Alapon

আলী শাহ গিলানী, জালিমের সামনে মাথানত না করা এক মুসলিম নেতা...



দুনিয়ার মাথা নত না করা মুসলিম নেতাদের একজন আলী শাহ গিলানী। মজলুম মুসলিমদের নেতা হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতের মত বর্ণবাদী ও দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার শির, জবান ও অস্ত্র সর্বদা উঁচু ছিল।

রাজনীতিবিদ হিসেবে ইসলামকেই তিনি আজাদীর মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জনগণকে আজাদীর জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন তাওহীদের কালেমা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র ভিত্তিতেই।

হৃদয়ের মিল। তিনিও আজাদী চান, কাশ্মীরীরাও আজাদী চায়। ইসলামকে তিনি মুক্তির রাজপথ হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একে কেন্দ্র করেই কাশ্মীরে পরিচালিত হত আজাদীর আন্দোলন। রাজনৈতিক ও সশস্ত্র আজাদী আন্দোলন।

আজাদীর জন্য, কালেমার জন্য যুদ্ধ না করলে কাশ্মীরের মত উপত্যকায় ঈমান টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। হোয়াট ইফ, কেউ কালেমাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন সংগ্রাম করল না। আর ইন্ডিয়ান সেনারা গিয়ে প্রতিটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। তাদের কারিকুলামে স্কুল খুলল। শিক্ষা দিতে লাগল?

এটা হচ্ছে এখন। সেখানকার ইসলামপন্থীরা অনেক স্কুল খুলেছিল। সেগুলো এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেন? আলী শাহ গৃহবন্দী ছিলেন। তার মত নেতা আজও কাশ্মীরের বুকে গড়ে উঠে নাই। তবে কাশ্মীর তার নিজের প্রয়োজনেই নেতা জন্ম দেবে। আজাদীর জন্য। তাওহীদের কালেমার জন্য। মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য।

আলী শাহ গিলানী উত্তর কাশ্মীরের সোপোর বারামুল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সাল। শিক্ষাদীক্ষা সেখানেই। এরপর বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজ হতে পড়াশোনা শেষ করেন।

রাজনীতিতে জড়ান ২১ বছর বয়সে। দমওয়ালা যুবক ছিলেন। শুরুতেই গ্রেফতার হন। জেল খাটেন দশ বছর। কাশ্মীরী এ তরুণ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে নাই। এই যে লেখাপড়া শেষ করা মাত্রই তাকে দশ বছর জেল খাটতে হল, এটা নিয়ে সারাজীবনে আফসোস করেছেন কিনা? করেন নাই।

আজাদীর স্বপ্নে বিভোর যুবক হয়ত জেলখানায় ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখতেন, ভারতের দখলদারির সমাপ্ত হয়েছে। পুরো কাশ্মীর এক হয়ে লড়াইয়ে নেমেছে। সবার হাতে অস্ত্র। আল্লাহু আকবার বলে সামনে ঝাপিয়ে পড়ছে তারা। ভারতীয় সেনারা পরাজিত হচ্ছে। তাদের জুলুম আর পাপাচারে ভরা নোংরা দেহ জমিনে লুটিয়ে পড়ছে। জমিনও যেন তাদের গ্রহণ করতে চায় না। জমিনও আজ তাদের প্রত্যাখ্যান করছে যেন!

কাশ্মীরের আজাদীর নেশায় মত্ত যুবকেরা যুদ্ধ করছে এভাবে। তারাও শহীদ হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন সে— আলী শাহ গিলানী। বীর দর্পে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনিও। তার সাথীদের অনেকেই দখলদার ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হচ্ছে। মৃত্যু মুহূর্তেও তাদের কন্ঠে তাওহিদের বানী- লা ইলাহা ইল্লালাহ! শাহাদাত, বীরত্ব, ত্যাগ এসব মিলিয়ে বিজয় আসল। ভারতীয় সেনারা পালিয়েছে। মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছে।

শহীদদের জানাজা শেষে সবাই একত্রিত হয়ে একটাই স্লোগান দিচ্ছে। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার! স্বপ্নে স্লোগান দিচ্ছেন আলী শাহ গিলানিও। আল্লাহু আকবার বলতে বলতে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। আলী শাহ দেখলেন, তিনি জেলখানায় বন্দী! তিনি কি কাশ্মীর নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেছিলেন?

এভাবে হয়ত অনেক রাত কেটেছে! দশ বছর! হাজার বার সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে পশ্চিমে অস্ত গেছে। আলী শাহ গিলানীর আবদ্ধ রুমে সূর্যের আলো পৌঁছাত কি? সে গল্প আমরা জানি না। কারণ আমরা বিপ্লবীদের জানতে ভয় পাই। কাপুরুষ তো বিপ্লবীদের জানার সাহস করবে না। তার কাপুরুষতা তখন আরো স্পষ্ট হবে। এটাই তার ভয়!

