Alapon

সমালোচনার নীতিমালা



بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
সমালোচনা (ইংরেজি Criticism) প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। ইদানিং ব্যাপকহারে দেখা যাচ্ছে (বিশেষভাবে ফেসবুকে) যার যেমন ইচ্ছা যে ব্যক্তি নিয়ে ইচ্ছা বা যে বিষয় নিয়ে ইচ্ছা সমালোচনা করে যাচ্ছেন। তা সমালোচনাকারির মধ্যে সমালোচনা করার মত যোগ্যতা না-ই বা থাকল এবং সমালোচনার স্বতসিদ্ধ নীতিমালার কোন তোয়াক্কা না-ই বা করা হল। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সমালোচনা কর্মে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বুঝি কোনোই যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না, এ ব্যাপারে বুঝি কোন নীতিমালা নেই, যে কারও মনে চাইলেই সে যেকোনো বিষয় সম্বন্ধে বা যেকোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে যেমন ইচ্ছা সমালোচনা করতে পারে। অথচ ব্যাপারটা এমন নয়। সমালোচনার জন্য বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু শর্ত, বেশ কিছু নীতি। সেই শর্তাবলি ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে সমালোচনা কর্মে প্রবৃত্ত হলে সেরূপ সমালোচনা দ্বারা ফায়দা হয় না, নুকসান হয়। সেটা হয় পাপকর্ম। অতএব সেরূপ সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়, কাম্য নয়। কিন্তু সেরূপ সমালোচনা চলছে অবাধে, বল্গাহীনভাবে। সমালোচনার অঙ্গনে বিরাজমান এই অবাধ ও বল্গাহীন স্বেচ্চাচারিতা এবং সমালোচনার আদলে এই অগ্রহণযোগ্য তৎপরতার কারণেই সমালোচনা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

‘সমালোচনা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে সম ও আলোচনা- দু’টো শব্দের সন্ধি যোগে (সম+আলোচনা=সমালোচনা)। ‘সম’ শব্দের মূল অর্থ সমান, তুল্য, যোগ্য। আর আলোচনার অর্থ তো সুবিদিত। তাই শব্দের গঠন বিবেচনায় কোন আলোচনা বাস্তবতার সমান (তথা বাস্তবসম্মত) বা যথাযোগ্য হলেই তা সমালোচনা। অর্থাৎ আভিধানিক অর্থে কোন কিছুর ইতিবাচক নেতিবাচক সব ধরনের আলোচনাকেই -যদি তা বাসস্তবসম্মত হয়- সমালোচনা বলা যায়। তবে শব্দটি নেতিবাচক আলোচনার ক্ষেত্রেই বহুল ব্যবহৃত। সে হিসেবেই অভিধানে সমালোচনার অর্থ লেখা হয়েছে- ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রদর্শনপূর্বক আলোচনা। এ অর্থে উল্লেখিত ‘প্রদর্শনপূর্বক’ শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। এতে বোঝানো হয়েছে শুধু কোন কিছুর ত্রুটি-বিচ্যুতি বললেই তা যথাযথ সমালোচনা আখ্যায়িত হবে না, ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখিয়েও দিতে হবে অর্থাৎ তার দলীল-প্রমাণ দেখিয়ে দিতে হবে। অতএব কোন ত্রুটি-বিচ্যুতিমূলক আলোচনা যদি বাস্তবসম্মত না হয় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য সমালোচনা নয় (বরং সেটা মিথ্যা আখ্যায়িত হবে)। এমনিভাবে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ক আলোচনায় তথা কোন সমালোচনায় যদি যথাযথ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত না হয় তাহলে সেটাও আদর্শ সমালোচনা বলে স্বীকৃতি পাবে না। তাহলে সমালোচনা শব্দের ধাতুমূলীয় অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকেই সমালোচনার দু’টো নীতি প্রতীয়মান হল। যথা:
(১) সমালোচনা হতে হবে বাস্তবসম্মত।
(২) সমালোচনার অনুকূলে যথাযথ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত হতে হবে।
সমালোচনাকে আরবিতে বলা হয় নক্বদ (نقد)। আরবি এ শব্দটির মূল অর্থে রয়েছে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মর্ম। নক্বদ শব্দের এই ধাতুমূলীয় অর্থ থেকেও সমালোচনার কয়েকটি নীতি প্রতীয়মান হয়- তিনটি নীতি প্রতীয়মান হয়। যথা:
