। এতেই নোমান আলী খানের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়। একদিন তাঁদের একজন নোমান আলী খানের সামনে সালাত পড়লেন। নোমান আলী খানের কাছে খুব খারাপ লাগলো – কারণ, তিনি সালাতের অনেক কিছুই ভুলে গেছেন; এমনকি মাগরিবের সালাত কয় রাকাত, তাও তিনি ভুলে গেছেন। নিজের অজান্তেই তিনি মুসলিম স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের এ দু’জন ভাইকে বন্ধু ভাবতে লাগলেন। এবং তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতেও লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে থাকে। তিনি কোরআনের অনুবাদ পড়া শুরু করলেন। আল্লামা ইউসুফ আলীর ইংরেজি অনুবাদ পড়তে লাগলেন। কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে কোরআন বোঝা খুবই কষ্টকর। কোথায় বাক্যের শুরু আর কোথায় বাক্যের শেষ – কিছুই তিনি বুঝতে পারছিলেন না। কেনো আল্লাহ হঠাৎ করে এক ইস্যু থেকে অন্য ইস্যুতে চলে যান – এসব কিছুই তিনি অনুবাদ পড়ে বুঝতে পারেননি। তখন তিনি ভালোভাবে কোরআন বোঝার জন্যে গুগল


সার্চ করতে লাগলেন। ইন্টারনেটে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর লেকচার পেলেন। কিন্তু কোরআনের ধারাবাহিক কোনো আলোচনা তখনো তিনি পাননি।
কোরআনের ধারাবাহিক আলোচনা প্রথম তিনি শুনেন তাঁর মহল্লার একটি মসজিদে। রমজান মাস উপলক্ষে সে মসজিদে পাকিস্তান থেকে একজন আলেম আসেন। তাঁর নাম ছিল ইমাম ডক্টর আব্দুস সামি।ডক্টর আব্দুস সামি পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের কুর’আন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যিনি সময়ে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন আরবি শিক্ষা এবং কুর’আন এর তাফসীরের উপরে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতে। তিনি প্রতিদিন এক পারা করে কোরআনের অনুবাদ এবং সংক্ষিপ্ত তাফসির করতেন। সকালে দুই ঘণ্টা, বিকালে চার ঘণ্টা এবং তারাবির পর রাত ১০টা পর্যন্ত কোরআনের ধারাবাহিক আলোচনা হত। নোমান আলী খান ডক্টর আব্দুস সামির সকল আলোচনায় অংশ নেন। এভাবে তিনি সম্পূর্ণ কোরআনের তাফসীর শুনে শেষ করেন। কোরআনের এই ধারাবাহিক আলোচনা শুনে তাঁর কাছে মনে হয়েছে, তিনি এবারই প্রথম কোরআন শুনেছেন। এতে কোরআনের প্রতি তাঁর ভীষণ আগ্রহ জন্মে।

তিনি তাঁর উস্তাদ ডক্টর আব্দুস সামিকে বলেন – ‘আপনি যেভাবে তাফসীর করেছেন, আমিও সেভাবে তাফসীর করতে চাই’। ডক্টর আব্দুস সামি তাঁকে বললেন – ‘তাহলে আগে আরবি শেখো’। নোমান আলী খান তাঁকে বললেন – ‘আমি থাকি নিউইয়র্কে, সারাদিন কাজ থাকে, কলেজে যেতে হয়, আমি কিভাবে সৌদি আরব গিয়ে আরবি শিখব?’ ডক্টর আব্দুস সামি তাঁকে বললেন – ‘তুমি আগামী সপ্তাহ থেকে এ মসজিদে আমার আরবি ক্লাসে আসতে পার’।

এরপর তাঁর অধীনে পড়াশোনায় নুমান আলী খান আরবি ভাষা ও ব্যাকরণের উপরে তীক্ষ্ণ এবং গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পরবর্তীতে ডক্টর আব্দুস সামির কাছে আরো উপকৃত হন তাঁর সম্পূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আত্মস্থ করে। তিনি ডক্টর সামির করা কাজগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তাঁর নিজের ছাত্রদের উপকারের জন্য। তার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষন হল ডাঃ ফাদেল আল সামারাই। উস্তাদ নুমান ১৯৯৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক এবং ক্লাসিক্যাল আরবি শিক্ষাদান শুরু করেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৭ বছর ধরে নুমান আলী খান নাসাউ কমিউনিটি কলেজে মডার্ন শিক্ষকতা করেন।২০০৬ সালে তিনি বাইয়্যিনাহ ইন্সটিটিউট নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন এবং বাইয়্যিনাহ টিভি নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। এই সাইটে কোরআনের সৌন্দর্য, আরবি ভাষা ও ইসলামের ইতিহাসের উপর বর্তমানে পাঁচ শতাধিক ভিডিও ক্লাস রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বাইয়্যিনাহ টিভি নামে বিশ্বব্যাপী একটি চ্যানেলও চালু হবে।চমৎকার উপস্থাপনা, যুক্তিযুক্ত কথা, সহজ-সরল পদ্ধতির কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ আজ কোরআন শেখার জন্যে তাঁর কাছে ভিড় করছে। কেবল অনলাইনে বর্তমানে ১০ হাজারেরও বেশি তরুণ তাঁর কাছে কোরআন ও আরবি ভাষা শিখছে।

তিনি ইসলাম কে মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম হিসেবে মনে করে, মুসলিম উম্মাহর ব্যাপারে অন্যরা যেখানে কেবল অভিযোগ আর সমস্যা চিহ্নিত করে, সেখানে নোমান আলী দেখেন সম্ভাবনা ও স্বপ্নের দ্বার। তিনি তরুণদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখতে পান। উম্মাহর ৭০ ভাগ তরুণকে যদি কেবল সঠিক অনুপ্রেরণা দেয়া যায়, তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বের চেহারাটাই পাল্টে যাবে।

সবশেষে বলতে চাই, একটা সময় নাস্তিক থাকা ছেলেটা আজ বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার । লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ তার লেকচার শুনে কুরআন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারোনা পাচ্ছে ,হিদায়াত প্রাপ্ত হচ্ছে । আল্লাহ তায়ালা তাকে আরো দ্বীনের কাজ করার তৌফিক দান করুন । আল-কোরআনকে দর্শকদের সামনে জীবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে সত্যিই নোমান আলী খান এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব এবং একটি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

এই লেখাটা লেখার সময় কুরআনের দুটি আয়াতের কথা মনে পড়ছে ,সে আয়াত বলে আজকের লেখাটা শেষ করতে চাই ,

"এটা আল্লাহ্র পথনির্দেশ, তিনি তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই।"[সূরা যুমার, ৩৯:২৩]

‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করবে, আমি তাদের অবশ্যই আমার পথে হিদায়াতের পথে পরিচালিত করব। (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)

লেখকঃ মাসুম বিল্লাহ আরাফাত

পঠিত : ৫৬৩ বার

মন্তব্য: ০