Alapon

ইসলাম ও গণতন্ত্র




“গণতন্ত্র একটি শিরকী ও কুফরি রাষ্ট্রব্যবস্থা।”
কেন?
কারণ এতে আল্লাহকে সর্বোচ্চ হুকুমদাতা হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়না, বরং জনগনকেই সমস্থ ক্ষমতার অধিকারী দাবী করা হয়। এতে আল্লাহ্‌র দেয়া অকাট্য বিধান উপেক্ষা করে মানবসৃষ্ট বিধান আরোপ করা হয়। দেশের আইনকে কুরআন ও সুন্নাহর ছাঁচে না সাজিয়ে সেক্যুলার-লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে সাজানো হয়। সমাজে ইসলাম কায়েম না করে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিদ্বেষ চর্চা করা হয়।
আচ্ছা, কোন এক গণতন্ত্রিক রাষ্ট্রে যদি আল্লাহকে সর্বোচ্চ বিধানদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলিল হতে শাসন করা করা হয় এবং এর বিরোধী কোন আইন না করা হয় তবে তা কি শিরকী-কুফরি রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা হবে?
===========
আসলে গণতান্ত্রিক যেসব ইসলামী দলগুলো আছে তাদের নীতি এরকমই। বলা বাহুল্য, ‘গণতন্ত্র: ইসলামী দৃষ্টিকোণ’ বইটির লেখক ড. Ahmad Ali’র দৃষ্টিভঙ্গিও এমন। তবে বইতে তিনি যথেষ্ট নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন বটে।
ইন্টারেস্টিংলি, লেখক এখানে একটা মাইন্ডসেট বর্ননা করে বইটি শুরু করেছেন। ইসলামী অনেক দল ও লোকদের মধ্যে গণতন্ত্রকে একটা অচ্ছুৎ শব্দ-সিস্টেম ভাবার মানসিকতা আছে। কারণেই বহু আলেম-উলামা এই বিষয়টি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চান আর এটা নিয়ে তেমন কথাও বলেন না। আসলে গনতন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামিস্টদের যেই মাইন্ডসেট সৃষ্টি হয়েছে তার বিপক্ষে বলে ফ্যানবেইস হারানো কঠিন ব্যাপার।
সমস্যা এখানে ডেফিনেশন বা সংজ্ঞায়। গণতন্ত্র বলতে আমরা শুধু পশ্চিমা সংজ্ঞা ও পশ্চিমা সেক্যুলার প্র্যাকটিসই গ্রহণ করি। ফলতঃ একদল একে পুরোপুরি গ্রহণ করে নিজেদের সেক্যুলার পরিচয় দেয় আরেকদল একে সম্পুর্নভাবে ত্যাগ করে গণতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবি খেতাব লাভ করে।
কিন্তু বইতে লেখকের মতে ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখলে গণতন্ত্র হলো এমন এক খিচুড়ি যার মধ্যে উপরে বর্নিত শিরক-কুফর সহ মুবাহ, মুস্তাহাব এমনকি ফরজ-ওয়াজিবও বিদ্যমান। অর্থাৎ, গণতন্ত্রে এমন অনেক কিছুই আছে যা ইসলামি শাসনের মূল স্পিরিটের সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই গণতন্ত্র নামক এই গিট্টুটাকে খুলতে হবে, এর ভেতর থেকে ময়লা বের করে ভালোগুলো রাখতে হবে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সহজভাবে ইসলামী শাসন প্রয়োগ করা খুব সহজ হয়ে যাবে।
অনেকেই এটা নিয়ে মশকরা করতে পারেন, সিস্টেমে ঢুকে সিস্টেম চেঞ্জ করা সম্ভব নয়, ট্রাকের উপর উঠে ট্রাককে ধাক্কিয়ে সামনে নেয়া যায় না। শুনতে ভালো লাগলেও ব্যাপারটা এতো সিম্পল নয়। আল্লাহ্‌র রাসুল ﷺ-এর সমাজ কীভাবে বদলেছিল? সমাজের বিদ্যমান আইনই তো এদিক ওদিক করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ইসলামী হুকুমাতের আন্ডারে অন্যান্য যেসকল সমাজ আসছিল রাসুলুল্লাহ ﷺ ও খেলাফতে রাশেদার সময়ে, সেসব সমাজে কি একেবারেই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল? নাকি বিদ্যমান সিস্টেমের মধ্যেই ইসলামের অকাট্য আইনগুলো ধীরে ধীরে অর্গানিকভাবে প্রয়োগ হয়েছিল?
