হুনাইনের ধাক্কা ও আমাদের শিক্ষা
তারিখঃ ৩১ আগস্ট, ২০২১, ০৯:০১
মক্কা বিজয়ের ১৮ তম দিন। রাসূল সা. তখন বিজয়ীর বেশে। মক্কা পুনর্গঠিত করছেন, নিজের মতো করে সাজাচ্ছেন। এমন সময় খবর এলো বনু হাওয়াজেন ও বনু সাকীফ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি সহকারে। এই নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ সৃষ্টি হলে আল্লাহর রাসূল সা. স্মিত হেসে বললেন, ইনশাআল্লাহ্ তাদের প্রস্তুত সামান আমাদের গনিমত হবে।
মহানবী সা. কালবিলম্ব না করেই পরদিন অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের ১৯ তম দিনে রওনা হয়ে গেলেন হুনাইনের দিকে। যেখানে বনু হাওয়াজেনের অবস্থান। তারিখ ছিল নবম হিজরির ১০ শাওয়াল। হুনাইন হচ্ছে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। মহানবী সা. দ্রুত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাতে তারা সংগঠিত হওয়ার আগেই মোকাবিলা করা যায়। এই সিদ্ধান্ত কাজে দিয়েছে। তায়েফ থেকে তখনো বনু সাকীফ হুনাইনে পৌঁছাতে সক্ষম হয় নি।
আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা থেকে ১০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে এসেছেন। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান রা. ও তার ছেলে মুয়াবিয়া রা.-সহ নতুন দুই হাজার মুসলিম সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়। কয়েকটি কারনে মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস চরমে পৌঁছে যায়। প্রথমত বনু সাকীফের সাহায্য আসে নি। দ্বিতীয়ত রাসূল সা. বলেছেন, তাদের মাল-সামান আমাদের গনিমত হবে। তৃতীয়ত ঐ সময় মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো বিপুল আর তাদের যুদ্ধ-সরঞ্জামও ছিলো প্রচুর। এটা দেখেই তাদের মনে পূর্ণ প্রত্যয় জন্মালো যে, দুশমনরা তাদের মুকাবিলা করতে কিছুতেই সমর্থ হবে না। বরং অচিরেই তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এমন কি, কোনো কোনো মুসলমানের মুখ থেকে এ উক্তি পর্যন্ত বেরিয়ে পড়লো, ‘আজ আর আমাদের ওপর কে জয়লাভ করতে পারে'!
কিন্তু এরূপ ধারণা মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কিছুমাত্রও সামঞ্জস্যশীল ছিল না। কারণ মুসলিমদের বিজয় তাদের দুনিয়াবি শক্তি সামর্থের ওপর নির্ভর করে না। মুসলিমদের বিজয় আসে আল্লাহর ইচ্ছেয় ও আল্লাহর সাহায্যে। এজন্য মুসলিমদের আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমানদার হতে হয়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হয়। বিজয়ের শর্ত এটাই। এই ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনে নির্দেশ করেছেন। মুসলিমদের কখনো আপন শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভরসা করা উচিত নয়। তাদের মূল শক্তি হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার দয়া ও করুণা। আর দুনিয়াবি ইপায় উপকরণ সাহায্যকারী মাত্র।
মুসলমানরা হুনাইনের প্রান্তরে আসা মাত্র বনু হাওয়াজেন মৃদু প্রতিরোধ করলো ও পিছু হটতে লাগলো। এটা ছিল একটি ফাঁদ। নির্দিষ্ট স্থানে মুসলিম বাহিনীকে এনে তারা কিছু মালামাল ফেলে পালিয়ে গেল। মুসলিমরা যুদ্ধ শেষ ভেবে মালামাল কুড়াতে লাগলো। এমন সময় শত্রুরা আশ-পাশের পাহাড় থেকে উপুর্যপুরি তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলো।
এ পরিস্থিতির জন্যে মুসলমানরা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের সৈন্যদলে বিশৃংখলা দেখা দিলো এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা ময়দান ত্যাগ করলো। অনেক বেদুইন গোত্র ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল সবেমাত্র ঈমান এনেছে এবং পূর্ণ প্রশিক্ষণ পায়নি এমন নও-মুসলিম। আবু সুফিয়ান রা. ভয় পেয়ে বললেন, ওরা সমুদ্রের পাড়ে না গিয়ে থামবে না। আরেক নতুন সাহাবী বললেন, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে।
এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে আমাদের নেতা মুহাম্মদ সা. অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রশান্ত চিত্তে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুশমনদের মুকাবিলা করা ও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানাতে লাগলেন।
সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সা. আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল! তোমরা আমার দিকে এসো, আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। সেই সময় রসূল সা.এর কাছে কয়েকজন মুহাজির এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় এই সংখ্যা মাত্র ৮০ জনের কাছাকাছি। ১২০০০ সেনার মধ্যে মাত্র ৮০ জনকে পাওয়া গেল যারা তীর বৃষ্টির মধ্যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে তীর ঠেকাচ্ছিলেন। এরাই মুহাজির। এরাই সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন।
রাসূল সা. শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাজিব! অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই। এরপর রসূল সা. তাঁর চাচা হযরত আব্বাস রা.-কে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করেন। হযরত আব্বাস রা.-এর ছিলো দরাজ গলা। তিনি বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা? কোথায় বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা?
