Alapon

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং মুশরিকদের তর্ক-বিতর্ক



ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর কওমের মানুষেরা মূর্তি পূজায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাঁর বাবাও মুর্তি পূজারিদের দলে। এসব দেখে মানসিকভাবে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন তিনি। তিনি তাদেরকে এর অসরতা নিয়ে নিয়মিত বুঝিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কেউ কোনো পাত্তা দিচ্ছেনা।

তারা তাঁর সাথে বিবাদ-বিস্বাদ এবং ঝগড়াঝাঁটিতে জড়িয়ে পড়লো। তারা যখন তাঁর সাথে এসব নিয়ে তর্ক করতে এগিয়ে এলো। তখন তিনি তাদেরকে সুস্পষ্টরূপে জানিয়ে দিলেন, “তোমরা কি মহান আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? তিনি তো আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে আল্লাহর আংশীদার মানো, আমি ওদের ভয় করিনা। আমি জানি ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। তিনি তাঁর বাবাকেও এ বিষয়ে সরাসরি বললেন-
“বাবা, আপনি কি মূর্তিকে রব্ব মানেন? আমিতো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা সুস্পষ্ট ভুলের মধ্যে আছেন।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৭৪)
দিনের পর দিন এভাবে তিনি বুঝিয়ে যেতে লাগলেন। তাদের অসরতা-অকর্মণ্যতা প্রকাশ করে যেতে লাগলেন। অতঃপর আরেকদিন তিনি পুনরায় নিজ পিতাকে বললেন- “বাবা আপনি কেনো সেসব জিনিসের ইবাদাত করেন? যেগুলো কানে শুনেনা, চোখে দেখেনা এবং আপনার কোন উপকার করতে পারেনা। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। বাবা, কেনো আপনি শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় মহান আল্লাহর অবাধ্য।”

কিন্তু অন্ধভক্তিতে তাঁর বাবা তখনও আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নিজ সন্তানের তাওহিদি আহ্বানকে তিনি পাত্তা দিলেন না। উল্টো সন্তানকে আরো শাসিয়ে দিলেন। বললেন- “ইব্রাহিম, তুমি কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলা? জেনে রাখো, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করবো।”

সাঈয়িদুনা ইবরাহিম মনোবল ভাঙলেন না। তিনি ভাবলেন, এমন কোনো কাজ করা দরকার, যাতে পুরোটা সমাজের ভিত নড়ে ওঠে। তাদের হারানো হুঁশ ফিরে আসে এবং একই সাথে তাদের অন্তরে একাত্ববাদের যে চেতনা, সে চেতনার যেনো উন্মেষ ঘটে। আর সে কারণে তিনি একদিন ঘোষণা করলেন- তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যে খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। কিন্তু ইবরাহিমের কথায় তারা কোনো গুরুত্ব দিলোনা।

ইবরাহিম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করতো। এবারও তারা সকলেই সে উৎসবে যোগদান করলো। লোকেরা তাঁকেও সে উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। অনেক চাপাচাপির পরও তিনি গেলেন না। যখন তারা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো তার ওপর, তখন তিনি বললেন আমি অসুস্থ। অতঃপর সকলেই চলে গেলো। গোটা শহরে রয়ে গেলেন শুধু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম মনে মনে নিয়ত করলেন যে, এই সুযোগে তিনি তাদের ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করবেন। মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরচুর করে ফেলবেন। যাতে তাদের বোধদয় ঘটে। তারা যাতে এমন ঘৃণিত কাজ থেকে, মিথ্যে প্রভুর উপাসনা থেকে ফিরে আসে। নিজ চোখেই তারা যেনো নিজেদের বাতিল উপাস্যদের নির্মম অসহায়ত্বের সকরুণ দৃশ্য অবলোকন করতে পারে। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এর মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে অনেকের অন্তরে ঈমান ফয়দা হবে। ঈমানী চেতনা জাগ্রত হবে। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং শিরক থেকে পবিত্র হয়ে তওবা করবে। যার কারণে সে চিন্তা হতে তিনি মন্দিরে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাদের তৈরি মূর্তিগুলো। এবং সে মুর্তিগুলোর সামনে রয়েছে হরেক রকম খাবার-দাবার এবং সুস্বাদু ফলফলাদি।
তিনি নীরব নেত্রে সেসব চেয়ে দেখতে লাগলেন। একে একে সবকিছু অবলোকন করে মূর্তিগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। সেগুলোকে লক্ষ্য করে বললেন, 'তোমাদের সামনে এতো বাহারি রকমের উপঢৌকন আর খানাপিনা রয়েছে, কিন্তু সেসব ‘তোমরা তা খাচ্ছো না কেনো? তারা চুপ। নিষ্প্রাণ পাথরের মূর্তি কী আর কথা বলার ক্ষমতা রাখে? এবার তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন- কী ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেনো? কুড়াল দিয়ে কষে আঘাত করলেন মুর্তিগুলোকে। আঘাতে আঘাতে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো যেটা, ওটাকে কিছু করলেন না। সেটাকে আগের মতোই স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দিলেন।
তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের পরে তারা যথারীতি ফিরে এলো এবং মন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলোর এমন বেহাল অবস্থা দেখে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহিমের কাজ হবে। কারণ, আমরা তাকে এদের সমালোচনা করতে দেখেছি। তাদের নেতারা রাগে-গোস্বায় গরগর করে কাঁপছে। নেতারা আদেশ করলো ইবরাহিমকে যেনো নিয়ে আসা হয়। অতঃপর ইবরাহিমকে ডেকে আনা হলো।
যুবক ইবরাহিম হাজির তাদের সামনে। তারা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তিনিও যথেষ্ঠ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তাদের প্রশ্নের জবাব দিলেন। পবিত্র কুরানুল কারিমে সে জিজ্ঞাসাবাদ ও জবাবের বিষয়টি এভাবেই এসেছে,
‘হে ইবরাহিম! আমাদের উপাস্যদের সাথে এমন আচরণ কি তুমিই করেছো’?
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাদেরকে যথাযথ জবাব দেয়ার একটা মহা মওকা পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘না, তাদের মধ্যে এই যে বড়টা, সে-ই এসব করেছে, তারা যদি কথা বলতে পারে তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।’

