Alapon

আনুগত্য না করা সাহাবীদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি



তাবুক যুদ্ধের আগে কিছু মু'মিন সাহাবা তাবুক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝামেলা করেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ নিজস্ব চিন্তা থেকে বিরোধীতা করেছে। কেউ কেউ মুনাফিকদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ কুরআনের আয়াত নাজিল হওয়ার পর বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ অলসতার জন্য যুদ্ধে যোগ দিতে পারেন নি। এসব সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা. কিছু নির্দেশনা দেন।

হিজরতের আগে আকাবার বাইআতের সময় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আবু লুবাবাহ রা. ছিলেন তাদের একজন। বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে তিনি সবসময় অংশ গ্রহণ করেন। কিন্তু তাবুক যুদ্ধের সময় মানসিক দুর্বলতার তার ওপর প্রধান্য বিস্তার করে এবং কোন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়াই তিনি ঘরে বসে থাকেন। এরকম আরো ছয়জন সাহাবী ছিলেন তারই মতো আন্তরিকতাসম্পন্ন। কিন্তু তারাও একই প্রকার দুর্বলতার শিকার হন।

মুহাম্মদ সা. যখন তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন এবং যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের মতামত কি তা তারা জানতে পারলেন তখন তারা ভীষণভাবে অনুতপ্ত হলেন। কোনো প্রকার জিজ্ঞাসাবাদের আগেই তারা নিজেদেরকে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে নেন এবং বলেন, আমাদের মাফ না করে দেয়া পর্যন্ত আমাদের জন্য আহার নিদ্রা হারাম। এ অবস্থায় আমাদের প্রাণ বায়ু বের হয়ে গেলেও আমরা তার পরোয়া করবো না। কয়েক দিন পর্যন্ত এভাবেই তারা বাঁধা অবস্থায় অনাহার অনিদ্রায় কাটান। এমনকি একদিন তারা বেহুশ হয়ে পড়ে যান। শেষে তাদের জানানো হলো, আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূল তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন।

তারা নবী সা. কে বলেন, ঘরের যে আরাম আয়েশ আমাদের ফরজ থেকে গাফেল করে দিয়েছিল তা এবং নিজেদের সমস্ত ধন-সম্পদ আমরা আল্লাহর পথে দান করে দেবো, এটাও আমাদের তাওবার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নবী সা. বলেন, সমস্ত ধন-সম্পদ দান করে দেবার দরকার নেই, শুধুমাত্র এক তৃতীয়াংশই যথেষ্ট। তদনুসারে তখনই তারা সেগুলো আল্লাহর পথে ওয়াকফ করে দেন। এ ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার জানা যায়, কোন ধরনের দুর্বলতা আল্লাহ‌ মাফ করেন। উল্লিখিত মহান সাহাবীগণ এ ধরনের আন্তরিকতাহীন আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। বরং তাদের বিগত জীবনের কার্যকলাপ তাদের ঈমানী নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ ছিল। এবারেও রসূল সা.-এর নিকট তাদের কেউ মিথ্যা অজুহাত পেশ করেননি। বরং নিজেদের ভুলকে নিজেরাই অকপটে ভুল হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তাঁরা ভুলের স্বীকারোক্তি সহকারে নিজেদের কার্য ধারার মাধ্যমে একথা প্রমাণ করে দিয়েছের যে, তারা যথার্থই লজ্জিত হয়েছেন এবং নিজেদের গোনাহ মাফ করাবার জন্য অত্যন্ত অস্থির ও উদ্ধিগ্ন।

আল্লাহ তায়ালা এ জাতীয় সাহাবাদের ব্যাপারে সহনশীল ও ক্ষমার নীতি ঘোষণা করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে। আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ১০৫ নং আয়াতে বলেন, //আর হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, তোমরা কাজ করতে থাকো। আল্লাহ‌ তাঁর রসূল ও মুমিনরা তোমাদের কাজের ধারা এখন কেমন থাকে তা দেখবেন। তারপর তোমাদের তাঁর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে যিনি প্রকাশ্যে ও গোপনে সবকিছু জানেন এবং তোমরা কি করতে তা তিনি তোমাদের বলে দেবেন।//

