Alapon

বিয়ের প্রস্তাব ও কিছু কথা


কোনো একজন মানুষকে ভালো লাগা, কোনো একজন মানুষকে পছন্দ হওয়া, কোনো একজন মানুষের কোনো একটা আচরণ কিংবা গুণাবলিতে তার প্রতি হৃদয়টা ঝুঁকে পড়া আসলে নিতান্তই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কোনো অন্যায় কিংবা অপরাধের বিষয়ও না তা।
যেহুতু আমরা মানুষ, রক্তে-মাংসে গড়া দেহ আমাদের। সেহেতু আমাদের মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ভালোলাগা-ভালোবাসা কাজ করতেই পারে। এই স্বাভাবিকতাকে কোনো ধর্ম, কোনো মতভেদ, কোনো বিজ্ঞান-ই অস্বীকার করেনা। করতে পারেনাও। করার সুযোগও নেই।

ইসলামের মূল সূত্র আল-কুরআন। এই মহাগ্রন্থটিই আমাদেরকে জানাচ্ছে যে—নারীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমাদের ভালো লাগে, যাদের কথা তোমাদের মনে পড়ে, যাদের চিন্তা তোমাদের মনের উঠোনে উঁকিঝুঁকি দেয়, তাদেরকে তোমরা তা জানিয়ে দাও তথা ভালোলাগার বিষয়টা বলে দাও। বিয়ের প্রস্তাব করো। এটা দোষের কিছু নয়। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে— “ ... বিয়ে করার ইচ্ছে ইশারা-ইঙিতে প্রকাশ করলে, অথবা মনের কোণে লুকিয়ে রাখলে কোনো ক্ষতি নেই। আল্লাহ জানেন তাদের চিন্তা তোমাদের মনে জাগবেই”। ( সুরা বাকারা : ২৩৫ )

এরপরেই কুরআন বলছে দেখো, তোমাদের ভালোলাগা, তাদের প্রতি দুর্বলতা আশাটা স্বাভাবিক। আল্লাহ তোমাদের মনের এসব বিষয় জানেন। তাই যতোটা সম্ভব তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো। তাক্বওয়ার নীতি অবলম্বন করো। এভাবে চলার পরেও মানুষ হিসেবে এতে যে ছোটোখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, আল্লাহ সেটা ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু একটা জিনিস আল্লাহর কুরআন সুষ্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে, তা হচ্ছে এই—দেখো, তোমরা ভালোলাগা থেকে কোনো গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যেওনা তাদের ( মেয়েদের ) সাথে। যে কথাটা তাদের সাথে বলবে, তা বলবে বৈধভাবে। মানে বৈধভাবে কথাবার্তা বলতে পারো। ( তাফসীরে তাইসিরুল কুরআন) যে চুক্তিটা তাদের সাথে করবে, তা-ও করবে বৈধভাবে। পরিচিত ও প্রচলিত পদ্ধতিতে।(তাফহীমুল কুরআন) যেটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ যা সামাজিক সৌন্দর্য-শৃঙ্ক্ষলা বিনষ্ট করবেনা—এমন পদ্ধতিতে। যেমন তাঁকে বলা যে—আমার বিয়ে করার প্রয়োজন, আমি একজন সৎ নারী খুঁজছি, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে কিংবা তোমাকে আমি চাই বা তোমার ব্যাপারে আমি আকাঙ্ক্ষা করি ইত্যাদি। অথবা তার অভিভাবককে বলা যে, তার বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে আমাকে অবশ্যই জানাবেন ইত্যাদি। ( তাফসীরে ইবনে কাসীর)
উক্ত আয়াতে যদিও বিধবা নারীদের বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছে, তথাপি আমি মনে করি বিষয়টি সকলের জন্যেই প্রযোজ্য। প্রযজ্য নারীদের ক্ষেত্রেও। তবে সেসব মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম, যারা ইতোমধ্যে স্বামীর সাথে স্বাভাবিক সংসার করে যাচ্ছে। এবং এক তালাক বা দু’তালাকপ্রাপ্তা নারীদেরকেও বিবাহের পয়গাম পাঠানো সুস্পষ্ট হারাম এবং মারাত্মক গুনাহের কাজ। কারণ এখনো সে প্রথম স্বামীর অধীনে আছে। ( তাফসীরে আহসানুল বায়ান )

এখানে আল-কুরআনের এই আয়াত আমাদেরকে একটা মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছে। আর তা হলো কাউকে ভালোলাগা, কারো প্রতি বিবাহের জন্যে মন ঝুঁকে যাওয়াটা কোনো গুনাহের কাজ নয়। কিন্তু একটা বিষয় হচ্ছে তা যেনো হয় সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্যপন্থায়। সমাজের কোনো রীতিনীতি-সংস্কৃতি যদি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে সেটা মেনে নেওয়া এবং গ্রহণ করা-অনুসরণ করার মাঝে কোনো অসুবিধে নেই। বরঞ্চ শান্তি-সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা রক্ষার্থে সেটার অনুসরণ করাটাই একজন মুমিনের কর্তব্য। ইসলাম তো একটা সুন্দর সমাজ-ই গঠন করতে চায়। তাই না?

অথচ কতিপয় মানুষ, কতিপয় গ্রুপ আমাদেরকে আমাদের তরুণ-তরুণীদেরকে সমাজের বিধিবদ্ধ নিয়মের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। মা-বাবা ও সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের মানসিকতা সৃষ্টি করছে। পালিয়ে বিয়ে, গোপনে বিয়ে, পিতা-মাতাকে না জানিয়ে কিংবা তাদের অবাধ্যতায় বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহের যোগান দিয়ে যাচ্ছে হরদম। এদের এমন বায়বীয় আবেগের ফাঁদে পড়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণী নিজেদের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভুল সীদ্ধান্তও নিয়েছে, এখনো নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত-ই। যদিও হানাফি মাজহাব অনুযায়ী অভিভাবক ছাড়াও বিয়ে হবে বলে রায় আছে, তবুও এটা অসুন্দর। বিয়ে তো শুধুই আবেগের নামই নয়। একটা সমাজের সাথে আরেকটা সমাজের, একটা পরিবারের সাথে আরেকটা পরিবারের বন্ধনও বটে। এখন দুই পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি করে, পিতা-মাতাকে কষ্ট দিয়ে নিজেদের নফসের দাসত্ব করাটা কি আদৌ কোনো মুমিনের জন্য শোভনীয় হতে পারে? অথচ ফেসবুকের কতিপয় গ্রুপের বদৌলতে হরহামেশা-ই এসব করে যাচ্ছে অনেক ভালো ভালো ছেলে-মেয়েও। যাদের এক সময় এসব নিয়ে এতোটা ফ্যান্টাসি ছিলোনা। এসব নিয়ে অতোটা ভাবতোও না। ভাবার সাহসও করতোনা।

যাইহোক, কুরআনের শিক্ষানুযায়ী আমরা যা করতে পারি, তা হলো আমরা আমাদের প্রস্তাবটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং তাঁর অভিভাবকের কাছে দেবো। সব মিলিয়ে যদি রাজি হয়, তা হলে আলহামদুলিল্লাহ। না হলে কুরআনের সেই আয়াতকে মাথায় রেখে চুপ হয়ে জীবনকে সামনে এগিয়ে নেওয়াটাই কল্যাণকর। যে আয়াতে আল্লাহ আমাদের বলেছেন — হয়তো তুমি কিছু তোমার জন্য পছন্দ করো বা ভালোবাসো যা তোমার জন্যে অকল্যাণকর। ( সুরা বাকারা : ২১৬)। এই আয়াতটা, আল্লাহর এই কথাটা মগজের ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে রাখলে হতাশা কিংবা না পাওয়ার দুঃখ-ব্যথা মনে ভর করবেনা। মাঝে মাঝে মন খারাপের বৃষ্টিতে তনুমন ভিজে জবুথবু হয়ে গেলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবেনা। ইন শা আল্লাহ। আর আমাদেরকে অবশ্যই এই বাস্তবতা মাথায় রেখে চলতে হবে যে, বিয়ের প্রস্তাব যেমন দেওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে, তেমনিভাবে সেই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করবার অধিকারও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে আমার কথা হলো নিজের ভালো লাগার কথা জানাতে হবে কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্যেই বা বিবাহের জন্যেই। এই বিধান নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে আবারো বলি, অবশ্যই পিতা-মাতাকে কষ্ট দিয়ে নয়। গোপনে গোপনে নিজেরা নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাও উত্তম কাজ নয়। এবং সাময়িক আবেগের ওপর নির্ভর করে, অজানা-অচেনা কাউকে হুট করে ভালো লেগেছে বলেই ফ্যান্টাসিতে ডুব দিবেন না। আপনাকে আমি ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই; ইত্যাদি বলে দিবেন না। এতে হিতে বিপরীত হয়। মানুষটাকে জানুন, স্পষ্ট করে বুঝুন। নিজের পরিস্থিতি এবং অবস্থা কী এবং কেমন -তা উপলব্ধি করুন। এরপর ঠান্ডা মাথায় সীদ্ধান্ত নিন।


//বিয়ের প্রস্তাব ও কিছু কথা//
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৬.০৯.২১

পঠিত : ৪৭৯ বার

মন্তব্য: ০