Alapon

৭ নভেম্বরে কী হয়েছিল বাংলাদেশে?



২ থেকে ৭ নভেম্বর । বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কুয়াশাচ্ছন এবং ঘোলাটে অধ্যায়। অনেকে এটাকে বলেন “কলঙ্কিত অধ্যায়’ কিংবা “মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ আবার অনেকেই বলেন ‘জাতীয় সংহতি এবং বিপ্লব দিবস’।

যারা এটাকে “কলঙ্কিত অধ্যায়’ বলেন তারা যে এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলেন না তার প্রমাণ কী? আর যারা বলেন ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস’ তারাই বা কতটুকু সত্যাশ্রয়ী?

মজার বিষয় হলো দুপক্ষই এখানে কর্নেল তাহেরকে উহ্য রাখেন। অথচ এই বিপ্লবের/ হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক তাহের।

যারা বলেন বিপ্লব তারাই বিপ্লবের নায়ক তাহেরকে অস্বীকার করে জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। আবার যারা বলেন হত্যাযজ্ঞ তারা খুব ভালোবাসা দেখান খালেদ মোশাররফের প্রতি। আর মূল হত্যাকারী তাহেরকে রাখেন উহ্য। তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট জিয়াউর রহমান।

এটাই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র। তারা যে যার মতো মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে। যেভাবে তাদের সুবিধা।

মূল কথায় আসা যাক। আন্দোলনে শেখ মুজিব দক্ষ হলেও দেশ পরিচালনায় তার দক্ষতার ঘাটতি ছিল প্রকট। তাছাড়া কিছু ঘটনা এবং তার অপরিপক্ক কিছু সিদ্ধান্ত জনগন ও সেনাবাহিনীতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো রক্ষীবাহিনী গঠন।

মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মোটেই বিশ্বাস করতেন না মুজিব। এর কারণ তারা প্রায়ই অবাধ্য আচরণ করতেন। ৭১ এ সফল ক্যু করার কারণে তারা চেইন অব কমান্ড মানতেন না। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সাথে তাদের ছিল ওপেন যোগাযোগ। অনেকে অনুমতি ছাড়াই ভারত সফর করতেন নিজের ইচ্ছানুযায়ী।

সেনাবাহিনী থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মুজিব সম্পূর্ণ নিজের মত করে সেনাবাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বি একটি একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করেছেন। কিন্তু ঐ বাহিনী মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী না হলেও তার চরিত্র অনুযায়ী হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ.এন.এম. নূরুজ্জামান বীর উত্তম ছিলেন রক্ষীবাহিনীর ১ম ডিরেক্টর। মুজিব তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। মুজিবের প্রশ্রয়ে তারা সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। গুন্ডামী, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, ছিনতাইসহ এমন কোন অপরাধ বাকী ছিল না যা তারা করেনি।

সেনাবাহিনীকে কন্ট্রোল করার জন্য তিনি আরেকটি ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী সেনা অফিসারদের নিয়ে এসে দেশের সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশে দশম রাষ্ট্রপতি লেজেহুমু এরশাদ। এই দুটো বিষয় সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়েছে প্রচুর।

একই সাথে মুজিব রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর চালিয়েছেন নিষ্ঠুরতম নির্যাতন। এই নির্যাতনেও ব্যবহার করা হয়েছে রক্ষীবাহিনী।

সব মিলিয়ে মুজিবের ভয়ংকর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পুরো বাংলাদেশের অবস্থান ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। আর সে সময়ে এর সদ্ব্যবহার করে সেনাবাহীনির কিছু ক্ষমতালোভী, উচ্ছৃঙ্খল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। তারা মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে।

এটি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের কাজ হলেও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোন বাধাই আসেনি। এর দ্বারা বলা যায় পুরো সেনাবাহিনী হত্যাকান্ডে জড়িত না হলেও এই হত্যাকান্ডে সবার সাপোর্ট ছিল। তখন সেনাপ্রধান ছিল কে এম শফিউল্লাহ।

