Alapon

ইসলামের স্বর্ণযুগে সাম্যের উদাহরণ



ইসলামের স্বর্ণযুগে সাম্যের উদাহরণ
~সাঈয়েদ কুতুব শহীদ


ইসলাম মানব জাতির জন্য পরিপূর্ণ সাম্যের বাণী নিয়ে এসেছিল। যত মূল্যবোধ সাম্যের পথে অন্তরায় সৃ্ষ্টি করেছে তার শৃংখল থেকে সে মানুষকে মুক্ত করতে এসেছিল। এবার আমরা দেখতে চাই এই মতবাদকে বাস্তব জীবনে কিভাবে রূপায়িত করা হয়েছে।


সে সময়ে সারা দুনিয়ার দাস-শ্রেণী স্বাধীন মানব জাতি থেকে পৃথক একটা স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসাবে বিদ্যমান ছিল। আরব উপদ্বীপেরও ছিল একই অবস্থা। এ ব্যাপারে আমরা যখন হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কার্যাবলী বিবেচনা করি তখন দেখতে পাই যে তিনি নিজের ফুফাতো বোন এবং কোরাইশ বংশীয় হাশেমী গোত্রের মেয়ে জয়নবকে নিজের আজাদ করা গোলাম জায়েদের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ে একটা অত্যন্ত নাজুক ব্যাপার, এতে উভয় পক্ষের সমতা অন্য সকল প্রশ্নের চাইতে গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।


মহানবী (সাঃ) ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো শক্তির পক্ষে এত বড় অসাধারণ কাজ করা সম্ভব ছিল না- এমন কি আজও মুসলিম জাহান ব্যতীত অন্য কোথাও সম্ভব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাসবৃত্তি বে-আইনী বটে কিন্তু কোনো নিগ্রোর পক্ষে কোন শ্বেতাংগিনীকে-তা সে যতই নিকৃষ্ট হোক- বিয়ে করা আইনানুগভাবে নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, বরং কোনো নিগ্রোর পক্ষে বাসে বা অন্য কোন যানে-রেস্তোঁরায় থিয়েটারে অথবা অন্য কোন স্থানে কোন শ্বেতাঙ্গের পাশাপাশি উপবেশন করাও আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ।


হিজরতের প্রথম যুগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন তখন তার স্বাধীনকৃত গোলাম জায়েদ এবং তার চাচা হামজা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন, হজরত আবু বকর (রাঃ) এবং খারেজা ইবনে জায়েদ ভাই ভাই বন্ধনে আবদ্ধ হন। খালেদ ইবনে রুয়াইছা খাশ্য়ানী এবং বিলাল ইবনে আবি রাবাহের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। এই ভ্রাতৃত্ব শুধু কথার মধ্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি- বরং রক্ত সম্পর্কের মত মজবুত ও পাকাপোক্ত সম্পর্কের রূপ ধারণ করে। জান-মাল ও জীবনের সকল ব্যাপারে তাদের মধ্যে আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়।


এরপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জায়েদকে মুতা যুদ্ধে সেনাপতি বানিয়ে পাঠান। অতঃপর তার ছেলে উসামা (রাঃ)-কে রোমের যুদ্ধে এমন এক বাহিনীর সেনাপতি করেন-যার মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন মুহাজের ও আনসার। এই সেনাবাহিনীতে হজরত আবু বকর (রাঃ) এবং ওমন (রাঃ)ও ছিলেন- যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকটতম সাথী ও উজীর এবং পরে পূর্ণ ঐক্যমত সহকারে খলিফা নির্বাচিত হন। উসামার নেতৃত্বে পরিচালিত এই সেনাবাহিনীতে রাসূলুল্লার (সাঃ) ঘনিষ্ট আত্মীয় সা’দ ইবনে আবি আক্কাসও ছিলেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মাতুল গোষ্ঠি-বনু জোহরা গোত্রের লোক। তাছাড়া কোরাইশদের যে সব ব্যক্তি নবুয়তের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন- তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। আল্লাহতায়ালা তাকে মাত্র সতের বছরে ইসলাম গ্রহণের তওফিক দেন। তিনি বিরাট বিত্তশালী ও মর্যাদা সম্পন্ন লোকি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ সমর-কুশলীও ছিলেন এবং সেই সাথে জেহাদী প্রেরণায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হজরত আবু বকর (রাঃ) যখন উসামার বাহিনীকে পুনরায় যুদ্ধে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিযুক্ত সেনাপতিকেও বহাল রাখেন। তিনি যখন সেনাপতিকে বিদায় দেয়ার জন্য মদিনার বাইরে আসেন- তখন উসামা সওয়ারীতে চড়ে যাচ্ছিলেন, আর খলিফাতুল মুসলেমীন চলছিলেন পায়ে হেঁটে। উসামা এতে অত্যন্ত কুন্ঠা বোধ করেন। নিজে সওয়ার হয়ে সওয়ারীতে চড়বেন, আর বৃদ্ধ খলিফা পায়ে হেঁটে চলবেন- এটা তিনি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। তাই উসামা বললেন, “খলিফাতুর রাসূল! আপনিও সওয়ারীতে আরোহন করুন-নইলে আমি নেমে আসবো”। খলিফা শপথ করে বলেন, “খোদার কছম! তুমি নীচে নেমনা। খোদার কছম! নীচে নেমনা। খোদার কছম! আমি সওয়ারীতে আরোহন করবো না। আমি কিছুক্ষণ আল্লাহর রাহে হেঁটে চললে আমার কোনোই ক্ষতি হবে না”। এরপর হজরত আবু বকরের (রাঃ) হঠাৎ মনে পড়ে যে, হজরত ওমরের তাঁর প্রয়োজন পড়তে পারে। অসুবিধা ছিল এই যে, ওমর (রাঃ) উসামার বাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন। যেহেতু সে বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন উসামা, তাই ওমর (রাঃ) কে রাখতে হলে উসামার অনুমতি প্রয়োজন।খলিফা বলেন, “যদি আপনি ভাল মনে করেন তবে অনুগ্রহ পূর্বক ওমরকে আমার সাহায্যের জন্য রেখে যান”।


এখানে এসে বিস্ময়ে ইতিহাসের গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। “যদি আপনি ভাল মনে করেন তবে অনুগ্রহ পূর্বক ওমরকে (রাঃ) আমার সাহায্যের জন্য রেখে যান”। একথা কত উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে খলিফা তার মামুলী সেনাপতিকে বলতে পারেন তা বুঝিয়ে বলার উপযুক্ত ভাষা আমাদের নেই।


ইতিহাস আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়। আমরা দেখতে পাই, ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আম্মার ইবনে ইয়াসার (রাঃ)কে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। অথচ তিনিও দাস শ্রেণী-উদ্ভুত ছিলেন। আমাদের কল্পনার চোখ আরো বিস্তারিত হয় যখনি আমরা দেখি যে, আমর ইবনে হিশামের পুত্র সোহায়েল, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং অন্যান্য কোরাইশ সর্দার দাঁড়ানো থাকতে হজরত ওমর দু’জন প্রাক্তন গোলাম সোহায়েব (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ)কে আগে ডেকে নেন। কেননা তারা ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবী ও বদর যুদ্ধের সিপাহী। এ অগ্রাধিকারে আবু সুফিয়ান অস্ফুট ক্রুদ্ধ স্বরে জাহেলিয়াতের উক্তি করে ফেলেনঃ “এমন কান্ড কখনো দেখিনি। আমাদেরকে দরজায় দাঁড় করিয়ে গোলামগুলোকে ভেতরে ডেকে নেয়া হলো”।


