Alapon

প্রতিভা বিকাশ ও গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা......



বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রতিভার উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিজ্ঞানী নিউটন, গ্যালিলিও, এডিসন, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রমুখের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাগুণেই। জগদ্বিখ্যাত লেনিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তি প্রতিভা ও সাধনার গুণেই আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। এরা প্রত্যেকে ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ও গবেষকও বটে।

শিক্ষাকে বাস্তব জীবনমুখী ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণালব্ধ জ্ঞান দিয়েই একটি জাতি উন্নতির শিকড় থেকে শিখরে পৌঁছাতে পারে। অপরিকল্পিত গগনচুম্বী দালান-কোটা বানালে যেমন নগরায়ণ হয় না; তেমনি গবেষণালব্ধ জ্ঞানব্যতিত মুখস্থ বিদ্যার বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে সে জ্ঞান কোনো দেশের অর্থনীতির কাজে লাগানো যায় না।

ঘুষ,-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ডোনেশনের মাধ্যমে যে শিক্ষা ও শিক্ষার মতো মহৎ পেশায় যারা আত্মনিয়োগ করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন- তাদের দ্বারা শিক্ষাদান মানেই দুর্নীতির শিকড় নতুন করে প্রোথিত করা, শিক্ষা ব্যবস্থায় অশিক্ষার প্রসারের নামান্তর। এ জাতীয় শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা আগামী প্রজন্ম-সমাজ, জাতি-রাষ্ট্র কখনই উপকৃত হতে পারবে না। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, “A hard working Street cleaner is better than lazy and corrupted scholar.”

টাকা কামানোই জীবনের শেষ কথা নয়। ঘুষ-দুর্নীতি করে অঢেল অর্থ-কড়ি, বিপুল বিত্ত-ভৈববের মালিক হওয়া যায়। কিন্তু আদর্শ ও সুখী মানুষ হওয়া যায় না। লর্ড টেনিসনের কথা স্মরণযোগ্য, তিনি বলেছিলেন, “Happiness dwells (lives) in soul. Not in silver, not in gold. Happiness dwells in soul.” পৃথিবীতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও গবেষণা হচ্ছে। এখন সময় এসেছে ঘুষ-দুর্নীতি, রাহাজানি, অর্থ-লোপাট, গুম-খুন, ধর্ষণের মতো লৌমহর্ষক ঘটনার ওপর সামাজিক গবেষণা করবার। মানুষের পৈশাচিক মনোবৃত্তি থেকেই জন্ম নেয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ।

জীবন চলার পথ পরিক্রমায় প্রায় সকল পথই বন্ধুর। তবুও নতুন গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের নতুন নতুন পথ তৈরি করে নিতে হবে। তবে সে পথ তৈরি করতে হবে শ্রম, সাধনা, গবেষণা ও প্রতিভার মাধ্যমে ।

প্রতিভা হলো সাধনা, পরিশ্রম, গবেষণা, অনুসন্ধিৎসা এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির সম্মিলনে সেই মানসিক ও শারীরিক শক্তি যা দ্বারা মানুষ দুরূহ কাজ সাধন করতে পারে। এই প্রতিভা থেকেই সৃজনশীলতার জন্ম হয়। প্রতিভা দ্বারাই জীবনে সফলতা অর্জন করা যায়। প্রত্যেক মানব সন্তানই সুপ্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মে। তবে সব মানুষের প্রতিভা সমান হয় না। কাজী নজরুল ইসলাম-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রতিভা সমাজের অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। বিশ্বে যা কিছু কল্যাণকর বলে সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে কাজ করেছে প্রতিভাধরদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম ও গবেষণা।

প্রতিভা কী আর কোন মানদণ্ডে মানুষ প্রতিভাবান বলে বিবেচিত হয় তা নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। শেষ নেই তর্ক-বিতর্কের। তবে সবাই এ ক্ষেত্রে একমত যে মহৎ প্রতিভার দেখা মেলে কালে-ভদ্রে, অনেক সময় যুগ-যুগান্তরে।

বিশ শতকের গোড়ায় প্রতিভাবান নির্ধারণ করার জন্যে একটা জনমত যাচাই হয়েছিল। তাতে মানব সভ্যতার ৫০ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রতিভাবান হিসেবে বিবেচিত হন মাত্র ৪০০ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি শতকে মাত্র এক জন। এক্ষেত্রে প্রতিভাবান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তারাই, যারা অসাধারণ মেধা, বিস্ময়কর সামর্থ্য ও অপূর্ব সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু প্রতিভার মূল রহস্য কী এবং কোন গুণে প্রতিভাবানরা সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকেন তার সমাধান আজও পাওয়া যায়নি। প্রতিভা সম্পর্কে ভলতেয়ার বলেছেন, “প্রতিভা বলে কোনো জিনিস নেই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর, গবেষণা কর প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।”