জাসদের উপরে নির্যাতন চালানোতে জাসদও শেখ মুজিবের পতন চেয়েছিলো। জাসদের মধ্যে কেউ কেউ শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন চেয়েছিল।

১৫ আগস্ট মুজিব হত্যার মাধ্যমে জাসদের পরোক্ষ ভূমিকায় নতুন পটপরিবর্তন হয়। নানান ঘটনা ও উপঘটনার মধ্য দিয়ে পাল্টা ক্যু হয় মেজর ফারুক. মেজর রশিদ এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ-এর গড়া সরকারের বিরুদ্ধে। আরও একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৫- তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাকে সহায়তা করে রক্ষীবাহিনী।

৬ নভেম্বরের মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসে একদল সৈন্য অস্ত্রাগারের কপাট খুলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সূচনা করে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। অনুঘটকের কাজটি করেছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এটি ছিল প্রথাবিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের একটি সংগঠন। বলা চলে সেনানিবাসগুলোতে জাসদের শাখা বা অঙ্গসংগঠন।

সৈনিকদের সংগঠিত করার কাজটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এর ধারণাগত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় জাসদ তৈরি হওয়ার আগেই। বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের ওপর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ২০ অক্টোবর ১৯৭২ সাবেক ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিরক্ষা বিষয়ে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো পেশাদার সেনাবাহিনী বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দেশরক্ষা বাহিনী জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল এবং যে দেশ সমাজতন্ত্রমুখী, সে দেশে পেশাদার সেনাবাহিনী না রেখে “পিপলস আর্মি” গঠন করাই বেশি যুক্তিসংগত।’ (গণকণ্ঠ, ২১ অক্টোবর ১৯৭২)।

৩১ অক্টোবর ১৯৭২ জাসদের জন্মমুহূর্তে ‘সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার পন্থা অবলম্বন করার’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল (গণকণ্ঠ, ১ নভেম্বর ১৯৭২)।

মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মো. আবদুল জলিল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে জাসদে যোগ দিয়েছিলেন। সেনাছাউনিগুলোতে সৈনিকদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজটি তিনিই শুরু করেন। সশস্ত্র বাহিনীর নন-কমিশন্ড ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররাই ছিলেন মাঠপর্যায়ের সংগঠক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন করপোরাল আলতাফ হোসেন, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, নায়েব সুবেদার বজলুর রহমান, নায়েব সুবেদার মাহবুবুর রহমান, নায়েব সুবেদার জালাল, নায়েক আবদুল বারী, হাবিলদার আবদুল বারেক প্রমুখ।

১৭ মার্চ ১৯৭৪, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে মেজর জলিলসহ কয়েকজন জাসদ নেতা গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে চিঠি পাঠিয়ে জলিল সামরিক বাহিনীতে যাঁরা সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলেন। তাহের সেনাবাহিনী ছেড়ে এলেও সরকারি চাকরিতে বহাল ছিলেন এবং গোপনে জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এরপর জাসদের পক্ষ থেকে সৈনিক সংস্থার দেখভাল তিনিই করতেন।

সেনাবাহিনীতে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এবং জিয়ার প্রশ্রয়ে সৈনিক সংস্থা বিস্তৃতি লাভ করেছিল। জিয়ার মধ্যে সেনাপ্রধান হতে না পারার ক্ষোভ ছিল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিয়ার পক্ষে তাহের খুব ভালোভাবেই জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল সাধারণ সৈন্যদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন।

এদের একটা ছোট অংশ জাসদের রাজনীতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল। তাঁরা ‘সামাজিক বিপ্লবের’ একটা ধারণা লালন করলেও বেশির ভাগ সৈন্য ছিল এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী, তথা আওয়ামী লীগ ও তার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের ঘোর বিরোধী। সেনাবাহিনীর রাজনীতিকীকরণ শুরু হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। সৈনিক সংস্থা এই রাজনীতিকীকরণকে আরও উসকে দেয়।

