Alapon

সূরা কাফিরূন কি সেকুলারিজমের দলিল?



মক্কার মুশরিকরা মুহাম্মাদ নামক এই পবিত্র যুবককে নিয়ে পড়ছে মহাবিপদে। তাঁর আনিত নতুন এই মিশনকে কোনোভাবেই তাঁরা ঠেকিয়ে রাখতে পারছেনা। তাই তারা চিন্তিত। মহাচিন্তিত। তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে তারা ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত। তটস্থ। কী করা যায়, কীভাবে করা যায়—এই নিয়ে তাদের সভা-সমাবেশগুলোতে চলে তুমুল আলোচনা-পর্যালোচনা।
একপর্যায়ে তারা চিন্তা করলো মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সাথে সমঝোতা করবে, তাঁকে বুঝাবে, তিনি যেনো ধর্মের ব্যাপারে একপক্ষীয় অবস্থান গ্রহণ না করেন। তাদের ধর্মকেও যেনো স্বীকৃতি দেন। কিংবা তাদের ধর্মের বিষয়ে যেনো কোনো বক্তব্য পেশ না করেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। মুশরিকদের মধ্য থেকে সে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, আস ইবনে আব্দে ইয়াগুছসহ তাদের কতিপয় নেতা চলে আসলো রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের নিকট। এসে বললেন; “আপনার ভাতিজা যদি আমাদের ধর্মের কিছু অংশ মেনে নেয়, তাহলে আমরাও তার ধর্মের কিছু অংশ মেনে নিতাম। সে কিছুদিন আমাদের ইলাহকে মানুক আমরাও তাঁর ইলাহকে মানবো।”
শুধু রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের চাচার কাছেই না, তারা স্বয়ং তাঁর কাছেই এসেছে আগে। এসে দিয়েছে লোভনীয় অনেকগুলো প্রস্তাব। তারা মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে জিজ্ঞেস করে হে মুহাম্মাদ! কী চাও তুমি আমাদের কাছে? কেনো তুমি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলছো? কেনো তুমি আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলো? কেনো এবং কী জন্যে দেবদেবীর বিরুদ্ধে বলছো?
তুমি কি এই সমাজের নেতৃত্ব চাও? চলো তোমাকে আমরা আমাদের নেতা বানিয়ে দিই।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর জবাব, নাহ! আমি নেতৃত্ব চাই না। প্রয়োজন নেই তোমাদের নেতৃত্ব আমার।
এরপর তারা বললো তাহলে কী চাও? অঢেল অর্থ সম্পদ চাও তুমি? একজন সম্পদশালী ব্যক্তি হতে চাও? যদি তা-ই চাও, আমরা তোমাকে তা-ই দেবো। বানিয়ে দেবো তোমাকে মক্কার সবচেয়ে সেরা ধনী।
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, নাহ! প্রয়োজন নেই। আমি এমন ধন-সম্পদের প্রাচুর্য চাই না। এবারও হতাশ হয়ে পড়লো মুশরিকরা ।
অতঃপর তারা বলে ওঠলো তাহলে কী চাও তুমি? সুন্দরী রূপসী কোনো নারী?
