Alapon

উপমহাদেশের প্রথম ছাত্র সংগঠন জমিয়তে তালাবা


১৯৪৭ সালের ২৩শে ডিসেম্বর ভ্যাপসা গরম ছড়ানো লাহোরের দুপুর।এই সময়ে লাহোর শহরের মানসুরা থানার ইচড়া এলাকার জালিয়াদারপার্কের পার্শ্ববর্তী ফুল বিল্ডিং এর সামনের উঠান।এই উঠানেই মাত্র ৪ মাস আগে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মিলিত হয়েছে ২৫ জন ছাত্র।উস্তাদ নঈম সিদ্দীকি আর মুহতারাম নাসরুল্লাহ খান আজীজ ছিলেন এই সম্মেলনের অন্যতম মহীরুহ।যথারীতি সম্মেলন শুরু হলো। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ইসলামবিদ্বেষ এবং সেক্যুলারিজমের বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে তার থেকে মুক্তির উপায় খুজে বের করা। এই আলোচনার একপর্যায়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেক্যুলারিজম আর ইসলামবিদ্বেষের মোকাবেলায় ছাত্রদের ইসলামের সুমহান পথে আহবান,একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা এবং আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকারের গুরুদায়িত্ব পালন করার লক্ষ্যে ছাত্রদের মধ্যেই একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা। এই সম্মেলনেই সর্বসম্মতিক্রমে সংগঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় "আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা) প্রদর্শিত জীবন বিধান অনুযায়ী মানুষের জীবনের সার্বিক পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।" এবং প্রাথমিকভাবে দাওয়াত,প্রশিক্ষণ এবং সংগঠন এই ৩ দফা কর্মসূচি (১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫১ সালে পর্যায়ক্রমে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র সমস্যা এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ এই দুই দফাও সংযুক্ত করা হয়) ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে উপস্থিত সবাইকে রুকন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।এবং রুকনরাই ভোটের মাধ্যমে মুহতারাম জাফরুল্লাহ খান আজীজকে নাজিমে আ'লা (কেন্দ্রীয় সভাপতি) হিসেবে নির্বাচিত করেন। এইবার সংগঠনের নাম ঠিক করার সময় আসলে রুকনদের একেকজন একেকটি নাম প্রস্তাব করা শুরু করেন। এই আলোচনা চলাকালীন সময়ে মুহতারাম নাসরুল্লাহ খান আজীজ "ইসলামী জমিয়ত-ই-তালাবা" নামটিকে ছাত্রদের সামনে পেশ করেন।এবং পরবর্তীতে ভোটের মাধ্যমে এই নামটিকেই নতুন সংগঠনের নাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।এবং এরই মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ইসলামী ছাত্র আন্দোলন "ইসলামী জমিয়তে তালাবা"র। প্রাথমিকভাবে লাহোরে এবং পরবর্তীতে তৎকালীন রাজধানী করাচিতে জমিয়তের কেন্দ্রীয় দফতর স্থাপন করা হয়েছিলো।পরবর্তিতে আবারো জালিয়াদারপার্কস্থ ফুল বিল্ডিং এর পাশেই কেন্দ্রীয় দফতর স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়,করাচি বিশ্ববিদ্যালয়,ইসলামিয়া কলেজ লাহোরসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইসলামী জমিয়তে তালাবা তার দাওয়াতি কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। যার ফল স্বরুপ প্রতিষ্ঠার মাত্র ৮ বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালে করাচি আর্ট কলেজে জমিয়ত প্রথমবারের মতো ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে। ওই বছরই পূর্ব পাকিস্তান তথা তদনীন্তন বাংলাদেশে জমিয়তের প্রথম সাংগঠনিক শাখা গঠিত হয়।১৯৫৫ সালে জমিয়ত স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে তার সমর্থন ব্যাক্ত করে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলে জমিয়ত ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ডেই তার কাজকে গতিশীল রাখে। উল্লেখ্য ষাটের দশকেই জমিয়ত তদনীন্তন পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়,করাচি বিশ্ববিদ্যালয়,কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল কলেজ,পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে একক ছাত্র সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৫ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠন হলে জমিয়ত পূর্ণভাবে এই কমিশনকে সমর্থন দেয়।একই বছর পাক-ভারত যুদ্ধ সংগঠিত হলে যুদ্ধে জমিয়ত কর্মীরা দেশের পক্ষে উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দেয়। ১৯৬৯ সালে নুর খান শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে জমিয়ত শিক্ষার আদর্শিক ভিত্তি নির্ধারণপূর্বক কাঠামো তৈরীর পক্ষে জনমত তৈরী করে। একই বছর ১৫ই আগস্ট ইসলামী জমিয়তে তালাবার ইতিহাসে প্রথম শাহাদাত সংগঠিত হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষাব্যাবস্থার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সেক্যুলার এবং সোশ্যালিস্টদের যৌথ হামলায় শাহাদাত বরণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন এবং অনুজীববিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র। ইসলামী জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের মজলিসে শুরা সদস্য এবং ঢাকা শহর শাখার নাজিম {সভাপতি} আব্দুল মালেক।যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্র এবং অনন্য চরিত্রের অধিকারী একজন ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। ৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তান জুড়েই গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। এবং এই গণ অভ্যুত্থানে ছাত্রদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য রোল প্লে করে ইসলামী জমিয়তে তালাবা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়,লাহোর,করাচি,বাহাওয়ালপুর,গুজরানওয়ালা,হায়দ্রাবাদ এবং মূলতানে জমিয়ত কর্মীদের সাথে আইয়ুব শাহীর আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।এই অভ্যুত্থানে নিজের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের একজন ছাত্র নেতা আসাদ আইয়ুবের পুলিশের গুলিতে শহীদ হলে জমিয়তের তৎকালীন নাজিমে আলা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার জানাযার নামাজে ইমামতি করেন।যা তৎকালীন সময়ে ব্যাপক আলোচিত হয়।৭০ এর দশক জমিয়তের জন্য বেশ ঘটনাবহুল ছিলো। ৭১ এ পাকিস্তান বিভক্তির পর পাকিস্তানে কাদিয়ানী বিরোধী তীব্র আন্দোলন দানা বাধে। চেনাব নগরের ঐতিহাসিক রাবওয়াহ রেল স্টেশনে জমিয়তের সীরাতুন্নবী কনফারেন্সে কাদিয়ানীদের সশস্ত্র হামলার পর থেকে জমিয়ত কাদিয়ানী বিরোধী তীব্র আন্দোলনের সূচনা করে। করাচি থেকে পেশোয়ার, কোয়েটা থেকে মুজাফফরাবাদ সমগ্র পাকিস্তানের শহর এবং ক্যাম্পাস গুলো জমিয়ত কর্মীদের "খাতামুল আম্বিয়া...মোস্তাফা মোস্তাফা" স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে। তীব্র আন্দোলনে জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকার কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করে আইন পাশ করে। তার বাইরেও ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদেও রাজপথ প্রকম্পিত রাখে জমিয়ত। ৭০ এর দশকে পাকিস্তানের প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জমিয়ত ক্লিন সুইপ করে। এর মধ্যে ৭০ এর দশকের শেষ দিকে করাচি শহরে মুহাজির জাতীয়তাবাদী নেতা আলতাফ হোসাইনের উত্থান ঘটে।আর আলতাফ তার দল এম কিউ এম(মুহাজির কওমী মুভমেন্ট) এর অগ্রযাত্রার পথে জমিয়তকে একমাত্র হুমকি হিসেবে ভাবা শুরু করে।তারই পরিপ্রেক্ষিতে এম কিউ এম এবং তার ছাত্র সংগঠন এ পি এম এস ও (অল পাকিস্তান মুহাজির স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন) এর সন্ত্রাসীদের হাতে ৮০র দশকের শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র করাচি শহরে কয়েকশো জমিয়তের নেতাকর্মী গুপ্তহত্যা এবং টার্গেট কিলিং এর শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। এর বাইরেও ৮০র দশকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার ছাত্র বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের প্রতিবাদে জমিয়ত রাজপথে সরব ভূমিকা পালন করে। এবং এর বাইরেও ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জমিয়ত পুনরায় প্রায় সব ক্যাম্পাসে ক্লিন সুইপ করে। ১৯৮৪ সালে জেনারেল জিয়া পাকিস্তানে ছাত্র সংসদ নিষিদ্ধ করে। এর বিরুদ্ধে জমিয়ত পুরো পাকিস্তানে ছাত্র বিক্ষোভের ডাক দিলে জেনারেল জিয়া জমিয়তের তৎকালীন নাজিমে আলা মিরাজুদ্দিন খান কে গ্রেফতার করে এবং সামরিক আদালতে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয় এবং জেলে আটকে রাখেন।পরবর্তীতে ছাত্র বিক্ষোভে জিয়া উনাকে ছেড়ে দেন।এর পর ৮০র দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন বিরোধী আফগান জিহাদের সুচনা হলে ইসলামী জমিয়তে তালাবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি সশস্ত্র জিহাদে অংশ নেন।জিয়া পরবর্তী মোশাররফ,জারদারী,নাওয়াজ শরিফের আমলে ছাত্র সংসদের উপর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে পাকিস্তানের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন গুলো যখন বিলুপ্তির পথে তখন ইসলামী জমিয়তে তালাবা তার সুপরিকল্পিত এবং ছাত্র মুখী বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে একক ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে সামরিক শাসকের চোখ রাংগানি,জাতীয়তাবাদীদের ভয়াল থাবা এবং মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা উপেক্ষা করেই।জমিয়ত কর্মীরা প্রতিনিয়ত আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মাতিয়ে রাখছে মূলতান থেকে ইসলামাবাদ, আজাদ কাশ্মীর থেকে সিন্ধুর প্রায় সবকটা ক্যাম্পাসে
আজ ২৩ শে ডিসেম্বর।উপমহাদেশের ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সূতিকাগার ইসলামী জমিয়তে তালাবার ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এই ৭৫ বছরে জমিয়ত একদিকে যেমন উপমহাদেশকে উপহার দিয়েছে খুররাম জাহ মুরাদ,ডাঃ ইসরার আহমেদ,প্রফেসর খুরশীদ আহমেদ,সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসান,শহীদ আব্দুল মালেক,শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী,লিয়াকাত বালুচ,সিরাজুল হকদের মতো বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের মহীরুহদের।আবার অন্যদিকে উপহার দিয়েছে ডঃ আব্দুল কাদির খানদের মতো লিজেন্ডারি মানুষদের আবার অন্যদিকে উপহার দিয়েছে পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডঃ আরিফ আল্ভী, জাভেদ হাশমি ,জাভেদ মিয়াদাদ সহ প্রমুখ রাজনীতিবিদ আর ক্রীড়া ব্যাক্তিত্বের।
শহীদ মালেকের জমিয়ত বেঁচে থাকুক হাজার বছর
শহীদ নিজামীর জমিয়ত বেঁচে থাকুক হাজার বছর ❤

পঠিত : ৯৪১ বার

মন্তব্য: ০