Alapon

ইসলামী ফিকহ ও নারীবাদ...



একটা পরিচিত কথা বরাবরই শুনতে পাবেন আমাদের দেশের ইসলামি ফেমিনিস্টদের থেকে যে, কোরআন এবং রাসুলের হাদিসের টেক্সট সরাসরি এক্সপ্লোরেশন করলে দেখা যাবে এখানে মৌলিক ভাবে পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা অনুপস্থিত, কিন্তু এর বিপরীতে ইসলামী তুরাসের ফিকহ'
(فن الفقه الإسلامي من التراث - Jurisprudence of islamic Legacy )

শাস্ত্রে এলে ধরতে সক্ষম হবেন কিভাবে সরল টেক্সট গুলো পুরুষতান্ত্রীক আদলে ফুকাহা কর্তৃক ইন্টার্প্রেট করা হয়েছে। অতএব কোরআন এবং হাদিস বোঝার জন্য ফুকাহা এবং মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এই কথাটি আসলে আমাদের দেশের ফেমিনিস্টদের কথা না, গোটা মুসলিম বিশ্বের ইসলামী ফেমিনিজমকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, এটা মূলত তাদের কথা। মিশর, লেবানন এক্ষেত্রে সর্বাগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিম থেকে যেসব কাচামাল আসে, এদের কাজ হলো সেগুলোকে কোরআন হাদিসের মোড়কে শুধু মাত্র ইসলামাইজেশন করে তৃতীয় মুসলিম বিশ্বে হাজির করা।
গত কয়েকদিন একটা কিতাব পড়ছি লেবাননের নারী সাংবাদিক লেখিকা প্রফেসর রিতা ফারাজ- এর।

কিতাবটার নাম শুনলেই আচ করা যাবে ভেতরে কী থাকতে পারে-
«امرأة الفقهاء وامرأة الحداثة: خطاب اللامساواة في المدونة الفقهية»
ফুকাহা ও মর্ডানিস্টদের দৃষ্টিতে নারী ;ইসলামী ফিকহের একটি অসম ডিস্কোর্স)

এখানে লেখিকা তার জীবনের সারবস্তু তুলে ধরেছেন একে একে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, রিতা দেখাতে চেয়েছেন যে, 'কোরানী ইসলাম' আর 'ফিকহী ইসলাম' দুটো দুই মেরুর আলাদা জিনিস। আরো দু:সাহসী এবং চটকদার কথা কি জানেন! তিনি বলেছেন ইসলামের নবী ছিলেন 'ফেমিনিস্ট নবী'; কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়ারীশদের মাঝে বিস্তর দূরত্বের ফলে ফেমিনিস্ট নবীর ফিকহের ধারকরা হয়ে গেছেন যুগপরম্পরায় পুরুষতান্ত্রিক। সায়্যিদাতুনা আয়িশা রাঃ-কে হাজির করেছেন নবী যুগের নারীবাদী আন্দোলনের প্রধান নেত্রী হিসেবে, তিনি নাকি নারী অধিকার নিয়ে একাই দাঁড়িয়ে গেছেন পুরুষ সাহাবীদের বিপরীতে। আর উম্মে সালামা রাঃ নাকী ছিলেন সায়্যিদাতুনা আয়িশার প্রধান উপদেষ্টা।
এক পর্যায়ে যেয়ে লেখিকা এই ধৃষ্টতাও দেখাতে কুন্ঠাবোধ করেন নি যে, হজরত উমর রাঃ-ই হলেন সর্বপ্রথম পুরুষতান্ত্রিক ফিকহের পুরোধা, যার হাত ধরে পরবর্তীতে চার মাজহাবের ফকিহরা ফিকহুয যুকুরিয়্যা শুরু করেছেন।

