Alapon

এই লাল রঙ আসলে কিসের প্রতীক?



এই লাল রঙ আসলে কিসের প্রতীক?
=========================
বাংলাদেশের নাম, পতাকা সবটাই ঠিক করেছে সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস। লাল সবুজের এই পতাকার রহস্য খুব কঠিন হয়ে আসছে আমার কাছে। মিলাতে পারছি না। তবে একটা সূত্র পেয়েছি। যদিও এখনো ধোয়াশা থেকে গেছে।
বাংলাদেশের পতাকা অঙ্কিত হয় ১৯৭০ সালের ৬ জুন। কাজেই এর লাল রঙের সাথে পরবর্তী বছরের কথিত তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের মাধ্যমে অর্জিত সূর্যের সম্পর্ক অবাস্তব, অলীক। ফলেই মূলত সৃষ্টি হয়েছে পতাকার এই রহস্যটা। তাহলে এই লাল রঙ আসলে কী? যুদ্ধের এক বছর আগে বানানো পতাকার ব্যাখ্যায় যুদ্ধের কথা বলা হয় কেন? যদিও আরেকটি প্রশ্ন আমার মধ্যে ছিল। মুসলিম বিশ্বে পতাকায় সবুজ রঙ এস্তেমাল হয়েছে ইসলামের নিশান হিসাবে। সোলায়মানের আ. মোহর (যেটা ইসরায়েলের পতাকায় রয়েছে) সেটিকে সবুজ রঙ পরিয়ে ইসলাম হিসাবে উপস্থাপন করেছে মরক্কো, তার পতাকায়। এমনকি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের পতাকাতেও সবুজের ব্যবহার ইসলাম বুঝাতে; গেরুয়া-হিন্দু, সাদা-শান্তি, সবুজ-ইসলাম। কিন্তু বাংলাদেশের পতাকায় সবুজ কিভাবে জমিন হয়ে গেল তার উৎস খুঁজতেছিলাম।
এই পতাকা রচিত হয়েছে সত্তরের ৬ জুন। এর বর্ণনা দিয়েছেন পতাকা অঙ্কনের সাথে জড়িতদের একজন কাজী আরেফ আহমেদ। তার বক্তব্য—
“৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই।
এ ফ্ল্যাগ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন, এ পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাহজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি-বটলগ্রিন জমিনের ওপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এ নকশা ‘নিউক্লিয়াস’ হাইকমান্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়।
তখন আমি প্রস্তাব করি, এ পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের মানচিত্র দেওয়া উচিত।” (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র, কাজী আরেফ আহমেদ, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৭৭)
জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শাহজাহান সিরাজ। তার প্রস্তাবেই এই পতাকায় লাল রঙ দেওয়া হলো। তবে এই লাল একটি আপত্তিকর রঙ। সারাবিশ্বে লাল রঙ সমাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। আমরা রাও ফরমান আলীর একটা বক্তব্য জানি, “পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ মাটি রক্তে লাল করে দেব”; কিন্তু এই বক্তব্যের ব্যাপারে রাও ফরমান বেশ ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দিয়েছিলেন। সৈয়দ মবনু তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে রাও ফরমান আলী তাকে বলেন—
“ঢাকাতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মিটিং ছিলো আনুমানিক নির্বাচনের এক বছর পূর্বে। এটা ভাসানীর দল। বাংলাদেশে দু’জন তোয়াহা ছিলো। একজন ইসলামিক এবং অন্যজন সেকুলার (নোয়াখালীর)। সেকুলার তোয়াহা সেই মিটিং-এ বলেছিলো, “আমি পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ মাটি রক্তে লাল করে দেব।” আমাকে কোর হেড কোয়ার্টার থেকে জেনারেল ইয়াকুব তা জানালো। আমি এই কথাটি স্মরণ রাখার জন্য ডাইরীতে লিখে রাখি এবং তোয়াহা-কে খবর দেই। তাদের সাথে আমার এতটুকু বন্ধুত্ব ছিলো যে, আমি যখন বলেছি তোমাকে গ্রেফতার করা হবে না, তখন সে বিশ্বাস করেছে তাই হবে। সে আসে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এসব কি বলেছো? সে বললো এটা আমার নয়। কাজী জাফরের বক্তব্য। আমি বললাম, এর অর্থ কি? সে বললো, এর অর্থ এদেশে কম্যুনিস্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা, লাল হচ্ছে কমুউনিস্টের প্রতীক। সে চলে গেলো। আমার ডাইরীতে কথাগুলো রয়ে গেলো। গুরুত্ব দেইনি। আমাকে গ্রেফতার করার পর তারা আমার ডাইরী নিয়ে গেলো। প্রচার করলো, জেনারেল ফরমান গোটা বাংলার মানুষকে হত্যা করার প্লান করেছিলো। এ কথা শেখ মুজিবও ভুট্টোকে বলেছিলো। তার দাবী ছিলো, সবাইকে ছেড়ে দিলেও ফরমান আলীকে ছাড়া যাবে না। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি আমার কাছে এসেছিলো। আমি বিস্তারিত তাদেরকে বললাম। এরপর তা নিয়ে তদন্ত হয়েছে। এমনকি হামিদুর রহমান কমিশনও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম, দেখুন এটা আমার হাতের লেখা সত্য, কিন্তু কথা আমার নয়। একথা ১৯৬৯ ইংরেজীর ১৬ই জুন কাজী জাফর পল্টন ময়দানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মিটিং-এ বলেছিলেন। এরপর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজো আমি বলছি, ওকথা আমার নয়। কাজী জাফরের কথা।”
— (লাহোর থেকে কান্দাহার, সৈয়দ মবনু, আবাবীল পাবলিকেশন্স, আগস্ট ২০০০, পৃ. ১৫৬-১৫৭)
এই কাজী জাফর আহমেদ ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ষাটের দশকে প্রথমে মার্ক্স আর পরে মাওবাদী ন্যাপে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। নিউক্লিয়াসের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল।
সার্বিকভাবেই বাম ধারার বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্রটি পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে কাজ করছিল, আর তাদের সঙ্গমস্থল নিউক্লিয়াস। বাংলাদেশের নাম, পতাকা, যুদ্ধ পরিস্থিতি সবটা তাদেরই তৈরি। কাজেই বাংলাদেশের পতাকার লাল রঙ কি আসলেই কোন স্বাধীনতার প্রতীক? নাকি কমিউনিজমের লাল সন্ত্রাসের প্রতীক? কাজী জাফরের সবুজ জমিনকে লাল করে দেওয়ার ধারণা নিউক্লিয়াস আর শাহজাহান সিরাজের কাছে পৌঁছানো অস্বাভাবিক না। তবুও এই প্রশ্নের কোন নিশ্চিত উত্তর কি মিলবে?

- শুকরান সাবিত

পঠিত : ১১৯৯ বার

মন্তব্য: ০