Alapon

আরবের মরু সিংহ খ্যাত উমর আল মুখতার...



উত্তর আফ্রিকাতে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র লিবিয়া। রাষ্ট্রটির বেশিরভাগ অংশজুড়েই সাহারা মরুভূমি। সেই মরুভুমির উপকূলে লঘু জনবসতি পূর্ব সিরেনিয়েকা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত আল-বুত-তান জেলার যানজুর গ্রাম। সে গ্রামেই ১৮৫৮ সালের ২০ই আগষ্ট জন্মেছিলেন আরবের মরু সিংহ খ্যাত " ওমর আল মুখতার,,।


শৈশবে পা রাখা মাত্রই তিনি হারিয়েছিলেন তার পিতা-মাতাকে। তবুও থেমে যায় নি তার জীবনের গতি। স্থানীয় মসজিদে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন।পরবর্তীতে তিনি সেনুসি আন্দোলনের মূলকেন্দ্র জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ৮ বছর শিক্ষালাভ করেন। এখানেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনুসিদের সাথে।

তাদের যোদ্ধা বাহিনীর নাম ছিল "সানুসি,।


পেশায় তিনি শিক্ষক হলেও অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সবসময় তার অবস্থান থাকতো সুদৃঢ়। সবসময় চেষ্ঠা করতেন মাথা উচু করে বেচে থাকার।


১৯১১ সাল। লিবিয়ায় তখন কেবল ইতালীয় ঔপনিবেশিক শুরু হয়েছে।

১৯১১ সালে ইতালী-তুর্কী যুদ্ধের সময় অ্যাডমিরাল লুইগি ফারাভেলির নেতৃত্বে ইতালীয় নৌবাহিনীর একটি দল লিবিয়ার উপকূলে পৌছায় যা তৎকালে উসমানীয় তুর্কীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তুর্কী প্রশাসন ও সেনাদেরকে তাদের অধীনস্থ অঞ্চল ইতালীয়দের কাছে ছেড়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু তুর্কী ও তাদের লিবিয় মিত্ররা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে লিবিয়ার অভ্যন্তরে চলে যায়। ইতালীয়রা তিন দিন পর্যন্ত শহরে গোলাবর্ষণ করে। এরপর অধিকৃত অঞ্চলকে ইতালীর অধীনস্থ বলে ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনা ইতালীয় ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী এবং ওমর মুখতারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা করে।


পেশাগত দিক থেকে কুরআন শিক্ষক হলেও মুখতার মরুভূমিতে যুদ্ধকৌশল বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। তার এই জ্ঞানকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইতালীয়দের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিলেন। এই ইতালীয়রা মরু অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল না। মুখতার তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে সফল গেরিলা আক্রমণে সক্ষম হন। আক্রমণের পর তার বাহিনী মরুভূমিতে আত্মগোপন করত। তার বাহিনী দক্ষতার সাথে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, সৈন্যবহরের উপর আক্রমণ চালায় এবং যোগাযোগ ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তার গেরিলা পদ্ধতির লড়াইয়ে ইতালীয় সৈনিকরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।


ওমর মুখতার এতোটাই কৌশলী বাহিনী পরিচালক ছিলেন যে, ১৯২৪ সালে যখন ইতালীয় গভর্নর আর্নেস্ট বমবেলি জেবেল আখদারের পার্বত্য অঞ্চলে পাল্টা গেরিলা বাহিনী গঠন করে তার বাহিনীর উপর বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করে। মুখতার দ্রুত তার কৌশল পাল্টান এবং মিশর থেকে সাহায্য লাভে সমর্থ হন। ফলে ব্যার্থ হয়ে যায় ইতালীয় গভর্নরের এই অপারেশন। কিন্তু, ১৯২৭ সালের মার্চে ইতালীয়রা জাঘবুব দখল করে নেয়।


তখন ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত মুখতার তার সানুসি বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। তার দক্ষতার কারণে ইতালীয় গভর্নর জেনারেল আটিলিয়ো তেরুজ্জি ওমরকে “ব্যতিক্রমী স্থিরচিত্ত ও অটল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন” বলে উল্লেখ করেন।


১৯২৯ সালে ইতালীয় নতুন গভর্নর পিয়েত্রো বাদোগলি তাকে আত্নসমর্পণের প্রস্থাব দেন। কিন্তু ওমর মুখতার সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং তার সানুসি বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে লড়ে যেতে থাকেন।


একসময়, স্থানীয় চর ও সহায়তাকারীদের সাহায্যে ইতালীয় বাহিনী স্থলযুদ্ধেও বিদ্রোহীদের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। ঝুকি সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যান মুখতার আর তার বাহিনী। ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্লোনটার নিকট এক যুদ্ধের সময় ইতালীয় বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে তিনি গ্রেপ্তার হোন।


ইতালীয় ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে মুখতারের প্রায় ২০ বছরব্যাপী লড়াই ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার প্রেপ্তারের মাধ্যমে সমাপ্তি লাভ করে। তাকে প্রেপ্তারে সাহায্য করায় স্থানীয় নেতাদেরকে পুরষ্কৃত করা হয়।


মাত্র তিন দিনের মধ্যেই মুখতারের বিচার সম্পন্ন হয়। বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৪ সেপ্টেম্বর রায়ে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এই বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল না। শেষ কথা জানতে চাওয়া হলে মুখতার কুরআনের আয়াত “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন” (আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাব) পাঠ করেন। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সুলুকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তার অনুসারীদের সামনে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল সত্তর বছর। আরবের এই মরু সিংহকে লিবিয়ার সুলুকে সমাহিত করা হয়।


১৯১২ সাল থেকে শুরু করে প্রায় বিশ বছর ওমর মুখতার ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছিলেন। মাঝারি উচ্চতা, সুঠাম দেহ, সাদা দাড়ি গোঁঁফ বিশিষ্ট ওমর মুখতার ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন, ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী, শক্তিসম্পন্ন ও ক্ষীপ্র ব্যক্তি, স্বার্থ ও আপোষহীন। তিনি খুব ধার্মিক ও দরিদ্র ছিলেন এবং সানুসি বাহিনীর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলেন এই আরবের মরু সিংহ খ্যাত "ওমর আল মুখতার,,।

-হোসাইন শাহাদাৎ

পঠিত : ৬৭৩ বার

মন্তব্য: ০