এক অদ্ভুত বিয়ে
তারিখঃ ৫ অক্টোবর, ২০২১, ২০:১৬
বিশ বছর বয়সে আমিনা বিয়ে করেন কামাল আল সানানি নামক এক মুজাহিদকে। কামাল ছিলেন মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রথম সারির নেতা। তার জ্ঞানগরিমা, শিক্ষাদীক্ষা ও আল্লাহর ওপর আস্থা ছিল ঈর্ষণীয়।
.
ইখওয়ানের বলিষ্ঠ নেতা হওয়ার অপরাধে জামাল আবদুন নাসেরের সামরিক সরকার ১৯৫৪ সনে তাকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়। পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে বা অন্য কোনো চাপে নতিস্বীকার করে এই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিলেও তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
.
পাঁচ বছর কারাগারের অত্যাচার তার দেহ ক্ষতবিক্ষত করে দেয়, ফলে এক মানবিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাকে কারা-হসপিটাল লিমান তুররা থেকে চিকিৎসা গ্রহণের দুর্লভ সুযোগ করে দেয়। চিকিৎসা গ্রহণের সময় ঘটনাক্রমে সাইয়িদ কুতুবের সাথে একই কেবিনে থাকার সুযোগ পান তিনি।
.
এই সময় একদিন আমিনা কুতুবকে কামাল দেখতে পান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। তার কথাবার্তায় ও স্বভাব-চরিত্রে বিমোহিত হন কামাল। অনেক ভেবেচিন্তে, ইসতিখারা করে, কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সাইয়িদের কাছে আমিনার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি।
.
কামালের যোগ্যতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না বড়ো ভাই সাইয়িদের। তারপরও এই প্রস্তাব তিনি আদরের ছোটো বোনের কাছে উপস্থাপন করেন এবং এ নিয়ে ইসতিখারা করার পরামর্শ দেন।
.
টানা কয়েকদিন ইসতিখারা করার পর আমিনা দু ভাই ও বোনকে জানিয়ে দেন এই অদ্ভুত বিয়েতে তার অনাপত্তির কথা। সবাই জানত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে পঁচিশ বছর কারাবাস। কিন্তু ইসতিখারায় যেহেতু ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়েছেন তিনি, তাই এই কারাগারের প্রকোষ্ঠে থাকা মুজাহিদ কামালকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করলেন না। বিয়ের পর অপেক্ষা করতে থাকলেন বিশটি বছর পার হবে কবে, দেখা হবে প্রিয়তম স্বামীর সাথে!
.
বিরহের এই সময় যদিও ছিল আমিনার জীবনে খুবই দুঃসহ দিন, কিন্তু দাওয়াতি জিন্দেগির সাথে দ্বিগুণ তৎপরতার মাধ্যমে সে ব্যথা উপশম করার প্রয়াস পেতেন তিনি। বেদনার দগ্ধ ক্ষতে হাত বোলাতে ধীরে ধীরে আসতে শুরু হলো সুরের উর্বশীরা; সেই সুরের মূর্ছনা ফুটে উঠল তার লেখা কবিতা ও গীতিকাব্যের সলিলপ্রবাহে।
কলম ধরলেন আমিনা। লিখতে থাকলেন অনিরুদ্ধ কবিতা আর নান্দনিক ছোটো গল্প। স্বামী ও বড়ো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেতেন তিনি প্রতি সপ্তাহে আর ফিরে আসতেন বুকভাঙা ব্যথা নিয়ে। তার ওইসব ব্যথা পঙক্তি হয়ে বেরিয়ে জমা হতে থাকত কায়রোর বিখ্যাত ‘আদাব’, ‘আদিব’, ‘আলাম আল আরাবি’ ইত্যাদি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে।
.
আমিনা কুতুবের পরিচয়
মিসরের ইসলামি পুনর্জাগরণের অন্যতম পুরোধা ছিল কুতুব পরিবার। এই পরিবারের বড়ো ভাই সাইয়িদ ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পথিকৃৎদের একজন। জামাল নাসেরের হাতে তিনি নির্মমভাবে শহিদ হয়েছেন। আরেক ভাই মুহাম্মাদ কুতুব। তারা তিন বোন : নাফিসা, হামিদা ও আমিনা কুতুব।
.
আমিনা কুতুব মিসরের আসিয়ুতের মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কুতুব ইবরাহিমের ছোটো মেয়ে। কুতুব ইবরাহিম যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আমিনার বয়স এতই কম ছিল যে, বাবার চেহারাটাও তার মনে পড়ত না। বাবার ইন্তেকালের পর কুতুব পরিবার কায়রোতে চলে আসে। এখানে মায়ের আদরে আর বড়ো দু ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড়ো হতে থাকেন আমিনা কুতুব।
.
অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া আমিনা কুতুবের তেমন একটা হয়নি। কারণ, স্কুলের চৌহদ্দিকে তিনি কারাগারের মতো মনে করতেন। ফলে বাসায় বসেই তার পড়ালেখা চলত। এ পরিবারের ঘরটাই ছিল স্কুলের মতোই। আশপাশের ছেলেমেয়েরা এই বাড়িতে আসত ইসলাম সম্পর্কে পড়ার জন্য। তাদের সাথে আমিনা কুতুব এক সুন্দর ইসলামি স্কুলে পড়াশোনা করতে লাগলেন।
.
মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ইসলামি জ্ঞান, দু ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া সাহিত্য ও কাব্যচেতনা এবং আজন্ম অধ্যাবসায় তাকে মিসরের পরিচিত কবি ও গল্পকারের আসনে ঠাঁই করে দেয়।
.
আরবি ভাষায় তার ছিল দারুণ দক্ষতা। কবিতা লিখতেন সাবলীল গতিতে। তবে তার ঈমান ছিল খুবই মজবুত। তাই সাহিত্যের সাথে গতিপথ রচনা করতে গিয়ে তিনি ইসলামের পথহারা হননি কখনও; বরং তিনি ছিলেন যেন ইসলামি আন্দোলনের এক জাগ্রত সিপাহি।
.
বই : সাইয়িদ কুতুব পরিবার
লেখক : ড. আব্দুস সালাম আজাদী
পৃ. ৪২-৪৪
মন্তব্য: ০