Alapon

মাওলানা মওদুদী: চিন্তা ও কর্মষণার পুনর্পাঠ



গত শতকের মহান মুজাহিদ, প্রখ্যাত আলেম, চিন্তক, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিক সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সে উপলক্ষে তাঁর চিন্তাপাঠ করার জরুরত অনেক বেশিই।
মওলানা মওদুদী গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। সমগ্র দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলন তাঁর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। একইসাথে তিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামী ব্যক্তিত্ব।
একালে এসে তাই তাঁর চিন্তা ও কর্মষণার অন্বয়ে সামগ্রিক পঠন-পাঠনের গুরুত্ব মোটেই কমেনাই।
উপমহাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাওলানা মওদুদী যে কাজ করছেন, তাকে "ইসলামী সভ্যতায়ন, রাজনৈতিক তত্ত্বায়ন ও পুনর্জাগরণী পরিকাঠামোগত প্রকল্প" তৈরির প্রক্রিয়া বলা যাইতে পারে। মাওলানাকে বুঝতে হলে এজন্য তৎকালীন পরিস্থিতি, সময়ের চাহিদা, ও যুগের সমস্যা বুঝা আবশ্যক।
প্রচলিত সকল মতবাদ, দর্শন, ও পদ্ধতিকে গভীরভাবে পাঠ করে তিনি তার যৌক্তিক সমালোচনা করেন। এবং বিকল্প সমাধান হিসেবে ইসলামের ব্যাপক ও শক্তিশালী দর্শনকে তুলে ধরেন। ধীরে ধীরে মাওলানা একটি পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্দোলন তৈরী করার পরিবেশ তৈরি করতে থাকেন।
মাওলানা মওদুদীর সবচেয়ে বড় সফলতার জায়গা ছিলো ইসলামের ক্ল্যাসিক ধারার একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন, একইসাথে মহান আলেম, চিন্তক ও শক্তিশালী ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন। উল্টাদিকে পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তায় তার গভীর দখল ছিলো। ফলশ্রুতিতে মাওলানা যখন খন্ডাইছেন, তা হয়েছে সর্বোচ্চ যৌক্তিক ও গভীর।
মাওলানার অন্যতম একটা প্রধান প্রকল্প ছিলো ইসলামের ধর্মতত্ত্বীয় বয়ান আর পশ্চিমা সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত ধর্ম তথা সেক্যুলারাইজড ধর্মের বিপরীতে ইসলামের বিস্তৃত অঙ্গন, বিশালতা, বহুমাত্রিকতাকে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপস্থাপন করা। মাওলানা লেখেন-
"ধর্ম নিছক একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং শুধু ব্যক্তিগত নীতিবোধের সঙ্গেই এর সম্পর্ক রয়েছে, একথা আজকে বাসি হয়ে গেছে। আসলে এ হচ্ছে ঊনিশ শতকেরই এক বিশেষ খামখেয়ালি মাত্র। অথচ বর্তমান সময়ে এসেও আমাদের দেশের একশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল লোক এই মতবাদটি প্রচার করে চলছে। এই শ্রেণীর লোকেরা ‘প্রগতি’ ‘প্রগতি’ বলে চিৎকার করা সত্ত্বেও হামেশা চলমান বিশ্বের চাইতে পঞ্চাশ বছর পেছনে চলতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজকে একথা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত বলা চলে যে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির কোন চিন্তাই করা যেতে পারেনা। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই অপরাপর ব্যক্তির সংঙ্গে বহুবিধ ছোট বড় সম্পর্কে জড়িত।
তিনি আরো তুলে ধরেন-
