Alapon

নবিজি যখন সন্তান হারিয়েছেন...



রাসূলকে (ﷺ) ক্ষুধার্ত অবস্থায় ও দারিদ্র্যের মধ্যে দেখা একটা ব্যাপার, আর তাঁকে মানবিক ও বেদনায় ভারাক্রান্ত অবস্থায় দেখা আরেক ব্যাপার। আপনি যদি তাঁর সমাজে বাস করেন, তবে তাঁকে একজন মহাপুরুষ হিসেবেই আপনি জানেন। তাঁকে বেদনায় ভারাক্রান্ত দেখতে আপনার অস্বস্তি হচ্ছে। নামাজে, ইবাদতে, আল্লাহর স্মরণে তাঁর কান্নার সাথে জীবনের দুঃখ ভারাক্রান্ত সময়ে তাঁর কান্নার পার্থক্য আছে।

প্রায় সময় রাসূলের (ﷺ) সন্তানদের মৃত্যুর কথা বলতে গেলে আমরা তাঁর সাত সন্তানের মধ্যে ছয়জনকে কবর দেওয়ার কথা উল্লেখ করি। সব ঘটনা গুলোকে একসাথে বলার প্রবণতা আমাদের আছে। অবশ্যই প্রতিটি সন্তানের মৃত্যু পৃথক পৃথক ভাবে তাঁকে দংশন করেছে। কিন্তু ইব্রাহিমের মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। পরিস্থিতিও ছিল ভিন্ন, কারণ তখন তিনি নিজেই প্রায় মারা যাচ্ছিলেন।

দীর্ঘ বিশ বছর পর রাসূলের (ﷺ) এই শেষ সন্তানের জন্ম হয়। ইব্রাহিমের পূর্বে ফাতিমাই (রাsmile ছিলেন তাঁর শেষ সন্তান। আর সবাই মারা গেছে, এই পর্যায়ে রাসূল (ﷺ) তাঁর পাঁচ সন্তানকে হারিয়েছেন। তাঁর দুই পুত্র শিশু অবস্থায় মারা গেছে। তাঁর তিন কন্যা তখন বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে হয়েছে, তারপর তাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন। রাসূল (ﷺ) তাদের সবাইকে কবর দিয়েছেন। ফাতিমা (রাsmile এখন বিবাহিতা, তাঁর নিজের সন্তান আছে। তাঁর সন্তানরা এখন রাসূলের (ﷺ) সন্তানদের মত।

এ পর্যায়ে আল্লাহ সুবহানা তা'য়ালা রাসূলকে (ﷺ) আশীর্বাদ করলেন ইসলামের প্রথম পুত্র সন্তান দিয়ে। এমন সময়ও এসেছিল যখন মনে হয়েছিল রাসূল (ﷺ) দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন, কাজেই এই সন্তানের সাথে অনেক কিছুই জড়িত। প্রথমবারের মতো ইসলামের সব আনুষ্ঠানিকতা তিনি পূর্ণ করেছিলেন এই সন্তানকে ঘিরে। তাঁর আনন্দটা একবার চিন্তা করে দেখুন। জীবনের এই পর্যায়ে, ইসলামের আবির্ভাবের পরে তাঁর নিজের পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি আযান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্য অনেকের সন্তানের তাহনিক (মুখে খেজুর ঘষে দেওয়া) করার পর এবার তিনি নিজের সন্তানের তাহনিক করলেন। অন্যের সন্তানের আকিকা করার পর, এবার তিনি নিজ পুত্র সন্তানের আকিকা করলেন। তিনি সগর্বে নিজ সন্তান ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে বলেন, قد رزق الله نبيكم ولد وسميته علي ابي ابراهيم - "তোমরা দেখো আল্লাহ তোমাদের নবীকে এক পুত্র সন্তান দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন, আমি আমার বাবার নামে তার নাম রেখেছে ইব্রাহিম।" একবার চিন্তা করে দেখুন, সুবহানাল্লাহ!