বাহ্যিকভাবে যখন গণতন্ত্রের বিরোধীতা করা হয় ইসলামী দলগুলোর দ্বারা তখন মূলত গণতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট পশ্চিমা লিবারেল-সেক্যুলার-ইসলামোফোবিক ভাল্যুগুলোকেই বিরোধীতা করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের বিরোধীতা করা হচ্ছে এর ভেতরকার শিরক ও কুফুরির জন্য, এর ভেতরের জনগনের নির্ভরযোগ্য সরকার, মতামতের ভিত্তিরে দেশ পরিচালনা, সাম্য ও সমানাধিকার, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জবাদিহিতা ইত্যাদি ভ্যাল্যুর বিরোধীতা মোটেও করা হচ্ছে না। এসব ভ্যালু তো ইসলামী শাসনের এসেন্স! ইসলামের প্রথম যুগের ব্যবস্থা থেকে এর প্রমাণ দেখানো হয়েছে বইতে।
গণতন্ত্রে শিরকের যেই প্রধান প্রশ্ন থাকে তা হলো জনগনই নাকি সকল ক্ষমতার উৎস। এটা আইডিয়ালিস্টিক সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। আচ্ছা, দুনিয়ার একটি গণতান্ত্রিক দেশ দেখানো সম্ভব কি যেখানে আসলেই জনগন সকল ক্ষমতার উৎস? বরং সকল ক্ষেত্রেই গুটিকয়েক আমলা, ধনী আর পলিটিশিয়ানদের হাতে জনগনের ক্ষমতা বন্দী। এটা শুধু গণতন্ত্র নয় বরং যেকোন তন্ত্রেই হওয়া সম্ভব। এটা গণতন্ত্রের দোষ না, বরং মানুষের দোষ যারা ‘গণতন্ত্র’ চালায়।
লেখকের মতে গণতন্ত্রের কিছু প্রধান ত্রুটি আছে যেগুলো দূর করে ইসলামী গণতন্ত্র কায়েম সম্ভব। লেখকের ভাষায়,
“আমরা মুসলিম বিশ্বের এমন অনেক দেশ (যেমন সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ) সম্পর্কে জানি, যেখানে গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামী হুকুমত কায়িম হবে। তাই এসব দেশে যাতে ইসলামী হুকুমত কায়িম হতে না পারে, এ কারণে মুসলিম বিদ্বেষী বিশ্বমোড়লরা সেসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চাকে নানা উপায়ে বাধাগ্রস্ত করে চলছে। মূল কথা হলো বর্তমান গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা ইসলামী হুকুমত কায়িমের জন্য বড়ো বাধা নয়।”
‘গণতন্ত্র’ নামটার সাথে অনেকের সমস্যা থাকলে নাম বদলানো যেতে পারে, কিন্তু সিস্টেম সেটা বর্তমান জমানার সাথে সামঞ্জস্যশীল হবে সবচাইতে বেশীই। সেই ত্রুটি আর দূর করার ক্ষেত্রে লেখকের নিজস্ব কিছু সাজেশন আছে।
১। সংবিধানে কিছু স্থায়ী মৌলিক নীতিমালা সন্নিবেশিত হবে। যেমন,
• আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মেনে নেয়া,
• শাসনব্যবস্থাকে খিলাফতের ধারণার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা,
• ইসলামের অকাট্য ধারার বিরুদ্ধে প্রণীত যেকোন আইন বাতিল করা,
২। নেতৃত্ব নির্বাচনে অসৎ ও অযোগ্য কেউ যাতে না আসতে পারে তার জন্য “প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠতা, আল্লাহভীরুতা, জ্ঞান-গরিমা ও যোগ্যতা প্রভৃতি শর্ত কঠোরভাবে আরোপ” করা যেতে পারে।
৩। অজ্ঞ ও বিজ্ঞ লোকদের ভোটের মূল্যমান যেন সমান না হতে পারে এজন্য “ভোটার জনগণের সততা, যোগ্যতা, জ্ঞান ও বুদ্ধির নিরিখে একটি স্কোরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। যার স্কোর যত বাড়বে, তার ভোটের মূল্যমানও তত বৃদ্ধি পাবে।”
৪। এসবের পরেও যদি কোনভাবে অযোগ্য ও অজ্ঞ লোকেরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েই যায় তবে “দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চালু করা যেতে পারে। একটি হলো- নিম্ন কক্ষ। এ কক্ষের সদস্যগণ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অংশ গ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। অপরটি হলো- উচ্চ কক্ষ।
এ কক্ষের জন্য সরকারপ্রধান যৌগ্যতা, সততা ও জ্ঞান-বুদ্ধি প্রভৃতি গুণ বিচারে দেশের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের মনোনয়ন দান করতে পারেন। উল্লেখ্য, নিম্নকক্ষের যেকোনো সিদ্ধান্ত উচ্চ কক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে। তদুপরি সরকারপ্রধান রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড উচ্চ কক্ষের সাথে পরামর্শ করে সমাধা করবেন। তবে রাষ্ট্রের জটিল সমস্যা যেমন সরকারপ্রধানের অপসারণ কিংবা যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি বিষয়ে উভয় কক্ষের সর্বসম্মতি কিংবা দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অভিপ্রেত হতে পারে।”
