Alapon

বিশ্বায়নের যুগে মুসলিম নারী



বিশ্বায়নের যুগে মুসলিম নারী
~আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ

সমাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র—দুটি ধারার মুসলিম নারীদের অবস্থান ঠিক কেমন; একটু বুঝা দরকার। ইতিহাসের আঙ্গিকে তাদের নারীবিষয়ক কর্মকাণ্ডের একটি ফিরিস্তি তুলে ধরা উচিত।
১৯১৭ সালে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয় রাশিয়ায়। সুষম বণ্টন এবং সাম্যবাদের ওপর নির্ভর করা এই সমাজব্যবস্থা ইসলাম এবং নারীকে ঠিক কতটুকু মর্যাদা দিয়েছে, তার একটা সহজ নমূনা সোভিয়েত ইউনিয়নকর্তৃক আফগান আগ্রাসনের সময়কার নারীদের ওপর চালানো ভয়ঙ্কর সব চিত্র—একইভাবে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী বোখারা, তাসকন্দ, সমরকন্দ, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানের মুসলিম পুরুষ এবং নারীদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতন।
একত্ববাদের ওপর বিশ্বাসী হওয়ায় নারীদের ওপর চালানো কঠিন সেসব অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরাও অনেকটা কষ্টসাধ্য। মুসলিম নারীদের তাদের হীনচেষ্টা চরিতার্থে বাধ্য করা হতো। অন্যথায় ধর্ষণের পর লজ্জাস্থানের আঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হতো। এমনসব ভয়াবহ চিত্র কীভাবে একজন সাম্যবাদির কাজ হতে পারে?
উইকিপিডিয়ার হিসাব অনুযায়ী ১৯৭৯ সন থেকে ১৯৮৯ সন পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে পাঁচ থেকে পনেরো লক্ষ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে রাশিয়া। এছাড়াও আহত, নিজেদের দেশে উদ্বাস্তু হয় আরও লক্ষ লক্ষ আফগানি।
এই সময়জুড়ে আফগান নারীরা হয় লাঞ্ছিত অপদস্ত। গর্ভবতী নারীদের গর্ভে আঘাত করে হত্যা করা হয় মা ও শিশুকে। যৌনসঙ্গী হতে অবাধ্য হওয়ায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শত-শত তরুনীকে। নারীদেহ হয়ে যায় তাদের কাছে শুধুমাত্র ভোগপণ্য।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র টিচিং অ্যাসোসিয়েট আয়শা আহমেদ বলেন :
‘কমিউনিস্ট দখলের অধীনে—ধর্ষণ, বিদ্রোহ দমনের সামরিক কৌশল হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সম্ভবত আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক সম্মানের গুরুত্বের কারণেই ধর্ষণকে সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় একটি প্রচলিত সামরিক কৌশলে পরিণত করা হয়েছিল। যা কাজে লাগানো হয়েছিল শত্রু দলগুলোকে ভয় দেখানো এবং আতঙ্কিত করতে। ধর্ষণ এবং নির্যাতন বিশেষভাবে সেসব গ্রামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল, যারা প্রতিরোধকে সমর্থন করে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। সৈন্যরা তাদের পুরুষ আত্মীয়দের সামনে মহিলাদের ধর্ষণ করেছিল বলে রিপোর্টও করা হয়েছিল। আফগান নারীরা যদিও সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে সক্রিয় যোদ্ধা ছিল না—তবুও “ইচ্ছাকৃত এবং নির্বিচারে হত্যা, নিপীড়ন, সন্ত্রাসী কৌশল, বঞ্চনা—একইভাবে সোভিয়েতপন্থী মিলিশিয়াদের দ্বারা যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং পতিতাবৃত্তির সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।”’ 1
এমনই ছিল সাম্যবাদী নারীঅধিকার রক্ষাকর্তাদের কাছে নারীজাতীর মূল্য। সোভিয়েত যেখানেই হামলা করেছে, বিদ্রোহ দমনের নামে নারীদের উপর চালিয়ে গিয়েছে এমন অমানবিক নির্যাতন। তাদের কাছে নারীরা কীভাবে নিরাপদ হতে পারে বলে ভাবা যায়!
এই তো কদিন আগে ন্যাটো-আফগান যুদ্ধ শেষ হলো। হাজার হাজার আফগান জনগণের রক্ত পাণ করে নিজেদের দেশে উড়াল দিল পরাজয়ের স্বাদ নিয়ে। প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার, মানুষের জীবন ধ্বংসে ব্যবহার করে নাম দিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’।
একাত্তর হাজার বেসামরিক মানুষ হত্যার পর যখন তারা আফগান ভূমি ছেড়ে পালালো, নারীঅধিকারের নামে তখন তাদের মুখে শ্রুতিমধুর প্রতিশব্দ। আশংকা প্রকাশ করতে থাকল নারীনিরাপত্তার প্রতি। কিন্তু তারা কি আদৌ মানুষের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি রেখেছিল? 2
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রজেক্ট অনুযায়ী মার্কিন-আফগান যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। রাস্তায় মাইন পুতে শিশুদের স্কুলে না যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
এসবকিছুকে এড়িয়ে শুধু নারীঅধিকার নিয়ে চিন্তিত মনোভাব; সাংবাদিকের ভাষায়—যেন আমেরিকা হামলা চালিয়েছিল নারীঅধিকার আদায় করতেই। আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে নারীক্ষমতায়নের জন্যই। কিন্তু বাস্তবতা তো আমাদের বলে আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে আফগানভূমি ধ্বংসের জন্য। আকাশ থেকে টনকে টন বোম ফেলে বিরান করে দেওয়া হয়েছে শত-শত ফসলি জমি, ঘরবাড়ি। সেখানে নারীঅধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য—এ তো এক ধোঁয়াশা মাত্র।
ন্যাটো অংশীদার ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের অধিকার কতটুকু দেওয়া হয়েছে? ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ সনে ফ্রান্স পার্লামেন্ট মুসলিম নারীর নিকাব নিষিদ্ধ করে।2| ১২ এপ্রিল ২০১১ সনে নিকাব পরায় এক মুসলিম নারীকে জরিমানা করা হয়।3| এ-ই কি নারীস্বাধীনতার বাস্তব রূপ?
বিশ্বায়নের এই যুগে সবাই যখন অন্যের ওপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত; তখন প্রশ্ন ওঠে আধুনিক এই সভ্যতাগুলো ঠিক কতটুকু মানুষের জন্য উপকারী। বিশেষ করে নারীজাতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়। আর এসব সভ্যতাগুলোও খুব সচেতনভাবে নারীঅধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করে। কিন্তু বাস্তবতা এবং নারীদের সাথে তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ, তাদের মুখোশ উন্মোচনে যথেষ্ট হয়ে যায়। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে তা স্পষ্ট অবলোকন করা যায়। না সেগুলো নারীদের জন্য উৎকৃষ্ট না মুসলিম নারীদের জন্য।
1- https://www.jstor.org/stable/42909150
2- ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’-এর ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্তের হিসাব।
https://watson.brown.edu/costsofwar/search?query=Afghan...
3- https://en.m.wikipedia.org/wiki/French_ban_on_face_covering
4- the guardian Tue, 12 Apr, 2011

পঠিত : ২৩১ বার

মন্তব্য: ০