যদি তা-ই চাও, তাহলে বলো, তোমাকে এবং তোমার জন্য আমরা মক্কার সেরা নারীটা এনে দেবো। সবচেয়ে রূপবতী মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের বন্দোবস্তো করবো।
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ জবাব দিলেন, নাহ! তোমরা যদি আমার এক হাতে চাঁদও এনে দাও, অন্য হাতে এনে দাও সূর্যটাও; তবুও আমি আমার মিশন এবং ভীষণ থেকে সরে দাঁড়াবো না।
আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম তো জাগতিক কোনো মোহ-মায়ায় কিংবা স্বার্থের জন্য এই দ্বীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছেন না। তিনি চাচ্ছেন মানুষের মুক্তি। মানুষের শান্তি। সেজন্য দুনিয়ার এমন লোভলালসার টোপে তিনি পড়েননি। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেলো মক্কার মুশরিক নেতৃবৃন্দ।
এতে ব্যর্থ হয়ে তারা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে ;
বছরে কয়েকটা দিন তুমি আমাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। আর আমরাও কিছুদিন তোমার ধর্মের অনুসরণ করবো। এতে যদি তুমি আমাদের ধর্মে ভালো কিছু পাও, তাহলে না হয় এর-ই অনুসরণ করবে! আর আমরাও যদি তোমার ধর্মের অনুসরণ করে ভালো কিছু পাই, তাহলে আমরা-ই তোমার ধর্মের অনুসরণকারী হয়ে যাবো।
মোটের ওপর তাদের দাবি হচ্ছে, কিছুদিন আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেনো তাদের দেব-দেবিরও ইবাদাত করা হয়। আনুগত্য করা হয়। যেনো কিছুদিন হলেও ধর্মনিরপেক্ষ থাকা হয়। আল্লাহ এবং আল্লাহর ইবাদাত ও আইনকে অন্যের ইবাদাত এবং আইনের সমমর্যাদা প্রদান করা হয়। কিন্তু আল্লাহর রাসুল, যিনি এসেছেন সকল প্রকার তন্ত্রমন্ত্রের ঊর্ধ্বে আল্লাহর আইনকে উচ্চকিত করতে, যিনি এসেছেন এক আল্লাহর দাসত্বের বাহিরে সকলের দাসত্ব পরিহার করার মিশন এবং ভিশন নিয়ে; তিনি তাদের এসব কোনো প্রস্তাবের প্রতিই মাথা নত করলেন না। তাদের সকল প্রকার প্রস্তাবকেই প্রত্যাখ্যান করলেন।
আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হলো ওহী। যেটাকে আমরা পবিত্র কুরআনে প্রায়শই পড়ি। সূরা কাফিরুন হিসেবে যেখানে তিনি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মক্কার কাফির-মুশরিক যারা, তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, নাহ! তাওহিদের সাথে শিরকের কোনো সমঝোতা নেই। ঈমানের সাথে কুফুরের কোনো আপোষ নেই। ইসলাম ছাড়া অন্যকোনো মতবাদ-ধর্ম-মতাদর্শকে মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। আর রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামও আল্লাহর আইন ও বিধানকে, তার আনুগত্য ও দাসত্বকে বুলন্দ করার ঘোষণা দিলেন মক্কার মুশরিকদের সামনে। যেখানে তিনি বলেছেন,
“হে কাফিররা! আমি তাদের ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা করো। এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমরা যাদের ‘ইবাদত করছো, আমি তাদের ‘ইবাদাতকারী হবো না’। তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। আমার কর্মকাণ্ডের ফলাফল আমার জন্য। তোমাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফলও তোমাদের জন্য।” [ সূরা কাফিরূন : ০১-০৬]
এই যে সূরা কাফিরূনের শেষ অংশটা, (লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়াদীন) এটা দিয়ে কেউ কেউ প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম অন্যান্য মতবাদকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ এটা দিয়ে সেক্যুলারিজমের দলিল পেশ করেন। কিন্তু আসলে কি তাই? ওপরের আলোচনাগুলো থেকে কী বুঝা যায়? এখানে তো মূলত ইসলাম ছাড়া অন্য সকল কিছুকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চপেটাঘাত করা হয়েছে সেক্যুলারিজমের গালে। চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবং এই আয়াতের অর্থ প্রচলিতভাবে যা জানি, এই আয়াতের অর্থ এটা নয় যে, (তোমরা তোমাদের ধর্ম পালন করো, আমি আমার ধর্ম পালন করি!) তা নয়। এর অর্থ হচ্ছে তোমরা যা করো, সেটার দায় তোমাদের। তোমাদের পথ ও পন্থা তোমাদের জন্য (সে পথে চলার পরিণতি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে) আর আমার জন্য আমার পথ (যে সত্য পথে চলার জন্য আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এ পথ ছেড়ে আমি অন্য কোন পথ গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত নই)। সোজা কথায়, তোমাদের কর্মফল তোমরা ভোগ করবে। আমার কর্মফলও আমি পাবো। এই কথার সমর্থনে পবিত্র আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে যে, “হে নবি! যদি এরা এখন আপনার কথা না মানে তাহলে বলে দিন, তোমরা যা কিছু করছে তা থেকে আমি দায়মুক্ত”। [সূরা আশ-শু'আরা: ২১৬] আরো বলা হয়েছে যে, “এদেরকে বলুন, আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছে সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। বলুন, আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন।” [সূরা সাবা: ২৫–২৬] সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে, ‘আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের।” [সূরা ইউনুস: ৪১] সুতরাং এর মাধ্যমে কি ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমকে মেনে নেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া প্রমাণ হয়? এ প্রসঙ্গে ইমাম মওদূদী রহঃ তাঁর তাফহিমুল কুরআনে বলেন, “এর দ্বারা কাফিরদের দ্বীনের কোনো প্রকার স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি। মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যাঁরা ঈমান এনেছে তাঁরা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না- এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়া; আর তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণাই এ সূরার উদ্দেশ্য।”
আসলে আল্লাহর রাসুল মুহামদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে যখন এতো সব লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছে, তবুও তিনি সেসব না মেনে এই ঘোষণার মানে হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের সাথে কোনো আপোষ চলবেনা। আমরাও এ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে পারি যে, একজন মুসলিম হিসেবে অন্য কারো বান্দেগি নয়, অন্যকোনো মতাদর্শকে স্বীকার করা নয়, সদা-সর্বদা এক আল্লাহর কাছেই নিজের মস্তককে লুটিয়ে দেবো। আল্লাহর দ্বীনের সাথে কোনো ক্রমেই আপোষ করবো না। থাকবো দ্বীনের ব্যাপারে আপোষহীন। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন। মক্কার মুশরিকরা মুহাম্মাদ নামক এই পবিত্র যুবককে নিয়ে পড়ছে মহাবিপদে। তাঁর আনিত নতুন এই মিশনকে কোনোভাবেই তাঁরা ঠেকিয়ে রাখতে পারছেনা। তাই তারা চিন্তিত। মহাচিন্তিত। তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে তারা ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত। তটস্থ। কী করা যায়, কীভাবে করা যায়—এই নিয়ে তাদের সভা-সমাবেশগুলোতে চলে তুমুল আলোচনা-পর্যালোচনা।
একপর্যায়ে তারা চিন্তা করলো মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সাথে সমঝোতা করবে, তাঁকে বুঝাবে, তিনি যেনো ধর্মের ব্যাপারে একপক্ষীয় অবস্থান গ্রহণ না করেন। তাদের ধর্মকেও যেনো স্বীকৃতি দেন। কিংবা তাদের ধর্মের বিষয়ে যেনো কোনো বক্তব্য পেশ না করেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। মুশরিকদের মধ্য থেকে সে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, আস ইবনে আব্দে ইয়াগুছসহ তাদের কতিপয় নেতা চলে আসলো রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের নিকট। এসে বললেন; “আপনার ভাতিজা যদি আমাদের ধর্মের কিছু অংশ মেনে নেয়, তাহলে আমরাও তার ধর্মের কিছু অংশ মেনে নিতাম। সে কিছুদিন আমাদের ইলাহকে মানুক আমরাও তাঁর ইলাহকে মানবো।”
শুধু রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের চাচার কাছেই না, তারা স্বয়ং তাঁর কাছেই এসেছে আগে। এসে দিয়েছে লোভনীয় অনেকগুলো প্রস্তাব। তারা মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে জিজ্ঞেস করে হে মুহাম্মাদ! কী চাও তুমি আমাদের কাছে? কেনো তুমি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলছো? কেনো তুমি আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলো? কেনো এবং কী জন্যে দেবদেবীর বিরুদ্ধে বলছো?