এই বক্তব্য গুলো ইসলামী নারীবাদীদের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য, এই একই বক্তব্য আমি বাংলাদেশের খুব পরিচিত কয়েকজন ফেমিনিস্ট থেকেও শুনেছি। এর নেপথ্য যুক্তি কি জানেন!- তারা বলতে চান,যারা গোটা ইসলামি দর্শন ও জীবনব্যাবস্থাকেই পুরুষতান্ত্রিক বলে, তাদের কথায় ইনসাফ নেই, মূলত কোরান এবং হাদিসে নারীবাদী এপ্রোচই ব্যাবহার করা হয়েছে, কিন্তু যখনই কোরানের কোনো আয়াত এবং কোন হাদিস মুফাসসিরিন কিংবা মুহাদ্দিসিন/ ফুকাহার কাছের পড়েছে, তিনি এটাকে পুরুষতান্ত্রিক বানিয়ে ফেলেছেন।
ফিকহ ও ফুকাহা সম্পর্কে যাদের নূন্যতম ধারণা নেই, ফিককের সিলসিলা, ধারা পরস্মপরা, প্রিন্সিপালস, মাকাসিদ, মাফাসিদ, ইতিহাস ও অবিচ্ছিন্ন লিগ্যাসি সম্পর্কে চুল পরিমাণ যাদের জানাশোনা নেই, তারাই আজ এসব অসাড়ে কুযুক্তি দিয়ে ফিকহ শাস্ত্রে আপত্তি দেখাতে চাচ্ছেন। কিংবা হতে পারে (এবং এটাই হওয়ার সম্ভবনা প্রবল) নফসের খাহেশাতকে প্রায়োরিটি দিতে যেয়ে সত্যকে জেনেও গোপন করে যাচ্ছেন।

মাত্র কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক, যার মাধ্যমে এসব নারীবাদী লেখিকাদের দাবির সত্যতা জানা যাবে-
* মেয়েরা মসজিদে যেতে পারবেন কিনা- এ মাসালার ব্যাপারে হজরত আয়িশা রাঃ ফেতনার আশংকার কারণে নারীদেরকে মসজিদে না যাওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু বিপরীতে দেখুন, হজরত ওমর ও আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাঃ মনে করতেন আপাতঃদৃষ্টে মেয়েরা মসজিদে যেতে কোন বাধা নেই ।
* বিবাহের ব্যাপারে মেয়েদের 'উলায়াত' তথা বিবাহ নিজে করা এবং অপরকে করানোর অধিকার আছে কিনা- এক্ষেত্রে হজরত আয়িশা রাঃ এর মত হলো, তাদের উলায়াত নাই। কিন্তু বিপরীতে দেখুন, ইমাম আবু হানিফা সহ অন্যান্য ফুকাহাদের বড় একটা জামাত বলছেন যে, হ্যা নারীর বিবাহের উলায়েত আছে।
* বাঈন তালাক প্রাপ্তা নারীর ইদ্দত চলাকালে খোরপোশ স্বামীকে বহন করতে হবে কিনা- এ ব্যাপারে নারী মুহাজিরা বিখ্যাত সাহাবিয়া হজরত ফাতিমা বিনতে কাইস রাঃ এর মত ছিলো, তার কোনো খোরপোশ স্বামীকে বহন করতে হবে না। কিন্তু দেখুন, লেখিকার চিত্রায়নের হজরত ওমর রাঃই কিন্তু সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে শক্ত মত দিয়ে বলেছেন- অবশ্যই এমতবস্থায় স্বামীকেই বহন করতে হবে তার নাফাকাহ এবং সুকনা। ইমাম আবু হানিফা রহঃ হজরত ওমরের এই বক্তব্যের ওপরে ফতোয়া দিয়েছেন।
* মুতাওয়াফফা আনহা যাওজুহা - তথা স্বামী মারা গেছেন, এমন নারীর জন্য স্বামীর পরিবার থেকে থাকার ব্যাবস্থা করতে হবে কিনা ইদ্দত চলা কালীন- এক্ষেত্রে উম্মে সালামা এবং আয়িশা রাঃ এর মত ছিলো, না, ব্যাবস্থা করতে হবে না। কিন্তু সাহনুন মালেকীর মুদাওয়ানা ও ইমাম শাফেয়ীর কিতাবুল উম্ম খুলে দেখুন- এই দুই মহান ইমামের মত ছিলো, অবশ্যই ওই নারীর জন্য থাকার ব্যাবস্থা করা স্বামীর ফ্যামিলির দায়িত্ব।
* স্বামী মৃত্যু সজ্জ্যায় থাকাকালে বাঈন তালাক প্রাপ্তা নারী স্বামীর সম্পদের অংশ মিরাস হিসেবে পাবেন কিনা- সায়্যিতাদুনা আয়িশা রাঃ বলেন, এক্ষেত্রে তার জন্য মিরাসের অংশ নাই। কিন্তু ইবনু আব্দিল রার আন্দালুসী লিখেছেন, ইমাম মালিকের মত হলো এক্ষেত্রেও স্ত্রী মিরাসের সম্পদের অধিকারী হবেন। এমনকি স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হয়ে গেলেও একই বিধান, এমনকি ওই স্ত্রী দ্বিতীয় কোন পুরুষের সাথে বিয়ে করে নিলেও একই বিধান, তথা প্রথম স্বামীর সম্পদের ভাগ পাবেন। একটু কল্পনা করুন তো, একজন পুরুষতান্ত্রিক ফকিহ কিভাবে একজন নারীর ব্যাপারে এতটা অধিকার নিশ্চিত করে গেছেন!