কল্পনা করুন আপনি তখন মসজিদে, আর রাসূল (ﷺ) ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে প্রথম বারের মতো মসজিদে আসলেন। আপনি তার আকিকায় উপস্থিত। রাসূল (ﷺ) তাঁর এই শিশু পুত্রটিকে বাইরে নিয়ে আসতেন। স্পষ্টতই, এই সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। শিশুটি যখন ধাত্রীর কাছে ছিল তিনি প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন। তিনি যখন তাঁর স্ত্রীদের ঘরে সাক্ষাতের জন্য যেতেন, ইব্রাহিমকে কোলে করে নিয়ে যেতেন। তিনি তাকে মসজিদে নিয়ে আসতেন। ধাত্রীর কাছে অবস্থানের সময়ও তিনি সর্বদা তাঁর সন্তানের কাছে যেতেন। সবাই জানত, তাঁর নিজের সন্তান ইব্রাহিমকে দেখতে যাওয়া তাঁর জন্য এক পরম আনন্দের বিষয়। এতগুলো বছর পর তাঁর নিজের পুত্র সন্তান, সবাই আশা করেছিল এই সন্তান তাঁর মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে।

সেই দিনের ঘটনা আনাস ইবনে মালিক (রাsmile বর্ণনা করেছেন। ইব্রাহিমের তখন ১৬ মাস বয়স, একেবারে ছোট্ট শিশু কিন্তু না। তখন তার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, সন্তানের সাথে তখন রাসূলের (ﷺ) গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আনাস ইবনে মালিক (রাsmile দৃশ্যটি বর্ণনা করেন এভাবে - ধাত্রীর দূত এসে রাসূলকে (ﷺ) বলল, "হে রাসূলুল্লাহ! ইব্রাহিমের ভীষণ অসুখ, মনে হচ্ছে সে মারা যাচ্ছে।" কাজ ফেলে তিনি সাহাবাদের সাথে ধাত্রীর বাসায় গেলেন। ধাত্রীর স্বামীর নাম ছিল আবু সাইফ, পেশায় সে ছিল একজন কামার। রাসূল (ﷺ) তাঁর কাছে ঘরে ঢুকার অনুমতি চাইলেন।

ঘরে ঢুকে তিনি ইব্রাহিমকে কোলে নিলেন। এই সেই সন্তান যাকে তিনি গর্বিত পিতার মতো আমাদের সবাইকে দেখিয়েছিলেন। তিনি সন্তানকে ভালোবাসেন এবং এখন তাকে মৃতপ্রায় দেখছেন। قبله وشمه - আনাস ইবনে মালিক (রাsmile বলেন, "তিনি তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেলেন, এবং তার চুলের ঘ্রাণ নিলেন।" তিনি তার সন্তানকে কোলে নিয়েছেন, আর সাহাবারা এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। রাসূলকে (ﷺ) সবচেয়ে মানবিক ও দুর্বল মুহূর্তে তারা দেখছে। ইব্রাহিম জোরে জোরে এবং ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আনাস (রাsmile বলেন, "রাসূলের (ﷺ) বাহুতেই তার সন্তানের প্রাণ চলে গেল।" একজন বাবার পক্ষে তা কতটা কষ্টসাধ্য একবার চিন্তা করে দেখুন, তাঁর নিজ বাহুতে তাঁর সন্তান যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আর আপনার রাসূলের (ﷺ) অন্তর তো ভালোবাসা ও দয়ায় পরিপূর্ণ।

রাসূল (ﷺ) ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাsmile তখন রাসূলের (ﷺ) দিকে তাকিয়ে বললেন, "وأنت يا رسول الله - আপনিও, হে রাসূলুল্লাহ!" তিনি নিষ্ঠুরভাবে তা বলেননি। এমনভাবে বলেননি যেভাবে ঐ লোকটি রাসূলকে (ﷺ) হাসান ও হোসাইনকে চুমু খেতে দেখে অহংকার নিয়ে বলেছিল সে তার সন্তানদের চুমু খায় না। সেভাবে নয়, তিনি বলেছিলেন গভীর সহানুভূতি নিয়ে - "হে রাসূলুল্লাহ! আপনিও কাঁদছেন?" আমরা তো তাঁকে এভাবে দেখে অভ্যস্ত না, আমরাতো তাঁকে কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখি নি, সন্তানের জন্য তাঁকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। এসবতো আমরা অন্য লোকদের মাঝে দেখি। রাসূল (ﷺ) তাঁর মৃত সন্তানকে তাঁর বাহুতে আগলে রেখে বলেছিলেন," হে ইবনে আউফ! এটা رحمه - আল্লাহর দয়া যা তিনি আমার অন্তরে দিয়েছেন। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা, এই সন্তানকে আমি ভালোবাসি।" আনাস (রাsmile বলেন, "রাসূল (ﷺ) আরো বেশি কাঁদতে লাগলেন। আমরা এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।" অবশ্যই সাহাবারাও তাঁর সাথে কাঁদছে। কিভাবে আপনি কাঁদবেন না বলুন? রাসূল (ﷺ) তাঁর মৃত সন্তানকে তাঁর বাহুতে আগলে রেখেছেন।

