Alapon

'মানবতাবাদী কবি আল্লামা ইকবাল'



একজন মানবতাবাদী কবির গল্প শোনাবো আজ। যার কবিতা রচিত হয়েছিলো সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে। কোনো দেশ, কাল, সম্প্রদায় বা জাতির জন্য নয়। যিনি কবিতার মাধ্যমে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীর অন্যায়, অবিচার আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত বস্তুবাদী সভ্যতার খড়কুটায়!
তিনি শুধু একজন কবিই ছিলেন না, ছিলেন একজন দার্শনিক ও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের একজন দূরদর্শী রাজনীতিক। বিশ্বজনীন এ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আজো প্রাচ্য এবং প্রাশ্চাত্য আগ্রহের কমতি নেই!
হ্যাঁ, তিনি হলেন ড. মুহাম্মদ ইকবাল, যিনি আল্লামা ইকবাল নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতের অন্যতম প্রধান মুসলিম কবি। তার জন্ম ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতবর্ষের শিয়ালকোট শহরে এবং মৃত্যু ১৯৩৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে।
তিনি শিয়ালকোটে স্কটিশ মিশন কলেজ থেকে দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়াশােনা করেন এবং স্বর্ণপদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর ১৮৯৯ সালে দর্শনে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন বিষয়ক গবেষণায় পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। আল্লামা ইকবাল যখন মাস্টার্সে পড়েন, তখন স্যার টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছেই তিনি ইউরোপে উচ্চশিক্ষার অনুপ্রেরণা পান ।
তাঁর ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর ফার্সি সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ, তিনি ইরানে 'ইকবাল-ই-লাহোরী' নামে পরিচিত।
ইকবাল গদ্য-পদ্য উভয় রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। তিনি ছিলেন মুক্তছন্দ কবি ও লেখক। তিনি লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। অর্থনীতির মত জটিল বিষয় থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতার মতো বিমূর্ত বিষয় পর্যন্ত উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় ইকবাল-কাব্যের ও তার অন্যান্য রচনার অনুবাদ শুরু হয় চলতি শতকের দ্বিতীয় দশকের দিকেই ৷ ইকবালের কাব্য ও অন্যান্য রচনার অনুবাদকদের মধ্যে রয়েছেন প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের অনেক প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বাংলা ভাষায়ও ইকবালের কাব্যগ্রন্থ, কবিতা ও গদ্য রচনার অনুবাদ হয়েছে৷
আল্লামা ইকবাল তার কাব্যে নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করেছেন। তার কবিতার লাইনগুলোতে চোখ বুলালেই তা বুঝা যায়।
"ওঠো দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও।
ধনীদের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও॥
কিষাণ-মজুর পায়না যে মাঠে শ্রমের ফল।
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও॥”
(কবিতা- 'ফারমানে খোদা')
ইসলামী দর্শনের প্রথম সার্থক ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আল্লামা ইকবালকে গণ্য করা হয়।। তাঁর কবিতায় দর্শন ভাবনার প্রকাশ সুস্পষ্ট।
বিশ্বের প্রায় ডজনখানেক ভাষায় অনূদিত আল্লামা ইকবালের 'আসরারে খুদী' একটি বিখ্যাত দর্শননির্ভর কাব্যগ্রন্থ। খোদ মানে নিজে/আমি। আসরার মানে রহস্য। এই কাব্যগ্রন্থটির জন্য বৃটিশ সরকার ইকবালকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। খুদী বা আত্বা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, স্বকীয়বোধ, নিজেকে জানা এবং নিজের আসল পরিচয় উপলব্ধি করা। আল্লামা ইকবাল বলেন- 'খুদীকে এইরূপ উন্নত কর যে, তোমার প্রতিটি ভাগ্যলিপি লিখার পূর্বে খোদা যেন শুধান, কি তোমার অভিপ্রায়।'
মানুষ যখন নিজেকে জানে, নিজের আত্মা ও সত্তা সম্পর্কে পরিস্বচ্ছ ধারনা পেয়ে যায়, তখন সে আল্লাহকে চিনে ফেলে। নিজের রবের পরিচয় নিজেকে চেনার মাঝেই নিহিত।