তারা এই জবাব শুনে লজ্জায় মাথা করে ফেললো এবং বললো, ‘ ইবরাহিম ! তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলতে পারেনা।’ ‘ তখন তাদের কথার প্রতিউত্তরে ইবরাহিম আলাইহিস সালাতু আসসালাম বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করো, যা তোমাদের কোনো ধরনের উপকারও করতে পারেনা, এবং ক্ষতিও করতে পারেনা। তোমাদের এবং তোমাদের দেবতাদের জন্য আফসোস, তোমরা কি বোঝোনা’?

ইবরাহিমের এমন কথাবার্তা শুনে তারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তেড়ে আসলো তাঁর দিকে। তিনিও ভয় পেলেন না। বরং আগের চেয়ে আরো দ্বিগুণ সাহস-শক্তিসহ বলে উঠলেন বললেন, ‘তোমরা এমন জিনিসের দাসত্ব করো , যা তোমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে তৈরি করো। ‘অথচ আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’ ।

যুক্তি-বুদ্ধি-বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে তারা শক্তি প্রয়োগের সীদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। তাদের অহংকার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, সত্যকে কাছ থেকে দখেও সেই সত্যের প্রতি তারা আত্মসমর্পিত হলো না। এবং তারা নিজেদের পরামর্শ সভায় ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ব্যাপারে এমন হটকারী সীদ্ধান্ত গ্রহণ যে, এর বিষয়টি রাজদরবারে উপস্থাপন করতে হবে। রাজাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে তাকে হত্যা করতে হবে। যেইভাবা সেইকাজ। তারা রাজার কাছে গেলো। রাজাকে বুঝালো যে, এই ছেলেকে কোনোক্রমেই বাঁচতে দেওয়া যাবেনা। একে বাঁচিয়ে রাখা হলে সে আরো ক্ষতি করবে আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের। অবশেষে রাজ দরবার থেকে তাঁকে এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। সেই শাস্তিটা কি জানেন ? সেটা হলো সাঈয়েদুনা ইবরাহিমকে তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার শাস্তি। এমন বর্বর পৈশাচিক শাস্তি দেওয়ার সীদ্ধান্ত শুধু একটি মাত্র কারণেই নিলো, সেটা হলো অসংখ্য দেবদেবির পূজা-অর্চনা না করে শুধু এক ইলাহ আল্লাহর দাসত্ব করার দাওয়াত পেশ করা।

ইবরাহিমকে রাজার মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহিমকে রাজ দরবারে আনা হলো। যে রাজার কাছে আনা হলো, সে নিজেও ছিলো এক পাক্কা জালিম। টানা চারশো বছর ধরে সে রাজত্ব করে যেতে লাগলো। তাই সে নিজেও সীমাহীন অহংকারী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। নিজেকেই উপাস্য হিসেবে ভেবে বসে আছে। তা-ও একমাত্র আরাধনারযোগ্য উপাস্য। সেও যথারীতি ইবরাহিমকে প্রশ্ন করা শুরু করলো। প্রথম প্রশ্নটাই হলো যে এমন, ‘বলো তোমার উপাস্য কে’?
তিনিও দৃঢ় অথচ শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন যে, ‘আমার রব তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যুও প্রদান করেন। এবার রাজা মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত দু’জন কয়েদীকে এনে সকলের সামনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে দিলো এবং ইবরাহিম আলাইহিস সালাতু আসসালামকে জবাব দিলো, দেখো; ‘আমিও তো জীবন দান করতে পারি এবং মৃত্যু ঘটাই’।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ভীত হলেন না। তাঁর ভেতর ছিলো দাওয়াতি মনোভাব। তাই তো তিনি জনতার সামনে নির্ভিক চিত্তে উত্তর দিলেন যে, ‘আমার আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদয় ঘটান, তুমি তাকে পশ্চিম দিক হতে উদিত করো’। এই যুক্তিপূর্ণ জবাব শুনেই সে পুরোপুরি নির্বাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’।

// ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং মুশরিকদের তর্ক-বিতর্ক//
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৩৮৯ বার

মন্তব্য: ০