Alapon

নিজের পরিবর্তন এবং কুরআনিক মিশন...



আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা কুরআনে এমন মানুষদের সম্পর্কে কথা বলেছেন যারা ধর্মীয় উপদেশ শুনে এবং একেবারে সর্বোত্তম উপদেশ শুনে কিন্তু তারপরেও উপদেশগুলোকে এক দিকে ফেলে রাখে। এমনকি জুমুয়ার নামাজেও যাওয়া দরকার এজন্য যায় এরপর নিজের ধর্মহীন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। এটা একটা রুটিনের কাজে পরিণত হয়।

দুঃখজনকভাবে, জুমুয়ার নামাজকে আমরা এমন একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখি না যা আমাদের জীবন পরিবর্তন করে দিবে; মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করে দিবে। এ ধরণের মানুষেরা ধর্মীয় উপদেশ থেকে কোনো উপকার পায় না।

এই হিসেবে চিন্তা করলে...আশা করি আমরা এমন না...যে ব্যক্তি ধর্মীয় উপদেশ থেকে উপকার পায় না তার অবস্থা রাসূলুল্লাহ (স) এর যুগের এমন মানুষদের থেকে ভিন্ন নয়, যাদের আল্লাহর কালাম সরাসরি শ্রবণ করার সুযোগ হয়েছিল কিন্তু তবুও এর প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পাশ কাটিয়ে চলে যেতো। হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমরা মুসলিম আর তারা কুফফার; এই পার্থক্যটা আছে।

কিন্তু, এর বাইরে আচার-আচরণের বেলায় তো আমরা একই। তাই না? আমি উপদেশ শুনি আর আপনিও শুনেন তারপর বলি— "খুব সুন্দর উপদেশ! আমার মনে হয় আমি এটা আগে থেকেই জানি।" এরপর নিজের মত করে চলতে থাকেন এবং আচার-আচরণে নেই কোনো পরিবর্তন। ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কিছুই বদলাইনি। মক্কার কুফফারদের বিরুদ্ধে শুধু এই অভিযোগ ছিল না যে, তাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না; তাদের কাজে-কর্মেও ইসলামের বিধি-নিষেধের কোনো ছোঁয়া ছিল না।

ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং যে, মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনে আল্লাহ শুধু কুফফারদের বিশ্বাসের সমালোচনা করেননি, তিনি এমনকি তাদের কাজেরও সমালোচনা করেছেন। যেমন, বিচার দিবসে তিনি কাফেরদের সম্পর্কে বলেন— "فَلَا صَدَّقَ وَ لَا صَلّٰی - সুতরাং সে বিশ্বাসও করেনি এবং সালাতও আদায় করেনি।”

কাফেরের ব্যাপারে কেন অভিযোগ করা হচ্ছে যে, সে নামাজ পড়েনি। কারণ, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলছেন হ্যাঁ, আমলসমূহের হিশেব রাখা হচ্ছে এমনকি যারা কুফরী করে তাদেরও। এমনকি তাদের কাজেরও হিশেব রাখা হচ্ছে।

কোন কারণে সে নামাজ পড়েনি? কোন কারণে সে ঈমান আনেনি? যদি সে ঈমান আনত তাহলে তার কাজেও সেটার প্রতিফলন ঘটতো। সে তখন নামাজ পড়তো। কোনো না কোনোভাবে এর প্রকাশ ঘটতো। সুতরাং, সূরাতুল ফুরকানের এই অংশটি যা আমি আরবিতে আপনাদের সামনে তিলাওয়াত করেছি, এতে বিচার দিবসের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞা থেকে বলেছেন- وَ کَانَ یَوۡمًا عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ عَسِیۡرًا - "আর কাফিরদের সে দিনটি জন্য হবে বড়ই কঠিন।" (২৫:২৬) অবিশ্বাসীদের জন্য, কাফেরদের জন্য।

কিন্তু, পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেননি ইয়াওমা ইয়াউদ্দুল কা-ফিরু, তিনি বলেছেন— وَ یَوۡمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیۡهِ - "আর সেদিন যালিম নিজের হাত দু’টো কামড়িয়ে বলবে…" আপনাদের হয়তো হাত কামড়ানোর অভ্যাস নাও থাকতে পারে। কিন্তু এটা প্রাচীন আরবিতে কথা বলার একটি ধরণ। কারো চরম আক্ষেপ বুঝাতে তারা এ শব্দগুলো ব্যবহার করত। সে কাঁদতে থাকবে, বিলাপ করতে থাকবে, প্রচণ্ড মরিয়া হয়ে বলবে— কী করলাম আমি!! আগের দিনের হাত কামড়ানো আজকের দিনের দুইহাতে মাথার চুল ধরে টেনে টেনে আক্ষেপ করার মত। "ও আল্লাহ! কি হচ্ছে! আমার গাড়ির এ কি হাল!!" "আমার বাড়ির একি দশা!!" " হায়! হায়! আমার চাকরি চলে গেলো!!"

