Alapon

মোঙ্গলদের ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস : যেভাবে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় সেবক!



ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম বিশ্বের উপর যত বিপদ ও দুর্যোগ নেমে এসেছে তার মধ্যে তাতারী বা মোঙ্গল হামলাই ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ। তাতারীরা পূর্ব দিক থেকে পঙ্গপালের মত ধেয়ে এসেছিলো এবং সমগ্র মুসলিম জাহান ছেয়ে গিয়েছিলো।
তাতার সেনাবাহিনী প্রথমে বোখারাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এরপর সমরকন্দের উপর আক্রমণ করে এবং শহরের একজন অধীবাসীও তাদের হাতে জীবিত রক্ষা পায়নি। তারা একে একে রে,হামদান, কযভীন,মার্ভ ও নিশাপুর পদাবনত করে।
হিজরী সপ্তম শতকে আব্বাসি খেলাফতের বাহিরে খাওয়ারিযম শাহী সালতানাত ছিলো খুবই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী। সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ খাওয়ারিযম শাহ ছিলেন সৎ,দীনদার, বীর ও দৃঢ়চেতা শাসক।
তা সত্বেও এই সাম্রাজ্যও তাতারীদের গতিরোধ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে প্রাচ্য ভুখন্ডে তাতারীদের প্রতিরোধ করার মতো তখন আর কোন শক্তি ছিলো না।
ইরান ও তুর্কিস্তান তছনছ করার পরে তাতারীরা ‘দারুল খিলাফত’ বাগদাদের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকায় এবং ৬৫৬ হিজরীতে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে বসে।
ঐতিহাসিকগণ বাগদাদ ধ্বংসের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মনোবেদনা ও হৃদয়-যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারেননি।
ইবন কাসির লেখেন, ৪০ দিন পর্যন্ত বাগদাদে গণহত্যা ও ধ্বংসের রাজত্ব চলে। নগর-উদ্যান, যা পৃথিবীর সুন্দরতম ও সমৃদ্ধতম নগর ছিলো, এমন ধ্বংস ও বিরান হয় যে, অলিতেগলিতে লাশের স্তুপ পড়ে থাকে।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসির তার হতবিহ্বল অবস্থা ‘আল কামিল’ গ্রন্থে উল্লেখ্য করে লেখেন, এ ঘটনা এমনই লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ছিলো যে, কয়েক বছর আমি এ সম্পর্কে ‘লিখবো কি লিখবো না’ এ দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ছিলাম।
হায়! আমার যদি জন্মই না হতো, কিংবা এর পূর্বেই আমার মৃত্যু হতো এবং আমার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে যেতো।
মোঙ্গল সম্পর্কে প্রচলিত এক বহুল আলোচিত প্রবাদতুল্য কথা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে “ইতিহাসে মোঙ্গলদের চেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন ইসলামের আর কোন জাতি করতে পারে নি এবং তাদের ন্যায় খেদমতও ইসলামের কোন জাতি করতে পারে নি ” কথাটা কতভাগ সত্য তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এ কথায় সকলেই একমত যে ধবংসযজ্ঞে তারা সর্বাগ্রে থাকলেও ইসলামের খেদমতেও তারা ছিলেন অগ্রগণ্য।
মোঙ্গল সম্পর্কে প্রচলিত এক বহুল আলোচিত প্রবাদতুল্য কথা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে “ইতিহাসে মোঙ্গলদের চেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন ইসলামের আর কোন জাতি করতে পারে নি এবং তাদের ন্যায় খেদমতও ইসলামের কোন জাতি করতে পারে নি ”
কথাটা কতভাগ সত্য তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এ কথায় সকলেই একমত যে ধবংসযজ্ঞে তারা সর্বাগ্রে থাকলেও ইসলামের খেদমতেও তারা ছিলেন অগ্রগণ্য।
