Alapon

কর্ডোবা মসজিদের গঠণ ও আল্লামা ইকবালের নামায...



১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের মসজিদটির নকশা করেন একজন সিরিয়ান স্থপতি। এর থামের সংখ্যা ৮৫৬টি। এছাড়াও ৯টি বাহির দরজা ও ১১টি অভ্যন্তরীণ দরজা রয়েছে। লাল ডোরাকাটা খিলানগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় স্থাপত্যশিল্পে মুসলিম পন্ডিতদের কথা।

এই মসজিদের থামগুলো নির্মিত হয়েছে মার্বেল, গ্রানাইট, জেসপার, অনিক্স পাথর দিয়ে। পরে নতুন করে সংস্কার করে সোনা, রুপা ও তামাসহ অনেক মূল্যবান উপাদান ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য আরও বাড়ানো হয়।

কর্ডোভা মসজিদ নির্মাণে সেকালেই আড়াই থেকে তিন লাখ মুদ্রা ব্যয় করা হয়েছিল। পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ছিল ৫০০ ফুট। এর সুন্দর ও আকর্ষণীয় মিহরাবগুলো স্থাপিত ছিল পাথরের নির্মিত এক হাজার ৪১৭টি স্তম্ভের ওপর। মিহরাবের কাছে একটি উঁচু মিম্বর ছিল হাতির দাঁত ও ৩৬ হাজার বিভিন্ন রং ও বিভিন্ন কাষ্ঠখূরে তৈরি। সেগুলোর ওপর ছিল হরেক ধরনের হীরা-জহরতের কারুকাজ। দীর্ঘ সাত বছরের পরিশ্রমে মিম্বরটি নির্মাণ করা হয়। তৈরি করা হয় ১০৮ ফুট উঁচু মিনার, যাতে ওঠানামার জন্য নির্মিত দুটি সিঁড়ির ছিল ১০৭টি ধাপ। মসজিদের মধ্যে ছোট-বড় ১০ হাজার ঝাড়বাতি জ্বালানো হতো। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ঝাড়বাতি ছিল রুপার, বাকিগুলো পিতলের তৈরি। বড় বড় ঝাড়ের মধ্যে এক হাজার ৪৮০টি প্রদীপ জ্বালানো হতো। শুধু তিনটি রুপার ঝাড়েই ৩৬ সের তেল পোড়ানো হতো। ৩০০ কর্মচারী ও খাদেম শুধু এই মসজিদের তদারকিতেই নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৮৪ সালে ঐতিহাসিক এ মসজিদটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত দেয়। মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য টিকিট ফি ১০ ইউরো। প্রতিদিন অনেক পর্যটক ভিড় করেন ঐতিহাসিক এ মসজিদটি দেখার জন্য। হৃদয়গ্রাহী নকশা ও স্থাপত্যশৈলীর জন্য নবম ও দশম শতাব্দীতে এটি ছিল সারা বিশ্বের প্রথম সারির মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম।

মসজিদ থেকে গির্জা

মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আন্দালুসিয়াকে বিভক্ত করে ফেলে। মুসলমানদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্যাসলের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা ১২৩৬ সালে স্পেন দখল করলে এই মসজিদকে গির্জায় পরিণত করা হয়। তখন থেকে একে বলা হয় দ্য মস্ক ক্যাথেড্রাল অব কর্ডোভা।

স্থাপনের পর থেকে মুসলিমরা এখানে নামাজ আদায় করেছিল প্রায় পাঁচশ বছর ধরে। এর সুউচ্চ চারকোনা আকৃতির মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন খলিফা তৃতীয় আব্দুর রাহমান। এক সময় সুন্দর সেই মিনার থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি। কিন্তু গির্জায় রূপান্তরিত হওয়ার পর মিনারটিতে অসংখ্য ঘণ্টা লাগানো হয়েছে।

মসজিদে ঢুকতেই চোখে পড়বে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি। মসজিদের বিভিন্ন আয়াত ও আল্লাহর নামের ক্যালিওগ্রাফির পরিবর্তে এখন শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন তৈলচিত্রের ক্রিশ্চিয়ান ফলক। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে ও দেয়াল সংলগ্ন অংশে খ্রিস্টধর্মীয় চিত্র ও ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় আলাদা করে গির্জার মঞ্চ ও পুণ্যার্থীদের বসার বেঞ্চ রয়েছে। মঞ্চে শোভিত হচ্ছে যিশুখ্রিস্ট ও সাধুদের ভাস্কর্য। বর্তমানে কর্ডোভা মসজিদে জুতা পরিহিত অবস্থায় প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং সেখানে নামাজ আদায় করা এখন নিষিদ্ধ।

আল্লামা ইকবালের নামাজ আদায়

স্পেন থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হওয়ার পর দীর্ঘ ৭০০ বছর কর্ডোভা মসজিদে কোনো আজান ও নামাজ হয়নি। আল্লামা ইকবালের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল এই মসজিদে দু’রাকাত নামাজ পড়া।

১৯৩৩ সালে স্পেন সফরকালে আল্লামা ইকবাল এই মসজিদ পরিদর্শন করেন। মসজিদে নামাজ পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও শুধু আল্লামা ইকবালকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে, প্রবেশের পর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলা হয়।

মসজিদে প্রবেশ করেই উচ্চস্বরে আজান দেন আল্লামা ইকবাল। দীর্ঘ সাতশ’ বছর পর ওই মসজিদে এটিই ছিল প্রথম আজান। মসজিদের দেয়াল ও স্তম্ভগুলো দীর্ঘকাল পর আজানের ধ্বনি শুনতে পায়। আজানের পর জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন ইকবাল। নামাজে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে মোনাজাত করেন। মোনাজাতের প্রতিটি বাক্যই কবিতার মতো করে আবৃত্তি করেছিলেন তিনি। তার এই মোনাজাতটিই ‘বালে জিবরিল’ নামে পরিচিত।
কর্ডোভার মসজিদে আল্লামা ইকবালের নামাজ আদায়ের ঘটনা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। অসাধারণ নৈপুণ্যে তৈরি এই মসজিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মহাকবি আল্লামা ইকবাল রচনা করেছিলেন ৭টি কবিতা।

২০০০ সালের প্রথম দিকে স্প্যানিশ মুসলমানরা এই মসজিদের নামাজ আদায় করার দাবি জানালে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন এই কর্ডোভা মসজিদটি এখনো গির্জা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

- ওয়াসিম খান

পঠিত : ৫৫২ বার

মন্তব্য: ০