Alapon

বাণিজ্যিক ব্যাংক কীভাবে টাকা সৃষ্টি করে...?



প্রথমেই আমরা জেনে নেই ব্যাংক কি। ব্যাংক হচ্ছে একটি টাকা অদল বদল কারী একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে আমাদের কারো টাকা গচ্ছিত থাকে না। আমরা ব্যাংককে কেবল ঋণ দিয়ে থাকি। তাই যখন আমরা টাকা রাখি, তখন আমরা হচ্ছি ঋণ প্রদানকারী এবং ব্যাংক হচ্ছে ঋণ গ্রহীতা। একারণেই ব্যাংক আমাদের সুদ প্রদান করে থাকে। আমাদের থেকে ঋণ নেবার পর ব্যাংক এই টাকা সমাজের অপরাপর সদস্য বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে থাকে।

পরবর্তীতে ঋণের টাকা ঘুরে ফিরে বার বার ব্যাংকে আসতে থাকে এবং তার সাথে সাথে লাভের অংক বৃদ্ধি করতে থাকে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়গুলো পরিষ্কার করা যাক।
মনে করি, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গৃহবধু সাবানা অনেক কষ্ট করে তিন লক্ষ টাকা সঞ্চয় করেছেন। এত গুলো টাকা আলমারিতে রাখলে চুরি হয়ে যেতে পারে ভেবে সাবানা তার দেবর বাপ্পার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাপ্পা, ভাবী কি করব একটু বুদ্ধি দাও তো। এতগুলো টাকা এখন কোথায় রাখব?” বাপ্পা বলল, ” আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাবী। আমি কালই আপনার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে টাকাটা নিরাপদে জমা রাখছি।” কথা মতন বাপ্পা পরদিন সততা ব্যাংকে ৩ লক্ষ টাকা জমা দিল। এদিকে একই দিনে ধনাট্য ব্যবসায়ী রাজিব সাহেব সততা ব্যাংকে এসে ব্যাংক ম্যানেজার সুচিত্রাকে বললেন, “ ব্যবসা পাতির অবস্থা ভালো না। আগামীকালই মাসের শেষ দিন। শ্রমিকদেরকে দেবার মত টাকাও এই মুহূর্তে হাতে নেই। আজকের মধ্যেই আমার ২.৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন।”
সবকিছু শুনে ব্যাংক অফিসার সুচিত্রা বললেন, “আপনার দুরবস্থা শুনে আমরা যার পর নাই দুঃখিত। আজকেই আপনার একাউন্টে আমরা আড়াই লক্ষ টাকা লিখে দিচ্ছি। আগামীকাল এসে আপনি টাকা তুলে নিয়ে যাবেন।”

এভাবে ব্যাংক রাজিব সাহেবকে ২.৫ লক্ষ টাকা ঋণ দিল এবং পরদিন সকালে রাজিব সাহেব টাকা তুলে নিয়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করে দিলেন।
আপনি যদি শ্রমিকদের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “আপনাদের নিকট মোট কত টাকা আছে?” তারা সাবাই মিলে গণনা করে বলবে, “আমাদের সকলের হাতে মোট আড়াই লক্ষ টাকা আছে।”

আবার আপনি যদি সাবানাকে প্রশ্ন করেন, “আপনার নিকট মোট কত টাকা আছে?” সাবানা বলবে, “সততা ব্যাংকে আমার ৩ লক্ষ টাকা জমা আছে। চাইলেই তুলে এনে ব্যবহার করা যাবে অথবা চেকে লেনদেন করা যাবে” অর্থাৎ, সাবানার হিসেব মতে তার কাছে মোট তিন লক্ষ টাকা আছে। আবার শ্রমিকদের হিসেব মতেও তাদের হাতে আড়াই লক্ষ টাকা আছে। অর্থাৎ, উভয় পক্ষের হিসেব মতে তাদের মোট টাকার পরিমাণ হচ্ছে ৫.৫ লক্ষ। কাগুজে মুদ্রা যেহেতু ডিম পেড়ে ছানা ফুটায় না, ৩ লক্ষ টাকা কিভাবে ৫.৫ লক্ষ টাকা হয়ে গেল? এটাই হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার জাদু।

