Alapon

প্রফেশনাল ক্রিকেট হালাল নাকি হারাম...?



প্রফেশনাল ক্রিকেট হারামের পক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করানো হয়। কেউ বলেন, 'খেলাকে পেশা বানানো বৈধ নয়।' যদিও এই বিষয়টি বেশ দ্বিমতপূর্ণ। একদল ফুকাহার মতে, কোন জিনিস স্বত্তাগতভাবে হালাল হলে তাকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। যেহেতু ক্রিকেট স্বত্তাগতভাবে বৈধ খেলার অন্তর্ভুক্ত, তাই পেশা হিসেবে একে হারাম বলা যাবে না (তবে অনুত্তম নিঃসন্দেহে)।

পেশাদার ক্রিকেট হালাল/হারাম বিতর্কের সমাধানের মূল পদ্ধতি হচ্ছে: ক্রিকেটারদের প্রাপ্ত অর্থের (মাসিক বেতন, ম্যাচ ফি, পুরস্কার) উৎসের খোঁজ করা। অর্থপ্রাপ্তির উৎসমূল হারাম হলে, অর্থ গ্রহণও এমনিতেই হারাম বলে গণ্য হবে।

ক্রিকেটারদের বিপুল অর্থ-কড়ির প্রাপ্তির পেছনে মূল যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, ICC (International Cricket Council). আইসিসির আয়ের মূল উৎস বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট (Oneday/T20 world cup, Champions Trophy). আয়কৃত অর্থের বড় অংশই আইসিসিভুক্ত সদস্য দেশগুলোর মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। দ্বি- পাক্ষিক (যেমন- পাকিস্তান দলের বাংলাদেশ সফর) আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো থেকে ICC কোন আয় করে না, এসকল ম্যাচের সত্ত্বের মালিকানা সদস্য দেশগুলোর একান্ত। তাই, রাজস্ব বৃদ্ধি করতে আইসিসিকে নতুন নতুন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হয়।

এবার চলুন দেখি, বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে আইসিসি কোন কোন মাধ্যম থেকে রাজস্ব পায়―
আইসিসির মোট রাজস্বের প্রায় পুরোটাই আসে (১) স্পন্সরশীপ (২) টেলিভিশনসত্ত্ব (৩) সদস্য সাবস্ক্রিপশান থেকে।

■ স্পন্সরশীপ ■
আইসিসির রাজস্বের স্তম্ভ বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান সমূহ তিনভাগে বিভক্ত। গ্লোবাল পার্টনার, অফিশিয়াল পার্টনার এবং ক্যাটাগরি পার্টনার। এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত মোট ১৪ টি পণ্যের মধ্যে অর্ধেকই সরাসরি মদ ও সুদী পণ্য!!! পণ্যগুলো হচ্ছে―

ভারতের আধুনিক ক্রাফ্ট বিয়ার ব্র্যান্ড, "বিরা ৯১ (Bira91)".
অস্ট্রেলিয়ার গ্লোবাল ওয়াইন ব্র্যান্ড, "জ্যাকবস্ ক্রিক (Jacob's Creek)".
ভারতীয় হুইস্কি ব্র্যান্ড, "রয়্যাল স্ট্যাগ (Royal Stag)".
অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্ম "Dream11"(মুম্বাই, ভারত).
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সুদী প্রতিষ্ঠান, "মানিগ্রাম (Money Gram)".
ভারতের বৃহত্তম অনলাইন সুদী প্ল্যাটফর্ম, "আপস্টক্স (UPSTOX)".
...এরাই আইসিসির রাজস্বের উৎস হিসেবে কাজ করে।

■ সদস্য সাবস্ক্রিপশান ■
টেলিভিশনসত্ত্ব বড় সমস্যা না হলেও সদস্য সাবস্ক্রিপশান বিষয়টা জুয়ার অনুরূপ। ব্যাপারটা হচ্ছে, আইসিসিভুক্ত দেশগুলোকে সদস্য সাবস্ক্রিপশান ফি হিসেবে অর্থ দিতে হয়, যা আইসিসির ফান্ডে রাজস্ব হিসেবে জমা থাকে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত সবচেয়ে বেশি ফান্ডিং করে। অন্যদিকে, ভারতের ক্রিকেট বোর্ড আইপিএল থেকে বিপুল আয় করে, যার বেশ বড় অংশ মদের বিজ্ঞাপন থেকে আসে।

আবার এখানে জুয়ার সমস্যা আছে। কোন প্রতিযোগিতা থেকে পুরস্কার গ্রহণ বৈধ হওয়ার শর্ত হলো, তৃতীয়পক্ষকে ফান্ডিং করতে হবে, যিনি প্রতিযোগী নন। কিন্তু নিজেরা অর্থ দিয়ে আয়োজন করে আবার নিজেরাই অংশগ্রহণ করে একপক্ষকে পুরষ্কৃত করা জুয়া। সদস্য সাবস্ক্রিপশান পদ্ধতি জুয়ার দোষে দুষ্ট।