( ১) কোন বিষয়ে সমালোচনা করার পূর্বে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক কোন বিষয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল সে বিষয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে ।
(২) কোন বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সে বিষয়ের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাও আবশ্যক। তাই যে বিষয়ের সমালোচনা হবে সমালোচনাকারির মধ্যে সে বিষয়ের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।
(৩) এমনিভাবে কোন ব্যক্তির সমালোচনা করতে হলে তার চেয়ে বেশি বা ন্যুনতম তার সম পর্যায়ের একাডেমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক, নতুবা তার কথা কিম্বা কর্ম যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হবে না।

তাহলে বাংলা শব্দ ‘সমালোচনা’ ও তার আরবি প্রতিশব্দ ‘নক্বদ’ (نقد)- এ দু’টোর ধাতুমূলীয় অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে সমালোচনার মোট পাঁচটি নীতি প্রতীয়মান হল। যথা:-
(১) সমালোচনা হতে হবে বাস্তবসম্মত।
(২) সমালোচনার অনুকূলে যথাযথ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত হতে হবে।
(৩) কোন বিষয়ে সমালোচনা করার পূর্বে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক কোন বিষয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল সে বিষয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে।
(৪) সমালোচনাকারির মধ্যে যে বিষয় নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক কিছু বলবেন সে বিষয় সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে এবং
(৫) কোন ব্যক্তির কোন কিছু নিয়ে সমালোচনা করতে হলে তার চেয়ে বেশি, ন্যুনতম তার সমপর্যায়ের একাডেমিক যোগ্যতা থাকতে হবে।

এ তো গেল ‘সমালোচনা’ ও তার আরবি প্রতিশব্দ ‘নক্বদ’ (نقد)- শব্দ দু’টোর ধাতুমূলীয় অর্থ ও ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে আহরিত সমালোচনার নীতিমালা (পাঁচটি নীতি) সম্বন্ধে বিবরণ। এবার সমালোচনার নীতিমালা সম্বন্ধে কুরআন-হাদীছের বক্তব্য কি জানা যাক। কুরআন-হাদীছের বক্তব্য থেকেও সমালোচনার ক্ষেত্রে উপরোক্ত নীতিপঞ্চ প্রমাণিত হয়। এভাবে-
(১) সমালোচনা যেহেতু কোন ব্যক্তি বা কোন বিষয় সম্বন্ধে খবরের অন্তর্ভুক্ত, আর কোন খবর বাস্তবসম্মত না হলে সেটা হয় মিথ্যা এবং মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি, তাই সমালোচনা বাস্তবসম্মত হওয়া জরুরি। মিথ্যার সংজ্ঞাই হল বাস্তবতা বিরোধী হওয়া। আল্লামা নববী মিথ্যার সংজ্ঞায় এমনই বলেছেন-
الإخبار عن الشيء على خلاف ما هو، عمدًا كان أو سهوًا، سواء كان الإخبار عن ماض أو مستقبل)
অর্থাৎ অতীত বা ভবিষ্যতের কোন বিষয়ে বাস্তবতার বিপরীত খবর দেয়াই হচ্ছে মিথ্যা, চাই তা ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে। অতএব মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকার জন্য সমালোচনা বাস্তবসম্মত হওয়া চাই। সমালোচনা বাস্তবসম্মত না হলে তাতে মিথ্যা বলার পাপ হবে, গোনাহে কাবীরা হবে।
(২) সমালোচনা এক ধরনের অপবাদ। আর কারও সম্বন্ধে অপবাদ আরোপ করতে হলে অপবাদের অনুকূলে দলীল-প্রমাণ পেশ করা জরুরি। হজরত আয়েশা রা,-এর প্রতি যারা ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করেছিল, কুরআনে কারীমে তাদেরকে শাসিয়ে বলা হয়েছে,
لولا جاءوا عليه بأربعة شهداء فاذ لم يأتوا والشهداء فاولئك عند الله هم الكاذبون.
