Alapon

বাহার আল হায়াত : ভারতীয় প্রাচীন আলোচিত গ্রন্থ...



প্রাচীন কালে কামরূপে আসার জন্য অন্যতম নিরাপদ রাস্তা ছিল, বাংলার উপর দিয়ে বয়ে চলা নদীপথ। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা পাড়ি দিয়ে আসামের বুক চিড়ে এই পথ দিয়ে সুদূর চীন পর্যন্ত যাওয়া যেত। তখনকার দিনে চীনে যাবার এটাই অন্যতম রাস্তা ছিল। আরবি বনিকদের এই রাস্তা ছিল নখদর্পণে। তারা বিভিন্ন গঞ্জে নৌকা মেরামত ও সুগন্ধি কাঠ সংগ্রহের জন্য কিছু দিন অপেক্ষা করত। এই ফাঁকে তারা আশে পাশের অঞ্চলে মানুষদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। মূলত এদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রথম ইসলামের পরিচিতি ঘটে। সে কারণে বাংলাদেশের মুসলমান ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে সাদৃশ্যগত পার্থক্য রয়েছে।


প্রাচীন ভারতের কামরূপ অঞ্চলটি, যাদুবিদ্যার জন্য যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। আজো মানুষ লোকমুখে কামরূপের কাহিনী আগ্রহ নিয়ে শুনে থাকে। প্রাচীন কালে অন্য মুল্লুক থেকে যারাই পূর্ব ভারত কিংবা বাংলায় আসত, তারা কামরূপ যেতে কিংবা কামরূপের কিছু জ্ঞান আহরণ করতে বদ্ধ পরিকর থাকত। কেউ কৌতূহলে, কেউ ভিন্ন ধরনের একটি চিত্তাকর্ষক বিদ্যা অর্জনের নিমিত্তেই কামরূপের সাথে পরিচিত হয়েছিল। এই চিন্তা-বুদ্ধির প্রভাবে মধ্য যুগে বহু সুফি-সাধকেরাও কামরূপে আগমন করেছিল। সে কথায় পরে আসব।


বর্তমান ভারতের আসামে কামরূপ নামে একটি জিলা রয়েছে, এটি কিন্তু সেই কামরূপ নয়। প্রাচীন কালে বর্তমান বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চলের মাঝখানের একটি রহস্যময় স্থানের নামই কামরূপ বলে ধারণা করা হত। যা বর্তমানের আসাম অঞ্চলের বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এই জায়গাটি কেমন ছিল সে সম্পর্কে ইতিহাসের কিছু বর্ণনা দেখা যেতে পারে,


– ইবনে বতুতা স্বয়ং নিজেও কামরূপে এসেছিলেন এবং কিছুদিন অবস্থান করেছেন। তিনি বলেছেন, “কামরূপ জাদুবিদ্যার প্রতি অনুরাগী ও অনুশীলনের জন্য খ্যাতিমান একটি জায়গা।” – রেহলায়ে ইবনে বতুতা

– সম্রাট আকবরের অন্যতম মন্ত্রী, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বলা হয়েছে, “কামরূপের বাসিন্দারা জাদুবিদ্যার প্রতি অনেক আসক্ত।”

– বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে তথা লখণৌতিতে কর্মরত মোগল সরকারী কর্মকর্তা “ফাতেহা-ই-ইবরাহ” গ্রন্থে আরো নির্দিষ্ট করে লিখেছিলেন যে, “কামরূপের খুতাঘাট অঞ্চলটি যাদু বিদ্যার জন্য খুবই কুখ্যাত।”

যে বইটি পরবর্তীতে Journal of the Asiatic Society of Bengal নামে ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়।


যাদু বিদ্যা নিয়ে বাহিরের দুনিয়াতে আসক্তি ও আগ্রহ ছিল। তাছাড়া এই বিদ্যায় কৌশল প্রদর্শন করে মানুষকে আকর্ষণ করা যেত। আজকের এই দিনেও, হাট-বাজারে, শহরে-নগরে-গঞ্জে মানুষকে জলদি একত্রিত করার উত্তম মাধ্যম হল ভেলকিবাজি দেখানো। ভেলকিবাজি হল হাতের চালাকি যাকে ইংরেজিতে Sleight of Hand বলে। আসামের উড়িয়া অঞ্চলের বেদে, সাপুড়িয়ারা এই খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জন থাকে। পাশ্চাত্য বিশ্বে এই বিদ্যাকে ডিজিটালাইজ করে স্টেজে দাড়িয়ে ভেলকিবাজির যাদুকরী দেখায়। আমাদের দেশে এখনও ভেলকি-পারদর্শী কেউ রাস্তার পাশে দাড়িয়ে, নিজের পণ্য বিক্রি করার জন্য, চলমান পথিকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হয়। তারা ক্ষুদ্র প্রকৃতির দু’একটি ভেলকিবাজি শিখেই কাজে নামে। মানুষদের আকৃষ্ট করতে কিংবা ষ্টেজে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে এই বিদ্যার আকর্ষণ দারুণ কার্যকরী। ধারনা করা হয়, মানুষকে সম্মোহন করায় দারুণ কার্যকরী এই বিদ্যা শিখতেই তুর্কি ও পারস্য থেকে কিছু সুফি-সাধকেরা বাংলা ও কামরূপে এসেছিলেন।


