Alapon

ক্বলব : অসুস্থতা ও চিকিৎসা



"ক্বলব : অসুস্থতা ও চিকিৎসা"

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন সুগঠিতভাবে আমাদের দেহখানিও । তিনি পবিত্র কুরানুল কারিমে ইরশাদ করেন ,
“ আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতি উত্তম আকার আকৃতি দিয়ে।” [ সূরা ত্বিন : ০৪ ]
তো এই সুন্দর-সুগঠিত দেহটা নানান কারণে নানান সময়ে অসুসস্থ হয়ে যায় । আমরা তখন আমাদের এই দেহখানির চিকিৎসা করাতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ি । কারণ চিকিৎসা না করলে যে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা যায় না ! আনন্দে থাকা যায় না। অসুখটা সেরে ওঠাতে না পারলে আমরা কখনো কখনো মৃত্যুর মুখেও পতিত হই । যার কারণে ধনী-গরীব সব মানুষই অসুস্থ হলে সুস্থ হবার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করি।
এই যে দেহের বা শরীরের অসুস্থতা, এর পাশাপাশি আমাদের একটা ক্বলবও আছে । সেটাও কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটারও এভাবে চিকিৎসা দরকার । যত্ন দরকার।
আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেন প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা আছে । আল্লাহ এমন কোনো রোগ পাঠাননি যেটার চিকিৎসা তিনি প্রদান করেননি । [ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫১৬৩]
সে হিসেবে আমাদের রোগাক্রান্ত ক্বলবেরও চিকিৎসা আছে। কারণ সেটা যদি ঠিক থাকে তাহলে আমাদের সব ঠিক। আমরা একথাটিই জানতে পারি আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে। তিনি বলেন,
‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’ [বুখারি: ৫২]
কলবের একটা অর্থ হৃদয় বা অন্তর। এই কলব সম্পর্কেও মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে অনেকগুলো আয়াত আছে। আর সেসব আয়াতে কারিমায় কলবের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আলোচনার উল্লেখ রয়েছে। যেমন,
‘তাদের কলবগুলোতে রোগ আছে।’ [সুরা: বাকারা-১০]
রোগাক্রান্ত কলবের ক্ষতি কেমন— তা-ও পবিত্র কালামুল্লাহ মাজিদে আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা উল্লেখ করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে,
‘তাদের কলব রয়েছে, কিন্তু তারা তা দ্বারা বোঝে না।’ [সুরা আরাফ : ১৭৯]
তার মানে অসুস্থ-রোগাক্রান্ত অন্তরের অধিকারী ব্যক্তির দ্বারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, দ্বীনের বিধি-বিধান বুঝা সম্ভব নয়। অনুধাবন করা সম্ভব নয় সত্যকে। সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ একই আয়াতে পশুর সাদৃশ্যও উল্লেখ করেছেন।
এভাবে যদি কলব বা অন্তর অসুস্থ হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে পড়ে; তখন ধীরে ধীরে আমাদের সামগ্রীক সত্তাটা-ই পাপিত হয়ে যায়। আমরা পশুর হয়ে পড়ি চেয়েও অধম । আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা-ই তা বলেছেন। পাপের পরিণতিতে আমাদের রূহ এবং দেহটাও অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। অন্তর হয়ে পড়ে অশান্ত । ফলশ্রুতিতে আমরা আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ করে যাই হররোজ। এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন,
“শরীরের রোগ থেকে অন্তরের রোগসমূহ আরো কঠিন। কারণ শাররীক রোগ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কিন্তু অন্তরের রোগ মানুষকে অনন্তকালের দুর্ভাগ্যের ( জাহান্নামের) দিকে নিয়ে যায়”। [মিফতাহু দারিস সায়াদাহ, ১/৩০৬]
অন্তরের এই রোগগুলো কী কী? বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আলিমে দ্বীন, শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদের রচিত কিতাবে অন্তরের রোগ হিসেবে যেগুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো—
প্রবৃত্তির অনুসরণ, দুনিয়ার মহব্বত, নিফাকি, মাখলুকের প্রেমাসক্তি, গাফিলতি, ঝগডা-বিবাদ, অহংকার, নেতৃত্বের লোভ।
এছাড়াও যেগুলো হৃদয়কে কলুষিত করে-অন্তরকে নষ্ট করে বলে ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর তিব্বুল ক্বুলুব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
তা হচ্ছে; হিংসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, প্রদর্শনেচ্ছা, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যসহ ইত্যাদি।
এগুলোই পাপিত-রোগগ্রস্ত কলবের নমুনা । এসব কারণেই অন্তরের শান্তি হারিয়ে যায়। হৃদয়টা প্রশান্তিহীন অস্থির হয়ে পড়ে। হৃদয়-মনে সব সময় সর্বাবস্থায়-ই অস্থিরতা বিরাজ করে।
আল্লাহর রাসূলের প্রখ্যাত সাহাবি জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন;
