Alapon

তুরস্কের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ও কিছু কথা



"অনেকেই এরদোয়ান ও তুরস্কের সমালোচনা করেন। বর্তমান সময়ে তুর্কী ইজ এরদোয়ান। এরদোয়ান ইজ তুর্কী। তাই এরদোয়ানের সমালোচনা মানে তুরস্কের সমালোচনা। তুরস্কের সমালোচনা মানে এরদোয়ানের সমালোচনা। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখে তারাও সমালোচনা করে, আর যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না তারাও সমালোচনা করে। যারা গভীর জ্ঞান রাখে তাদের সমালোচনা দু ধরনের। এক, এরদোয়ান কট্টরপন্থী এক নেতা। সে তুরস্কের ইসলামিকরণ করছে। সেকুলার তুরস্ককে মুছে ফেলছে। ইসলামকে ঢাল বানিয়ে নিজের ক্ষমতা পাকা পোক্ত করছে। সে ওসমানী খিলাফাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। দুই, এরদোয়ান ইসলামকে ব্যবহার করে ক্ষমতা পাকা পোক্ত করছে। সে তুরস্কের স্বার্থ দেখে। সে তুর্কী পুতিন। এক নিষ্ঠুর রাজনৈতিক। রাজনীতিতে আদর্শের কোন জায়গা নেই। আর যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখে না তথাকথিত মুসলিম। যারা খেলাফাত চায় বলে লাফালাফি করে তাদের সমালোচনা হলো এরদোয়ান খেয়ালী মনের মানুষ। ইহুদি খ্রিস্টানদের বন্ধু। কারণ সে ক্ষমতায় থাকার পরও তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য ও ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক রেখেছে। এরদোয়ান হচ্ছে মডারেট। তুর্কী জাতিয়তাবাদী। এর কাছে নিজের ও তুর্কীদের স্বার্থই আসল। এ মুসলিম নেতা নয়। এখন এই তথাকথিত মুসলিমদের অভিযোগগুলোর জবাব দেওয়া যাক।
তথাকথিত মুসলিমদের অভিযোগ তুরস্ক এরদোয়ানের শাসনামলেও ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক আছে। আর মুসলিম দেশগুলোর ভিতর তুরস্ক ইসরায়েলের সাথে সবচেয়ে বেশী বাণিজ্য। এটার জবাব হলো তুরস্ক সর্ব প্রথম মুসলিম দেশ যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৪৯ সালে। তুরস্কে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর ২০০৫ সালে এরদোয়ান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের সমস্যার সমাধানে মধ্যস্ততার প্রস্তাব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ২০০৫ সালে ইসরায়েল সফর করেন। ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন এবং বুঝতে পারেন ইসরায়েলের শুধারাবে না। তিনি ঐ সফরে আল আকসা মসজিদে যান এবং সালাত আদায় করেন। ইসরায়েল সফরে যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো আল আকসায় যাওয়া। এরপর ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কে শীতলতা আসতে থাকে। তুরস্ক গাজায় সাহায্য পাঠানোর জন্যই ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক রেখে থাকে। তুরস্ক গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য গাজায় ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাঠিয়েছে। যা গাজায় বিদ্যুৎের চাহিদা মেটায়। এছাড়া তুরস্ক গাজায় মানবিক, প্রযুক্তি দিয়ে আসছে। ২০১০ সালে ইসরায়েলর প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজার জন্য তুরস্কের পাঠানো ত্রাণবাহী জাহাজকে আক্রমণ করে। জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ৮ জন তুর্কী নাগরিক নিহত হয় এবং আমেরিকান নাগরিকও নিহত হয়। ইসরায়েলের এই আক্রমণ আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়। তুরস্ক থেকে ইসরায়েলি দূতকে ফেরত পাঠানো হয়। আর ইসরায়েল থেকে তুর্কী দূতকে ডেকে পাঠানো হয়। তুরস্ক ইসরায়েল কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। ২০১৪ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তুরস্ক এবং ইসরায়েলের অচল অবস্থা কাটাতে মধ্যস্থতা করে। ওবামার মধ্যস্থতার পর বেনজামিন নেতানিয়াহু এরদোয়ানকে ফোন করে ক্ষমা চান।
আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০ মিলিয়ন ডলার দেন। ইসরায়েল কোন দেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে এই ইতিহাস বিরল। সেখানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর তুর্কী প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাওয়া তুরস্কের অনেক বড় বিজয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে এরদোয়ান তুর্কী প্রধানমন্ত্রী থাকা কালীন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করার পর এরদোয়ান ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেন। বর্তমানে গত বছর তুরস্ক ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ভালো করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর দুটি উদ্দেশ্য। এক, ইসরায়েলর যাতে তুর্কী বিরোধী জোট গঠন যাতে সাময়িক ভাবে বিলম্বিত হয়। দুই, গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর পরিমাণ বাড়ানো। সব মিলিয়ে প্রতিয়মান হয় এরদোয়ানের শাসনামলে ইসরায়েলের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় কারণ হলো ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করা। তুরস্কের সাথে ইসরায়েলের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই কুটনৈতিক সম্পর্ক থাকা যে কোন দেশের সাথেই থাকে। তুরস্ক ইসরায়েলে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। আর ইসরায়েল তুরস্কে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। তুরস্ক এবং ইসরায়েলের দ্বি পাক্ষিক বাণিজ্যে তুরস্ক বেশী লাভভান। অন্যদিকে তুরস্ক সামান্য কিছু অস্ত্র ইসরায়েল থেকে আমদানি করে। এটা সময়ের সাথে বাড়ছে। এটা বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করার জন্য ইসরায়েলের সাথে এতটুকু সম্পর্ক রাখতেই হবে। তবে ২০২৮ সাল নাগাদ এটার পরিবর্তন হতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠে যে, আরব বিশ্ব এখন যা করছে তা তুরস্কও করছে। তাহলে তুরস্ক এবং অন্যান্য আরব দেশের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য হলো তুরস্কের সাথে ইসরায়েলের কুটনৈতিক সম্পর্ক এরদোয়ানের আমলে স্থাপিত হয় নি। তুরস্কের সাথে ইসরায়েলের সব ধরনের সম্পর্ক থাকলেও তুরস্ক ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। গাজায় সবচেয়ে বেশী মানবিক সহায়তা পাঠায়। এরদোয়ান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বক্তব্যও দেন। বিগত ৫ বছরে আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোকে ইসরায়েলের নিন্দা করতে দেখা যায় নি। যদি বলা হয় এটাতে রাজনৈতিক ফায়দা আছে। তাহলে কী আরব দেশগুলো রাজনৈতিক ফায়দার জন্য এটা করতে পারতো না? তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্বের সাথে লাগাতার সংঘর্ষ করছে তাঁর ফলে তুরস্কের অর্থনীতিকে আঘাত করা হচ্ছে। তাহলে কী বলা যায় তুরস্ক আর আরব দেশগুলো সমান? এরদোয়ান যদি আসলেই তুর্কী জাতীয়তাবাদী হতেন তাহলে এসব করতেন? যদি বলা হয় এটা এরদোয়ানের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। তাহলে বলবো আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ সকল আরব দেশ প্রভাব বিস্তারের জন্য এটা না করে এর উল্টোটা করছে কেন? তুরস্ক কেন ন্যাটোর সদস্য তা নিয়ে আরেক দিন লিখবো।
[সমাপ্ত]

তুরস্কের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ও কিছু কথা
লেখিকাঃ জান্নাত খাতুন
ইন্টারন্যাশেনাল নিউজ এডিটর, হাভার টার্ক।
তথ্যসূত্রঃ Israel (ISR) and Turkey (TUR) Trade |
OEC
Turkish Leader Visits Israel, Restoring
Friendly Ties - The New York Times
May 2, 2005.
Turkey set to send floating power
generator to Gaza | Daily Sabah -
August 20, 2014.
Israeli attack on Gaza flotilla sparks
international outrage - The Guardian
May 31, 2010.
A decade has passed, but the Mavi
Marmara killings I saw still shape -
Al-Jazeera - 30 May, 2020.
Recep Erdogan storms out of Davos
after clash with Israeli president -
The Guardian - January 30, 2009.
Turkey expels Israeli ambassador -
Ynetnews - February 9, 2011.
Turkey expels Israel's consul in
Istanbul in escalating tit for tat - 16
May, 2018.

পঠিত : ৯৯৫ বার

মন্তব্য: ০