Alapon

মুসলিম ব্রাদারহুড ও পাকিস্তান জামাত কেন আহমেদ শাহ মাসুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো ?



সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে মূলত দুইটা বড় পক্ষ যুদ্ধ করছিলো। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উত্তর অংশ যা ছিলো স্ট্র্যাটেজিক্যালি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক্স ও সাপ্লাই চেইনের জন্য সে অংশটি নিয়ন্ত্রণ করতো আহমেদ শাহ মাসুদ। উত্তর আফগানিস্তান যদি একটা রাজ্য হয় তবে আহমেদ শাহ মাসুদ ছিলো সেই রাজ্যের রাজা, একচ্ছত্র অধিপতি। মাসুদ কারো সহায়তা ছাড়াই কম্যুনিস্ট আফগান সরকারের বিরুদ্ধে মাত্র ৩০ জন অনুসারী,১৭টা রাইফেল আর ১৩০ ডলার সম্বল নিয়ে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে্ন। সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর পরেও মাসুদ এক্সটার্ন্যাল কোন সাহায্য ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
.

মাসুদের বাবা মিলিটারী কমান্ডার হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই মাসুদ খুবই নিয়ম শৃংখলার মধ্য দিয়ে বড় হয়। ফলে ছোটবেলা থেকেই মাসুদ ছিলো পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী ও ডিসিপ্লিন্ড। মাসুদের সেনাবাহিনীতেও অত্যন্ত কঠোর শৃংখলা মেনে চলা হতো। মাসুদ তার সেনাদেরকে প্রচন্ড আনুগত্যপরায়ণ, নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তুলতেন। ফলে যে কেউ চাইলেই যখন তখন গিয়ে মাসুদের বাহিনীতে যোগ দিতে পারতো না। যেহেতু আরব মুজাহিদরা একটু বিশৃংখল প্রকৃতির ছিলো ও তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিলো না ফলে মাসুদের বাহিনীতে আরব মুজাহিদদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। মাসুদের বাহিনীর সাফল্য ছিলো ঈর্ষণীয়। সোভিয়েতদের প্রশিক্ষিত এক রেজিমেন্ট সৈন্যের মোকাবেলায় মাসুদের ৩০/৪০ জন সেনাই যথেষ্ট ছিলো। একই সাথে তার সেনারা একদিকে ছিলো নৈতিকভাবে প্রাণবন্ত ও ধার্মিক অন্যদিকে পাথুরে অঞ্চলে যুদ্ধ করায় গেরিলা ওয়ারফেয়ারে তারা আলাদা সুবিধা পেতো। ফলে উত্তর আফগানিস্তানে মাসুদের সেনারা ছিলো অসম সাহসী, অদম্য আর দুর্দমনীয়।
.

অন্যদিকে আফগানিস্তানের দক্ষিণ অংশে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো রসুল সাইয়্যাফ,বুরহানুদ্দীন রাব্বানী, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার আর আরব মুজাহিদরা। পেশোয়ার আর পাকিস্তানে আফগানিস্তানের শরণার্থী শিবির ও আরব মুজাহিদদের শিবিরগুলো পরিচালিত হতো রসুল সাইয়্যাফ ও হেকমতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে। তাদের কাজ ছিলো আফগান শরণার্থী ও আরব মুজাহিদদেরকে আফগান যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া ও ফ্রন্ট লাইনে পৌছে দেয়া। এই পুরো কাজে তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করতো পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
.

মাসুদ যেহেতু আইএসআইয়ের কমান্ড না মেনে প্রথম থেকেই স্বাধীনভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতো তাই মাসুদের প্রতি আইএসআইয়ের ক্ষোভ ছিলো। অন্যদিকে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই হেকমতিয়ারের সাথে মাসুদের সংঘাত ছিলো ফলে মাসুদের প্রতি ক্ষোভ ছিলো তারও।
.

স্বাধীনচেতা মাসুদ যুদ্ধের শুরুতেই একদিকে হেকমতিয়ার অন্যদিকে আইএসআইকে তার শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলো। ফলে তার বিরুদ্ধে একাট্টা হয় তার শত্রুরা। যেহেতু আফগান শরণার্থী শিবির ও আরব মুজাহিদদের শিবিরগুলো হেকমতিয়ার ও আইএসআইয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ফলে তারা মাসুদের বিরুদ্ধে এইসব শিবিরে ব্যাপক মিথ্যা প্রপাগান্ডা শুরু করে। আরব মুজাহিদদেরকে বুঝানো হয় যে মাসুদ শিয়া, কম্যুনিস্ট। সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে মাসুদের যুদ্ধ মূলত আদর্শিক না বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক।
.

যেহেতু আরব মুজাহিদদের বড় একটি অংশ একসময় মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ব্রাদারহুড থেকে এসেছিলো ফলে তারা হেকমতিয়ার-আইএসআইয়ের প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে মাসুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মুজাহিদ রিক্রুটের করা হতো। রিক্রুটের জন্য আফগান যুদ্ধের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আরব মুজাহিদরা কলাম লেখতো ও সিআইএয়ের সহায়তায় আরব বিশ্বে তাদের লেখা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতো। এইসব লেখায় তারা মাসুদের বিরুদ্ধে না জেনেই মিথ্যাচার করতো। ফলে আরব মুজাহিদদের এইসব লেখা পড়ে মুসলিম ব্রাদারহুড মাসুদকে ভুল বুঝে ও তার সম্পর্কে ভুল অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে পাকিস্তান জামাতও আইএসআইয়ের প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে মাসুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
.

এভাবেই মাসুদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে শুধুমাত্র জিঘাংসা চরিতার্থ করতে হেকমতিয়ার আর আইএসআই মিলে বিংশ শতাব্দীর মহান মুজাহিদ আহমেদ শাহ মাসুদের চরিত্র হনন করে ও মুসলিম ব্রাদারহুড ও পাকিস্তান জামাতকে তার বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দেয়।
.

(ছবিতে পাকিস্তান জামাতের সাবেক আমীর কাজী হোসাইন আহমেদের সাথে আফগান জামাতের নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ)
.

পঠিত : ২৬৩ বার

মন্তব্য: ০