Alapon

প্রিয় একটি দোয়া


প্রিয় একটি দোয়া

আসসালামু আলাইকুম। "সাপ্তাহিক কুরআন" আলোচনায় আপনাদের স্বাগতম। যারা দেখছেন সবাইকে রমজানের অগ্রিম শুভেচ্ছা। আপনাদের সবার সাথে আমার হজ্জের একটি ঘটনা শেয়ার করছি। আরাফাতের দিন সম্ভবত আমার গোটা জীবনের সবচেয়ে বেশি আধ্যাত্মিকভাবে আলোকিত অভিজ্ঞতার দিন।

হজ্জের সময়ে আরাফাতের সমগ্র দিনকে দোয়ার একটি অনুশীলনের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আমাদের সারা দিন কেটেছে দোয়া করে। প্রসঙ্গত: আমি যেহেতু এই সাবজেক্ট নিয়ে আলোচন করছি, দুইটি বইয়ের নাম বলছি যে দুইটি বই সকল মুসলিম পরিবারে থাকা উচিত। আপনার বাসায় পড়ে থাকা উচিত, এমনকি কয়েক কপি থাকলে আরো ভালো। যেন সময় পেলেই কোনো একটি বই খুলে দোয়া পড়া শুরু করতে পারেন।

প্রথমটি হল, "ফোরট্রেস অব দ্যা মুসলিম" আর দ্বিতীয়টি হল, "এক্সেপটেড হুইস্পারস।" উভয়টিই সংগ্রহ করার জন্য আমি জোরালোভাবে সুপারিশ করছি। হজ্জ্ব করার সময় আমার কাছে উভয়টি ছিল। আর আমি সবগুলো দোয়া পড়তে থাকলাম এবং প্রতিটি দোয়া নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকলাম। আমি এক জায়গায় সারা দিন বসা ছিলাম, অন্য কোথাও যাইনি।

অবশেষে দিনের সমাপ্তি হল। এরপর আমার সাথে আমাদের হজ্জ্ব গ্রূপের লিডার ওমর সুলেইমানের দেখা হয়। তো, সে আমাকে বললো, ''আচ্ছা, তাহলে তোমার প্রিয় দোয়া কোনটি? কোন দোয়াটি তোমার মাথায় বার বার এসেছিলো এবং তুমি বার বার দোয়াটি পড়ছিলে?" আমি বললাম, "আচ্ছা ঠিকাছে, আমি তিন পর্যন্ত গুণবো, তারপর দুইজনে একসাথে আমাদের প্রিয় দোআটি বলবো।" এরপর আমরা দুইজনে একসাথে ঠিক একই দোয়া বললাম। সেই দিন আমরা শত শত দোয়া পড়েছি। কিন্তু দুইজনে একই দোয়া উচ্চারণ করলাম!!

এটি খুবই সুন্দর এবং শক্তিশালী একটি দোয়া। দোয়াটি আমার এবং তার অন্তরের খুব কাছাকাছি। সম্ভবত, আমরা যে ধরণের চাকরি করি এবং যেসব কাজে আমাদের সময় ব্যয় করি, তার জন্য।

দোয়াটি ইবনে মাজা হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত আছে। এটি একটি সহীহ হাদিস। হাদীসটি উম্মে সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। "আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান... " দোয়াটির প্রথম অংশের অর্থ হলো, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান চাই। ইলমান নাফিয়ান।

আরবি নাফি' শব্দটি একটি শক্তিশালী শব্দ। কারণ এর অর্থ শুধু নিজের জন্য উপকারী নয়, বরং অন্যদের জন্যেও উপকারী। সুতরাং, আমি এমন জ্ঞান কামনা করছি যা আমাকে ভালো মানুষে পরিণত করবে, কোনো না কোনভাবে আমার উপকার করবে, এটি আমার পারিবারিক জীবনে উপকার নিয়ে আসবে, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে উন্নত হতে সাহায্য করবে; ঠিক একইসময়ে এটি অন্যদের জন্যেও উপকার বয়ে নিয়ে আসবে।

এটা হলো দোয়ার প্রথম অংশ।

স্পষ্টতঃ একজন জ্ঞানের ছাত্র হিসেবে, যে নিয়মিত কুরআন থেকে কিছু শিখতে চাইছে, আপনি উপকারী কিছু শিখতে চান। শেখার এই যাত্রায় বিভিন্ন বই থেকে এমন অনেক কিছু শিখবেন যা উপকারী নয়। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে উপকারী জ্ঞানের সাথে আটকিয়ে রাখেন। এমন উপকারী জ্ঞান যা আমাদের এবং অন্যদের কাজে লাগবে। এটা প্রথম কথা।

বিশ্বাস করুন, যে কোনো ধরণের জ্ঞান অর্জন করতে গেলে, ইসলামী জ্ঞানও এই নিয়মের বাইরে নয়- আপনি এমন সব জ্ঞানের শাখায় বা ভিন্ন জগতে হারিয়ে যেতে পারেন যা দিনশেষে তেমন উপকারী নয়। যে জ্ঞান হয়তো গবেষণার কাজে লাগতে পারে কিন্তু সাধারণ মুসলমানরা এর দ্বারা কোনো উপকার পায় না। তাহলে, দোয়ার প্রথম অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। "হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন জ্ঞান চাই যা আমার উপকার করবে এবং অন্যদেরও উপকারে আসবে।"

এবার দ্বিতীয় অংশ। তিনি বলেন— ''ও রিজকান তৈয়্যেবান"। অর্থাৎ, এবং আমি আপনার কাছে এমন রিজিক চাই যা ভালো ও বিশুদ্ধ। তৈয়্যেব দ্বারা দুটি বিষয় বোঝায়: এক, এমন কিছু যা ভালো। মানে, যা আমাকে সন্তুষ্ট করে, যা আমি উপভোগ করি। আর দুই, একই সময়ে যা পবিত্র।

