Alapon

আল্লাহ ভরসা বা তাওয়াক্কুল বলতে আসলে কী বোঝায়?



সূরা তাওবার ৫১ নাম্বার আয়াত কুরআনের অন্যতম শক্তিশালী আয়াতগুলোর একটি। বস্তুতঃ এটি সমগ্র কুরআন জুড়ে আমার অন্যতম প্রিয় আয়াতগুলোর একটি। আমাদের সবারই পছন্দের আয়াত রয়েছে। কুরআনের সকল আয়াতই প্রিয় এবং আশীর্বাদপুষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু আয়াতের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

এই আয়াতটি মুখস্ত করার জন্য আমি সবাইকে উৎসাহ প্রদান করি। কারণ, এই আয়াতটি সত্যিই বিপদের সময় আমাদের অন্তরে এক ধরণের নিরুদ্বেগ স্বাচ্ছন্দ্য এবং প্রশান্তি নিয়ে আসে।

এই আয়াতটি তাবুক যুদ্ধের চাপ মোকাবেলায় খুব কাজে আসে। বড় ধরণের একটি কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন সাহাবীরা। সময়টি ছিল দারুণ প্রতিকূল। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদেরকে খেত খামারের দায়িত্ব পরিত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল। মদিনায় তাঁদের অবস্থানটা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন তাঁদেরকে মদিনা ত্যাগ করতে হয়েছিল। তীব্র গরমের ভেতর দিয়ে তাঁদেরকে হাজার মাইল ভ্রমণ করতে হয়েছিল। যুদ্ধটা হওয়ার কথা ছিল তাঁদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী রোমান সৈন্যদের সাথে।

তখন আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা তাঁদেরকে বললেন, قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا ۚ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ - "বল, ‘আমাদেরকে শুধু তা-ই আক্রান্ত করবে যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন। তিনিই আমাদের রক্ষক, আর আল্লাহর উপরই যেন মুমিনরা তাওয়াক্কুল করে’।" (৯:৫১)

এটি এতো চমৎকার একটি আয়াত! এখানে বান্দার সাথে তার সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এখানে কুরআনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা 'তাওয়াক্কুল' নিয়ে কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপর নির্ভর করা। এই আয়াতটি আমাদেরকে 'তাওয়াক্কুল'-এর প্রাথমিক উপকার সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। আপনার যদি 'তাওয়াক্কুল' থাকে, দুনিয়ার সমস্যাগুলো আপনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। যদি 'তাওয়াক্কুল' থাকে, পরিস্থিতি যতই খারাপ হউক না কেন, বাহিরে যত শক্তিশালী ঝড়ই থাকুক না কেন, আপনার অন্তর প্রশান্তিতে পূর্ণ থাকবে।

কেন? কারণ, আপনি জানেন কোন কিছুই ঘটবে না, যদি না তিনি ইচ্ছা করেন। আর তিনি কে? তিনি আমার মাওলা। তিনি আমার রক্ষক। তিনিই সেই সত্তা যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার যত্ন নেন। আমার প্রতিপালন করেন। তাহলে কেন আমি উদ্বিগ্ন হবো? কেন আমি অশান্ত হয়ে উঠবো? কেন আমি দুঃখ কাতর হয়ে পড়বো?

এটা স্বাস্থ্যগত সমস্যা হউক, আর্থিক সমস্যা হউক, সামাজিক সমস্যা হউক, কিছুই ঘটবে না, যদি না আল্লাহ কিছু ঘটার ইচ্ছা করেন। আমার চরম শত্রুরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি না আল্লাহ এটার ইচ্ছা করেন। আমার উপর কারো কোনো ক্ষমতা নেই, যদি না আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এর ইচ্ছা করেন। কোনো আর্থিক সমস্যাই আমাকে চাপে ফেলতে বা আমার উপর বোঝা হয়ে দেখা দিবে না, যদি না আল্লাহ এর ইচ্ছা করেন। তাই, কেন আমি কাউকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবো? আমার তাওয়াক্কুল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপর রাখতে হবে।