বর্তমান সময়ে ভেলকিবাজি-যাদু দেখিয়ে অর্থ কড়ি অর্জন করা হয়। তদানীন্তন জমানায় যোগীরা এটা ব্যবহার করে অর্থকড়ি কামাতেন না। তারা বিশ্বাস করত এটা করলে তার ভেলকির ক্ষমতা লয় হবে এবং তাকে কঠিন ভাবে মরতে হবে। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে তাদের এই বিশ্বাসের কথাটি উল্লেখ করেছেন। সুফি-সাধকেরা সংসার বিরাগী ছিলেন, এই বিদ্যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করবেন এমন ধান্ধা তাদের ছিলনা। হয়ত নিত্য নতুন পদ্ধতিতে, নিজেদের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করে, ধর্ম প্রচারের লক্ষ্য নিয়েই তারা এই বিদ্যা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন।


উল্লেখ্য ইমাম গাজ্জালী, জালালুদ্দীন সূয়তি, শাহ জালাল, শাহ মোহাম্মদ বলখি (রহঃ) সহ, জগত বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিরাই সুফি চিন্তার মানুষ ছিলেন। তবে এখানে সে সব সুফিদের কথা বলা হচ্ছে, যারা উপরোক্ত বিদ্যার প্রতি আগ্রহী ছিল। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে, তাদেরকে ওদের থেকে আলাদা করে বাছাই করা বেজায় দুঃসাধ্য। ইসলামের চিরাচরিত দাওয়াতি পন্থা বাদ দিয়ে কিছু সংখ্যক সুফি কেন এই বিদ্যায় আগ্রহী হয়েছিল, তার বহু বিশ্লেষণ নীচের গ্রন্থে উল্লেখ আছে। সেখান থেকে একটি কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থে এ কথাটি পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে,


“পার্থিব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা দ্বারা নির্বিঘ্নিত অলৌকিক বাস্তবতা অনুধাবন করানো যায় না। এর ফলে সূফী, ধর্মীয় পুরোহিতরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তাই অবাক হবার কিছু নেই যে, মুসলমান সুফিরাও কামরূপের যোগী পৌরোহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল।” সূত্র- The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760


কামরূপের যাদু বিদ্যা শিখার জন্য, সেখানে যেতে হত। কারো অধীনে মুখে মুখে শিখে অনুশীলন করতে হত। এ বিষয়ে বিস্তারিত কোন লিখিত গ্রন্থ ছিলনা। তবে “অমৃত-কুণ্ড” নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি গ্রন্থ রচিত ছিল। বাহির থেকে আসা আগন্তুকেরা এই ভাষা পড়তে পারত না। আবার সেটার কোন অনুবাদও ছিল না। বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের পরই, এ বিষয়ে একটি বিরাট পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে মুসলমান হওয়া, এক বাহ্মণ যোগী অমৃত-কুণ্ড অনুবাদে সহযোগিতা করেন। রোকন আল দ্বীন আল সমরখন্দি কর্তৃক আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুদিত এই গ্রন্থটি মোগল অধিকৃত তদানীন্তন বাংলার রাজধানী লখনৌতির প্রধান কাজীর হাতে হস্তান্তর করেন। সেই থেকে বইটি চারিদিকে আলোচিত হতে থাকে ও প্রসার পায়। তথ্য সূত্র- The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760


কাশ্মীরের সুফি আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গোহী (মৃত্যু ১৫৩৭) এই বইয়ের যৌগিক তথা শরীর বৃত্তিয় অংশটিকে কার্যকরী বলে ঘোষণা দেন এবং অনুসারীদের প্রশিক্ষণ নিতেও বলেন। যা আজো মানব সমাজে যোগ ব্যায়াম বলে প্রচলিত আছে। এই বইয়ের কিছু অংশ যোগীর মন্ত্র সন্নিবেশিত ছিল। সবগুলোকে পরিপাটি ও বিন্যস্ত করে ১৬০২ সালে মোহাম্মদ গাউথ উপরোক্ত বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে “বাহার আল হায়াত” নাম দিয়ে ফার্সি ভাষায় এক যুগান্ত-সৃষ্টিকারী গ্রন্থের রচনা করেন! পরবর্তীতে এই গ্রন্থটিই কিছু সুফিদের কাছে পছন্দের গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়ে উঠে।


এসব সুফিরা এই গ্রন্থের তথ্য ও ইসলামের উৎসের সাথে মিশিয়ে, নতুন ভাবে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করে। সাধারণ মানুষও এ ধরনের সুফিদের কথায় অন্ধভাবে প্রভাবিত হতে থাকে। ধারণা করা হয়, কিছু কিছু সুফিরা কেরামতের চাদরে যাদু প্রদর্শন করেই মানুষকে বিভ্রান্ত করত, মানুষেরাও তাদেরকে আল্লাহর জীবন্ত আউলিয়া জ্ঞান করে মান্য করে চলত।


তথ্য সূত্র Haud al-Hayat-294

- নজরুল ইসলাম টিপু

পঠিত : ৩৮২ বার

মন্তব্য: ০