Alapon

“বিশ্বব্যাপী জুলুমের অবস্থা এবং মুক্তির পন্থা”



বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মহাজুলুমে পরিপূর্ণ। মানুষের মুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা বিশ্ব মোড়লদের মুখে শোনা গেলেও সত্যিকার মুক্তির দেখা পাচ্ছে কী মানবতা? কিংবা আদৌ কী পাওয়া সম্ভব?

যারা মুখে মানবতার বয়ান তুললেও অদৃশ্য ছোবলে পেঁচিয়ে রাখে পুরো বিশ্বকে; তাদের দিয়ে মানুষের মুক্তি কীভাবেই বা সম্ভব!

মহাজুলুমে ভরা বিশ্বের বাস্তবিক অবস্থা বুঝতে হলে আমাদের পাশ্চাত্যের পরিয়ে দেওয়া চশমাটা খুলতে হবে। অতীতের ইতিহাস না জানলে; পর্যালোচনা করতে না পারলে বর্তমানকে বুঝা সম্ভব নয়। আর বর্তমানকে না বুঝতে পারলে ভবিষ্যতও বুঝা অসম্ভব। আমরা কি বর্তমান সময়ের ফেরাউন, কারূন আর বালাবুরিদের চিনতে পারছি?

২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন ৮০ কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতো, ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮০ কোটিতে! প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন শিশু খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে। জুলুমপূর্ণ এই ব্যবস্থায় ৪০০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন মানুষ শরনার্থী হচ্ছে, ১৫০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না, ২৫০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে , এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে (২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী)। বর্তমানে তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই দরিদ্র্যতাকে দূর করতে প্রয়োজন মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডলার। আর সকল মানুষের বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। অথচ ফুটবল খাতে প্রতিবছর ৬০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় শুধুমাত্র আমেরিকায়। গত অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের মতো ৩য় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের বিশ্ব ব্যাংককে সুদ দেওয়ার পরিমাণ ছিলো ৬ বিলিয়ন ডলার! এই যদি হয় বাংলাদেশের দেওয়া সুদের পরিমাণ, তাহলে উন্নত দেশ গুলোর কথা চিন্তা করুন! বিশ্ব মোড়লেরা যদি বাস্তবিকই মানুষের মুক্তি চাইতো, তাহলে মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সকল মানুষের দরিদ্র্যতা দূর হতো, ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সকল মানুষ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতো।

পাশ্চাত্যের পলিসি হচ্ছে– নিজের জাতিকে রক্ষা করতে অন্য জাতিকে শোষণ করা, গণহত্যা চালানো, মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া সবই জায়েজ। আমেরিকায় মায়া সভ্যতা, ইনকা সভ্যতায় জনসংখ্যা ছিলো ৮ কোটি। বৃটিশরা সেখানে যাওয়ার ১০০ বছরে মধ্যে
জনসংখ্যা নেমে আসে ১ কোটিতে! জনসংখ্যা যেখানে বাড়ার কথা ছিলো বহুগুণে; অথচ হয়েছে ঠিক তার উল্টো। ভাবতে পারেন, কত বড় গনহত্যাই না হয়েছে! আফ্রিকার গণহত্যা, রেড ইন্ডিয়ানদের বর্বর সাজানো, এই তো বেশ কিছুদিন আগেই রুয়ান্ডার ১ সপ্তাহের নিধনে ১০ লক্ষ মানুষকে মারা এসব পাশ্চাত্যের ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনের রক্তচোষা ঘটনা।

মানুষের মাঝে পার্থক্য করা হয় ভাষা, বর্ণ এবং জাতের ভিত্তিতে। এই বিভেদ মূলত কার সৃষ্টি তা সহজেই অনুমেয়। হলিউড নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া আমাদের সামনে যেটা প্রচার করছে, যেসব নিউজ জানাচ্ছে আমরা কেবলমাত্র তাই দেখছি। মিডিয়া একটা ইস্যু আমাদের সামনে এনে দিলে আমরা সেটার পেছনেই লাফাচ্ছি। এতো বড় বড় জুলুমের প্রতিবাদ করার কেউ নাই! অথচ এই বিশ্বব্যবস্থা আমাদের কাছে আমানত। আমরা সেই আমানতের খিয়ানত করছি। দরিদ্রের ক্ষুধার ছটফটানি আমাদের বুকে এসে বিঁধে না, নীড় হারানো মজলুমের কান্না আমাদের চেতনা জাগায় না, মজলুমের রক্তের প্রবাহ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না, বিশ্বব্যবস্থা আজ সুদে জর্জরিত; বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর উপদেশ আমরা বেমালুম ভুলে আছি! শুধু তাই নয়, পশ্চিমা সৃষ্ট কৃত্রিম জাতীয়তাবাদের বুলিও আমরা কপচাচ্ছি।

