Alapon

তালিবদের বন্দীখানায় একজন অধ্যাপকের ইসলাম গ্রহণের গল্প; কেন তারা শত্রুর ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়?



টিমোথি উইকস ওরফে ওমর জিব্রিল। ৫২ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান প্রফেসর। অস্ট্রেলিয়ার গ্রামাঞ্চল ওয়াগা ওয়াগায় বেড়ে উঠা এই ইংরেজি ভাষার শিক্ষক জানাচ্ছিলেন, তার একই গ্রাম থেকে তার সমসাময়িক সময়ে বেড়ে উঠেছেন কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নসহ আরো অনেকেই। ভ্রমণপিপাসু এই শিক্ষক যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর থাইল্যান্ড, প্যালেস্টাইন এবং পূর্ব তিমুরে(তিমুর-লেস্টে) ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসাবে ২০ বছর কাটিয়েছেন। পরবর্তীতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানে চাকরির জন্য একটি বিজ্ঞাপন দেখার পর, তিনি আবেদন করেছিলেন এবং সেই আবেদন গৃহীত হয়েছিল।

টিমোথি উইকস ২০১৬ সালে দুবাই থেকে কাবুলে উড়ে এসে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ আফগানিস্তানে যোগ দেন। উইকস কে আফগানিস্তানের পূর্ববর্তী মার্কিন মদদপুষ্ট ঘানি রেজিমের পুলিশ অফিসারদের জন্য একটি ভাষা কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তার কাবুল আগমনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর ৯ আগস্ট, ২০১৬-এর রাতে তাকে এবং তার আরেক সহকর্মী আমেরিকান শিক্ষক কেভিন কিং কে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে চার সদস্যের একটি সশস্ত্র দল অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা উইকস ও কেভিন কে তালিবদের হাতে তুলে দেয়। "আমাকে কাবুল আসার ঠিক ৩৩ দিন ৩ ঘন্টা ৩ মিনিট পরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল - বা এরকম কিছু!" পরবর্তীতে টিমোথি উইকস সাংবাদিকদের সাথে আলাপে মজাচ্ছলে ঐ ঘটনার স্মৃতিচারণ করছিল।



উইকস জানায় তাকে ও কেভিন কে বন্দী পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে ৩৩ বার বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। সে নিশ্চিত না, তবে সে মনে করে বন্দী থাকাবস্থায় তাদের পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চল ওয়াজিরিস্তানসহ সীমান্তের উভয় পাশে বিভিন্ন শহর বা গ্রামে রাখা হয়েছিল। উইকস সাড়ে তিন বছর তালিবের বন্দীদশায় কাটিয়েছেন - বেশিরভাগ সময় তাকে একটি ছোট জানালাবিহীন ঘরে আটক করে রাখা হয়েছিল। তাকে তালিবদের কেউ কেউ বিভিন্নভাবে কষ্ট দিত বলে সে জানায়। তাকে সবসময় মেঝে পরিষ্কার রাখতে হতো এবং নিজ কাপড় ধুতে হতো। জামাকাপড় নোংরা হলে তাকে মারধর করা হতো। এছাড়াও খাবারের কষ্ট (যদিও তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা তালিব সদস্যরাও দাবি করতো তাকে সরবরাহ করা খাবারই তারা খেতো), বাসস্থানের কষ্ট, শীতে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল, স্থানান্তরের সময় দুর্ভোগ ইত্যাদিও উইকসদের বন্দিজীবনের নিত্যসঙ্গী ছিল। এক তালিব কমান্ডার উইকস কে মারধর করতো বলে তার অভিযোগ, বিশেষ করে যখন বেশ কয়েকবার তাকে এবং তার অন্য আরেক সহকর্মী কেভিন কে উদ্ধার করতে মার্কিন বিশেষ বাহিনী বেশ কয়েকটি ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেছিল। এই অভিযানের সময় তালিবদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয় যার দায় স্বরূপ উইকসদের উপর মারধর চালানো হতো। যদিও বেশীরভাগ সময় তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হতো বলে জানায় সে।