============
আসলে গণতন্ত্র সিস্টেমটি নিজস্বভাবে কোন খারাপ কিছু নয়। এর মধ্যে মানুষ নিজস্ব ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করিয়ে, নিজস্ব সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে তাকে সর্বোচ্চ ভালো বা শিরকী-কুফরি তকমা দিয়ে থাকে। অথচ গণতন্ত্র শুধুমাত্র একটি কনসেপ্ট, এর ভালো-মন্দ চর্চাকারীর উপর বর্তাবে। লেখকের ভাষায়,
“পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক অর্থে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় (অর্থাৎ জনসাধারণের এবং জনসাধারণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকারের কর্তৃত্ব) তার সাথে ইসলামের বড়ো ধরনের মিল আমরা খুঁজে পাই। গণতন্ত্রের মানে কখনও এমন নয় যে, একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে নাস্তিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে।…আমরা মনে করি, ইসলাম সর্বার্থে গণতন্ত্র নয়; আর গণতন্ত্রও সর্বার্থে ইসলাম নয়। গণতন্ত্র হলো নিছক মানব-অভিজ্ঞতার নির্যাস।”
আর গণতন্ত্র যেসব কারণে ইসলামবিরুদ্ধ হয় সেগুলো দূর করলে তা আর তেমন থাকে না। কারণ “শরীয়তের মূলনীতি হলো, নিরেট দ্বীনী বিষয় ছাড়া অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে যতক্ষণ না নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো দলীল পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা মুবাহ ও বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে একান্ত দ্বীনী বিষয় হলে তাতে নতুন কিছু সংযোজন করা বা উদ্ভাবন করা অবশ্যই জায়িয নয়।”
লেখকের কিছু কথা গুছিয়ে তুলে দিয়ে বইটির রিভিউ শেষ করছিঃ
শরীয়ত আমাদের এ স্বাধীনতা ও অধিকার প্রদান করেছে যে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে যে ব্যবস্থাই আমাদের জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর মনে হবে, তা-ই আমরা অবলম্বন করতে পারব। বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না, তা জানার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই হলো সর্বাধিক কার্যকর ও ফলপ্রসু ব্যবস্থা।… এ কারণেই আমি মনে করি, বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিই হলো অধিকতর উপকারী ও বাস্তবসম্মত। বর্তমানে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার গঠন করা ছাড়া যদি অন্য কোনো উপায়ে সরকার গঠন করা হয়, তাহলে বর্তমানে এর ফলে স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পথ খুলে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।”
“ইসলামের শূরা এবং গণতন্ত্র…সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন আকার ও অবয়বে এদের বিকাশ সম্ভব। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে…পুরোপুরি গ্রহণ অথবা পুরোপুরি বর্জন করতে হবে—এরূপ ধারণা করা ভুল। অনুরূপভাবে প্রাথমিক খিলাফতের ঘটনাকে শূরা পদ্ধতির একমাত্র উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে তাকে আঁকড়ে থাকা এবং বিকাশমান নিত্য-নতুন পরিস্থিতির প্রয়োজনকে উপেক্ষা করাও ভুল হবে।”
.
বইঃ গণতন্ত্র: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
লেখকঃ ড. আহমাদ আলী
প্রকাশনীঃ প্রচ্ছদ প্রকাশন - Prossod Prokashon
মূল্যঃ ১৩০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭৯

~ খোন্দকার শাহিল রেদওয়ান

পঠিত : ৩১৮ বার

মন্তব্য: ০