হজরত ওমর (রাঃ) একদিন মক্কা শরীফের কোথাও যাচ্ছিলেন। দেখেন যে চাকর-নফররা মুনিবদের সাথে খেতে বসেনি বরং একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি রাগান্বিত হয়ে মুনিবদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ব্যাপার কি! নিজেদের ভৃত্যদের সাথে এরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?” অতঃপর তিনি ওই ভৃত্যদেরকে ডেকে জোর পূর্বক মনিবদের সাথে ভোজনে বসিয়ে দেন।


হযরত ওমর (রাঃ) নাফে ইবনুল হারেসকে মক্কার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার সাথে উসফানে খলিফার সাক্ষাত হলে জিজ্ঞাসা করেন, “কি সংবাদ, কাকে স্থলাভিষিক্ত করে এসেছ?” নাফে জবাব দেন, “ইবনে আবজাকে স্থালাভিষিক্ত করে এসেছি। তিনি আমাদের আজাদকৃত গোলামদের অন্যতম”। ওমর (রাঃ) বললেন, “সে কি! একজন আজাদকৃত গোলামকে মক্কাবাসীদের ওপর নিজের স্থলাভিষিক্ত করে এলে?” জবাব এলো, “তিনি কোরআনে অভিজ্ঞ, শরিয়তে সুপন্ডিত এবং সুবিচারক”। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “হবেই তো! আমাদের নবী (সাঃ) বলে গেছেন যে, আল্লাহতায়ালা এই কিতাব দ্বারা অনেককে ওপরে তুলবেন, অনেককে নীচে নামাবেন”।


বলা বাহুল্য, হযরত ওমর (রাঃ) আপত্তি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে নয়- বরং ইবনে আবজার পরিচয় জানবার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন। নইলে এই ওমরই নিজের পরবর্তী খলিফা নির্বাচনকারী ছয় সদস্য বিশিষ্ট পরিষদকে অছিয়ত করার সময় বলতেন না যে, “হোজাইফার গোলাম সালেম জীবিত থাকলে আমি তাঁকে খলিফা নিয়োগ করে যেতাম”। এ থেকে বুঝা যায়, তিনি তাকে পরিষদের ছয়জন সদস্যের প্রত্যেকের চেয়ে উত্তম মনে করতেন। এই ছয়জন ছিলেন, ওসমান, আলী, তালহা, জোবায়ের, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবি আক্কাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)।


একবার জনৈক আজাদকৃত গোলাম অন্য একজন কোরাইশ বংশীয় ব্যক্তির নিকট তার বোনের পাণি গ্রহণের অভিলাষ প্রকাশ করে এবং তার বোনকে প্রচুর অর্থ দিতে চায়। কিন্তু সে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ওমর (রাঃ) যখন একথা জানতে পারলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোন কারণে তার সাথে তোমার বোন বিয়ে দিতে চাওনি? সে অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং সে তোমার বোনকে অনেক অর্থ সম্পদও দিতে চেয়েছে”। লোকটা বললো, “আমরা উচ্চ সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক। কিন্তু সে আমার বোনের সম-পর্যায়ভুক্ত নয়”। ওমর (রাঃ) বললেন, “এই ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় দিক থেকে সম্ভ্রান্ত, দুনিয়ায় সম্ভ্রান্ত এই জন্যে যে, সে প্রচুর বিত্তবান আখেরাতে সম্ভ্রান্ত এই জন্য যে, সে খোদাভীরু ও সৎকর্মশীল। যদি মেয়ে রাজী থাকে তবে তাকে এই ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়ে দাও”। লোকটি তার বোনের মতামত গ্রহণ করে দেখে যে সে সম্মত। অতঃপর তার সাথে তার বোনকে বিয়ে দিয়ে দেয়।