সাধারণ যাযাবর জীবন ধারণ করা যে মোঙ্গল জাতির উত্থান হয় ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। চেঙ্গিস খানের সমসাময়িককালে মোঙ্গলরা ইসলামের দিকে না ভিড়লেও তার প্রয়াণের পর ক্রমেই মোঙ্গল সাম্রাজ্য ইসলামের দিকে ঝুকতে থাকে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
দূরদর্শী চেঙ্গিস খান মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে তার জীবদ্দশাতেই তার চার উত্তরাধিকারের মাঝে বন্টন করে দেন খানাত বা প্রদেশ আকারে।
বড় ছেলে জোচি খান পান ককেশাস অঞ্চল যাকে গোল্ডেন হোর্ড বলা হত। চুগতাই খান মধ্য এলাকার শাসক হোন। ওগেদাই খান খাকান নির্বাচিত হোন। তোগলাই খান ইরানের অধিপতি হোন।
জোচি খান সাম্রাজ্য অধিকারের পূর্বেই মারা গেলে তার ছেলে বাতু খান ১২২৭ সালে গোল্ডেন হোর্ডের ক্ষমতায় আসীন হোন। বাতু খান ১২৫৫ সালে মারা গেলে তার স্থলে জোচি খানের দ্বিতীয় ছেলে বারকে খান ১২৫৭ সালে গোল্ডেন হোর্ডের শাসক রূপে অধিষ্টিত হোন।
এদিকে কাজাখস্তানের বুখারা ছিল মুসলমানদের প্রথম শহর যা মঙ্গোলদের অধীনে আসে। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান নিজেই এ শহরটি দখল করেছিলেন।
যেভাবে এল ইসলামের ছায়াতলেঃ
******************************
চেঙ্গিস খানের নাতি বারকে খান একবার এই বুখারার ভেতর দিয়ে ইউরোপ থেকে রাজধানী খারখোরিন যাচ্ছিলেন মঙ্গোলীয়দের উচ্চ পর্যায়ের রাজসভায় যোগ দেবার জন্য। তিনি মুসলমানদের একটি মরুযাত্রী দলের সাক্ষাৎ পেলেন। সে দলে ছিলেন একজন সুফী দরবেশ, হযরত সুফী সাইফ উদ্দিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁর কাছে মুসলমানদের বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চান তিনি। আল্লাহর অলিগণের একটি মাত্র সুদৃষ্টিতে যে মানুষের ভাগ্য বদলে যায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই ঘটনাটি। বারকে খানের মাও ছিলেন একজন খৃষ্টান এবং তিনি নিজেও খৃষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তাদের এতদিনের ধর্ম বিশ্বাস হযরত সুফী সাইফ উদ্দিন রহমতুল্লাহি আলাইহির একটি মাত্র দৃষ্টিতে পাল্টে যায়। বারকে খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে উনার হাতে বায়াত হন ।
বারকে খান নিজেই শুধু ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং অন্যান্য মঙ্গোল খানদেরও ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাদের অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মোঙ্গল শাসক যিনি ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন। আমৃত্যু তিনি ইসলামের খেদমত করে গিয়েছিলেন এবং মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে ইসলামকে রক্ষার জন্য ঢাল হিসেবে মোঙ্গল ও ইসলামের মাঝে ঠায় দাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে তারই চাচাত ভাই হালাকু খান তৎকালীন খাকান মংকে খানের আদেশে মুসলিমদের ধবংসের নীল নকশা হাতে নিয়ে বাগদাদে মুসলিমদের উপর ইতিহাস কুখ্যাত অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালালে বারকে খান শপথ নেন।
“সে (হালাকু) মুসলিম জনপদগুলো ধ্বংস করেছে। আল্লাহর সহায়তায় অবশ্যই আমি তার কাছে থেকে প্রতিটি নিরপরাধ লোকের প্রতিশোধ নিব।“