যারা মুহাম্মদ সা.-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাদের সবার মানসিক অবস্থা যে এক ছিল না, এই আয়াতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তা নিশ্চিত করেছেন। এখানে মিথ্যা ঈমানের দাবীদার মুনাফিক ও দুর্বল মু’মিনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে। যে ব্যক্তি ঈমানের দাবী করে, কিন্তু আসলে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ব্যাপারে আন্তরিক নয়, তার এ আন্তরিকতাহীনতার প্রমাণ যদি তার কার্যকলাপের মাধ্যমে পাওয়া যায়, তাহলে তার সাথে কঠোর ব্যবহার করা হবে।

আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য সে কোন সম্পদ পেশ করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। সে মারা গেলে কোনো মুসলমান তার জানাযার নামায পড়বে না এবং তার গোনাহ মাফের জন্য দোয়াও করবে না। অন্যদিকে যে ব্যক্তি সত্যিকার মু’মিন কিন্তু এ সত্ত্বেও সে এমন কিছু কাজ করে বসেছে যা তার অবাধ্যতার মতো, এক্ষেত্রে সে যদি নিজের ভুল স্বীকার করে নেয় তাহলে তাকে মাফ করে দেওয়া হবে। তার সদকা, দান-খয়রাত গ্রহণ করা হবে এবং তার ওপর রহমত নাযিলের জন্য দোয়াও করা হবে।

আল্লাহর নির্দেশনা হলো, দুর্বল ঈমানের মুসলিমদের ক্ষেত্রে আগের কার্যকলাপ যাচাই করা হবে। সে অবাধ্য ও অপরাধী কিনা তা যাচাই করা হবে। যদি আগে সে সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে এবং তার জীবনের সমস্ত কার্যকলাপে আন্তরিক সেবা, ত্যাগ, কুরবানী ও ভালো কাজের রেকর্ড থেকে থাকে, তাহলে ধরে নেয়া হবে যে, বর্তমানে যে ভুল সে করেছে নিছক সাময়িক সৃষ্ট একটি দুর্বলতা বা পদস্খলন ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা মুনাফেকি বা বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবে না।

শুধু তাই নয়, তার ভবিষ্যত কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা হবে। দেখতে হবে, তার ভুলের স্বীকৃতি কি নিছক মৌখিক, না আন্তরিকভাবেই সে তা উপলব্ধি করেছে। যদি নিজের ভুল সংশোধনের জন্য তাকে অস্থির ও উৎকণ্ঠিত দেখা যায় এবং তার প্রতিটি কথা থেকে এ কথা প্রকাশ হয় যে, তার জীবনে যে ঈমানী ত্রুটির চিত্র ভেসে উঠেছিল তাকে মুছে ফেলার ও তা সংশোধন করার জন্য সে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাহলে সে যথার্থই লজ্জিত হয়েছে বলে মনে করা হবে। এ লজ্জা ও অনুশোচনাই হবে তার ঈমান ও আন্তরিকতার প্রমাণ।

এখানে তাওবা কবুলের জন্য আরেকটি নির্দেশনা পাওয়া গেল তা হলো, গুনাহ মাফের জন্য মুখ ও অন্তর দিয়ে তাওবা করার সাথে সাথে বাস্তব কাজের মাধ্যমেও তাওবা করতে হবে। আর আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ দান করা হচ্ছে বাস্তব তাওবার একটি পদ্ধতি। এভাবে নফসের মধ্যে যে দূষিত ময়লা আবর্জনা লালিত হচ্ছিল এবং যার কারণে মানুষ গুনাহে লিপ্ত হয়েছিল তা দূর হয়ে যায় এবং ভালো ও কল্যাণের দিকে ফিরে যাবার যোগ্যতা বেড়ে যায়।

আল্লাহ তায়ালা তিনজন সাহাবীর ব্যাপারে আলাদা সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তারা ছিলে খুবই বিশ্বস্ত ও মর্যাদাপূর্ণ সাহাবী। উপরোক্ত সাহাবীদের চাইতেও তাঁরা ছিলেন অগ্রগামী। কিন্তু অলসতা ও মানসিক দুর্বলতার শিকার হয়ে তাবুক যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। নবী সা. যখন তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে এলেন তখন যারা পিছনে অর্থাৎ মদীনায় থেকে গিয়েছিল। তারা ওজর পেশ করার জন্য হাজির হলো। তাদের মধ্যে ৮০ জনেরও বেশি ছিল মুনাফিক। মুনাফিকরা মিথ্যা ওযর পেশ করেছিল এবং রসূলুল্লাহ সা. তা মেনে নিচ্ছিলেন। তারপর এলো এ তিন জন মু’মিনের পালা। তারা পরিষ্কারভাবে নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। নবী সা. তাদের তিনজনের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশে ফয়সালা মুলতবী রাখলেন।

