Alapon

মাওলানা মওদূদী ইসলামি সভ্যতার এক নির্মাতা



মালয়েশিয়ার কয়েকজন ইসলামিক স্কলার The Architects of Islamic Civilisation নামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। এদের মধ্যে একজন হলেন প্রখ্যাত গবেষক ও চিন্ত্যক ড. হাশিম কামালি।

তারা খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতার প্রভাবশালী ৪৩ জন নির্মাতাদের জীবনী সংকলন করছেন। ফরম্যাটিভ পেরিয়ড থেকে এনেছেন তিনজনকে। এক. উমর ইবনে খাত্তাব, দুই. আলী ইবনে আবু তালিব ও তিন. আয়িশা বিনতে আবু বকর রা.ত্রয়কে।

বিংশ শতাব্দী থেকে নিয়েছেন ছয়জন ইসলামী সভ্যতার নির্মাতাকে। তারা হলেন,
এক. মালেক বেননাবী
দুই. মুহাম্মাদ আবু জাহরা
তিন. আলী শরিয়তী
চার. সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
পাঁচ. হামকা ( হাজী আবদুল মালিক করিম আমরুল্লাহ)
ছয়. ফজলুর রহমান

এ ছয়জনের মধ্যে আজ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রহ.-এর অংশের প্রথম দিকের কিছুটা আলোচনা করছি।

(প্রথম পর্ব)
মাওলানা মওদুদী ইসলামী সভ্যতার এক নির্মতা
---ওয়ান নাইম ওয়ান মানসুর

“সামজ জীবনের যেসব উপাদান সংস্কৃতি ও নৈতিকতাকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী শক্তি হলো সরকার। তাই সমাজ থেকে ফিতনার যবনিকাপাত এবং মন্দকে পরিশুদ্ধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সকল দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের অপসারণ এবং তদস্থলে তত্ত্বে ও প্রয়োগে ধার্মিক ও সৎ লোকদের ক্ষমতায়ন।”
মওদুদী, আল জিহাদ ফিল ইসলাম

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতাংশে মাওলানা মওদুদী রহ. ইসলামী রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, একজন সত্যিকার মুসলিম কখনও দ্বীনকে ব্যক্তিগত অঙ্গনে সীমাবদ্ধ করবে না। আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সকল প্রকৃত মুসলিমই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আল্লাহর আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করবেন, যাতে তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন করতে পারেন।

এই সংক্ষিপ্ত উক্তিতে মাওলানা মওদূদী রহ.-এর সতন্ত্র, আনঅ্যাপোলজেটিক ও তেজোদৃপ্ত উপস্থাপনাশৈলি প্রতিফলিত হয়েছে, যা জোরালো কিন্তু যৌক্তিক, যা আধুনিক কিন্তু সুশৃঙ্খল।

মওদূদী রহ. এমন এক শক্তিমান মুজাদ্দিদ যে মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পরও দক্ষিণ এশিয়ায় তার জন্য কোনো ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। মধ্য উনিশ শতকের উষালগনে, মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালে মাওলানা ইসলামের যুগান্তকারী পুনঃব্যাখ্যা হাজির করেন। একজন ধর্মতাত্তিক, সামাজ-রাজনীতির দার্শনিক, রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলামী সংস্কারক হিসেবে মুসলিম সমাজে তিনি ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ সমাধান হিসেবে প্রমাণের প্রয়াস চালিয়েছেন।

১৯২৪ সালে মুসলিমদের শেষ খিলাফত পতন পরবর্তী দৃশ্যপটে বৈদ্যভূমির শূন্যতা তৈরি হয়। প্রায় সকল মুসলিম ভূখণ্ডে জগদ্বল পাথরের মতো চেপে বসে কলোনি শাসন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা তার চরমে পৌঁছে। তখন থেকে মুসলিম সমাজের মানসপটে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে- শিক্ষাব্যবস্থা সেক্যুলার ও ধর্মীয় দুটি পৃথক ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে, উদার পশ্চিমা দর্শনের সাথে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক কাঠামো নতুন রূপ লাভ করতে থাকে। এসব উদার দর্শন ও নতুন শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ-রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং জনপরিমণ্ডলে উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামের ভূমিকাকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করতে থাকে। মওদুদী এটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হন। তিনি বলেন, মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব কেবল একটি উপায়ে পুনরুদ্ধার করতে পারে, তাহলো ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে, ইসলামকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা ও ইবাদতের পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ করে কিংবা ইসলামকে অতীত বাস্তবতা হিসেবে উপলব্ধি করে আজাদি অর্জন করা যাবে না।

অনেকেই মওদুদীকে একজন প্রতিভাধর, প্রাজ্ঞ ও পুনর্জাগরণবাদী চিন্ত্যক হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর লেখনি প্রায়শ জোরালো, শক্তিশালী, অকাট্য ও যুক্তিসঙ্গত প্রতীয়মাণ হয়েছে; ইসলামকে একটি সামগ্রিক ও সুসঙ্গত জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্রের মতো পশ্চিমা সভ্যতার মৌলিক ধারণাগুলোকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। মওদুদীর ইসলাম চিন্তা ও দর্শন তার সমসাময়িক স্কলারদের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে- মিসরের সুন্নি স্কলার হাসান আল বান্না ও সাইয়েদ কুতুব, ইরানের শিয়া নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাদের মধ্যে অন্যতম। উদাহরণসরূপ, সাইয়েদ কুতুব মওদুদীর বিপ্লবী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অন্যদিকে মাওলানা মওদুদীর ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাকে ইমাম খোমেনি দেখেছেন তার শিয়া ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের যথার্থ মডেল হিসেবে। মওদুদী রহ. আল্লামা ইকবালের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; তাঁর সাথে “ফিকহ অ্যান্ড মডার্নিটি” নামক একটি গবেষণা প্রকল্পে একসাথে কাজও করেছেন।
...

পঠিত : ৫১৯ বার

মন্তব্য: ০