আলী শাহ থামেন নাই৷ হুররিয়াত পার্টি খুলে আজাদীর লড়াই চালিয়েছেন। প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে যোগ দিয়েছেন কাশ্মীরের মুক্তিকামী আরেক কাফেলা জামায়াতে। মনে করা হচ্ছিল, জামায়াত নিজেদের 'মডারেট ফোর্স' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কাশ্মীরের জামায়াত স্বাধীনতাকামীদের প্যাট্রোনাইজই করেছে। সম্ভবত সেখানে ভীতুদের সংখ্যা কম। নইলে আলী শাহ গিলানীর মত ব্যক্তিকে ধারণ করা সম্ভব ছিল না।

আলী শাহ কাশ্মীরের জন্য যেভাবে পেরেছেন কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার হুররিয়াত পার্টিতে ফিরে আসেন। লড়াই অব্যাহত রাখেন। এই যে লড়াই অব্যাহত রাখা, ক্ষ্যান্ত না হওয়া, সারাজীবন সংগ্রামে অতিবাহিত করা, এগুলো সাহসের ব্যাপার। ঈমান ও ঈমানী তাক্বদের ব্যাপার৷

গিলানী ভোটের রাজনীতিও করেছেন৷ বিপ্লবীদের সাথেও ছিলেন। মুক্তিকামী মানুষ যখন লড়াইয়ে নামে, তখন তিনি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন। সংহতি প্রকাশ করেন মুক্তি সংগ্রামীদের প্রতি।

আলী শাহ গিলানীর সময়ে গাদ্দার ছিল। সব জায়গায় গাদ্দার থাকে। এরা এসে বলে, এভাবে হবে না। যুদ্ধ করা যাবে না। ওদিকে ভারতীয় বাহিনি থামে না, কিন্তু আলী শাহ গিলানীদের থামতে বলা হয়। মুক্তির লড়াইকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

মুসলমানদের মুক্তির জন্য তাওহীদের কালেমাকে কেন্দ্র একত্রিত হওয়া, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া তাদের পছন্দ নয়। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী বের হয়, রাজনৈতিক উপদল বের হয়, নেতা বের হয়। এরা ইসলাম ছেড়ে, এক পাশে রেখে তারপর কথা বলে। অন্যরা তাদের অনুসরণ না করলে এদের ভাষার সাথে দখলদার ও জালিমদের ভাষা মিলে যায়। যেন একই মাইকে দুজনের সঙ্গীত বাজে। পরাধীনতার সঙ্গীত। মাথা নোয়ানোর সঙ্গীত। ভীরুতা ও কাপুরুষতার সঙ্গীত। কি ছিল সে সঙ্গীতের ভাষ্য? —
“কাশ্মীরী জনগণের জন্য গিলানী যে পথ দেখিয়েছেন, তা আরো ধ্বংসাত্মক।”

আলী শাহ গিলানী এই সঙ্গীত কখনোই গান নাই। তিনি স্লোগান দিয়েছেন। যোদ্ধা তৈরি করেছেন। আজাদীর জন্য। মুক্তির জন্য। স্বাধীনতার জন্য। তার স্লোগান কেমন ছিল? —
— নারায়ে তাকবীর!
— আল্লাহু আকবার!
— নারায়ে তাকবীর!!
— আল্লাহু আকবার!!
— ইসলাম!
— জিন্দাবাদ!!
— ইসলাম!
— জিন্দাবাদ!!
— হাম কিয়া চাতি?
— আজাদী!
— হাম কিয়া চাতি?
— আজাদী!
— আজাদী কা মতলব কিয়া?
— লা ইলাহা ইল্লালাহ
— আজাদী কা মতলব কিয়া?
— লা ইলাহা ইল্লালাহ
— জিঞ্জির কাটেগি
— ইন শা আল্লাহ! ইন শা আল্লাহ!
— জিঞ্জির কাটেগি
— ইন শা আল্লাহ! ইন শা আল্লাহ!
..
সাইয়্যেদ আলী শাহ গিলানী রাহিমাহুল্লাহ গতকাল ১ সেপ্টেম্বর ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। আমরা এই মহান সংগ্রামী সাধকের জন্য রহম ও ক্ষমার দোয়া করি। আরো দোয়া করি, কাশ্মীর যেন মুক্ত স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে যেন আজাদী কা মতলব 'লা ইলাহা ইল্লালাহ' প্রতিষ্ঠিত হয়। আমিন।

- খালিদ সাইফুল্লাহ

পঠিত : ৩৩০ বার

মন্তব্য: ০