অর্থাৎ, কেন এই লোকগুলো এ বিষয়ে চারজন সাক্ষী পেশ করল না? সুতরাং যখন এরা সাক্ষী পেশ করল না তখন এরাই আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী। (সূরা নূর: 13) এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় অপবাদের অনুকূলে সাক্ষী তথা দলীল-প্রমাণ পেশ করা জরুরি। অন্যথায় তা মিথ্যার শামিল হবে। সমালোচনাও যেহেতু এক ধরনের অপবাদ, তাই সমালোচনার অনুকূলে যথাযথ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত হতে হবে। অন্যথায় সমালোচনাকারী আল্লাহর নিকট মিথ্যা বলার দায়ে অভিযুক্ত হবে। উল্লেখ্য, আয়াতটি যদিও ব্যভিচারের অপবাদ প্রসঙ্গে নাযেল হয়েছে, তবে উসূলে ফিকহের ইস্তিমবাত সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ পদ্ধতি দালালাতুন্নস (دلالة النص)-এর ভিত্তিতে অন্যান্য অপবাদের ক্ষেত্রেও এর হুকুম প্রযোজ্য।
(৩) সমালোচনা করার পূর্বে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় নিম্নোক্ত হাদীছ থেকে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
كفى بالمرء كذبا ان يحدث بكل ما سمع.
অর্থাৎ মানুষের মিথ্যুক হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে (যাচাই-বাছাই ছাড়া) তা-ই বর্ণনা করে দিবে। (মুকাদ্দামায়ে মুসলিম) অতএব কারও কোন দোষ শুনেই (বা অন্য কোনভাবে জেনেই) তার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাবে না। যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে।
(৪) সমালোচনা যদি কোন ব্যক্তির কোন বিষয় সম্বন্ধে হয় তাহলে তার বিষয় যাচাই-বাছাই করার জন্য তার চেয়ে বেশি, ন্যুনতম তার সমপর্যায়ের একাডেমিক যোগ্যতা থাকার অপিহার্যতা অতি অবশ্যই সাব্যস্ত হয়ে যাবে। সামনের ৫ নম্বরে এর দলীল আসছে।
(৫) সমালোচনা হচ্ছে কোন একটা কিছুর পিছে পড়া (দোষের পিছে পড়া)। আর কুরআন কারীমে বলা হয়েছে, ولا تقف ما ليس لك به علم অর্থাৎ, যে বিষয়ে তোমার যথাযথ জ্ঞান নেই তার পিছে পড় না । ((সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৬)
(এ আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত হয় সমালোচনাকারির মধ্যে যে বিষয় নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক কিছু বলবেন সে বিষয় সম্বন্ধে যথাযথ ও পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। ব্যক্তির সমালোচনা করতে গেলে যেহেতু সেই ব্যক্তি তার জ্ঞানের যে স্তর থেকে কিছু করেছেন বা বলেছেন সে সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে, তাই এভাবে বলা যায় কোন ব্যক্তির সমালোচনা করতে হলে তার চেয়ে বেশি, ন্যুনতম তার সমপর্যায়ের একাডেমিক যোগ্যতা থাকতে হবে। সমালোচনার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান থাকা জরুরি- এ ব্যাপারে হজরত আয়েশা রা, থেকে একটি স্পষ্ট উক্তি রয়েছে। জানাযা সংক্রান্ত একটি বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ما اسرع الناس الى ان يعيبوا ما لا علم لهم به. অর্থাৎ, যে ব্যাপারে লোকদের জ্ঞান নেই সে ব্যাপারে তারা সমালোচনা করতে ত্বরা করল কেন? (মুসলিম: হাদীছ নং ১০০/২২২৬)

এতক্ষণ কুরআন-হাদীছ দ্বারা সমালোচনার এমন পাঁচটি মূলনীতি সপ্রমাণিত করা হল যা সমালোচনা ও তার আরবি প্রতিশব্দ নক্বদ-এর ধাতুমূলীয় অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকেও প্রতীয়মান হয়েছিল। কুরআন-হাদীছের আলোকে সমালোচনার শর্ত ও নীতি পর্যায়ের আরও পাঁচটি বিষয় রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-