যাই হোক, হাতে টাকা পাবার পরে শ্রমিকরা যখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন তেল, চিনি, সাবান ইত্যাদি কিনবেন, সেই টাকা শ্রমিকদের হাত থেকে ব্যবসায়িদের হাতে চলে যাবে। টাকা হাতে আসার পরে ব্যবসায়িরা নিশ্চয়ই খাদ খুঁড়ে মাটির নিচে টাকা পুতে রাখবে না। তারাও ব্যাংকে টাকা জমা রাখবে। এভাবে ২.৫ লক্ষ টাকা পুনরায় ব্যাবসায়ীদের মাধ্যমে ব্যাংকে এসে পৌঁছুবে। ব্যাংকের হাতে টাকা আসার পর ব্যাংক নিশ্চয়ই টাকার খাট তৈরি করে তার উপর শুয়ে ঘুম যাবে না। ব্যাংক এই টাকা পুনরায় সুদের উপর ঋণ দিয়ে দিবে। ধরা যাক, ব্যাংক ২ লক্ষ টাকা ঋণ হিসেবে ইলিয়াস সাহেবকে দিয়ে দিল।

ঠিকাদার ইলিয়াস সাহেব দুই লক্ষ টাকার ইট কিনে বাড়ি নির্মাণ কাজে খাটালেন। এভাবে ইলিয়াস সাহেবের হাত থেকে টাকা চলে গেল ইটের ভাটার মালিক জসিমের হাতে। জসিম তার ছোট বোন পুর্ণিমার জন্য এই টাকা পূর্ণিমার ব্যাংক একাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন।
এবার আপনি আবার হিসেব করতে বসুন- সাবানা বলছে তার জমানো টাকার পরিমাণ ৩ লক্ষ টাকা, ব্যবসায়ীরা বলছেন ব্যাংকে তাদের জমা আছে মোট ২.৫ লক্ষ টাকা, পুর্ণিমা বলছে তার নামে ব্যাংকে ২ লক্ষ টাকা জমা আছে। এভাবে ব্যাংকের জাদুতে ৩ লক্ষ টাকা হয়ে গেল মোট ৭.৫ লক্ষ টাকা। ওদিকে মোট ঋণের পরিমাণ হয়ে গেল ৪.৫ লক্ষ টাকা।
এরপরে পুর্ণিমার তার প্রয়োজনে টাকা খরচ করবে এবং সেই টাকা আবারও ব্যাংকে প্রবেশ করবে। আবারও টাকা ব্যাংক থেকে বের হবে এবং হাত বদল করে আবারও টাকা ব্যাংকে ফেরত আসবে। এভাবে সাবানার টাকা চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাংক ব্যালেন্স এবং ঋণ চক্রাকারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। দেখা যাবে দিন শেষে মোট ব্যাংক ব্যালেন্স হয়ে দাঁড়াচ্ছে ১০ লক্ষ টাকা এবং মোট ঋণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ লক্ষ টাকা। ব্যাংকের জাদুতে সাবানার ৩ লক্ষ টাকার ডেপসিট থেকে কত কিছু হয়ে গেল! এখন প্রশ্ন হচ্ছে সকলের হিসেব মতে যে ব্যাংকে তাদের ১০ লক্ষ টাকা ডেপসিট আছে তা কি প্রকৃতপক্ষেই টাকা?

অর্থনীতিবিদদের মতে ব্যাংক ব্যালেন্স এবং কাগুজে মুদ্রা উভয়ই টাকা। কারণ ঋণ গ্রহীতারা যদি দেউলিয়া না হয়ে থাকে, ব্যাংক সকলের টাকা সুন্দর করে পরিশোধ করে দিতে পারবে। তাছাড়া ব্যাংক ব্যালেন্সের বিপরীতে চেক লিখে আপনি কেনাকাটা করতে পারেন। অর্থাৎ ব্যাংক ব্যালেন্স হচ্ছে টাকার বিকল্প। অর্থনীতির পরিভাষায় কাগুজে মুদ্রাকে অর্থাৎ ৩ লক্ষ টাকাকে এম ০ বা চিকন টাকা (Narrow money) এবং ব্যাংক ব্যালান্সসহ কাগুজে মুদ্রাকে অর্থাৎ, ১০+৩ বা ১৩ লক্ষকে এম ১ বা মোটা টাকা (Broad money) বলা হয়ে থাকে।

আমাদের গল্পে আমারা ৩ লক্ষ টাকাকে ১৩ লক্ষ টাকায় রুপান্তর করেছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তিন লক্ষ টাকার কাগুজে মুদ্রা ত্রিশ লক্ষের অধিক টাকার ঋণ এবং ব্যাংক ব্যালান্স তৈরি করে। এভাবে অর্থনীতির মোট টাকার ৯০ শতাংশের অধিক টাকাই সৃষ্টি হয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। অর্থাৎ, বর্তমান ব্যবস্থায় টাকা, ঋণ এবং সুদ মিলে মিশে এক হয়ে গেছে।

লেখক: মোহাইমিন পাটোয়ারী

পঠিত : ৩০৫ বার

মন্তব্য: ০