১৯১০ সালে শুরু হয় বলকান-ত্রিপোলির যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ‘লিবীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের ফলে ইতালি অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ত্রিপোলি দখল করে নেয়। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক দুর্বলতার সুযোগে ইতালির সঙ্গে অটোমানদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বলকান লীগ অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালায় এবং প্রথম বলকান যুদ্ধের সূচনা ঘটায়।
এই যুদ্ধ আল্লামা ইকবালের মন ও মননে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মুসলিমদের ওপর নির্যাতন দেখে তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। তিনি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের প্রতি ঘৃণা অনুভব করেন।
‘রাসূলের সমীপে নিবেদন’ কবিতায় তার রক্তাক্ত হৃদয়ের দেখা পাওয়া যায়। কবিতায় কল্পনায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন রাসূলের দরবারে। রাসূল জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমার জন্য কী উপহার এনেছো?’
ইকবাল বলেন, ‘এই পৃথিবীর কোনো উপহারই আপনার শান মোতাবেক নয়। তবে আপনার জন্য আমি একটি আয়না নিয়ে এসেছি। এই আয়নায় তাকালে আপনার উম্মতের করুণ দৃশ্য দেখা যায়; দেখা যায় লিবিয়ায় শহীদদের রক্ত।’
আল্লামা ইকবালের মতাদর্শ অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতি ছাড়া মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট উত্তরণের কোনো বিকল্প পথ নেই।
আল্লামা ইকবালের কবিতায় ফুটে উঠেছে রাসূলের প্রতি গভীর ভালোবাসা।
তার কবিতার কয়েকটি লাইন -
'মুসলিমের হৃদয় শাসিত হয় মুস্তফা সা. এর ভালোবাসায়...
তিনিই আমাদের সম্মানের কারণ,
আমাদের গর্বের উৎস।'
'পশ্চিমা জ্ঞানের ঝলক আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি, চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেনি।
কারণ, আমি চোখে লাগিয়েছি মদীনার সুরমা...'
আল্লামা ইকবাল বিশ্বাস করতেন, ইসলাম ছাড়া মানুষ সফল হতে পারে না। তাঁর মতে, ইসলাম হচ্ছে একটি গতিশীল ও বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। এই বিশ্বাসটিই ছিলো তার স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্বের উৎস।
আল্লামা ইকবাল তার পুরো জীবনকাল কুরআনের ইলমে মগ্ন ছিলেন। তিনি কুরআন পড়তেন এবং কুরআন থেকে নতুন নতুন চিন্তার উদ্ভাবন করতেন। তিনি শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। নিজের যতো দুঃখ, যতো চাওয়া শেষ রাতের কান্নায় নিবেদন করতেন। শেষ রাতের এই কান্না ছিলো তার চিন্তার খোরাক, ছিলো হৃদয়ের প্রশান্তি।
আল্লামা ইকবাল ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। ভাষার সমস্যার কারণে আল্লামা ইকবালের রচনা আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে কম চর্চা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আল্লামা ইকবালের রচনার বাংলা অনুবাদ নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে তারা বিশাল জ্ঞানসমুদ্রের সন্ধান পাবে।
নানা ক্ষেত্রে আল্লামা ইকবালের রয়েছে অসামান্য অবদান। যা তাকে নিয়ে গেছে খ্যাতির আসনে। দিয়েছে অনন্য সম্মান।মানবতা ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে তিনি সবার মনে আসন করে নিয়েছেন।
গণমানুষের কবি আল্লামা ইকবাল মানুষের হৃদয়ে যুগে যুগে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন!
---------------------------------------------------------
'মানবতাবাদী কবি আল্লামা ইকবাল'
-লিখেছেন : সাজেদা হোমায়রা

তথ্যসূত্র :
১. ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তা ধারা: মুহাম্মদ আব্দুর রহীম।
২. মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন: ড: আমিনুল ইসলাম।
৩. মহাকবি ইকবাল: ফাহমিদুর রহমান।
৪. ইন্টারনেট আর্টিকেল।

পঠিত : ৮৪৩ বার

মন্তব্য: ০