আবু তাহেরকে নিয়ে পরে অনেক গল্প তৈরি হয়েছে। তিনি সৈনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নন। ১৯৭৩ সাল থেকেই জাসদ নেতৃত্ব একটা ‘বিপ্লবী পার্টি’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় চুয়াত্তরের জুনে ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি চলছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম। জাসদের বিকাশমান বিপ্লবী পার্টির কার্যক্রমের দায়িত্ব একেকজনের ছিল একেক রকম। তাহের সেনাবাহিনীর কাজটি দেখভাল এবং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন। দলের সুপ্রিম নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে জিয়া সেনাপ্রধান হন। কিন্তু একচ্ছত্র ক্ষমতা তিনি পাননি। জিয়া তখনই রাষ্ট্রপতি হতে উন্মুখ ছিলেন এবং তাহের এ জন্য ফারুক-রশিদের কাছে দেনদরবারও করেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ওই সময় জাসদের প্রধান নেতারা হয় জেলে, নয়তো ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে। তাহেরের হাতে জাসদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে যায়। তিনি অনেক বিষয়েই জাসদের রাজনৈতিক ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন।

৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারণে মোশতাক-জিয়ার বিরুদ্ধে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। অসামরিক নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক সরকার যাতে গঠিত না হতে পারে সে জন্য চারজন জাতীয় নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। সেনানিবাসগুলো অস্থির হয়ে পড়ে।

জাসদ এই সুযোগটা নিতে চেয়েছিল। ষাটের দশকের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির উত্তরাধিকার বহনকারী জাসদের মূল নেতৃত্বের চিন্তায় তখনো কাজ করছে ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭১-এর গণসংগ্রামের মডেল। সিদ্ধান্ত হলো ৯ নভেম্বর থেকে লাগাতার হরতাল হবে এবং ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে শ্রমিকদের জড়ো করে ঢাকায় ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করতে হবে।

৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় বসল জাসদের বিপ্লবী পার্টির ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা। হঠাৎ করেই সেখানে তাহের এসে উপস্থিত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসে নিজ গৃহে অন্তরীণ জিয়ার হাতের লেখা একটা চিরকুট পড়ে শোনান। চিরকুটটা ইংরেজিতে। বাংলা তরজমা করলে তার অর্থ হবে—আমি বন্দী, নেতৃত্ব দিতে পারছি না। আমার লোকেরা তৈরি। তুমি যদি নেতৃত্ব দাও, আমার লোকেরা তোমার সঙ্গে যোগ দেবে। (জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন)।

তাহের প্রস্তাব দেন, জিয়াকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় সভায় উপস্থিত জাসদ নেতারা বেশ বেকায়দায় ছিলেন। তাঁরা একপর্যায়ে তাহেরের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। অবশ্য তাহের জাসদ নেতাদের সম্মতির অপেক্ষায় থাকেননি। ওই দিন দুপুরেই তিনি সৈনিক সংস্থার সংগঠকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, মধ্যরাতে অভ্যুত্থান শুরু হবে।

অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য হলো
১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করা;
২. বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করা;
৩. একটা বিপ্লবী মিলিটারি কমান্ড কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা;
৪. রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া;
৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা;
৬. বাকশাল বাদে অন্য সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন; এবং
৭. সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করা।

রাত ১২টায় শুরু হয় অভ্যুত্থান। প্রথম প্রহরেই জিয়া মুক্ত হন। ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই জিয়া-তাহেরের সমীকরণ ভেঙে যায়। ভোরে বেতারের বুলেটিনে সবাই জানতে পারেন, সিপাহি বিপ্লব হয়েছে এবং জিয়া মুক্ত হয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক-লরি ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। আমজনতা পথের পাশে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে, হাততালি দেয় এবং অনেকে জীবনে প্রথমবারের মতো ট্যাংকে বা সেনাবাহিনীর ট্রাকে চড়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।