(১) সমালোচনা শরয়ী পরিভাষার গীবত তথা পশ্চাতে দোষ-বদনাম করার হুকুমভুক্ত। আর তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত গীবত হারাম তথা নিষিদ্ধ। অতএব সেই তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত সমালোচনাও হারাম তথা নিষিদ্ধ। যে তিনটি ক্ষেত্রে গীবত তথা পশ্চাতে দোষ-বদনাম বলা যায় এবং সেসব ক্ষেত্রে সমালোচনার অনুমতিও রয়েছে সে ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে (এক) কারও ভুল-ভ্রান্তি ও গোমরাহী সম্বন্ধে অন্যদেরকে সাবধান-সতর্ক করার জন্য সমালোচনা। দেশ ও জাতিকে ক্ষতি


থেকে বাচাঁনোর উদ্দেশ্যে কারও সমালোচনা তথা দোষ-ত্রুটি তুলে ধরা এ পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ফেরআউন, কওমে আদ, কওমে ছামুদ প্রভৃতির দোষ-ত্রুটি তুলে ধরেছেন মানুষকে সাবধান-সতর্ক করার জন্য। অতএব কারও সমালোচনা তথা কারও দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য থাকা চাই মানুষকে সংশ্লিষ্ট দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে সাবধান করা। মানুষকে ক্ষতি থেকে বাচাঁনো। কাউকে হেয় করা বা কাউকে ছোট প্রতিপন্ন করে নিজেকে বড় হিসেবে দেখানো নয়। (দুই) ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য বিচারক-এর সামনে প্রতিপক্ষের যে দোষ-বদনাম তুলে ধরার প্রয়োজন পড়ে তার অনুমতি রয়েছে। বেসরকারীভাবে নির্বাচিত বিচারকমণ্ডলি তথা পঞ্চায়েতের সামনে বা যেকোনো শালিস বিচারের সময় কোন পক্ষের যে দোষ-বদনাম বলার প্রয়োজন পড়ে তা এর অন্তর্ভুক্ত। (তিন) তাদীব তথা আদব শিক্ষা দেয়া বা শাসনের নিয়তে মুরব্বী ও গুরুজনের কাছে অধীনস্থ ও ছোটদের দোষ-বদনাম তুলে ধরা যায়। উস্তাদের কাছে তার ছাত্রদের ব্যাপারে নালিশ এ পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত। তাদীব বা শাসনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে দেশের অপরাধীদের অবস্থা তুলে ধরাও এ পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত।
(২) সমালোচনার ভাষা হওয়া চাই ভদ্রোচিত, শালীন, মার্জিত ও ভারসাম্যপূর্ণ। ইসলাম সমালোচনার ক্ষেত্রে অশালীন ও ভারসাম্যহীন কথা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দিয়েছে। সব রকম গালিগালাজকে হারাম করেছে। অশালীন ভাষায় সমালোচনা, গালিগালাজ, মানহানিকর অভিব্যক্তি প্রতিপক্ষকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে, জেদী করে তোলে, আলেম উলামা ও ইসলাম থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়। এরূপ সমালোচনা দ্বারা তাই ক্ষতি হয়। মনে রাখতে হবে অশ্লীল ভাষা ও গালিগালাজ ইত্যাদির প্রয়োগ দ্বারা মনের ঝাল মেটানো যায় কিন্তু তা দ্বারা কাউকে কাছে টানা যায় না। ইসলামের স্বার্থে সমালোচনা হলে তা এমনভাবে হওয়া চাই যেন প্রতিপক্ষও আপন হয়ে ওঠে।
বাতিল ফিরকার লোকদের ও বিধর্মীদের সমালোচনার ক্ষেত্রেও উপরোক্ত নীতি প্রযোজ্য। । অশালীন ভাষার ব্যবহার ও গালিগালাজ তাদের বেলায়ও নিষিদ্ধ। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে,
ولا تسببوا الذين يدعون من دون الله فيسبوا الله عدوا بغير علم.