"সমাজ হচ্ছে মোটামুটিভাবে একটি দেহ সদৃশ। এখানে ব্যক্তির মর্যাদা হচ্ছে জীবন্ত দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো। ধর্মের প্রয়োজন যদি থেকেই থাকে, তবে তা শুধু ব্যক্তির নিজস্ব মনঃতুষ্টি বা পরকালীন মুক্তির জন্য নয়; বরং গোটা সমাজের সংগঠন এবং জীবনের তাবৎ কাজ কারবার পরিচালনার জন্যেই প্রয়োজন। আর তার প্রয়োজন না থাকলে ব্যক্তি বা সমাজ কারুর জন্যেই নেই। সমাজের বিধি-ব্যবস্থা হবে একরূপ আর ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মচারণ হবে তার থেকে ভিন্নরূপ, এটা একটি অযৌক্তিক বক্তব্য বৈ ভিন্ন কিছু নয়"।
ইসলামকে মুক্তির বিকল্প প্রস্তাবনা হিসেবে উল্লেখ করে মাওলানা লেখেন-
এমতাবস্থায় মানবতার মুক্তি কেবল এ পন্থাটির মধ্যেই নিহিত এবং এই পন্থাটি বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে, কারণ ইহা ভিন্ন মুক্তির কোন সম্ভবনা নেই"।
একালে মাওলানার অবদান কি তা নিয়ে নানান ধরণের তফসির-তাবিল আছে, ব্যখ্যায়ন ও তত্ত্বায়ন আছে। মাওলানাকে আমরা কিভাবে দেখবো তাও অনেকে অনেকভাবে বুঝাইছেন। আবার মাওলানাকে শ্রেষ্ঠ করতে অনেকেই দেওবন্দ ধারার আলেমগণ, মাদানী শায়েখদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়া তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের স্লোগান দিতে চাইছেন। তবে এই বয়ান যথেষ্টই ঝামেলাপূর্ণ।
(একজন মানুষরে ব্যাখ্যা করতে চাইলে নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিরে মানদন্ড বানানোটা আমার দৃষ্টিতে নাজায়েজ! জর্মন তাত্ত্বিক মহামতি কার্ল জাঙও এই মামলায় একমত যে, মানুষের কাছে চিন্তা করা কঠিন, সেই কারণে তারা মানুষকে বিচার করে, জাজ করে। এই জিনিসটা সেই কারণে বড়ই সমস্যাজনক)
মাওলানার অবদান, কাজ আর চিন্তার মুখতসর করা যায় এভাবে-
• মানব মুক্তি আন্দোলনের চিন্তাগত কাঠামায়ন ও তত্ত্বায়ন
• ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের পরিকাঠামো তৈরি ও ব্যাখ্যাদান
• ইসলামী রাষ্ট্রের চেতনাকে জাগ্রত করা, ছড়িয়ে দেওয়া
• সাংগঠনিক আন্দোলন তৈরি
• শক্তিশালী ইসলামী সাহিত্যধারা তৈরি, ইসলামী সাহিত্যে বিপ্লব সৃষ্টি
• কালাম ও ফিকহকে একত্রিত করে তুলে ধরা
• সাহিত্যে তাসাউফকে স্থান দেয়া
• পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন হিসেবে ইসলামের কাঠামোগত প্রকল্পকে তুলে ধরা
• ইসলামী সভ্যতার বিজয়ী চেতনাকে তুলে ধরা
• ইসলামী চিন্তার পুনর্জাগরণ
• উম্মাহর চেতনাকে জাগ্রত করা
• মুসলিমদের আত্মবিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনা
• সমগ্র বিশ্বের সাথে সম্পর্ক ও ইসলামী আন্দোলনসমূহের আন্তঃসম্পর্ক তৈরি করা
• যুগ সমস্যার সর্বাধিক যৌক্তিক ও ইসলামী মূলনীতিভিত্তিক সমাধান হাজির করা (এবং মডেল দাড় করানো)
এসকল বিষয় অবশ্যই তাঁর অবদান ও শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা।
একালে যখন ইসলামী সভ্যতার বিজয়, মানবমুক্তি আন্দোলন ও ইসলামী পুনর্জাগরণী চিন্তার তত্ত্বায়ন করতে হবে, সেকালে মাওলানা অপরিহার্য। ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য মাওলানা মওদূদী যে কাঠামো প্রস্তাবনা হিসেবে তুলে ধরেন তাঁর সংক্ষিপ্তসার-
• ইসলামের মূলনীতি ও মূল্যবোধকে জনগণের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি পাশ্চাত্য দর্শনকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। ইসলামের নীতিকে যুগোপযোগী ও যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। যাতে সকল মতবাদের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