এই আয়াত আমাদের নিকট আরও ব্যাখ্যা করে তাওয়াক্কুল বলতে কী বোঝায়? তাওয়াক্কুল হলো একটি বিশেষ মানসিক অবস্থার নাম। তাওয়াক্কুল হলো একটি আধ্যাত্মিক অবস্থার নাম। তাওয়াক্কুল হলো অন্তরের একটি তাত্ত্বিক বিশ্বাসের নাম। আপনার কাজের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে না। আপনার কর্মপদ্ধতিতে এটি কোনো পরিবর্তন আনে না। আপনি কিভাবে দুনিয়া দেখেন, দুনিয়াকে কিভাবে উপলব্ধি করেন এটা তাতে পরিবর্তন আনে। তাওয়াক্কুল আপনার কাজে-কর্মে পরিবর্তন আনবে না। তাওয়াক্কুল আপনার অনুভূতিতে পরিবর্তন আনবে। তাওয়াক্কুল হলো একটি আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

সাহাবারা তবু অভিযানের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবই তারা সাথে নিলেন। যা কিছু বস্তাবন্দী করা দরকার করলেন। নিজেদের বর্ম পরিধান করলেন। যুদ্ধের জন্য মার্চ করে এগিয়ে গেলেন। তাওয়াক্কুলের কারণে কোনো কিছুতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বললেন- চিন্তা করো না। আমি না চাইলে কিছুই ঘটবে না। لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا -
খুব চমৎকার একটি হাদিস আছে যাতে তাওয়াক্কুলের ধারণাটির একটি সুন্দর সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের রাসূল (স) বলেছেন- الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ - "শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে প্রিয়।" এখানে শক্তিশালী বলতে শক্তিশালী ঈমানকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু, এর দ্বারা আবার জীবনের সকল ক্ষেত্রের শক্তিমত্তাকেও বুঝায়। "আর সকল মুমিনের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে।" احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ - "তোমার উপকারে আসবে এমন কিছুর জন্য আগ্রহী হও।" وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ - "এবং এটা অর্জন করতে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর।" وَلاَ تَعْجِزْ - এবং "অক্ষম হয়ে থেকো না।"

এই হাদিসের সাথে তাওয়াক্কুলের কী সম্পর্ক? খুব সহজ। আমাদের রাসূল (স) বলেছেন যখন বুঝতে পারো যে কিছু একটা তোমার উপকারে আসবে তখন সেটি অর্জন করার জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ কর। احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ - "তোমার উপকারে আসবে এমন কিছুর জন্য আগ্রহী হও।"

যদি চাকরি করতে চাও ডিগ্রী অর্জন কর। কোম্পানিতে নিজের প্রমোশন চাও? এরজন্য যে যে প্রচেষ্টা করতে হবে, করো। যা তোমার উপকার করবে তার জন্য আগ্রহী হও। এটা হালাল। এরপর রাসূল (স) বলেন- وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ - "এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর।" তোমার হাত তুলে আল্লাহকে বল- ও আল্লাহ! আমার জন্য এর অর্জন সহজ করে দিন। এরপর وَلاَ تَعْجِزْ - এবং "অক্ষম হয়ে থেকো না।" বাদ দিও না, পরিত্যাগ করো না, অলস হয়ে পড়ো না। "আজাজ" মানে অলসতা। লক্ষ্য অর্জন করার প্রচেষ্টায় অলস হবে না। তোমাকে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে চেষ্টা করতে হবে। নিজের ডেস্কে অলস বসে থেকে তো তুমি প্রমোশন পাবে না।

পড়া লেখা না করলে, শিক্ষা অর্জন না, যোগ্যতা অর্জন না করলে তো ভালো চাকরি পাবে না।

সুতরাং, তোমার উপকারে আসবে এমন কিছু পেতে চাইলে এর জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ কর। আল্লাহর কাছে দুআ কর। এবং অলস হইও না। হতাশ হয়ে ছেড়ে দিও না। এরপর কী? এরপর রাসূল (স) বলেন- "যদি কোন কিছু (বিপদ) তোমার উপর আপতিত হয়..." এমন কিছুর আশা তুমি করনি। যদি অনেক চেষ্টার পরেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পার, তখন দোষারোপ করবে না। "এরূপ বলবে না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তবে এরূপ এরূপ হত।" বরং বল- “কাদ্দারাল্লাহু ওমা শাআ ফাআল- আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন।"