মুহাম্মদ সা. সকল মুসলমানদের হুকুম দিলেন, আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এই তিনজনের সাথে সাথে কোনো প্রকার সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। এ তিন জন সাহাবী ছিলেন কাব ইবনে মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়াহ এবং মুরারাহ ইবনে রুবাই। এরা তিনজন ছিলেন সাচ্চা মু’মিন। এর আগে তারা বহুবার নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। শেষের দুজন তো বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাজেই তাদের ঈমানী সত্যতা সব রকমের সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল। আর প্রথম জন যদিও বদরী সাহাবী ছিলেন না কিন্তু বদর ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধে মুহাম্মদ সা. এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ইসলামের জন্য তার এমন ত্যাগ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম-সাধনা সত্ত্বেও তারা সংকটকালীন সময়ে তাবুক যুদ্ধে অংশ নেন নি, যদিও তাদের সামর্থ ছিল। আল্লাহ তায়ালা এই অগ্রগামী সাহাবীদের অলসতা পছন্দ করেননি। তিনি এর জন্য তাদেরকে কঠোরভাবে পাকড়াও করেছিলেন। নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে মুসলমানদের প্রতি কড়া নির্দেশ জারি করেন কেউ এদের সাথে সালাম কালাম করতে পারবে না। ৪০ দিন পরে তাদের স্ত্রীদেরকেও তাদের থেকে আলাদা বসবাস করার কঠোর আদেশ দেওয়া হলো।

এটা ছিল সেইসব সাহাবীসহ মুমিনদের জন্য কঠিন পরীক্ষা। আমরা এই পরীক্ষা সম্পর্কে কা'ব বিন মালিক রা.-এর নিজ মুখেই শুনি। তিনি বলেন,
"তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে নবী সা. যখনই মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার আবেদন জানালেন তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেবো। কিন্তু ঘরে ফিরে এসে আমাকে অলসতায় পেয়ে বসলো এবং আমি চিন্তা করলাম, এখনই এতো তাড়াহুড়া কিসের, রওয়ানা দেবার সময় যখন আসবে তখন তৈরি হবো। তৈরি হতে কতটুকু সময়ইবা লাগবে। এভাবে আমার প্রস্তুতি পিছিয়ে যেতে থাকলো। তারপর একদিন সেনাবাহিনীর রওয়ানা দেবার সময় এসে গেল। অথচ তখনো আমি তৈরি ছিলাম না। আমি মনে মনে বললাম, সেনাবাহিনী চলে যাক, আমি এক দু-দিন পরে পথে তাদের সাথে যোগ দেবো। কিন্তু তখনো একই অলসতা আমার পথের বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে সময় পার হয়ে গেলো।

এ সময় যখন আমি মদীনায় থেকে গিয়েছিলাম আমার মন ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছিল। কারণ আমি দেখছিলাম যাদের সাথে এ শহরে আমি রয়েছি তার হয় মুনাফিক, নয়তো দুর্বল বৃদ্ধ ও অক্ষম লোক, যাদেরকে আল্লাহ‌ অব্যাহতি দিয়েছেন।

নবী সা. তাবুক থেকে ফিরে এসে যথারীতি মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লেন। তারপর তিনি লোকদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য বসলেন। মুনাফিকরা এ মজলিসে এসে লম্বা লম্বা কসম খেয়ে তাদের ওরর পেশ করতে লাগলো। মুহাম্মদ সা. তাদের প্রত্যেকের বনোয়াট ও সাজানো কথা শুনলেন। তাদের লোক দেখানো ওজর মেনে নিলেন এবং তাদের অন্তরের ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ‌ তোমাদের মাফ করুন। তারপর আমার পালা এলো। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আসো! তোমাকে কীসে আটকে রেখেছিল?