অর্থাৎ, যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য উপাস্যদের ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না, তাহলে তারাও অজ্ঞতাবশত শত্রুতায় এসে আল্লাহকে গালি দিয়ে বসবে। (সূরা আনআম: ১০৮)
ছোটখাটো শাখাগত বিষয়ে আপনার সঙ্গে কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর মতবিরোধ থাকতে পারে, তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে বা লিখতে গেলেও আপনাকে সমালোচনার এই মাপকাঠি অনুসরণ করে চলতে হবে। শালীন ও ভারসাম্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে হবে। মার্জিত ও মোলায়েম ভাষা ব্যবহার করতে হবে। যার সমালোচনা করবেন তার ব্যক্তি সম্মান রক্ষা করে কথা বলতে হবে। অতএব তার ব্যাপারে সে বলে- এরূপ না বলে তিনি বলেন- এরূপ বলুন। তিনি তার লোকজনের কাছে আলেম মাওলানা বা পীর দরবেশ হিসেবে পরিচিত থাকলে আপনার দৃষ্টিতে সেরূপ আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য না হলেও বলুন, মাওলানা অমুক এরূপ বলেন, বা অমুক পীর সাহেব এরূপ বলেন। এরপর আপনার যা সমালোচনা করার করুন। এভাবে আপনি তার সমালোচনা করলেও তিনি ও তার অনুসারীগণ অন্তত আপনার ভদ্রতা ও শালীনতায় মুগ্ধ না হয়ে পারবে না, যা তাদেরকে আপনার কথা মানতে উদ্বুদ্ধ করতেও পারে। এর বিপরীত করলে তারা হয়তো আপনার কথা পড়েও দেখবে না এই ভেবে যে, তার মধ্যে তো শালীনতা ভদ্রতাই নেই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুম সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে যে দাওয়াতী পত্র দিয়েছিলেন তাতে রুম সম্রাটকে ‘আজিমুর রূম’ তথা রুমের প্রধান বা রুমের বড় সম্মানিত ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছিলেন। যদিও ইসলামের বিচারে সে এমন নয়। কিন্তু তার লোকদের কাছে সে এমন ছিল বিধায়ই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা করেছিলেন। এ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা চাই। আগেও বলেছি অশ্লীল ভাষা, গালিগালাজ ও অসম্মানমূলক অভিব্যক্তি ইত্যাদির প্রয়োগ দ্বারা মনের ঝাল মেটানো যায় কিন্তু তা দ্বারা কাউকে কাছে টানা যায় না। ইসলামের স্বার্থে সমালোচনা হলে তা এমনভাবে হওয়া চাই যেন প্রতিপক্ষকেও কাছে টানা যায়, প্রতিপক্ষও আপন হয়ে ওঠে।
(৩) সমালোচনায় ভারসাম্য থাকা চাই। ঢালাও সমালোচনা না হওয়া চাই। প্রয়োজনে কারও দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতে হলেও এমনভাবে আলোচনা না করা যেন অনুমতি হয় তার আপাদ-মস্তক সম্পূর্ণটাই দোষে ভরা, তার মধ্যে বুঝি ভাল কোন দিকই নেই। বরং তার মধ্যে বিশেষ ভাল কোন দিক উল্লেখ করার মত থাকলে তাও উল্লেখ করা চাই। যাতে তার বিশেষ ভালটি