গোলামদের যে ক্ষেত্রে ইচ্ছা, উচ্চ থেকে উচ্চতর পদমর্যাদায় উন্নীত হবার অবাধ সুযোগ ছিল। তাই আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের সাথে তার গোলাম ইকরাম, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের সাথে তার গোলাম নাফে, আনাস ইবনে মালিকের সাথে তার গোলাম ইবনে শিরীন এবং আবু হোরাইরার সাথে তার গোলাম ইবনে হরমুজ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বসরায় হাসান বসরী এবং মক্কায় মুজাহেদ ইবনে জুবায়ের, আতা ইবনে আবি রাবাহ এবং তাউস ইবনে কাইসান খ্যাতনামা ফকীহ ছিলেন এবং তাঁরা সকলেই ছিলেন দাস বংশোদ্ভুত। অনুরূপভাবে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়কার মিশরের মুফতি ইয়াজিদ ইবনে আবু যিব দিনকালার আসওয়াদ নামক ব্যক্তির গোলাম ছিলেন। (আবু হানিফাঃ আবদুল হালিম জুন্দী)।


শ্রমজীবীদের ব্যাপারেও মুসলমানদের নীতি অনুরূপ ছিল। গায়ে খেটে জীবিকা উপার্জনকারীরা মুসলমানদের সমাজ জীবনে অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী ছিল। স্বয়ং শ্রমের মর্যাদা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। তাই শ্রমিক মাত্রই- তা সে যে পেশার সাথেই সংশ্লিষ্ট হোক- সমান শ্রদ্ধা লাভ করতো। কোনো শ্রমজীবীর পেশা তাকে জ্ঞানার্জনে বাধা দিতে পারতো না- এমনকি বড় বিদ্বান ও ওস্তাদে পরিনত হবার পথেও কোনো বাধা ছিল না।


ইমাম আবু হানিফা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন, আর তার পরবর্তী বহু বিখ্যাত মনীষি ব্যবসায়ী অথবা কারিগর ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবনে আমর ছিলেন জুতা প্রস্তুতকারী। তার পিতা ছিলেন ইমাম আবু হানিফার সহচর মুহাম্মদ ও হাসানের শিষ্য। ইনি একদিকে জুতা তৈরী করে জীবিকা উপার্জন করতেন, আবার অপরদিকে খলিফা মুহতাদী বিল্লাহর জন্য ‘কিতাবুল খারাজ’ বা ‘ইসলামের রাজস্ব-নীতি’ প্রণয়ন করেছিলেন। এই সময়ে তিনি ফেকাহ শাস্ত্রের ওপর নিজের মূল্যবান গ্রন্থাবলী প্রণয়ন করতেন। কাফ্ফালের হাতে তালা বানানোর দাগ পরিদৃষ্ট হতো, ইবনে কাত্তান্দুবাগা দর্জ্জীগিরী করতেন, খ্যাতনামা ইমাম জাসসাস ছিলেন কাঁচপাত্র র্নিমাতা। এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিতে আমাদের সামনে আসেন পিতলের পাত্র বিক্রেতা (সাফ্ফার), আতর বিক্রেতা (সায়দালানী), হালুয়া বিক্রেতার পুত্র (হালওয়ারী), আটা বিক্রেতা (দাক্কাক), সাবান বিক্রেতা (সাজুনী), জুতা প্রস্তুতকারী (নায়ালী), তরকারী বিক্রেতা (বাক্কালী) এবং হাড়ী বিক্রেতা (কুদূরী) প্রমুখ।


ইসলামী সভ্যতার প্রাতঃকালেই অর্থাৎ প্রথম শতাব্দীতে মুসলমানরা যা করে দেখান, বহু শতাব্দীব্যাপী চেষ্টা করেও পাশ্চাত্য জগত তা করতে পারেনি- অর্থাৎ কিনা কোন পেশাই মূলতঃ নীচ কিংবা সম্ভ্রান্ত নয়, আসলে মানুষই উচ্চতর গুণাবলীর অধিকারী হয় অথবা তা থেকে বঞ্চিত হয়। (আবু হানিফাঃ জুন্দী)

পঠিত : ৩৩২ বার

মন্তব্য: ০