আমি বললাম, আল্লাহর কসম! যদি আমি কোন দুনিয়াদারের সামনে হাজির হতাম তাহলে অবশ্যই কোন না কোন কথা বানিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতাম। কথা বানিয়ে বলার কৌশল আমিও জানি। কিন্তু আপনার ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এখন কোনো মিথ্যা ওজর পেশ করে আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করেও নেই তাহলে আল্লাহ‌ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি আবার নারাজ করে দেবেন। তবে যদি আমি সত্য বলি তাহলে আপনি নারাজ হয়ে গেলেও আমি আশা রাখি আল্লাহ‌ আমার জন্য ক্ষমার কোন পথ তৈরি করে দেবেন। আসলে পেশ করার মতো, কোন ওজরই আমার নেই। যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সক্ষম ছিলাম।

একথা শুনে রসূলুল্লাহ সা. বললেন, এ ব্যক্তি সত্য কথা বলেছে। ঠিক আছে, চলে যাও এবং আল্লাহ‌ তোমার ব্যাপারে কোন ফয়সালা না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো। আমি উঠে নিজের গোত্রের লোকদের মধ্যে গিয়ে বসলাম। এখানে সবাই আমাকে তিরস্কার করতে লাগলো। তারা আমাকে এ বলে তিরস্কার করতে লাগলো যে, তুমি কেন মিথ্যা ওজর পেশ করলে না? তাদের এসব কথা শুনে আবার মুহাম্মদ সা.-এর কাছে গিয়ে কিছু বানোয়াট ওজর পেশ করার জন্য আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু যখন শুনলাম আরো দুজন সৎ লোক (মুরারাহ ইবনে রুবাই ও হেলাল ইবনে উমাইয়াহ) আমার মতো একই সত্য কথা বলেছেন তখন আমি মানসিক প্রশান্তি অনুভব করলাম এবং আমার সত্য কথার ওপর অটল থাকলাম।

এরপর নবী সা. সাধারণ নির্দেশ জারি করলেন, আমাদের তিন জনের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। অন্য দুজন তো ঘরের মধ্যে বসে রইলো কিন্তু আমি বাইরে বের হতাম, জামায়াতে নামায পড়তাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। মনে হয়তো, এ দেশটি একদম বদলে গেছে। আমি যেন এখানে একজন অপরিচিত আগন্তুক। এ জনপদের কেউ আমাকে জানে না, চেনা না। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে যথারীতি নবী সা.-কে সালাম করতাম। আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়ে উঠছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু শুধু অপেক্ষা করাই সার হতো।

তাঁর নজর আমার ওপর কীভাবে পড়ছে তা দেখার জন্য আমি আড়চোখে তাঁর প্রতি তাকাতাম। কিন্তু অবস্থা ছিল এই যে, যতক্ষণ আমি নামায পড়তাম ততক্ষণ তিনি আমাকে দেখতে থাকতেন এবং যেই আমি নামায শেষ করতাম অমনি আমার ওপর থেকে তিনি চোখ ফিরিয়ে নিতেন। একদিন ঘাবড়ে গিয়ে আমার চাচাত ভাই ও ছেলে বেলার বন্ধু আবু কাতাদার কাছে গেলাম। তার বাগানের দেয়ালের ওপর উঠে তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর সেই বান্দাটি আমার সালামের জবাবও দিলো না। আমি বললাম, হে আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি আমি কি আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলকে ভালবাসি না? সে নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সে নীরব রইলো। তৃতীয়বার যখন আমি কসম দিয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম তখন সে শুধুমাত্র এতটুকু বললো, আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলই ভাল জানেন।

একথায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি দেয়াল থেকে নেমে এলাম। এ সময় আমি একদিন বাজার নিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সিরিয়ার নাবতী বংশীয় এক লোকের সাথে দেখা হলো। সে রেশমে মোড়া গাসসান রাজার একটি পত্র আমার হাতে দিল। আমি পত্রটি খুলে পড়লাম। তাতে লেখা ছিল, আমরা শুনেছি, তোমার নেতা তোমার ওপর জুলুম করছে। তুমি কোনো নগণ্য ব্যক্তি নও। তোমাকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে মর্যাদা দান করবো। আমি বললাম, এ দেখি আরেক আপদ! তখনই চিঠিটাকে চুলোর আগুনে ফেলে দিলাম।

