Alapon

মুক্তিযুদ্ধ ও বাটা স্যু কোম্পানি



উসমানী সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে মুসলিম পরিচয়ে রাষ্ট্র গঠন হওয়া ছিল একমাত্র ঘটনা। পৃথিবীর প্রায় সব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র চেয়েছিল পাকিস্তান যাতে ভেঙে যায়। এজন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছিল। ২২ মার্চ পাকিস্তান বিষয়ে পাকিস্তানের নেতারা (ইনক্লুডিং শেখ মুজিব) ঐক্যমতে পৌঁছে যাওয়ায় সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিউক্লিয়াস শেখ মুজিবকে চেপে ধরেছে যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী না হন।

ভারত, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড থেকেও চাপ অব্যাহত থাকে যাতে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চাপের অংশ হিসেবে ২৩ মার্চ রাশিয়া ও ইংল্যান্ড তাদের ঢাকাস্থ দূতাবাসে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। বলাবাহুল্য মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার আগেই দুটি রাষ্ট্র প্রকাশ্যে স্বাধীনতাকে সাপোর্ট করে। এর দ্বারা অনুমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এসব রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ছিল দীর্ঘদিনের।

যাই হোক আমরা আজ এমন একজন দক্ষ গোয়েন্দা নিয়ে কথা বলবো যিনি হিটলারকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম ছিলেন। তার নাম ওডারল্যান্ড। পুরো নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জার্মানি কর্তৃক নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার পর তিনি জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন। তার উপুর্যপুরি আক্রমণে হিটলার বাহিনী নাজেহাল হয়। এক পর্যায়ে জার্মান গোয়েন্দারা ওডারল্যান্ডকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তবে তাকে ধরে রাখা জার্মানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যান এবং হল্যান্ডের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে থাকেন। জার্মানদের পরাজয়ে তার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল।[৪৪৮]

২য় বিশ্বযুদ্ধের ২৫ বছর পর ওডারল্যান্ড তখন বড় গোয়েন্দা অফিসার। ব্রিটেন পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে তাকে কাজে লাগাতে চায়। তিনি রাজি হন। এরপর ঢাকায় তিনি তার বাহিনীর সদস্যদের পাঠান। তারা নিউক্লিয়াস, আওয়ামী লীগ,সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়েন। ৭০ সালের শেষদিকে যখন পাকিস্তানের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় বেছে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীরা, তখন ওডারল্যান্ড নিজেই ঢাকায় আসেন।

এত বড় একজন গোয়েন্দা অফিসার ঢাকায় আসবেন ও কাজ করবেন, পাকিস্তানী গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই তা সহজ চোখে দেখবে না। তাই তিনি 'বাটা স্যু কোম্পানি'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে ঢাকায় আসেন। যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বাটার নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি নেন। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় ছিল তার অবস্থান। সেখান থেকেই তিনি একইসাথে সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যুক্ত ছিলেন। [৪৪৮]

বাটা স্যু কোম্পানী ভালো ব্যবসা করেছে মিত্রবাহিনীর সেনাবাহিনীর জন্য জুতো তৈরি করে। সেই হিসেবে ওডারল্যান্ড পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জুতো,বেল্ট ইত্যাদি তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে ঢাকার বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে।

এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।

নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাকে 'সম্মানিত অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করা হয়। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর (পরবর্তীতে লেফটেনেন্ট জেনারেল) জিয়াউর রহমান এর কাছে। [৪৪৯]

মার্চের শুরুতে আওয়ামী কর্মীরা যে অরাজক পরিস্থিতি ও গণহত্যা চালিয়েছিল এতে পরিকল্পনা ও অস্ত্র সহায়তা দিয়েছেন ওডারল্যান্ড। বাটা স্যু কোম্পানির মালামালের সাথে তিনি অস্ত্র, বোমা ও গোলাবারুদ পরিবহন করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ভারত থেকে আসা নিরীহ ও গরীব মুহাজির বিহারিদের ওপরে গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তারই।

একইভাবে যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে অস্ত্র সাহায্য করতেন। ওডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। তার প্রতিটি কাজের সাইনবোর্ড ছিল বাটা স্যু কোম্পানি। যার কারণে তিনি সবসময় রাষ্ট্রের সন্দেহের বাইরে থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই আওয়ামী কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

তিনি দুই নং সেক্টরের গেরিলাদের থেকে আশানুরূপ সাফল্য পাননি। হতাশ হয়ে তিনি নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি তার ঢাকাস্থ গোয়েন্দাদের নিয়ে একের পর এক টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। সেনাবাহিনীর সাথে সখ্যতা থাকায় তাদের অভিযানের খবর ও অবস্থানের খবর আগেই বিদ্রোহীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এতে সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়।

এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বাংলাদেশে বিহারিদের ওপর করা নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার ছবি তুলে ব্রিটিশ মিডিয়াতে পাঠাতে থাকেন। নিজেই বিহারিদের হত্যা করে তাদের বাঙ্গালি বলে চালিয়ে দেন এবং বহিঃবিশ্বে খবর পৌঁছে দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালি গণহত্যার মিথ্যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়।

যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার বাটা স্যু কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ওডারল্যান্ডকে 'বীরপ্রতীক' সম্মাননায় ভূষিত করে। [৪৫০] স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭ নম্বর।

তথ্যসূত্র :
৪৪৮- Ouderland, William AS / Banglapedia / https://bit.ly/3bsFJiG / Access in 9 mar 2021
৪৪৯- জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা / মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া / সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ / পৃ. ৬০-৬৩
৪৫০- বিদেশি বীর প্রতীককে নিয়ে আজ তথ্যচিত্র / প্রথম আলো / ৯ আগস্ট ২০১৬ / https://bit.ly/3v7g6f0

- প্রকাশিতব্য বই 'বঙ্গকথা' থেকে।

পঠিত : ৫৫১ বার

মন্তব্য: ০