বন্দী জীবনের এক বছর পরে, তালিব রক্ষীদের মনোভাব পরিবর্তন হতে শুরু করে। উইকসদের একটি অপেক্ষাকৃত সুন্দর কক্ষে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যেখানে একটি জানালা ছিল এবং প্রথমবারের মতো উইকস পাহাড় দেখতে পায়। তাদের কে সতেজ আঙ্গুর ও ডালিম খেতে দেওয়া হয়েছিল। উইকস তালিব যোদ্ধাদের কাছে বই আনতে অনুরোধ জানালে তাকে তারা আল কোরআনের ইংরেজি অনুবাদ এনে দেয়। তালিব রক্ষীদের এই আচরণের পরিবর্তন এবং তার পরিবর্তিত উন্নত পরিস্থিতিতে উইকস বুঝতে পেরেছিল যে সে কতটা ভাগ্যবান ছিল। উইকস যখন মুক্ত ছিলেন তখন পুরো দেশজুড়ে সরকারি বাহিনী ও দখলদার ন্যাটো বাহিনীর উপর তালিব যোদ্ধাদের একের পর এক ভয়াবহ হামলার স্বাক্ষী হয়েছিলেন আবার তালিব যোদ্ধাদের হাতে বন্দী হওয়ার পর সেই তাদের মধ্যেই প্রচণ্ড অধ্যবসায় আর দৃঢ় বিশ্বাস দেখেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

সম্পূর্ণ নতুন এই বন্দিজীবন উইকসের মনে এক তুমুল সাড়া ফেলেছিল। "আমাকে (আল্লাহর প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়েছিল। আমার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু করার দরকার ছিল।" উইকস সেসময়ে নিজের উপলব্দির কথা মনে করছিল। তিনি বন্দী অবস্থায় ইসলাম গ্রহণের চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু ইসলাম কেন? একজন ভাল খ্রিস্টান থাকাকালীন তিনি কি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারতেন না? তার নিজের কথায়, "আমার ভাইঝি এবং ভাগ্নেসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ায় চার্চের সক্রিয় সদস্য। হ্যাঁ, আমি একজন খ্রিস্টান থাকার মাধ্যমে আমার ধন্যবাদ জানাতে পারতাম। কিন্তু একটা জিনিস যা দেখে আমি একেবারেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম তা হল তালিবদের অবিচল বিশ্বাস। তাদের অগাধ, অটল বিশ্বাস ছিল যা আমরা পশ্চিমা বিশ্বে দেখতে পাই না।" তালিব যোদ্ধাদের সাথে জিম্মি থাকাবস্থায় সে যে সময় কাটিয়েছিল তা তার উপর বেশ গভীর এবং অকল্পনীয় প্রভাব ফেলেছে," উইকস নিজেই তা বলেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস এই যে, তাঁর কারাবাসের সময় একজন ফেরেশতা তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।



ধীরে ধীরে উইকস কীভাবে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয় এবং তার আগে অযু করতে হয় তা শিখে নেয় এবং অবশেষে ৫ মে, ২০১৮ তারিখে তিনি তালিবদের হাতে আটক থাকাবস্থাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তরিত হন। খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে টিমোথি উইকস থেকে নতুন মুসলিম নাম গ্রহণ করেন ওমর জিব্রিল।

উইকসদের এই অগ্নিপরীক্ষা যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল সেভাবেই হঠাৎ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাকে এবং তার মার্কিন সহকর্মী কেভিনকে তালিবদের সাথে এক বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অপরদিকে যে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় মুক্ত হয়েছিলেন তালিবদের প্রভাবশালী সামরিক গ্রুপ হাক্কানি নেটওয়ার্কের শীর্ষ নেতা ও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিনের ছোট ভাই আনাস হাক্কানি। মার্কিন সামরিক বাহিনী উইকস ও আরেক মার্কিন শিক্ষক কেভিন কে দেশে আনার জন্য দুটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিল।"