কিন্তু বিরাট মোঙ্গল বাহিনীর বিরুদ্ধে একা লড়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। তাই তিনি অনুধাবন করেন মোঙ্গলদের পরাস্ত করতে আগে তাদের দুর্বল করা প্রয়োজন। তারই সূত্র ধরে তিনি খাকান হিসেবে আরিকবুকাকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে মোঙ্গলদের মাঝে প্রথম গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটান,মামলুকদের সহায়তা দেন যার ফলশ্রুতিতেই হালাকু খান ইতিহাস বিখ্যাত আইনে জালুতের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন।
ইসলামী ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে আল্লাহ তায়ালা যদি ইসলামকে বারকে খান দ্বারা সহায়তা না করতেন তাহলে মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়া থেকে ইসলামের আলো নিভে যেত। গোল্ডেন হোর্ড, ককেশাস অঞ্চল ছাড়াও মোঙ্গলদের মাঝে ইসলামের বিকাশ ঘটানো তে বারকে খানের অতুলনীয় অবদান ছিলো। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। বারকে খানের দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণকারীর অন্যতম ছিলেন খোরাসানের গভর্নর আজতাঈ, বলা হয়ে থাকে তার সাথে তার সকল সৈন্যও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।
এছাড়াও মোঙ্গল শিবিরে ইসলামের হাওয়া আগুণের মতো ছড়ানো শুরু করে যখন বাগদাদ ধবংসকারী হালাকু খানের সপ্তম ছেলে তাকুদার খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হালাকু খান কর্তৃক ইরাক, ইরান ও সিরিয়া দখলের সময় তাকুদার চীনে অবস্থান করছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আহমাদ বিন হালাকু নাম ধারণ করেন। কথিত আছে যে, তিনি নাছিরুদ্দীন তূসীর কথায় প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
এছাড়াও ইলখানাতের সপ্তম শাসক চেঙ্গিস খানের বংশধর মাহমুদ ক্বাযানও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যার সাথে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া(রহ) এর বার্তালাপের বেশ কিছু কিংবদন্তিও প্রচলিত রয়েছে।
এসকল মোঙ্গল শাসকদের ইসলাম গ্রহণের দরুন মোঙ্গল সাধারণ্যের মাঝেও ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এছাড়াও মোঙ্গলরা বিজিত ইসলামী এলাকা গুলো থেকে যে সকল মুসলিম হাতুনদের দাস-দাসী বানিয়ে এনেছিল। তাদের উন্নত চরিত্র, ব্যবহার্য্যে মুগ্ধ হয়ে মোঙ্গলরা তাদের বিয়ে করতে শুরু করে৷ ক্রমেই মুসলিম নারীরা মোঙ্গলদের ভেতর থেকে জয় করতে শুরু করে, যাদের তালোয়ারের জোড়ে শত বৎসরেও অবনমন করা যেত না সেসকল মানুষদের হৃদয়েই ইসলামের সুপ্ত বীজ বপন করতে থাকেন মুসলিম নারীরা, যদ্দরুন ক্রমেই মোঙ্গলরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে।
ইতিহাসের মোড় কে একেবারে পরিবর্তন করে ফেলা মোঙ্গল জাতি যাদের নৃশংসতা কে মুসলিমরা প্রথমে ইয়াজুজ-মাজুজ এর নৃশংসতা ভেবে তঠস্থ হয়ে পড়েছিল এবং যাদের এক কথায় অপরাজেয় ভাবছিল তৎকালীন বিশ্ব। সে জাতি থেকেই মহান আল্লাহ তায়ালা এমন কিছু মানুষকে ইসলামের ঢালে পরিণত করে দিয়েছিলেন যাদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রসার এবং রক্ষা পাচ্ছিল ।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ত বলেই দিয়েছিলেন ;
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালাই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী"
তথ্যসূত্র -
১) উইকিপিডিয়া
২)"Preaching of Islam" লেখক টি. ডব্লিউ. আর্নল্ড

পঠিত : ১২৬৩ বার

মন্তব্য: ০