অথচ ইসলামের শিক্ষা আমাদের জাগ্রত করে না। গোটা উম্মাহ আজ ষড়যন্ত্রের শিকার। আর আমরা হলাম দাবার গুটির মতন। আমাদেরকে খেলাচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না।

ফিলিস্তিন, চীন, মায়ানমার, সিরিয়া, আফ্রিকার প্রকৃত অবস্থা আমরা জানি না। রুয়ান্ডায় কি হচ্ছে তাও জানি না। বর্তমান স্বায়ত্তশাসিত মিন্দানাওয়ে গত ১০ বছরে কী হয়েছে তা আমরা জানি না। মিডিয়া ইচ্ছে মতো যাদেরকে ভিলেন সাজাচ্ছে, আমরাও তাদেরকে ভিলেন হিসেবেই চিনছি। প্রকৃত সত্য আমাদের কাছে আসছে না।

ইরানের শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব, তরস্কের তুর্কি-কুর্দি দ্বন্দ্ব, বাংলাদেশে আহলে হাদীস-হানাফী দ্বন্দ্ব, বাঙালি-উপজাতি দ্বন্দ্ব, সালাফী, সুফী, পীর, আহলে কুরআন এত এত মতবাদ আর ফেরকায় বিভক্ত আমরা। সোনালী সভ্যতার উত্তরসূরীদের এই অবস্থার পেছনে মূলত স্বার্থ কার, কারা লাভবান হচ্ছে তার ভিতরটা আমরা তলিয়ে দেখছি না।

বর্ণবাদকে উস্কে দেওয়া, মাজহাবী যুদ্ধ তৈরী করা, দ্বীন ইসলামকে পুনর্গঠন, পাশ্চাত্যে ইসলাম ফোবিয়া ছড়িয়ে দেওয়া এসব কিছুই পরিকল্পিত ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এই অবস্থায় আসার পেছনের বড় বড় ঘটনাগুলো হলো–

* আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার এবং শোষণ।
*২য় ভিয়েনা অবরোধ এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক পতন।
*১ম বিশ্ব যুদ্ধ।
*২য় বিশ্ব যুদ্ধ।
*স্নায়ু যুদ্ধের অবসান।
*টুইনটাওয়ার আক্রমণ।

আচ্ছা, তাহলে মুক্তি কোথায়?

মানব রচিত আইন, দর্শনের ব্যর্থতা আর ইসলামের স্বর্ণালী সভ্যতার ইতিহাসে ফিরে গিয়ে চলুন উত্তরটা খুঁজি।

ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি হলো আদালত । উমর (রাঃ) এর ভাষায়, “রাষ্ট্রের ধর্ম আদালত। আর একমাত্র ইসলামই আদালত প্রতিষ্ঠা করতে পারে।”
উৎপাদন এবং সুষম বণ্টন, আদালতপূর্ণ ব্যবস্থা একমাত্র ইসলামে বিদ্যমান।

যে রাষ্ট্রের প্রধান না খেয়ে দিনাতিপাত করতেন, সে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে সাড়ে ৩৮ লক্ষ বর্গমাইলে যাকাত নেওয়ার মতো একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটা শুধুমাত্র আদালতপূর্ণ ব্যবস্থায় সম্ভব হয়েছিলো। কেননা একমাত্র ইসলামেই মানবতার মুক্তি সম্ভব। জিবরাইল (আঃ)-কে প্রথম দেখার পরে রাসূল (সাঃ) এর ভীত অবস্থায় খাদিজা (রাঃ) এর দেওয়া অভয়গুলো আরেকবার স্বরণ করিয়ে দেয় ইসলামের মাহাত্ম্য। আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর সামনে আরবের সহায় সম্বলহীন জাফর বিন আবি তালিবের বলিষ্ঠ ভাষণ দেওয়ার মতো সাহস একমাত্র ইসলামী সভ্যতার ধারকদেরই মানায়। খলিফা হওয়ার পরে উমর (রাঃ) এর ভাষণ, “ফোরাত নদীর তীরে যদি একটা কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমি উমরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।” এই ভাষণ আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয় বিশ্বব্যবস্থা আমাদের কাছে আমানত। আলী (রাঃ) এর গভর্নরদেরকে দেওয়া চিঠিতে বর্ণিত উৎপাদন, বন্টন, নগরায়নের উপদেশগুলো আমাদেরকে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার শিক্ষা দেয়।