অপরদিকে এডিসনের মতে, “প্রতিভা একভাগ প্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ কঠিন পরিশ্রম।” Burtrand Russel বলেছেন- ÒTalent is nothing but an inner spirit that uplifts and accelerates the hidden treasure lying in any living beingÓ. মানুষের এই প্রতিভা জন্মগত না অর্জিত এ নিয়ে এখনও বিতর্ক বিরাজমান। কারো মতে প্রতিভা প্রকৃতিগত, আবার কেউ মনে করেন এটি সাধনালব্ধ, অনেক সাধনার ফসল। প্রকৃতপক্ষে প্রতিভা তৈরি করা যায় না, তা প্রকৃতিপ্রদত্ত।

এ সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গের দিকে তাকাতে হবে। কেননা, যে কেউ ইচ্ছা করলেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা নিউটন হতে পারবেন না। আবার প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিলেই একজন মানুষ জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে না। প্রতিভার মূলে অলৌকিকত্ব, আবেগ, ইচ্ছা ও প্রেরণা যা-ই কাজ করুক না কেন এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাধনা, শ্রম ও গবেষণা ছাড়া কোনো প্রতিভা সফল হয়ে ওঠে না। এজন্যে চাই নিরলস শ্রম, সাধনা ও গবেষণা। চাই ত্যাগ, অধ্যবসায় ও ধৈর্য। প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর জীবনই তার প্রমাণ। বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘Origin of Species’ লেখার জন্যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন বিশ বছর ধরে।

মহাকবি ফেরদৌস দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে রচনা করেছেন অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজের চেষ্টা ও সাধনায় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে সংগ্রহ করেছিলেন দু’হাজার প্রাচীন পুঁথি, যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রায় চার শ’ বছরের ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উদঘাটিত হয়।

১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে বেরোয় জনসনের বিখ্যাত অভিধান “A Dictionary of the English Language.”- যাকে ইংরেজ জাতি গ্রহণ করে এক মহৎ কীর্তিরূপে। ফরাসিরা যা সম্পন্ন করেছে অ্যাকাডেমির সাহায্যে, ইংরেজ তা করেছে এক ব্যক্তির শ্রমে, মেধা ও গবেষণায়। এ-সবই নিরন্তর সাধনা ও গবেষণার ফসল। জনৈক দার্শনিক বলেছেন, “প্রতিভা তৈরি করা সম্ভব নয়, প্রতিভা জন্ম নেয়।” তবুও বলা প্রয়োজন যে, ‘ যত্ন না করলে রত্ন মিলে না।’ অনেক প্রতিভা যত্নের অভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। প্রতিভাকে লালন করতে পারলে তার সুফল পাওয়া যায়। প্রতিভা অবশ্যই বিধাতার দান-তবে একে লালন করা আবশ্যক। অন্যথায় প্রতিভা নামক বস্তুটি ফুলের কুঁড়ির মতোই অকালে ঝরে যাবে। সভ্যতা এবং মানব জীবনের সফলতা ও বিকাশের মূলে রয়েছে যুগে যুগে বিভিন্ন প্রতিভাধর মানুষের অবদান।

বিজ্ঞান-দর্শন, সাহিত্য- সর্বক্ষেত্রে মানুষের ব্যাপক অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের প্রতিভার অবদানে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। প্রতিভার গুণেই আড়াই হাজার বছর পরেও এরিস্টটল জ্ঞানীজনদের গুরু। গ্রিক সাহিত্যের হোমার, ইংরেজি সাহিত্যের শেক্সপিয়র, বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রতিভার উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিজ্ঞানী নিউটন, গ্যালিলিও, এডিসন, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রমুখের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাগুণেই। জগদ্বিখ্যাত লেনিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তি প্রতিভা ও সাধনার গুণেই আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। এরা প্রত্যেকে ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ও গবেষকও বটে।

মানুষকে বিকশিত করার মূলে যে প্রতিভা ও গবেষণা তার শক্তি বিস্ময়কর। এ মহাবিশ্বকে নানাভাবে যারা সমৃদ্ধ করেছেন তারা হলেন প্রতিভাধর এবং তাদের হাতেই রয়েছে আগামী দিনের সম্ভাবনা। তবে প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে শেখ সাদি বলেছেন, “বিকাশের ক্ষেত্র না পেলে প্রতিভা ও শক্তি ক্রমশ ম্লান হয়ে বিনষ্ট হয়। আগুনে স্পর্শ না পেলে ধূপ কীরূপে পুড়ে গন্ধ দান করবে?”

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিংগাপুর এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশে প্রতি দশ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় সাত হাজার এবং প্রায় আড়াই হাজার গবেষক রয়েছেন। আমাদের দেশে কতজন গবেষক আছেন তার পরিসংখ্যান স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭টি এবং ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৎসামান্য গবেষণা হলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না বললেই চলে। এটি একটি দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র বটে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে হলে, শিল্প বিপ্লব ও গবেষণার মাধ্যমে এগিয়ে অবশ্যই দরকার।

সবারই একটি কথা মনে রাখা দরকার, “Become an educated myself is proud but other people educated is super proudest.” অর্থাৎ ‘নিজে শিক্ষিত হওয়া গর্বের তবে অন্য মানুষদের শিক্ষিত করা পরম গৌরবের।’ অতএব ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সৎ, নিষ্ঠাবান, প্রতিভাধর ও সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রয়াসে সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

পঠিত : ২৯৮ বার

মন্তব্য: ০