Alapon

গাসীসুল মালায়িকা- 'হানজালা ইবনে আবী আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু'



উহুদ যুদ্ধের ময়দান। যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালামের নির্দেশে সকল শহীদদের লাশ এনে এক জায়গায় রাখা হয়েছে।
কিন্তু হানজালা রাদিয়াল্লাহু আনহুর লাশটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না!
সাহাবীরা বেরিয়ে পড়লেন হানজালার লাশ খুঁজতে....
হঠাত হিজাবে আবৃত একজন মহিলা রাসূল সা. এর কাছে এসে দাঁড়ালেন। রাসূল সা. মহিলাটিকে চিনতে পারলেন না। তিনি বললেন, "ইয়া রাসূলুল্লাহ! গতকাল আপনি একটি বিয়ে পড়িয়েছিলেন, আপনার মনে আছে?"
রাসূল সা. বললেন, "হ্যাঁ, আমি তো গতকাল হানজালার বিয়ে পড়িয়েছি! যার বিয়ের খুশীতে আমি খুরমা খেজুর ছিটিয়েছিলাম!"
মহিলাটি বললেন:
"আমি হানজালার স্ত্রী। আজ তিনি আমার সাথেই ছিলেন। সে সময় তিনি গোসল শুরু করছিলেন। হঠাত এক ঘোষকের কথা তাঁর কানে এলো- 'এক্ষুনি জিহাদে বেরুতে হবে'....আর সেই ডাক শুনে তিনি গোসল অসম্পূর্ণ রেখেই তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়েছিলেন।
.....তাঁর সাথে আমার ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি। যাওয়ায় আগে শুধু বলে গেছেন, 'যদি বেঁচে থাকি, তাহলে দুনিয়ায় আবার দেখা হবে। আর যদি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে দেখা হবে জান্নাতে!'
.....তারপর তিনি আমার কপালে একটি চুমু দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন।
.....ইয়া রাসূলুল্লাহ! শহীদদের তো আপনি গোসল দেন না। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি, আমার হাজবেন্ডকে আপনি গোসল দেয়ার অনুমতি দিন। তিনি ফরজ গোসল করার সুযোগ পাননি।"
এমন সময় এক সাহাবী দৌড়ে এসে বললেন, হানজালাকে পাওয়া গেছে!
সব সাহাবীরা হানজালার লাশের কাছে গেলেন এবং দেখতে পেলেন, কাফনের ভেতর লাশের মাথায় পানি! হানজালার চুল থেকে পানি ঝরছে!
সেসময় জিবরাইল আ. রাসূল সা. এর কাছে আসলেন এবং বললেন, "ইয়া রাসূলুল্লাহ! হানজালা রা. এর কুরবানীতে আল্লাহ তা'য়ালা এতোটাই খুশী হয়েছেন যে, তিনি হানজালার গোসল ফেরেশতাদের দিতে আদেশ করেছেন। ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তাঁকে তৃতীয় আসমানে এনে জমজমের পানি দিয়ে গোসল করিয়েছি আর তাঁর শরীর থেকে যে সুগন্ধ বের হচ্ছে, এটা আল্লাহর বিশেষ খুশবু মিশক আম্বরের। আমরা এটি তাঁর কাফনে ছিটিয়ে দিয়েছি।" (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৪)
সুবহানআল্লাহ!
সেই থেকেই হানজালা রা. এর উপাধি হয় 'গাসীসুল মালায়িকা' (ফেরেশতাদের দ্বারা গোসলকৃত)
হানজালা রা. ছিলেন মদীনার আউস গোত্রের সন্তান। রাসূল সা. মদীনায় আসার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হানজালা রা. এর বাবা ফাসিক ছিলেন। আর এই ফাসিক পিতার ছেলে হানজালার উপাধি ছিলো 'তাকী' (আল্লাহ ভীরু)- বুঝাই যাচ্ছে কতোটা উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি!
হানজালা রা. বলেন, 'একবার একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে রাসূল সা. বক্তৃতা করছিলেন। তাঁর কথাগুলো শুনে আমাদের মন এতো নরম হয়ে গিয়েছিলো যে, সেখানে উপস্থিত সবার চোখ থেকেই পানি পড়ছিলো...
আমরা আখিরাতে আমাদের পরিণাম নিয়ে অস্থির হয়ে ভাবছিলাম!
প্রোগ্রাম শেষে আমি যখন বাসায় ফিরে আসলাম তখন আমি ফ্যামিলির সবার সাথে হাসি মজা করতে লাগলাম, দুনিয়াদারি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। বাসায় আসার একটু আগে আমার যেই ফিলিংসটা ছিলো সেটা কেমন যেন বিলীন হয়ে গেল! আমার মন তখন বলে উঠলো, 'হানজালা! তুমি মুনাফিক হয়ে গেছ! কারণ রাসূল সা. এর কাছে যখন তুমি ছিলে, তখন তুমি ছিলে একরকম আর বাসায় আসার পরই তোমার অবস্থা হয়ে গেছে অন্যরকম।'
কতোটা গভীর উপলব্ধি ছিলো তাঁর! কতোটা গভীর ছিলো তাঁর আত্নপর্যালোচনা!
উহুদ যুদ্ধের আগের দিন তাঁর বিয়ে হয়। হানজালা রা. এর বিয়ের রাতেই অন্যান্য সাহাবীরা উহুদের ময়দানে চলে যান। কিন্তু হানজালা রা. রাসূল সা. এর অনুমতিতে স্ত্রীর সাথে রাতটি কাটান। উহুদ যুদ্ধের দিন তিনি যখনই শুনতে পেলেন মুসলিমরা বিপর্যয়ের মুখে, সাথে সাথেই তিনি কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে উহুদের প্রান্তরে ছুটে যান। যুদ্ধে তিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেন। তাকে তলোয়ার দিয়ে তিনি আঘাত করতে যাচ্ছেন.... এমন সময় আরেক কাফির শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ আল-লায়সী দেখে ফেলে এবং দ্রুত হানজালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তলোয়ারের এক আঘাতে সে হানজালার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফলে। এভাবেই শহীদ হয়ে যান রাসূল সা. এর অন্যতম প্রিয় সাহাবী হানজালা রা.। (সীরাত ইবনে হিশাম- ২/৭৫)
আনাস রা. বলেন, একবার আনসারদের দুই গোত্র আউস ও খাযরাজ নিজেদের গৌরব ও সন্মানের কথা বর্ণনা করছিলো। তারা নিজ নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম বলছিলো। আউস গোত্র সর্বপ্রথম উচ্চারণ করলো হানজালা ইবনে আবী আমিরে রা. এর পূণ্যময় নামটি! তারা গর্ব করে বললো-
"আমাদের আছে হানজালা, যাকে গোসল দিয়েছেন ফেরেশতারা!"
হানজালা রাদিয়াল্লাহু আনহু! একজন মহা সৌভাগ্যবান সাহাবী!
-------------------------------
গাসীসুল মালায়িকা- 'হানজালা ইবনে আবী আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু'
- সাজেদা হোমায়রা

পঠিত : ১১৬৬ বার

মন্তব্য: ০