তুমি কি এই সমাজের নেতৃত্ব চাও? চলো তোমাকে আমরা আমাদের নেতা বানিয়ে দিই।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর জবাব, নাহ! আমি নেতৃত্ব চাই না। প্রয়োজন নেই তোমাদের নেতৃত্ব আমার।
এরপর তারা বললো তাহলে কী চাও? অঢেল অর্থ সম্পদ চাও তুমি? একজন সম্পদশালী ব্যক্তি হতে চাও? যদি তা-ই চাও, আমরা তোমাকে তা-ই দেবো। বানিয়ে দেবো তোমাকে মক্কার সবচেয়ে সেরা ধনী।
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, নাহ! প্রয়োজন নেই। আমি এমন ধন-সম্পদের প্রাচুর্য চাই না। এবারও হতাশ হয়ে পড়লো মুশরিকরা ।
অতঃপর তারা বলে ওঠলো তাহলে কী চাও তুমি? সুন্দরী রূপসী কোনো নারী?
যদি তা-ই চাও, তাহলে বলো, তোমাকে এবং তোমার জন্য আমরা মক্কার সেরা নারীটা এনে দেবো। সবচেয়ে রূপবতী মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের বন্দোবস্তো করবো।
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ জবাব দিলেন, নাহ! তোমরা যদি আমার এক হাতে চাঁদও এনে দাও, অন্য হাতে এনে দাও সূর্যটাও; তবুও আমি আমার মিশন এবং ভীষণ থেকে সরে দাঁড়াবো না।
আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম তো জাগতিক কোনো মোহ-মায়ায় কিংবা স্বার্থের জন্য এই দ্বীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছেন না। তিনি চাচ্ছেন মানুষের মুক্তি। মানুষের শান্তি। সেজন্য দুনিয়ার এমন লোভলালসার টোপে তিনি পড়েননি। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেলো মক্কার মুশরিক নেতৃবৃন্দ।
এতে ব্যর্থ হয়ে তারা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে ; বছরে কয়েকটা দিন তুমি আমাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। আর আমরাও কিছুদিন তোমার ধর্মের অনুসরণ করবো। এতে যদি তুমি আমাদের ধর্মে ভালো কিছু পাও, তাহলে না হয় এর-ই অনুসরণ করবে! আর আমরাও যদি তোমার ধর্মের অনুসরণ করে ভালো কিছু পাই, তাহলে আমরা-ই তোমার ধর্মের অনুসরণকারী হয়ে যাবো।
মোটের ওপর তাদের দাবি হচ্ছে, কিছুদিন আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেনো তাদের দেব-দেবিরও ইবাদাত করা হয়। আনুগত্য করা হয়। যেনো কিছুদিন হলেও ধর্মনিরপেক্ষ থাকা হয়। আল্লাহ এবং আল্লাহর ইবাদাত ও আইনকে অন্যের ইবাদাত এবং আইনের সমমর্যাদা প্রদান করা হয়। কিন্তু আল্লাহর রাসুল, যিনি এসেছেন সকল প্রকার তন্ত্রমন্ত্রের ঊর্ধ্বে আল্লাহর আইনকে উচ্চকিত করতে, যিনি এসেছেন এক আল্লাহর দাসত্বের বাহিরে সকলের দাসত্ব পরিহার করার মিশন এবং ভিশন নিয়ে; তিনি তাদের এসব কোনো প্রস্তাবের প্রতিই মাথা নত করলেন না। তাদের সকল প্রকার প্রস্তাবকেই প্রত্যাখ্যান করলেন।
আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হলো ওহী। যেটাকে আমরা পবিত্র কুরআনে প্রায়শই পড়ি, সূরা কাফিরূন হিসেবে। যেখানে তিনি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মক্কার কাফির-মুশরিক যারা, তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, নাহ! তাওহিদের সাথে শিরকের কোনো সমঝোতা নেই। ঈমানের সাথে কুফুরের কোনো আপোষ নেই। ইসলাম ছাড়া অন্যকোনো মতবাদ-ধর্ম-মতাদর্শকে মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। আর রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামও আল্লাহর আইন ও বিধানকে, তার আনুগত্য ও দাসত্বকে বুলন্দ করার ঘোষণা দিলেন মক্কার মুশরিকদের সামনে। যেখানে তিনি বলেছেন,
“হে কাফিররা! আমি তাদের ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা করো। এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমরা যাদের ‘ইবাদত করছো, আমি তাদের ‘ইবাদাতকারী হবো না’। তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। আমার কর্মকাণ্ডের ফলাফল আমার জন্য। তোমাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফলও তোমাদের জন্য।” [ সূরা কাফিরূন : ০১-০৬]