রাসূল (ﷺ) তখন বললেন, إِنَّ الْعَيْنَ تَدْمَعُ، وَالْقَلْبَ يَحْزَنُ، وَلاَ نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ ‏ - "চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে, হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত, তারপরও আমাদের পালনকর্তার খুশি ব্যতীত আমরা কিছুই বলবো না।" وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ يَا إِبْرَاهِيمُ لَمَحْزُونُونَ - "তোমার প্রয়াণে আমরা দুঃখিত ইব্রাহিম, তোমার চলে যাওয়াতে আমরা দুঃখিত। [সহি বুখারী: ১৩০৩] "তোমার মৃত্যুতে আমরা শোক প্রকাশ করছি।" এই একটিমাত্র সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি ইসলামের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, আর এখন তাঁকে ইসলামের আনুষ্ঠানিকতা মেনে তার জানাযা সম্পন্ন করতে হবে। তাকে গোসল দিতে হবে, কাফন পড়াতে হবে। রাসূল (ﷺ) নিজ পুত্রকে কবরের শুইয়ে দিলেন এবং তার জানাজা পড়ালেন।
আপনি যদি মদিনার অধিবাসী হন, সূর্য গ্রহণ সংক্রান্ত ওই হাদীসটি অনেকবার শুনে থাকবেন। রাসূলের (ﷺ) পুত্র ইব্রাহিম যেদিন মারা যায়, একই দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। কিভাবে আপনি চিন্তা না করে পারবেন যে এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ নেই?

আপনি রাসূলকে (ﷺ) দুঃখ ভারাক্রান্ত হতে দেখেছেন, যা আগে কখনো দেখেননি। রাসূল (ﷺ) এক অনন্য শোকের মুখোমুখি হলেন। অবশ্যই সাহাবারা বলাবলি করতে লাগলেন, ইব্রাহিমের মৃত্যুর জন্যই সূর্য গ্রহণ হয়েছে, এ কারণেই আমরা এই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছি। অবশ্যই দুটো ঘটনা একই দিনে ঘটেছিল। রাসূল (ﷺ) বের হয়ে এসে খুসুফ - গ্রহণের নামাজ পড়ালেন। এত দীর্ঘ নামাজ যে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আপনি মূর্ছা যাবেন। সূর্য গ্রহনের সময় তাঁর নামায এতটাই দীর্ঘ হয়েছিল। সেই মুহূর্তে তাঁর অন্তরের অবস্থা এবং দু'য়া গুলো কি আপনি কল্পনা করতে পারেন?

সর্বোপরি তিনি আমাদের শিক্ষক, কিভাবে শোক প্রকাশ করতে হয় তাও তিনি আমাদের শেখাচ্ছেন। অন্তরে সেই পরিমাণ কোমলতা থাকা উচিত যে আপনি কান্নাকাটি করবেন, কিন্তু একই সাথে আপনি এমন কিছু বলবেন না, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। পুত্র বিয়োগের পরেও তিনি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "চন্দ্র ও সূর্য হলো আল্লাহর দুটি নিদর্শন, কারো মৃত্যুর জন্য এদের গ্রহণ হয় না, কারো জন্মের জন্য এদের গ্রহণ হয় না।" কাজেই আপনি যখন গ্রহণ প্রত্যক্ষ করবেন, আল্লাহর কাছে দু'আ করুন, নামাজ পড়ুন, দান সদকা করুন।

সুবহানাল্লাহ! এমনকি তখনও তিনি তাঁর কথা ও কর্মের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন।
আপনি যদি দুঃখ পান, জেনে রাখুন আপনার নবীও (ﷺ) দুঃখ পেয়েছিলেন, যদি আপনি কাঁদেন জেনে রাখুন তিনিও কেঁদেছেন। একই সাথে এটাও জেনে রাখুন, তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও ধৈর্য ধারণের নজির স্থাপন করে গেছেন। তাঁর মুখ থেকে তখন যা বের হয়ে এসেছিল তা হল الحمد لله! - আলহামদুলিল্লাহ! এবং যা তাঁর অন্তরেও তিনি লালন করেছিলেন।

সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (صلى الله عليه وسلم)
আবু হুরায়রা (রাsmile থেকে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন, বলেন, যে ব্যক্তির তিন সন্তান অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তা’আলা সন্তানদের উপর স্বীয় রহমতের কারণে তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তিনি বলেন, সন্তানদের বলা হবে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। তখন তারা বলবে, আমাদের মাতা-পিতা জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব না। তখন তাদের বলা হবে, তোমরা এবং তোমাদের মাতা-পিতা জান্নাতে প্রবেশ কর। [সুনান আন নাসাই:১৮৭৬]

মূল: ড: ওমর সুলাইমান
অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত

পঠিত : ৩৫৫ বার

মন্তব্য: ০