জনতা ও সৈনিকদের এমন সমর্থন পাওয়ার মূল কারণ ছিল মুজিবের ভয়ংকর দুঃশাসন। মানুষ সেই দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো, সেটা যেভাবেই হোক। খালেদ মোশাররফ মুজিবের পক্ষ হয়ে পাল্টা ক্যু করার কারণে মানুষ খালেদকে ঘৃণা করতে শুরু করে। রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনও অন্যতম কারণ ছিলো।

জাসদের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি যে ছিল না, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কয়েক শ সৈনিক ও জাসদ কর্মী একটি ট্যাংক নিয়ে ৭ নভেম্বর ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন জাসদ নেতা এম এ আউয়াল, মো. শাহজাহান ও মির্জা সুলতান রাজা। কারাগারে তখন শত শত জাসদ কর্মী। তাঁরা তিনজন সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখি।’ তাঁরা আর ফিরে আসেননি। ওই কর্মীরা অনেক দিন কারাবন্দী ছিলেন। কেউ দুই বছর, কেউ তিন বছর, কেউবা তার চেয়েও বেশি।

তাহের ক্ষমতার লড়াইয়ে ছিটকে পড়লেও নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ তাহের সরাসরি জিয়ার সঙ্গে সংঘাতে গেলেন। তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন এবং একই সঙ্গে জিয়ার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাসদকেও ডোবালেন। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল স্বস্তি এবং শান্তি। তারা অস্থিরচিত্তের তাহের ও জাসদের পক্ষে দাঁড়ায়নি।

নেপথ্য নায়ক তাহের হলেও জনতার সামনে নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত হয় জিয়াউর রহমান
জিয়া-তাহেরের এই ‘বিপ্লব’ ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর সকালে বন্দী অবস্থায় খালেদ নিহত হলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর দুজন সহযোগী কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারও নিহত হন। এই তিনজনই ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের স্মরণে ওই দিনটি অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেন।

ক্ষমতার ত্রিভুজ লড়াইয়ে জিয়া-তাহেরের সম্মিলিত শক্তির কাছে খালেদ হেরে গিয়েছিলেন। পরে জিয়া-তাহেরের মধ্যকার দ্বন্দ্বে তাহের ছিটকে পড়েন। ২১ জুলাই ১৯৭৬ একটা মামলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ক্ষমতার মূল লড়াইয়ে আবেগ বা মান-অভিমানের কোনো জায়গা নেই। হেরে গেলে মূল্য দিতে হয়, এটাই চরম সত্য।

সৈনিক সংস্থার সংগঠকেরা অনেকেই গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ আত্মগোপন করেন। এঁদের সামনের কাতারের নেতা করপোরাল আলতাফের অনুপস্থিতিতে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার একটা গ্রামে টাঙ্গাইলের গণবাহিনী কমান্ডার খন্দকার আবদুল বাতেনসহ একদল কৃষকের সঙ্গে সভা করার সময় পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে তিনি নিহত হন। খন্দকার বাতেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আলতাফের লাশ পাওয়া যায়নি। বাতেন পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছিলেন।

এতে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। ধারণা করা হয় ৭ই নভেম্বরে কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াউর রহমান শংকিত ছিলেন। আবার জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে তাহের চেয়েছে মূলত জাসদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ক্ষমতা নিষ্কন্টক রাখার জন্যই তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন এবং হত্যা করেন।

মুজিবের মত জিয়াও সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাস করতেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে তাই তিনি অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের (যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন) পদোন্নতি দেন।

জিয়ার আমলে ক্যু হয়েছে ২২ বার। এর মধ্যে ২১ বার তিনি তা ঠেকাতে পেরেছেন। ২২ তম ক্যু তে প্রাণ হারান। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই নিজেদের রক্ত পান করেছে প্রায় দশ বছর। ধারণা করা হয় এসব ক্যু'তে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুই সহস্রাধিক সেনাসদস্য।

তথ্যসূত্র:
১- জাসদের উত্থান পতন, অস্থির সময়ের রাজনীতি, মহিউদ্দিন আহমদ
২- অসমাপ্ত বিপ্লব, লরেন্স লিফশুলজ
৩- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.)

পঠিত : ৩৪০ বার

মন্তব্য: ০