Alapon

ইবনে আল-হাইথাম: আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক...



“সত্যকে উদঘাটন করা এবং সত্যকে যদি জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করাই বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হয়, তবে তাকে অবশ্যই তার পঠিত সকল কিছুকেই নিজের শত্রু বানিয়ে ফেলতে হবে কিংবা তার বিরোধী হতে হবে! যে ব্যক্তি বিজ্ঞানীদের লেখাকে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তার কর্তব্য হল চারদিক থেকে খুঁটিয়ে দেখা। সমালোচনামূলক পরীক্ষা করার সাথে সাথে নিজেকেও তার সন্দেহের আওতায় আনা উচিত, যাতে তিনি কুসংস্কার বা নম্রতার মধ্যে না পড়েন কিংবা সেসব থেকে স্বীয় চিন্তাভাবনাকে দূরে রাখতে পারেন।”

– হাসান ইবনে আল হাইথাম

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণালী যুগে, যখন বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও খুঁটিনাটি আবিষ্কারে মুসলমানেরা দিগ্বীদিক আলোড়ন তুলেছিল, ঠিক সে সময় এমন চিন্তাধারার একজন মুসলিম বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে।তিনি হলেন হাসান ইবনে।আল হাইথাম। তিনি ৯৬৫ সালে ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৪০ সালে মিশরের কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। পাশ্চাত্যে তিনি ‘আল হাজেন’ নামে পরিচিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান। প্রাথমিক জীবনে তিনি ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। কর্মজীবনের শেষে তিনি বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বাগদাদ ছিল তৎকালীন জ্ঞানের রাজধানী। সেখানকার বিজ্ঞ পণ্ডিতদের অধীনে পড়াশোনা করে এবং স্বীয় মেধায় তিনি খুব অল্প বয়সেই বিদ্বান হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

ইবনে আল হাইথাম আলোকবিজ্ঞানের উপর লেখা তার অবিস্মরণীয় বই “কিতাব আল-মানযির” বা “অপটিকস” প্রকাশ করেন ১০১১-১০২৭ এর মধ্যবর্তী সময়ে। এই বই আলো এবং দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বইটি সম্পর্কে প্রথম কমেন্টারি গ্রন্থ লেখেন গণিতবিদ কামাল উদ্দিন আবুল হাসান মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল ফারসি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর আগে প্রাচ্যের কেউ এটিকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে একজন অজ্ঞাত অনুবাদক বইটিকে ল্যাটিনে অনুবাদ করেন। তখন থেকেই বইটি এক সুদীর্ঘ প্রভাব রেখে গেছে বিশ্বজুড়ে। ত্রয়োদশ শতকের বিজ্ঞানী রজার বেকন থেকে শুরু করে ষোড়শ শতকের জোহানেস কেপলারের (১৫৭১-১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) সময় পর্যন্ত যুগের পর যুগ ধরে এটি আলোকবিজ্ঞানের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জ্যোতির্বিদ্যার উপর তাঁর লেখা “হায়াত-উল-আলম” ল্যাটিন ভাষায় একাধিকবার অনুবাদ করা হয়েছে। ইবনে আল হাইথামের লেখা যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানমহলে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলার, রেনে দে কার্তে প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মূলত আলোকবিজ্ঞানে তাঁর অবদান জগতজোড়া খ্যাতি এনে দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নন, বিজ্ঞানের অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান ঈর্ষনীয়। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, অধি-পদার্থবিদ্যা (meta-physics), গতিবিদ্যা, উল্কাতত্ত্ব (meteorology), দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ বিজ্ঞানের বিবিধ শাখায় এমনকি মনোবিজ্ঞানের উপরও তাঁর লেখা গ্রন্থ পাওয়া যায়। তাকে অনেক সময়ই প্রথম বিজ্ঞানী (first scientist) বলে সম্মানিত করা হয়। তিনি পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনেক উন্নতি সাধন করেন এবং প্রথম ব্যক্তি হিসেবে হাইপোথিসিসকে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করেন। দশম-একাদশ শতাব্দীতে যে অবিস্মরণীয় মুসলিম ত্রয়ী ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

ইবনে আল হাইথাম ব্যাখ্যা করেছেন যে, কোন বস্তুকে কেবলমাত্র তখনই দেখা যায়, যখন অপর কোন বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয় এবং তারপর কারো চোখে সেই আলো প্রবেশ করে। তিনি চোখের যাবতীয় খুঁটিনাটি এবং চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশের নামকরণও করেছেন। তিনি মানুষের অপটিক্যাল সিস্টেমের একটি স্কেচও আঁকেন।