একটি বড় ধূলিকণার মেঘের মাঝখান থেকে মার্কিন এক বিশেষ বাহিনীর ছয় সদস্য এসেছিল এবং তারা আমাদের দিকে এগিয়ে গেল এবং তাদের মধ্যে একজন আমার দিকে এগিয়ে আসলো, সে শুধু আমার চারপাশে তার হাত রাখল এবং সে আমাকে ধরে বলল, 'তুমি ঠিক আছ?' এবং তারপর সে আমাকে নিয়ে হাঁটা দিল।

এর কয়েক মুহূর্ত আগে, উইকস তার তালিব রক্ষীদের ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে, তিনি তাদের কয়েকজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন কারণ তারা তার মঙ্গল কামনা করেছিলেন। সে বন্দী অবস্থায় পশতুন ভাষায় কথা বলতে শিখেছে এবং বলেছে তার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন যে, "যে তালিব রক্ষীরা আমাকে বন্দী করার জন্য অভিযুক্ত তারা একাজ করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল। তারা সৈনিক ছিল এবং সৈন্যরা তাদের কমান্ডারদের আদেশ পালন করে। তারা নিজেদের কোন পছন্দ নেই। তারা সেখানে ছিল কারণ তাদের আমার দেখাশোনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি তাদের মোটেও ঘৃণা করি না। এবং তাদের মধ্যে কারো কারো প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা আছে, এবং অনেক বেশি ভালোবাসাও আছে।"

উইকস মুক্তির প্রায় দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তালিবরা দখলদার ন্যাটো বাহিনী ও তাদের পাপেট ঘানি রেজিম কে হঠিয়ে কাবুলের শাসনভার নিয়ন্ত্রণে নেয়। উইকস বিভিন্ন মাধ্যমে বেশ জোরালোভাবেই তালিবদের সমর্থন দিয়ে আসছে। সর্বশেষ সে তালিব নেতাদের আমন্ত্রণে দোহায় এসেছিল। যে শীর্ষ তালিব নেতাদের মুক্তির বিনিময়ে উইকসরা মুক্ত হয়েছিল তাদের একজন আনাস হাক্কানি তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দোহা বিমানবন্দরে এসেছিলেন। "আমি তাকে দেখে বেশ অভিভূত হয়েছিলাম। আমি তাকে এমন একজন মানুষ হিসাবে বিচার করি যে আমার মতোই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে - আসলে বন্দী জীবনটা অনেক খারাপ। আমরা আমাদের বন্দী জীবনের বিভিন্ন দিক মেলাতে চেষ্টা করি। আমরা আমাদের কারাবাসের সময় যা যা ঘটেছিল এমন জিনিসগুলি নিয়ে কথা বলি।" আনাস হাক্কানির সাথে সাক্ষাৎকার বিষয়ে বলছিলেন উইকস।



সেসময় দোহায় উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন তালিব নেতা ক্ষমা প্রার্থনা করতে উইকসের কাছে গিয়েছিল। "এই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি বেশ চমৎকার ছিল কিন্তু আমি যে নরকে গিয়েছিলাম তা তো ভুলবার নই! কিন্তু আমার মনে হয় আমি যদি এত কষ্ট না পেতাম, তাহলে আমি ইসলাম গ্রহণ করতাম না।" নির্মোহ স্বীকারোক্তি অধ্যাপক টিমোথি উইকস ওরফে ওমর জিব্রিলের।

এবছরের শুরুতে টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাংবাদিকরা যখন তার সাক্ষাৎকারের জন্য সিগন্যালে (এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ) যোগাযোগ করছিল তখন সে তাদের বারংবার তাগাদা দেন যেন তাকে তার নতুন নাম ওমর জিব্রিল নামে ডাকা হয়। তাকে তার পূর্বনাম টিমোথি উইকস নামে ডাকা হচ্ছিল।

পঠিত : ৮১৮ বার

মন্তব্য: ০