• ইসলামের নীতিকে যারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের আখলাক নৈতিক চরিত্রকেও ইসলামের আলোকে পুনঃনির্মাণ করতে হবে। যাতে তারা সামাজিক সংস্কার, শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও আর্থসামাজিক অবস্থার চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে পারে।
• এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার জন্য দরকার জিহাদ ও ইজতিহাদের শক্তি। ইজতিহাদ হচ্ছে ইসলামী ব্যবস্থায় গতিশীলতার নীতি আর জিহাদ হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে চালিত সংগ্রাম। এক্ষেত্রে ইসলামের মূল্যবোধ ও দর্শনকে আজকের দিনের প্রয়োজনকে সামনে রেখে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ইসলামী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে দরকার ইজতিহাদের চর্চা ও বাস্তব কর্মজীবনে দরকার জিহাদের নীতির প্রয়োগ।
• এ প্রক্রিয়ার সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নেতৃত্বের পরিবর্তন। আর এর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবই অন্তর্ভুক্ত। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র বা ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর করা যাবেনা যদি না নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, যোগ্যতা, ও সততা প্রশ্নাতীত না হয়। একইসাথে ইসলামী সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণও নেতৃত্ব সংকট। তাই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
বাস্তবিকই আজ যখন মাওলানা মওদুদীর অবদানকে পর্যালোচনা করি তখন দেখি, মাওলানা মওদুদী ইসলামী ভাবজগতের এমন এক ধ্রুব ব্যক্তিত্ব, যার চিন্তা পাঠ ও চর্চা একালেও বিরাট জরুরত বহন করতেছে। দুঃখজনক হইলেও সত্য এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক কোন কাজ নাই। মাওলানা মওদুদীকে প্রত্যেকেই নিজস্ব চোখে আর চশমায় মূল্যায়ন করছেন, ফলে তাঁর সামগ্রিক সুরত বিম্বিত হয়নাই কোনখানেই। একশ্রেণি যথাযথ বুঝশক্তি ছাড়াই মাওলানার চিন্তার চৌহদ্দিতে ঢুকছেন, ফলে দিনশেষে তারা তাকে ফতোয়া দিয়া, আর গালিগালাজ করেই দায়িত্ব শেষ করে রাখছেন। অপর শ্রেণি, মাওলানাকে মূর্তি বানায় রাখছেন, গঠনমূলক ক্রিটিক ও পর্যালোচনাও করেননাই। অনেকক্ষেত্রে তাঁর পর্যালোচনা এত অদ্ভুত আর একপেশে হইছে যে, যেগুলা তাঁর কৃতিত্ব বলা হইছে, সেগুলাই মূলত মাওলানার সাথে দ্বিমতের জায়গা। যে জায়গায় সমালোচনা করা হইছে, সেটাই মূলত তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্গন।
একদল তারে বানাইছেন রাজনীতিক, আরেকদল লেখক, আরেকদল সংগঠক কিন্তু কোনখানেই তাঁর পুরো চেহারা আমরা খুজে পাইনা! আংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, তুর্কিসহ বহু ইউরোপিয়ান জবানে উনারে নিয়া কাজ হইলেও বাংলাদেশে এবং বাংলা ভাষায় অদ্যাবধি চিন্তা পর্যালোচনামূলক কোন কাজ (একাডেমিকভাবে তো না-ই, এম্নিতেও না) হয়নাই।
একালে ইসলামী পুনর্জাগরণের তত্ত্বায়নে আপনি আলাপ করতে গেলে মওলানা মওদুদী অপরিহার্য। অবশ্যই তাঁর চিন্তা সমালোচনার উর্দ্ধে নয় (আমি নিজেও বেশকিছু বিষয়ে তাঁর সাথে একমত নই।) কিন্তু তাঁর চিন্তার অনিবার্য প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করার মতো নয়। মাওলানার চিন্তা সমালোচনার উর্দ্ধে না হলেও, উপেক্ষার উর্দ্ধে। কারণ পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের প্রবল প্রকোপ ও স্রোতের বাধ হিসেবে মাওলানার চিন্তা যে প্রাসঙ্গিকতা রাখতো, আজও তা বহাল তবিয়তেই বিদ্যমান আছে।
-মুসান্না

পঠিত : ৫১২ বার

মন্তব্য: ০