অর্থাৎ, তৈয়্যেবের মধ্যে হালাল অন্তর্ভুক্ত। এর অনুমোদন এবং শুচিতা মজ্জাগত। কারণ, আল্লাহ আমাদের জন্য কেবল এমনসব জিনিসই হালাল বানিয়েছেন যা তৈয়্যেব বা পবিত্র। নোংরা জিনিস.... ইউহাররিম আলাইহিমুল খাবায়েস। আল্লাহ আমাদের জন্য নোংরা এবং বাজে জিনিস হারাম করেছেন। সুতরাং, সংজ্ঞানুসারেই হারাম জিনিসগুলো নোংরা। সংজ্ঞানুসারেই হালাল জিনিসগুলো উত্তম এবং পবিত্র।
তাই, দোয়ার এই দ্বিতীয় অংশে আমরা আল্লাহর কাছে এমন রিজিক, এমন উপার্জনের জন্য দোয়া করছি যা উত্তম এবং পবিত্র। সুতরাং, আমার চাকরি ভাল এবং পবিত্র হতে হবে, আমার উপার্জনের রাস্তা ভাল এবং পবিত্র হতে হবে, আমার ব্যয়ের পথও ভাল এবং বিশুদ্ধ হতে হবে। যে খাবার আমি গ্রহণ করি তা ভাল এবং পরিচ্ছন্ন হতে হবে, যে পানীয় আমি পান করি তাও ভাল এবং বিশুদ্ধ হতে হবে। যেখান থেকে আমি ক্রয় করি তা ভাল এবং পরিচ্ছন্ন হতে হবে। মোটকথা, একজন দায়বদ্ধ ভোক্তা হিসেবে আমার যা যা করা দরকার সবকিছু এই একটি বাক্যের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে; আমার সবকিছুই ভাল এবং বিশুদ্ধ হতে হবে।

তাহলে দোয়ার একটি অংশ ছিল আমার আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থতার জন্য, আর অন্যটি আমার শারীরিক সুস্থতার জন্য। আমার শরীর, ঘরবাড়ি, চাকরি-বাকরি সবকিছুই রিযকান তৈয়্যেবান হওয়া উচিত। ভাল, খাঁটি এবং বিশুদ্ধ রিযক।
আর দোয়ার শেষ অংশ হল, ''ও আমালান মুতাকাব্বালান।" সবার শেষে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি চাই। আর তা হল- কবুলকৃত আমল বা গৃহীত কর্ম। এমন আমল করার তৌফিক দান করুন যে আমলগুলো আপনি কবুল করে নিয়েছেন। অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমাকে এমন কিছু করতে দিবেন না যা যথেষ্ট ভাল নয় অথবা যা ভুল নিয়তে করা হয়। আমাকে সবসময় সঠিক পথে রাখুন, সঠিক নিয়তের উপর রাখুন।
স্পষ্টত, আমরা সবাই জানি, ইসলামে কাজের ফলাফল নির্ভর করে নিয়তের উপর। এখানে কবুলকৃত আমল বলার মাধ্যমে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে যে, নিয়ত সঠিক হতে হবে। আপনার নিয়ত ঠিক না থাকলে কাজটি গ্রহণ করা হবে না। তাই, এই দোয়াতে আপনাকে এমনকি সরাসরি সঠিক নিয়তের জন্য দোয়াও করতে হয়নি, "আমালান মুতাকাব্বালান" বাক্যাংশের আলঙ্কারিক সৌন্দর্যের কারণে। "আমালান মুতাকাব্বালান বা গৃহীত কর্ম" বলার মাধ্যমে নিয়তের কথাটা অলরেডি বলা হয়ে গেছে।
এই ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার হল, আপনার নিয়ত হয়ত ভাল কিন্তু যা করছেন তা সঠিক জ্ঞানের ভিত্তিতে করা হচ্ছে না। আপনি হয়ত মনে করছেন কাজটি ভাল কিন্তু আসলে কাজটি ভাল নয়। এইজন্য, দোয়ার প্রথম অংশ নিশ্চিত করছে যে, আপনার উপকারী জ্ঞান রয়েছে। তাই যে কাজগুলো করবেন তা হবে উপকারী জ্ঞানের ভিত্তিতে। যেমন আল্লাহ বলেছেন - وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ - “আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না।” (17:36)

তাহলে, শেষ অংশে আমি আল্লাহর নিকট এমন আমল করতে পারার জন্য দোয়া করছি যা আল্লাহ গ্রহণ করবেন। আমি যে এখন আপনাদের সাথে কথা বলছি, আমি দোয়া করছি আমার এই কাজটি যেন ''আমালান মুতাকাব্বালান'' হয়। যে কেউ এই কথাগুলো শুনবে এবং সে তার মাবাবা, চাচাতো-খালাতো ভাই বোন, পরিবার এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে শেয়ার করবে— আমি দোয়া করছি আল্লাহ যেন আপনাদের সবার নিকট থেকে এটি গ্রহণ করে নেন এবং আমার কাছ থেকেও গ্রহণ করে নেন। এটি আমালান মুতাকাব্বালান এর একটি উদাহরণ।

তো, আমরা আল্লাহর কাছে ''ইল্মান নাফিয়ান" চাই, তারপর চাই "রিযকান তইয়েবান" এবং শেষে "আমালান মুতাকাব্বালান" চাই। আমি যুক্তি দেখাবো কারো জীবনে যদি এই তিনটি বিষয় থাকে তাহলে তার জীবনে আর কোন কিছুর দরকার নেই। আপনি আর কী চাইবেন!

—উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ৬৫৩ বার

মন্তব্য: ০