যথেষ্ট চেষ্টা করার পরেও যদি না পান তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন। আল্লাহ এটা আপনার জন্য লিখেন নি। এটা আপনার কপালে ছিল না। আপনার ভাগ্যে ছিল না।
তাহলে তাওয়াক্কুল আমাদের প্রচেষ্টায় কোন প্রভাবে ফেলে না। এটা আমাদের চিন্তা-ভাবনায়, আমাদের উপলব্ধিতে প্রভাব ফেলে। এটা আমাদের কাজেকর্মে পরিবতন আনে না। আমরা যেভাবে বাস্তবতা বুঝি এটা তাতে পরিবর্তন নিয়ে আসে।

প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, এই সুন্দর আয়াতটি আমাদের মুখস্ত করে রাখা উচিত এবং কঠিন সময়ে এটি ব্যবহার করা উচিত। দুর্ভাগ্য বশত, আমাদের তাওয়াক্কুল যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, আমরা তখন এই দুনিয়ার বিপদ-আপদ নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়ি- আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিবর্তে। আর আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন- وَ مَنۡ یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ - “যে কেউ আল্লাহর উপর ভরসা করে, তবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (৬৫:৩) আল্লাহ তার যত্ন নিবেন।

আমাদের রাসূল (স) আমাদের এই বিষয়ে একটি দুয়া শিখিয়ে গেছেন। দুয়াটি কুরআনে বর্ণিত আছে। যখন পরীক্ষায় পড়েন, বিপদ-আপদে পড়েন যদি এই কথাগুলো বলেন আল্লাহ আপনার দায়িত্ব নিবেন। যদি ঈমানের সাথে বলেন। সেই কথাগুলো হলো حَسۡبُنَا اللّٰهُ وَ نِعۡمَ الۡوَکِیۡلُ - ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! (3:173) ওয়াকিল মানে এমন সত্তা যার উপর আমি তাওয়াক্কুল করবো, ভরসা করবো।

আমাদের রাসূল (স) আমাদের বলেছেন ইব্রাহিম (আ) এ কথাগুলো বলেছিলেন যখন তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ফলে দেখেছেন? আল্লাহ কিভাবে তাঁকে রক্ষা করলেন।
ইব্রাহিম (আ) কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তিনি শুধু বলেছিলেন " হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল ওয়াকিল"। যখন নেবুচাদনেজারের সেনাবাহিনী আগুনের চুল্লি তৈরি করেছিল এবং তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তিনি শুধু বলেছিলেন "হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি'মাল ওয়াকিল"। তখন আল্লাহ ইব্রাহিম (আ) এর জন্য সেই আগুনকে সুন্দর একটি বাগানে পরিণত করলেন।

তাই, প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, তাওয়াক্কুলের বাস্তবতা হলো এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর উপর আমাদের আশা রাখি। আমাদের বিশ্বাস রাখি। কোনো কিছুই ঘটবে না যদি না তিনি এর ডিক্রি জারি করেন।

কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, আমরা অলস হয়ে বসে থাকবো। সবশেষে আরেকটি হাদিস বলছি। আমাদের রাসূল (স) বলেছেন- "আল্লাহর উপর যদি তোমাদের যথাযোগ্য তাওয়াক্কুল থাকত, আল্লাহ যেভাবে ডিজারভ করেন, তাহলে তিনি তোমাদের এমনভাবে জীবিকা সরবরাহ করতেন যেভাবে তিনি সকল পাখিদের জীবিকা সরবরাহ করেন। তারা সকাল বেলা খালি পেটে তাদের বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে..." কেউ জানে না কোথায় তারা তাদের শস্য পাবে। কেউ জানে না তাদের খাদ্য কোথা থেকে আসবে। "আর তারা ভরাপেটে তাদের নীড়ে ফিরে আসে।"

এই সুন্দর হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় তাওয়াক্কুলের আসল অর্থ কী। এর মানে এটা নয় যে, আপনি নীড়ে বসে থাকবেন। এর মানে এটা নয় যে, কিছু না করেই আপনি আশায় থাকবেন আল্লাহ আপনাকে দিবেন। না। পাখিগুলো ভোরবেলা নীড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং সমগ্র অঞ্চলে উড়ে বেড়ায়। তাদের আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল আছে আর তাই আল্লাহ তাদের খাবার সরবরাহ করেন। এমন উৎস থেকে যার আশা তারা করেনি।
আমি দুয়া করছি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেভাবে তাওয়াক্কুল পাওয়ার যোগ্য আমরা যেন সেভাবে তাঁর উপর তাওয়াক্কুল করতে পারি।

— ড. ইয়াসির ক্বাদী

পঠিত : ৩৬৩ বার

মন্তব্য: ০