পাশ্চাত্যের শোষণ নীতির বিপরীতে ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা, প্রতিবেশির হক আদায় করা, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ না করা। বর্তমানের কারূনদের সুদী ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের আছে যাকাত ব্যবস্থা, কর্জে হাসানা, সাদাকাহ এর মতো ইনসাফপূর্ণ আখলাকী ব্যবস্থাগুলো।

পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারীরা যে সকল বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে–

1. Mineral Resource
2. Agricultural Resource
3. Seeds and Food System
4. Fresh Water Resource
5. Banking and Finance
6. Nuclear Energy
7. Ocean trading
8. Weapons and Mass Destruction
9. Media and Communication
10. Energy Resources
11. Energy Transmission Roads

এসব উপাদানগুলোর মূল উৎসগুলো বেশিরভাগই মুসলিম দেশগুলোতে। কৃষি ব্যবস্থা, বনাঞ্চল, খনিজ সম্পদ, গ্যাস, প্রণালীগুলোর ৯০-৮০% মুসলিম দেশ গুলোতে (এগুলো সবই আমাদের থেকে নিয়ে আমাদেরকেই শোষণ করা হচ্ছে)। শুধুমাত্র D-8 ভুক্ত দেশ গুলোতে বিশ্বের ১৫% তেল,২৩% গ্যাস রয়েছে। বিশ্ব বানিজ্যের ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার এসব দেশে যেখানে আমেরিকা ২০ ট্রিলিয়ন ডলার দেখায়।

গবেষণায় প্রমাণিত যে, বর্তমানে মানুষের কাছে যে জ্ঞান রয়েছে, এর ৭০%র বেশি এসেছে মুসলিমদের কাছ থেকে। ৭ম শতাব্দী থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপ্লব শুরু হয় মুসলমানদের হাতে। দীর্ঘ ৭শত বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় একচ্ছত্র বিচরণ ছিলো মুসলমানদের।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ; যুব সমাজের অধিকাংশ আমাদের। বিশ্বের অধিকাংশ যুবক শ্রেণি মুসলিম দেশগুলোতে। পৃথিবীর যত পরিবর্তন, বেশিরভাগই যুবকদের হাত ধরেই এসেছে। শাশ্বত ব্যবস্থার সোনালী ইতিহাস আছে আমাদের অনুপ্রেরণার জন্য। এত অবারিত সম্পদ, সুযোগ আমাদের আছে; অথচ আমরা কিনা অনুভূতি শূন্য!
সোনালী সভ্যতার সন্তান হয়েও আমরা আমানতের খিয়ানত করছি! শিক্ষাগত দিক থেকে পুরো উম্মাহ আজ পঙ্গুত্ব বরণ করে বসে আছে। আমাদের চেতনা নাই, শোষণ থেকে উত্তরণের অনুভূতিও নাই! গতানুগতিক স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর দেওয়া আমানতের খেয়ানত করে তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা পাবার আশা কীভাবে করতে পারি?

ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে এ যুগে আয়েশা (রাঃ), খাদিজা (রাঃ), খাওলা বিনতে আজওয়ার (রাঃ), উম্মে সালামা (রাঃ), সুফিয়া (রাঃ), ফাতিমা আল ফিহরীদের উত্তরসূরী হিসেবে অবদান রাখা খুবই দরকার; যারা নিঃসংকোচে ঘোষণা দিতে পারবে,

اِنَّ صَلَاتِىْ وَنُسُكِىْ وَ مَحْيَاىَ وَمَمَاتِىْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْن.
আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে।
(সূরা আল আন-আমঃ১৬২)

– তোহফা শরীফা

পঠিত : ২৯৫ বার

মন্তব্য: ০