এ তো মাত্র কয়েকটা উদাহরণ, ইসলামী ফিকহে এমন দৃষ্টান্ত খুজলে শত শত পাওয়া যাবে। এসব উদাহরণ এখানে টেনে আনার উদ্দেশ্য আমার মোটেও এটা নয় যে, ফুকাহারা কতটা নারী বান্ধব ছিলেন, কতটা নারীবাদী ছিলেন, এসব প্রমাণ করা। বরং আমাদের সামনে যেভাবে প্রপাগাণ্ডা শিল্পকে বানিজ্যিকরণ করা হচ্ছে, কোরান এবং ফুকাহাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি প্রচেষ্টা চলছে, তার অসাড়তা সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণা দেওয়া মাত্র।
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, কোনো ফহীহ কোন মাসালা ইস্তিম্বাতের( deriving) এর ক্ষেত্রে কখনো এ কথা মাথায় রেখে গবেষণা করতেন না যে, এটা তো নারী কিংবা পুরুষের মাসালা। বরং মানব মাসলাহাত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শারিয়ার স্বার্থ মূর্ত করে তোলাই ছিলো ফুকাহাদের কাজের মৌলিক ক্রাইটেরিয়া।

অতএব, যারা কোরানী ইসলাম আর ফিকহী ইসলাম বলে আলাদা দুটো মেরুকরণের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, তাদের মূলত খোদ কোরান এবং হাদিসের টেক্সটগুলো নিয়েই আপত্তি আছে, যদিওবা মুখে প্রকাশ করছেন না।

ইসলাম কখনোই অন্যসব ধর্মের মত নয়, বরং এখানে একটা আলাদা জায়গা আছে সনদ কিংবা সিলসিলার। ফুকাহা, মুহাদ্দিসিন, মুফাসসিরিনের সিলসিলা। কোরান হাদিসকে যদি এই সিলসিলা পুরপুরি বাদ দিয়ে চর্চা করতে শুরু করেন, তবে জেনে রাখেন, অবশ্যই আপনার এই এপ্রোচটা স্পষ্ট ভুল এবং আনএথিক্যাল এপ্রোচ। আমৃত্যু বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরেও আসল বনলতা সেন খুজে পাবেন না...
আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।

- হুজায়ফা

পঠিত : ৪৩০ বার

মন্তব্য: ০