এরকম হতচকিত মুহূর্ত, যখন আপনার আক্ষেপের আর শেষ থাকে না, এমন মুহূর্ত বুঝাতে প্রাচীন আরবিতে হাত কামড়ানোর কথা বলা হত। তাই, যদি আপনার হাত কামড়ানোর অভ্যাস না থাকে তার মানে এই না যে, এই আয়াতটির সাথে আপনার সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি আপনাদের বলছি, শেষ বিচারের দিনে ব্যক্তি এমন হতাশায় নিমজ্জিত হবে যে, সে অযৌক্তিক সব আচরণ করতে থাকবে।

এই পৃথিবীতেই আপনারা হয়তো এ ধরণের অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকবেন। এমন কারো কথা যদি জানেন যে প্রচণ্ড চাপে আছে বা অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ তার পরিবারের কোনো সদস্যের সার্জারি চলছে। ওয়েটিং রুমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সে কি তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে? না। পায়চারি করতে থাকে, এভাবে হাত ধরে রাখে। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকে। চরম অস্থিরতা এবং উৎকণ্ঠায় সময় পার করে বা খবর শুনে হাতের তালু দিয়ে মুখ চেপে ধরে।

বিচার দিবস সম্পর্কে আল্লাহ বর্ণনা করেন— অপরাধী তার উভয় হাত কামড়াতে থাকবে। এক হাত নয়। 'ইয়াদাইহি' অর্থ উভয় হাত।

কেন এই হতবিহবল অবস্থা এবং চরম আক্ষেপ? সে বলবে...আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বর্ণনা করছেন— یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِی اتَّخَذۡتُ مَعَ الرَّسُوۡلِ سَبِیۡلًا - "ইস! যদি আমি রাসূলের সাথে কোনো পথ অবলম্বন করতাম’! " (২৫:২৭) সে বলবে না— "ইয়া লাইতানি আ-মানতু বিররাসূল- যদি আমি রাসূলের প্রতি ঈমান আনতাম!" আয়াতে এটা বলা হয়নি। আয়াত বলছে— "যদি আমি রাসূলের সাথে কোনো পথ অবলম্বন করতাম’!"

এখানে যে ব্যাপারটার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, আমরা যে শুধু রাসূলুল্লাহ (স) এর প্রতি ঈমান আনি তাই নয়— যেটা আমরা ইতোমধ্যে এনেছি, আলহামদুলিল্লাহ্‌— বরং আমরা এই মানুষটির জীবন পদ্ধতিও অবলম্বন করবো। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম। আমরা তাঁর অভ্যাসগুলো মেনে চলব, তাঁর আচার-আচরণ, তাঁর চরিত্র, যেভাবে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন, যেভাবে তিনি মানুষের প্রতি দয়া দেখাতেন, যেভাবে তিনি অন্যদের তাঁর হাসি উপহার দিতেন, যেভাবে তিনি অন্যদের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতেন, যেভাবে তিনি অমুলসিমদের সাথে আচরণ করতেন, যেভাবে তিনি মুসলিমদের সাথে আচরণ করতেন, যেভাবে তিনি বড়দের সাথে আচরণ করতেন, যেভাবে তিনি ছোটদের সাথে আচরণ করতেন, যেভাবে তিনি স্ত্রীদের সাথে আচরণ করতেন, যেভাবে তিনি বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতেন। এটাই তাঁর পথ। এটাই তাঁর সাবিল।

যদি চান সাবিলের আধুনিক অনুবাদ এভাবে করা যায়— এটা ভাষাগত অনুবাদ নয়, সমাজতাত্ত্বিক অনুবাদ— অনুবাদটি হবে 'জীবনপদ্ধতি'।

"ইস! আমার যদি রাসূলুল্লাহ (স) এর জীবনপদ্ধতির মত কোনো জীবনপদ্ধতি থাকত।" "ইস! আমি যদি তাঁর মত করে জীবন চালাতাম!" "ইস! আমি যদি সেই পথ অবলম্বন করতাম!"

কিন্তু, 'সাবিল' দ্বারা অন্য কিছুও বুঝায়। একদিকে রাসূলুল্লাহ (স) আমাদেরকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এসেছিলেন, আমাদের মাঝে এই উপলব্ধি জাগিয়ে তোলার জন্য যে, আমরা ইচ্ছে করলে অসম্ভব রকমের ভালো মানুষ হতে পারি। অন্যদিকে, তিনি এসেছিলেন আমাদেরকে একটি মিশন দেওয়ার জন্য। শুধু নিজেরা ভালো হওয়া নয়, বরং অবশিষ্ট মানবজাতিকে ভালো করাটাও আমাদের মিশন। এটাও আমাদের রাসূল (স) এর মিশনের অংশ ছিল। আর এ পথটা অনেক দীর্ঘ এক পথ। এটা একটা সাবিল।

অতএব, আপনি শুধু নিজেকে পরিবর্তন করেই থেমে যান না, বরং এখন আপনার পরিচয় হলো— নিজের মাঝে এই পরিবর্তন নিয়ে আসার কারণে মানবজাতির অবশিষ্ট অংশের সাথেও আপনি এটা শেয়ার করতে চান।

- উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ২৭১ বার

মন্তব্য: ০