পলায়নপর সাহাবারা হঠাত থমকে দাঁড়ালেন। হুনাইয়ের উপত্যাকায় রব উঠে গেল। সাহাবারা চিৎকার করে বলতে লাগলেন আমরা আছি! আমরা আসছি! সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলেন। আব্বাস রা. বলেন, সাহাবার আমার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়াজ শুনে বাছুর ছুটে আসে। রাসূল সা. আবার সাহাবাদের সংগঠিত করে যুদ্ধ শুরু করলেন। সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। দু'পক্ষই মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। রাসূল সা. সাহাবাদের নিষ্ঠা দেখে সন্তুষ্ট হলেন। এরপর রাসূল সা. রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো। আল্লাহর সাহায্যে হুনায়েনের প্রান্তরে বিজয় আসলো। মুশরিকদের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত এবং সহস্রাধিক লোক বন্দী হলো।
এই প্রসঙ্গ আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষার জন্য কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মহান রব সূরা তাওবায় ২৫ ও ২৬ আয়াতে উল্লেখ করেন,
//হুনাইনের দিনকে স্মরণ করো, যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যাধিক্যতে তুষ্ট ছিলে; কিন্তু তাতে তোমাদের কোনো কাজ হয়নি; বরং জমিন প্রশস্ত থাকা সত্ত্বেও তা তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়েছিলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের ওপর নিজের তরফ থেকে সান্ত্বনা ও প্রশান্তির ভাবধারা নাযিল করলেন এবং তোমরা দেখতে পাওনি এমন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শাস্তি দিলেন। কাফিরদের জন্যে এমনি শাস্তিই নির্ধারিত।//
নবী করীম (স) এবং তার সাহাবীদের এই ধৈর্য ও দৃঢ়তাকেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ সান্ত্বনা ও প্রশান্তির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে অদেখা সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেলো এবং মুসলমানরা পুরোপুরি জয়লাভ করলো। আল্লাহু আকবার।
এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আমরা আজকে আমাদের কাঙ্খিত বিজয় না আসার জন্যে নানান বিষয় আমাদের বিবেচনায় আনি। এই বিবেচনা ও পর্যালোচনায় আমরা লোকে কী বলবে? অমুককে কীভাবে বোঝাবো? কীভাবে আমরা সংখ্যাধিক্যে পৌঁছাবো? এসব বেশি পর্যালোচনায় আনি। যে বিষয়টা পর্যালোচনায় আনি না তা হলো কীভাবে আমরা আরো ভালো ঈমানদার হবো?
আমরা কীভাবে আরো বেশি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করবো এই চিন্তা আমাদের মধ্যে কমে গেছে। আমরা সাহাবা ও আল্লাহর ওলিদের ফানাফিল্লাহকে গালগল্প বানিয়ে ফেলেছি। আমরা বৈষয়িক উপায় উপকরণকে বিজয়ের মূল উপজীব্য করে নিয়েছি।
আমরা আমাদের বিজয়ের জন্য অনুসরণ করছি কীভাবে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করেছে? আমরা বারাক ওবামার থিম নেওয়ারও চেষ্টা করি অথচ আমাদের উচিত নবীর দেখানো পথ। সাহাবাদের দেখানো পথ। ক্ষমা করবেন। উপায় উপরকণকে আমরা অস্বীকার করি না বরং মনে করি পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রযুক্তি আমাদের থাকা উচিত। এটা সহায়ক শক্তি। তবে এটা মূল উপজীব্য হতে পারবে না। আল্লাহ আমাদের বিজয়ের জন্য শর্ত দিয়েছেন "আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান"। মহান রব বলেন, তোমরা হতাশ হয়োনা, চিন্তিত হয়োনা, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও” (সূরা আলে ইমরান-১৩৯)
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের একথা দৃঢ়ভাবে অনুধাবন করতে হবে, যে পথে আওয়ামী লীগ, জো বাইডেন, বিজেপি, কংগ্রেসের বিজয় আসবে সে পথে ইসলামের বিজয় আসবে না। ইসলামের বিজয় আসবে আল্লাহর ইচ্ছেয় ও সাহায্যে। যেভাবে হুনাইনের প্রান্তরসহ সব যুদ্ধে বিজয় এসেছিলো। এটাই সূরা তাওবার ২৫-২৬ আয়াতের শিক্ষা।
মন্তব্য: ০