চল্লিশটা দিন এভাবে কেটে যাবার পর মুহাম্মদ সা.-এর কাছ থেকে তাঁর দূত নির্দেশ নিয়ে এলেন। নিজের স্ত্রী থেকেও আলাদা হয়ে যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে কি তালাক দিয়ে দিবো? জবাব এলো, না, তালাক নয়। শুধু আলাদা থাকো। কাজেই আমি স্ত্রীকে বলে দিলাম, তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও এবং আল্লাহ‌ এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো।

এভাবে উনপঞ্চাশ দিন পার হয়ে পঞ্চাশ দিন পড়লো। সেদিন সকালে নামাযের পরে আমি নিজের ঘরের ছাদের ওপর বসে ছিলাম। প্রতিদিনের মতো নিজের জীবনের প্রতি আমার ধিক্কার দিচ্ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি চেঁচিয়ে বললো, কাব ইবনে মালিককে অভিনন্দন। একথা শুনেই আমি সিজদায় নত হয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার ক্ষমার ঘোষণা জারি হয়েছে। এরপর লোকেরা দলে দলে ছুটে আসতে লাগলো। তারা প্রত্যেকে পাল্লা দিয়ে আমাকে মুবারকবাদ দিচ্ছিল। তারা বলছিল তোমার তওবা কবুল হয়েছে।

আমি উঠে সোজা মসজিদে নববীর দিকে গেলাম। দেখলাম, নবী সা. এর চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমাকে মোবারকবাদ! আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে। এরপর তিনি সূরা তাওবার ১১৮ নং আয়াত পাঠ করে শোনালেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

//আর যে তিনজনের ব্যাপার স্থগিত করা হয়েছিল তাদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেলো, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই তখন আল্লাহ‌ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। অবশ্যই আল্লাহ‌ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।//

আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিতে চাই। এটাও আমার তাওবার অংশ বিশেষ। মুহাম্মদ সা. বললেন, কিছু রেখে দাও, এটাই তোমার জন্য ভালো। এ বক্তব্য অনুযায়ী আমি নিজের খায়বারের সম্পত্তির অংশটুকু রেখে দিলাম। বাদবাকি সব সাদকা করে দিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলাম, যে সত্য কথা বলার কারণে আল্লাহ‌ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন তার ওপর আমি সারা জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকবো। কাজেই আজ পর্যন্ত আমি জেনে বুঝে যথার্থ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা বিরোধী কোন কথা বলিনি এবং আশা করি আল্লাহ‌ আগামীতেও তা থেকে আমাকে বাঁচাবেন।"

এ ঘটনার মধ্যে দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে লিপ্ত মুজাহিদদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে।

প্রথমত সারাজীবন দ্বীনের পথে অবিচল থাকার পরও একবারের জন্য জিহাদ থেকে দূরে থাকা বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

দ্বিতীয়ত দুনিয়াতে হক ও বাতিলের চলমান লড়াইতে বাতিলকে তো সহায়তা করাই যাবে না। আর হককে যদি সহায়তা না করা হয় তবেও তা বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এখানে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত দ্বীন কায়েমের দায়িত্ব মামুলি কোনো ব্যাপার নয়। সারাজীবন যথাযথ দায়িত্ব পালনের পরও একবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অলসতার পরিচয় দেওয়া বড় অপরাধ। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটি করা হয়নি এই কথা বলে কেউ পার পাবে না।

চতুর্থত মু'মিন কখনো মুনাফিকের মতো আচরণ করবে না। তাদের এই আচরণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-কে কষ্ট দিয়েছে। যেহেতু তারা সত্যিকারের মুমিন ছিলেন তাই তাদের দুনিয়ায় শাস্তি দিয়ে আখিরাতের রাস্তা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুনাফিকদেরকে দুনিয়ায় ছাড় দিয়ে আখিরাতের পাকড়াওয়ের মুখোমুখি করা হয়েছে।

পঞ্চমত যখন মুমিন কোনো অপরাধ করে ফেলবে তখন তা থেকে বাঁচার জন্য সে মিথ্যে অজুহাত দিবে না। বরং অপরাধ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে তাওবা করবে। তবেই একমাত্র ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যায়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের কায়েমের সংগ্রামে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।

পঠিত : ৮৫৮ বার

মন্তব্য: ০