ইবনে আল হাইথামকে আলো এবং দৃষ্টির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে পিনহোল ক্যামেরা। এটি পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা। এটিই আজকের আধুনিক ক্যামেরাগুলোর পূর্বসূরি। এটি একটি আলোনিরোধক কাঠের বাক্স। এর কোনো এক পৃষ্ঠে ছোট একটি ছিদ্র হতো, একটি পিন দিয়ে ছিদ্র করলে যতটুকু ছিদ্র হয়, ঠিক ততটুকু। তাই এই ক্যামেরার নাম ছিল পিনহোল ক্যামেরা। ছিদ্রযুক্ত তলটি আলোমুখী করে তার সামনে কোনো বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করা হতো, যেন এর ছায়া ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে বিপরীত তলে প্রতিবিম্বিত হয়। এভাবেই সেকালে পিনহোল ক্যামেরা দিয়ে কোনো বস্তুর প্রতিবিম্বিত আউটলাইন পাওয়া যেতো। পিনহোল ক্যামেরার সাথে সাথে রয়েছে তাঁর আবিষ্কৃত আরো একটি ক্যামেরা। একটি অন্ধকার চেম্বার ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি এটি তৈরি করেন। আবিষ্কারের সময় এটি “আল-বেইত আল-মুজলিম” নামে পরিচিত ছিল, যার ল্যাটিন অনুবাদ “ক্যামেরা অব্সকুরা”। এই ডিভাইসটি আধুনিক ফটোগ্রাফি/ক্যামেরার ভিত্তি তৈরি করে। এটিও পিনহোল ক্যামেরার মতোই, তবে এতে কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে।

ইবনে আল হাইথাম লেন্স এবং আয়না ব্যবহার করে আলোর গতিপথ পরীক্ষা করে তা অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, “আলোর প্রতিসরণ হয়, যখন এটি বিভিন্ন উপকরণের মধ্য দিয়ে চলে যায়।”

ইবনে আল হাইথাম ছিলেন একজন বহুমুখী লেখক। এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি গণিতের উপর ২৫ টি গ্রন্থ এবং অ্যারিস্টটলীয় পদার্থবিদ্যা, অধি-পদার্থবিদ্যা (মেটাফিজিক্স), উল্কাতত্ত্ব (মিটিওরোলজি) মনোবিজ্ঞান প্রভৃতির উপর ৪৪ টি গ্রন্থ লিখেন। এছাড়া তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই থেকে জানা যায়, তিনি অ্যারিস্টটলীয় প্রাকৃতিক দর্শন (ন্যাচারাল ফিলোসফি) এবং যুক্তি (লজিক) বিষয়েও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বিস্তৃত বিষয়ের উপর ২০০ টিরও বেশি রচনা লিখেছেন, যার মধ্যে কমপক্ষে ৯৬ টি বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচিত এবং এগুলোর প্রায় ৫০ টি আজ অবধি বেঁচে আছে। বেঁচে থাকা প্রায় অর্ধেক কাজ গণিতের উপর, তার মধ্যে ২৩ টি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এবং ১৪ টি অপটিক্সের উপর এবং কয়েকটি বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত বই হলো “হায়াত উল আলম” (On the Configuration of the World)। এই বইয়ে তিনি সহজ ভাষায় তাঁর সময়ের প্রাকৃতিক দর্শনের আলোকে টলেমির জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ “অ্যালমাজেস্ট” (Almagest) ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইয়ে টলেমির ব্যাখ্যা তিনি গ্রহণ করলেও তাঁর পরবর্তীতে লেখা একটি বই “আল শুকুক আলা বাতলামিস ”(Doubts about Ptolemy) এ তিনি টলেমির সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার জন্য আরব বিশ্বে তাকে দ্বিতীয় টলেমি বা Baṭlamyūs Thānī বলা হয়। তাঁর লেখা শতাধিক বইয়ের মধ্যে মাত্র অর্ধেকের মত টিকে ছিল।

তিনি একাদশ শতাব্দীতে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে নতুন মান নির্ধারণ করেছিলেন। আলো এবং দৃষ্টি বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ইবনে আল হাইথামকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক ২০১৫ সালকে “ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ লাইট” উদযাপনের প্রাক্বালে হাসান ইবনে হাইথামকে অপটিক্স তথা আলোকবিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধনে পথিকৃৎ (পাইওনিয়ার) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

-সংকলক: লামিয়া তাসনিম

পঠিত : ৩৮৩ বার

মন্তব্য: ০