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন প্রতিটি ব্যাধির-ই প্রতিকার রয়েছে। অতএব রোগে যথাযথ ঔষধ প্রয়োগ করা হলে আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য লাভ হয়। [মুসলিম: ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৫৫৩]
সে হিসেবে ক্বলবের রোগসমূহেরও চিকিৎসা আছে। সে অনুযায়ী চললে পাপিত-অশান্ত-অসুস্থ ক্বলবকেও সুস্থ করা, শান্ত-স্থির করা বা রাখা সম্ভব ।
পাপিত-রোগগ্রস্ত-অশান্ত যে কলব, প্রশান্তিহীন যে হৃদয়— যখন তাতে শান্তি থাকে না, তখন কীভাবে সেটায় প্রশান্তি পাওয়া যায়, পবিত্র কুরআন মাজিদ তা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে বলেন,
“ নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়। [ সূরা রা’দ : ২৮]
এ সম্পর্কে তথা আল্লাহর স্মরণের উপকারিতা সম্পর্কে, রোগাক্রান্ত অন্তরের চিকিৎসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি তার প্রভুর স্মরণ করে আর যে করেনা—তাদের উদাহরণ হলো জীবিত এবং মৃত ব্যক্তির ন্যায়। তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশোবার سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ (সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী) পাঠ করবে, তার পাপ যদি সমুদ্রের ফেনার সমতূল্যও হয়, তবুও আল্লাহ দয়া করে তা ক্ষমা করে দিবেন।” [বুখারি: ৬৪০৫-০৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, যে ব্যক্তি দিনে একশোবার لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ‏ (‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ও-লাহুল হামদু ও-হুয়া 'আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’) পড়ে সে ব্যক্তি দশটি দাস স্বাধীন করার সওয়াব পাবে, তার জন্য একশোটি নেকি লেখা হবে এবং তার একশোটি গুণাহ মিটিয়ে দেয়া হবে। ওইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে তার রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তার চেয়ে উত্তম আর কেউ হবে না। [বুখারি: ৬৪০৩ ]
এভাবে আমরা যদি আমাদের কলবকে আল্লাহর জিকিরে-ফিকিরে ব্যস্ত রাখতে পারি, তাহলে ইন শা আল্লাহ রোগ এসে বাঁধবেনা। কোনো রোগ (পাপ) যদি আমাদের আঘাত করে, আক্রমণ করতে আসে, তখন সে রোগ স্থায়ী হতে পারবেনা। আমাদের আত্মাকে চিরস্থায়ী আখেরাতে আজাবের মুখোমুখি হওয়া লাগবেনা। আমরা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমেই আত্মার যত্ন নেয়াটা সম্ভবপর হবে। অন্তরের এই যে রোগ, এ-রোগের সুস্থতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়াও একটা চমৎকার সাজেশন দিয়েছেন। তিনি বলেন,
কলবকে অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় পরিণত করা কেবল ইলমের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই তো আল্লাহ তার কিতাবের নাম দিয়েছেন অন্তরের রোগসমূহের সুস্থতা। আর এ কারণেই শরীরের চিকিৎসক ডাক্তারেরা আর অন্তরের চিকিৎসক আলিমেরা” । [মিফতাহু দারিস সায়াদাহ, ১/৩০৫]
এখান থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? তা হচ্ছে এই যে— আমরা কুরআনের ইলম অর্জন করবো। আলিমদের সংস্পর্শে থাকবো। আর আল্লাহকে ভালোবাসবো। কারণ, এই দুনিয়ায়ও তো আমরা যাকে ভালোবাসি, তার কথা-ই হরহামেশা স্মরণ করি। চিন্তা-ভাবনার বিশাল একটা অংশজুড়ে থাকে সে ভালোবাসার ব্যক্তিটি কিংবা সে ব্যস্তুটি। আর যদি আমরা সত্যিকারের-ই আল্লাহর ভালোবাসার দাবিদার হই, কিংবা ভালোবাসি, তাহলে অবশ্যই আমাদের ধ্যান-ধ্যারণায়, আমাদের চিন্তা-ভাবনায় বিরাজিত থাকবে আল্লাহর জিকির-ফিকির। আসলে এটাই কলব বা অন্তরের স্বরূপ-প্রকৃতি। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে একটা মজলিশে ওনার কিছু ছাত্রবৃন্দু অন্তরের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
“অন্তরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহকে ভালোবাসার জন্যে। আল্লাহর ভালোবাসা-ই হলো অন্তরের আসল স্বভাব বা প্রকৃতি”। [রূহের চিকিৎসা]
এখন আমরা যদি সত্যিকারের মুসলিম হয়ে থাকি; তাহলে আমাদের দেহখানির, সে দেহের নানান অঙ-প্রত্যঙের যেভাবে যত্ন নিই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাই, তদ্রুপ আমাদের অন্তরটাকেও এভাবে যত্ন নিতে নিতে হবে । আল্লাহর রাসূল (সঃ) যেভাবে যত্ন নেয়ার, চিকিৎসার নেয়ার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, আমাদের আকাবির-আসলাফগণ আল্লাহ-রাসূলের নির্দেশনার মধ্যে থেকে যে পন্থাগুলো আমাদের বাতলে দিয়েছেন, আমরা যদি সেভাবে নিজের ক্বলব বা অন্তরের যত্ন নিতে পারি তাহলে ইন শা আল্লাহ আমাদের অন্তরটাও বিশুদ্ধ থাকবে । আমরা কর্মে গতি পাবো । পাপমুক্ত থাকতে পারবো । হতে পারবো জান্নাতের বাসিন্দা ।

-রেদওয়ান রাওয়াহা
[ লেখাটি দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত]

পঠিত : ৭৮৫ বার

মন্তব্য: ০