Alapon

~বদরুদ্দীন উমর: একজন বুদ্ধিজীবি কমিউনিস্ট~




বদরুদ্দীন উমরের কমিউনিজম ছিল স্বতন্ত্র প্রকৃতির। অর্থাৎ তার কমিউনিস্ট রাজনীতি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকৃতির। তিনি শ্রমিক বা কৃষকের কথা বলতেন ঠিকই, কিন্তু তিনি আসলে ছিলেন আপাদমস্তক একজন উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি। ফলে তার রাজনৈতিক ভাষা ও কর্ম তার টার্গেট গ্রুপ শ্রমিক, কৃষক কিংবা মেহনতি মজলুম জনতার কাছে বোধগম্য হতে পারে নি। এক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা কেবল তার একার ব্যর্থতা নয়। এটা এক অর্থে অনেক মার্কসিস্ট বুদ্ধিজীবিদের একটা টিপিক্যাল সমস্যার দিকেই নির্দেশ করে। তাত্ত্বিক মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতনে যতটা স্বচ্ছন্দ, শ্রমিক, কৃষক কিংবা মেহনতি জনতার কাছে ততোটাই দুর্বোধ্য ও অনাত্মীয়।
বাংলাদেশে এমন কিছু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি মার্কসিস্টও আমি দেখেছি যারা দিনরাত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে গালাগাল করছেন অথচ সেই দেশে গিয়ে সেখান থেকে পড়াশুনা, চাকরি বাকরির সুবিধা নিচ্ছেন; এমনকি বিয়ে করে গ্রীন কার্ড নিয়ে গর্বিত মার্কিন নাগরিকও হচ্ছেন কেউ কেউ। আসলে মার্কসিজম হল একধরনের ইউটোপিয়ান মধ্যবিত্তের আঁতেলপনার লাইফস্টাইল আইডিওলজি। এর সঙ্গে শ্রমিক বা কৃষকের সম্পর্ক খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে খোদ মার্কিন মার্কসিস্ট এলভিন গুল্ডনারের আত্মপরিহাসমূলক মূল্যায়নের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন যে বুদ্ধিজীবিরা নিজেরাই একটা শ্রেণি যারা বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিক-কৃষক ইত্যাদি মেহনতি শ্রেণি থেকে আলাদা। এরা বুর্জোয়া শ্রেণিসহ অন্যান্য সব শ্রেণির বিশ্ববীক্ষাকে বাতিল করে দেয় কারণ এদের আসল উদ্দেশ্য থাকে এভাবে সবকিছুর বৈধতা ও সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই যাতে ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে পারে। বুর্জোয়ার পুঁজি হল ধন-সম্পদ আর বুদ্ধিজীবির পুঁজি হল তার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান।
বদরুদ্দীন উমর এমনই এক বুদ্ধিজীবিসুলভ কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন। যা বুদ্ধিজীবিদের একাংশে সাড়া জাগালেও তার প্রকাশ্য অডিয়েন্স শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি।
তার এই বুদ্ধিজীবি রাজনীতি ছিল এতই শুদ্ধতাবাদী যে তিনি তার সঙ্গে না পেয়েছেন জাতীয়তাবাদীদের, না পেয়েছেন অন্যান্য কমিউনিস্টদের। আর ইসলামিস্টদের তো তিনি সঙ্গে নেবার যোগ্য বা ন্যায্যই মনে করেন নি। ফলে তার রাজনীতি কখনোই সাইনবোর্ড সর্বস্বতার বেশি হতে পারেনি।
তবে তিনি কিছু গবেষণামূলক কাজ করেছেন যা তাকে এদেশের মার্কসবাদী বুদ্ধিবৃত্তিতে একটা স্থায়ী আসন দিয়েছে বলা যায়। যেমন তার বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং পূর্ব বাংলায় 'সাম্প্রদায়িকতা' ও 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা"র বয়ান। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার শক্তিশালী মুসলিম পরিচয়ভিত্তিক জাতিবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছিলেন; বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক একটি "অসাম্প্রদায়িক" বাঙালি পরিচয় তার এই বয়ান থেকে বিনির্মিত হতে পেরেছে। এই বিনির্মাণে তিনি অন্যান্য বাঙালি জাতিবাদীদের মত উগ্র না হয়ে উঠলেও এতে তার বয়ানটিও যে যথেষ্ট সহায়তা করেছে একথা অস্বীকার করা কঠিন। অর্থাৎ তিনি রাজনীতিতে জাতিবাদীদের থেকে সচেতনভাবে দূরে অবস্থান করলেও তার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ানের সঙ্গে জাতিবাদীদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ফলে তার বয়ান জাতিবাদীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা এর ফায়দা নিয়েছে একশতভাগ।
তবে তিনি ব্যক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সৎ ছিলেন, কাজেই অন্যান্য অনেক বুদ্ধিজীবি-রাজনীতিবিদের মত তিনি জাতিবাদীদের প্রকাশ্য গোলামী বা চাটুকারিতা করেন নি। এখানে তার সততা ও স্বাতন্ত্র্যের প্রশংসা করতেই হবে। তিনি এদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবি কমিউনিস্ট এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয় তিনি একজন গুড বুদ্ধিজীবি কমিউনিস্ট।

পঠিত : ৩৬২ বার

মন্তব্য: ০