এই যে সূরা কাফিরূনের শেষ অংশটা, (লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়াদীন) এটা দিয়ে কেউ কেউ প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম অন্যান্য মতবাদকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ এটা দিয়ে সেক্যুলারিজমের দলিল পেশ করেন। কিন্তু আসলে কি তাই? ওপরের আলোচনাগুলো থেকে কী বুঝা যায়? এখানে তো মূলত ইসলাম ছাড়া অন্য সকল কিছুকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চপেটাঘাত করা হয়েছে সেক্যুলারিজমের গালে। চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবং এই আয়াতের অর্থ প্রচলিতভাবে যা জানি (তোমরা তোমাদের ধর্ম পালন করো, আমি আমার ধর্ম পালন করি!) তা নয়। এর অর্থ হচ্ছে তোমরা যা করো, সেটার দায় তোমাদের। তোমাদের পথ ও পন্থা তোমাদের জন্য (সে পথে চলার পরিণতি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে) আর আমার জন্য আমার পথ (যে সত্য পথে চলার জন্য আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, এ পথ ছেড়ে আমি অন্য কোন পথ গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত নই)।* সোজা কথায়, তোমাদের কর্মফল তোমরা ভোগ করবে। আমার কর্মফলও আমি পাবো।
এই কথার সমর্থনে পবিত্র আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে যে, “হে নবি! যদি এরা এখন আপনার কথা না মানে তাহলে বলে দিন, তোমরা যা কিছু করছে তা থেকে আমি দায়মুক্ত”। [সূরা আশ-শু'আরা: ২১৬] আরো বলা হয়েছে যে, “এদেরকে বলুন, আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছে সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। বলুন, আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন।” [সূরা সাবা: ২৫–২৬] সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে, ‘আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের।” [সূরা ইউনুস: ৪১]
সুতরাং এর মাধ্যমে কি ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমকে মেনে নেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া প্রমাণ হয়? এ প্রসঙ্গে ইমাম মওদূদী রহঃ তাঁর তাফহিমুল কুরআনে বলেন, “এর দ্বারা কাফিরদের দ্বীনের কোনো প্রকার স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি। মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যাঁরা ঈমান এনেছে তাঁরা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না- এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়া; আর তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণাই এ সূরার উদ্দেশ্য।”
আসলে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে যখন এতো সব লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়েছে, তবুও তিনি সেসব না মেনে এই ঘোষণার মানে হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের সাথে কোনো আপোষ চলবেনা। আমরাও এ-থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে পারি যে, একজন মুসলিম হিসেবে অন্য কারো বান্দেগি নয়, অন্য কোনো মতাদর্শকে স্বীকার করা নয়, সদা-সর্বদা এক আল্লাহর কাছেই নিজের মস্তককে লুটিয়ে দেবো। অন্য কোনো তন্ত্র-মন্ত্রে নিয়ে আল্লাহর দ্বীনের সাথে কোনো ক্রমেই আপোষ করবো না। থাকবো দ্বীনের ব্যাপারে আপোষহীন। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন।

~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ২৬৫ বার

মন্তব্য: ০