থেকে উপকার লাভ করা যায়। কোন ফিরকা বা দলের সমালোচনা করলে সেই ফিরকা বা দলের মধ্যে কেউ ভাল বা ব্যতিক্রম থাকলে তারও উল্লেখ থাকা চাই, ঢালাওভাবে সকলের সমালোচনা না হওয়া চাই। ইয়াহূদীরা ইসলাম ও মুসলমানদের বড় দুশমন। আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে কারীমে তাদের বহু কুকীর্তির কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ তাদের সমালোচনা করেছেন। সাথে সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখ যারা ভাল ছিলেন তাদের প্রশংসাও করেছেন ।

(দ্রষ্টব্য: সূরা আলে ইমরান: ১১৩-১১৪ আয়াতদ্বয়) এমনিভাবে কুরআনে কারীমে খ্রিস্টানদের সমালোচনা করা হলেও হাবশার খ্রিস্টান -যারা ভাল ছিল- তাদের প্রশংসাও করা হয়েছে। (দ্রষ্টব্য: সূরা মায়িদা: ১৮২) এ থেকে ঢালাও সমালোচনা না করার নীতি প্রমাণিত হয়।
আর একটা উদাহরণ দেই। মনে করুন আপনি কোন একটা গ্রন্থের একটা দু’টো ভুল-বিচ্যুতি নিয়ে সমালোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছেন। অথচ সে গ্রন্থটিতে উল্লেখ করার মত বহু উপকারী ও ভাল বিষয়ও রয়েছে যেগুলো দ্বারা মানুষের প্রচুর ফায়দা হচ্ছে বা হতে পারে। তাহলে সমালোচনার বিষয়গুলো তুলে ধরার সাথে সাথে সে গ্রন্থটির ভাল দিকগুলোও ব্যক্ত করা চাই। অন্যথায় গ্রন্থটির প্রতি অবিচার করা হবে, ভারসাম্য নষ্ট হবে।গ্রন্থটির বিষয় বিশেষের সমালোচনা করতে হলেও তার উল্লেখযোগ্য ভাল দিকগুলোও বর্ণনা করা চাই, তাহলেই ভারসাম্য রক্ষা হবে, তাহলেই গ্রন্থটির প্রতি অবিচার থেকে বিরত থাকা হবে। অন্যথায় মানুষের লেখা কোন গ্রন্থই এমন নেই যা সম্পূর্ণই ভুল-বিচ্যুতি মুক্ত। এখন কোন গ্রন্থের শুধু কয়েকটা ভুল তুলে ধরে সে গ্রন্থটিকে ঢালাওভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে দেখানোর নীতি গ্রহণ করা হলে মানুষের লেখা সব গ্রন্থকেই অগ্রহণযোগ্য বলে দেখানো যাবে। যেমন ধরুন বুখারী শরীফের সর্বশ্রেষ্ঠ শরাহ গ্রন্থ ইবনে হাজার আসকালানী রচিত ফাতহুল বারী। বুখারী শরীফের শ্রেষ্ঠ ও অনন্য শরাহ গ্রন্থ হিসেবে এবং রেফারেন্স বুক হিসেবে সকলেই এটিকে গ্রহণ করেছেন। অথচ এতে যে ভুল-বিচ্যুতি বা সমালোচনার মত কোনো বিষয় একেবারেই নেই তা নয়। আল্লামা আইনী উমদাতুল কারী গ্রন্থে ফাতহুল বারির অনেক বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তার বহু ভুল তুলে ধরেছেন। আরও অনেকে ফাতহুল বারির দু’চারটে ভুল ধরেছেন। এখন কেউ যদি ফাতহুল বারী গ্রন্থের ভাল ও গ্রহণযোগ্যতার দিকগুলো সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু এ রকম বিশ পঞ্চাশটা ভুল একত্র করে সেগুলোর সমালোচনা করতে গিয়ে সেগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন মনে হয় এ গ্রন্থটি তাহলে অসংখ্য ভুলে ভরা, অতএব এ গ্রন্থটি বর্জনযোগ্য, তাহলে সেটা হবে ভারসাম্যহীন সমালোচনা। সেটা হবে ফাতহুল বারির প্রতি অবিচার। তবে হাঁ কোন গ্রন্থ যদি লেখাই হয়ে থাকে কোন বাতিল মতাদর্শ প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, তাহলে তার ভাল দিকগুলো তুলে ধরে কাউকে তার প্রতি আকৃষ্ট করা সংগত নয়। কেননা সার্বিকভাবে সে গ্রন্থটা বিভ্রান্তিরই সহায়ক।
(৪) সমালোচনা যেন কারও প্রচার প্রসিদ্ধির কারণ না ঘটে। কোন বাতিলপন্থী বা ভণ্ড যদি তার সীমিত পরিসরের বাইরে অপরিজ্ঞাত থাকে, তার ভুল-ভ্রান্তি সম্বন্ধে যদি সমাজে তেমন জানাজানি না হয়ে থাকে, তাহলে প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে সীমিত পরিসরে তার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু কোন বইপত্রে বা জাতীয় পর্যায়ের কোন প্ল্যাটফর্মে তাকে নিয়ে সমালোচনা করা সংগত নয়। কেননা তাতে তার প্রচার-প্রসিদ্ধি ঘটবে। আর তার প্রচার প্রসিদ্ধি ঘটা তার ভ্রান্ত মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। কেননা বহু লোকের স্বভাব এমন আছে তারা নতুন কিছু শুনলেই তার প্রতি কৌতুহলী হয়ে ওঠে, এমনকি তার অনুসারীও হয়ে যায়। অতএব এরূপ লোকের সমালোচনা বনাম তার প্রচার-প্রসার ঘটানো থেকে বিরত থাকাই সংগত। তার সমালোচনা না করলেই তথা তার আলোচনা না ছড়ালেই বরং একসময় সে এবং তার ভ্রান্ত মতবাদ আপনা আপনি মরে যাবে। পক্ষান্তরে তার সম্বন্ধে আলোচনা-সমালোচনা করলে সে মরা-থাকা-অবস্থা হতে জেগে উঠবে। সারকথা তার সম্বন্ধে আলোচনা-সমালোচনা হল একজন অখ্যাতকে খ্যাত করে দেয়া। আর আলোচনা-সমালোচনা থেকে বিরত থাকা হল অখ্যাতকে অখ্যাত থেকেই মরতে দেয়া। ইমাম মুসলিম রহ, মুকাদ্দামায়ে মুসলিমে এরকম একটা প্রসঙ্গে বলেছেন,
الاعراض عن القول المطرح أحرى لاماتته وإخمال ذكر قايله.
অর্থাৎ পতিত বক্তব্যের উল্লেখ থেকে বিরত থাকাই তাকে মেরে ফেলার এবং তার প্রবক্তাকে অখ্যাত রাখার অধিকতর উপযোগী পন্থা।
(৫) সমালোচনার নিয়ত ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে ইসলাহ-সংশোধন ও সতর্ককরণ। কাউকে হেয় করা বা তিরস্কার করা নয়। পূর্বে একটা প্রসঙ্গের আওতায় এটা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের সাবধান থাকা চাই এবং মনে রাখা চাই যে, কোন পাপ বা অপরাধের কারণে কাউকে হেয়-তিরস্কার করলে হেয়-তিরষ্কারকারীকে আল্লাহ সেই পাপে জড়িয়ে দিতে পারেন। তিরমিযী শরীফের এক হাদীছে এসেছে- রসুল সাল্লাল্লাহু ইলাহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
مَنْ عَيَّرَ أَخَاهُ بِذَنْبٍ لَمْ يَمُتْ حَتَّى يَعْمَلَهُ. أَخْرَجَهُ التِّرْمِذِيُّ وَحَسَّنَهُ، وَسَنَدُهُ مُنْقَطِعٌ.