■ ক্রিকেটারদের উপার্জিত অর্থের উৎস ■
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বোর্ডের যাবতীয় আয় আসে ক্রিকেট থেকে এবং ক্রিকেটারদের মাধ্যমে ((বাংলাদেশ সরকার কিংবা জনগণের আয়কর থেকে কোন অর্থ আসে না))। আইসিসির রাজস্ব খাত বিসিবির আয়ের একটি বড় উৎস (( বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট থেকে আয়ের বেশিরভাগ অংশ আইসিসি সদস্যদেশ সমূহে বন্টন করে দেয়))

✪ সারাংশ হচ্ছে: ✪
মাদক, সুদি, জুয়ার খাত ――>> আইসিসির রাজস্বের ভিত্তি ――>> বিসিবির রাজস্বের বৃহৎ অংশ আসে আইসিসি থেকে ――>> ক্রিকেটাররা যাবতীয় অর্থ (বেতন, ম্যাচ-ফি, পুরস্কার) পায় বিসিবি থেকে।
তাহলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের প্রাপ্ত অর্থের মূলে রয়েছে মাদক, সুদি, জুয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।

■ একটি সংশয় ■
আইসিসির স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা মাদক,সুদি,জুয়া... ইত্যাদির কারবার থেকে পৃথক। যেমন- জাপানি অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক কোম্পানি নিশান (Nissan), চীনা মোবাইল কোম্পানি অপো (OPPO), এমআরএফ টায়ার, বুকিং ডট কম, এমিরেটস এবং বাইজু।

তাছাড়া বিসিবির স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও দেশি অনেক বৈধ ব্যবসায়িক (দারাজ, আরএফ এল, ওয়াল্টন, ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও ম্যাচটিকিট বিক্রি, টিভিসত্ত্ব থেকে বেশ বড় অংকের রাজস্ব আসে।

অতএব, পুরো প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই― ক্রিকেটারদের প্রাপ্ত অর্থ (বেতন, ম্যাচ-ফি, পুরস্কার) হালাল এবং হারাম মিশ্রিত। হারামের অংশ বেশি অথবা, সমান সমান হবে।

এক্ষেত্রে শরয়ী হুকুম কি?

প্রফেশনাল ক্রিকেট বৈধ/হারামের হুকুম এই একটি বিষয়ের উপর ঝুলে রয়েছে। সেটা হচ্ছে, হালাল-হারাম মিশ্রিত উৎস থেকে অর্থগ্রহণের হুকুমের উপরে।
এ ব্যাপারে শরয়ী উসুল হচ্ছে:
فى الفتاوى الهندية- أهدى إلى رجل شيئا أو أضافه إن كان غالب ماله من الحلال فلا بأس إلا أن يعلم بأنه حرام ، فإن كان الغالب هو الحرام ينبغي أن لا يقبل الهدية ، ولا يأكل الطعام إلا أن يخبره بأنه حلال ورثته أو استقرضته من رجل ، كذا في الينابيع
সারমর্ম:
কোন প্রতিষ্ঠানের #সমস্ত_আয় হারাম হলে সেখান থেকে ১ টাকাও পারিশ্রমিক হিসেবে গ্রহণ করা হারাম। যদি হালাল/হারাম মিশ্রিত হিসেবে থাকে, কিন্তু #হালাল_অংশ_সর্বাধিক হয়, তাহলে পারিশ্রমিক নেয়া বৈধ হবে। কিন্তু যদি #হারাম _অংশ_বেশি থাকে তাহলে পারিশ্রমিক হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের বেশিরভাগ গরিবদের মাঝে সদকাহ করে দিতে হবে। #হারাম_অর্ধেক হলে, পারিশ্রমিক হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক সদকাহ করতে হবে (সওয়াবের নিয়ত ছাড়া)।

অর্থাৎ, হারাম অংশের আনুপাতিক হিসাব করে সদকাহ করতে হবে।
من ملك بملك خبيث ولم يمكنه الرد الى المالك فسبيله التصدق على الفقراء

■ চূড়ান্ত হুকুম ■
বাংলাদেশের প্লেয়াররা মাসিক যে অর্থ পায় সেটা সরকার থেকে নয়, বিসিবি থেকে, যার অর্থের উৎস হালাল-হারাম মিশ্রিত। আবার বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট কিংবা ম্যাচ-ফি, পুরস্কারের অর্থের বড় অংক আইসিসি থেকে সরাসরি আসে। যার বেশিরভাগ হারাম।
অতএব, ক্রিকেট খেলে উপার্জিত টাকার খুব অল্প অংশ বৈধ, বেশিরভাগ উপার্জন হারাম। তাই, ক্রিকেটকে কোনভাবেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ হবে না।

- মুহাম্মদ আল ফাতিহ

পঠিত : ৪৮৭৯ বার

মন্তব্য: ০