অর্থাৎ যে লোক কোন পাপের কারণে তার ভাইয়ের নিন্দা-তিরষ্কার করবে সে ঐ পাপ না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। এ হাদীছের সনদে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও নিম্নোক্ত হাদীছ দ্বারা তার অর্থ সমর্থিত হয় বিধায় ইস্তিদলালযোগ্য-

আয়াশ আব্দুল্লাহ, [21.10.21 19:44]
عَنْ وَاثِلَةَ بْنِ الأَسْقَعِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُظْهِرِ الشَّمَاتَةَ لأَخِيكَ فَيَرْحَمُهُ اللَّهُ وَيَبْتَلِيكَ ـ
সাহাবা ও তাবিয়ী থেকেও উক্ত হাদীছের বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। যেমন-
قَالَ إِبْرَاهِيم: إِنِّي لأرى الشَّيْء، فأكره أَن أعيبه مَخَافَة أَن أبتلى بِهِ، إِن عَبْد اللَّهِ، كَانَ يَقُول: إِن الْبلَاء مُوكل بالْقَوْل. (شرح السنة للبغوي).
অর্থাৎ, হযরত ইবরাহীম নাখায়ী রহ, বলেছেন, আমি কোন জিনিস দেখে তার সমালোচনা করতে ভয় পাই পাছে আবার আমি না তাতে জড়িয়ে পড়ি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা, বলতেন, মুখের কথায় মুসীবত চেপে বসে। (শরহুস সুন্নাহ)

সমালোচনার নীতিমালা প্রসঙ্গে এতক্ষণের দীর্ঘ আলোচনার সারকথা হল- ইসলামে সমালোচনার নীতিমালার মধ্যে রয়েছে বিশেষ ১০ টি বিষয়। যথা:-
(১) সমালোচনা হতে হবে বাস্তবসম্মত।
(২) সমালোচনার অনুকূলে যথাযথ দলীল-প্রমাণ উপস্থাপিত হতে হবে।
(৩) কোন বিষয়ে সমালোচনা করার পূর্বে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে।
(৪) সমালোচনাকারির মধ্যে যে বিষয় নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক কিছু বলবেন সে বিষয় সম্বন্ধে যথাযথ ও পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।
(৫) কোন ব্যক্তির সমালোচনা করতে হলে তার চেয়ে বেশি, ন্যুনতম তার সমপর্যায়ের একাডেমিক যোগ্যতা থাকতে হবে।
(৬) যে তিনটি ক্ষেত্রে গীবত তথা পশ্চাতে দোষ-বদনাম বলা যায় কেবল সে তিনটি ক্ষেত্রেই সমালোচনার অনুমতি রয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে সমালোচনা পাপকর্ম।
(৭) সমালোচনার ভাষা হওয়া চাই ভদ্রোচিত, শালীন, মার্জিত ও ভারসাম্যপূর্ণ।
(৮) ঢালাও সমালোচনা না হওয়া চাই।
(৯) সমালোচনা যেন কারও প্রচার প্রসিদ্ধির কারণ না ঘটে।
(১০) সমালোচনার নিয়ত ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে ইসলাহ-সংশোধন ও সতর্ককরণ। কাউকে হেয় করা বা নিছক নিন্দা-তিরস্কার করা নয়।
আল্লাহ্ আমাদের সবকিছুকে দোরস্ত করে দেন। আমীন!

পঠিত : ৭৭৬ বার

মন্তব্য: ০