Alapon

একসময় জিন্নাহ মানে বুঝতাম একটা রাক্ষস



একসময় জিন্নাহ মানে বুঝতাম একটা রাক্ষস, কসাই, যে বাংলা ভাষাকে জবাই করতে এসেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালিয়ের ছাত্রদের তাড়া খেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে বেচেছে। তখন সম্ভবত ২০১৩-১৪ সাল। আমি আরো ভাবতাম, উপমহাদেশের যে পার্টিশন এবং এই পার্টিশন কেন্দ্রিক প্রাণক্ষয়, একাত্তর ও দ্বিজাতিতত্ত্ব, এই সবকিছুর পেছনে দায়ী ব্যক্তি হচ্ছেন জিন্নাহ। এরপর ধীরে ধীরে আমি জানা শুরু করলাম যে ব্যাপার পুরোই উলটো। দ্বিজাতিতত্ত্বের জনক মূলত আমি বলবো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবকুমার মিত্ররা, এ ব্যাপারে আপনারা আহমদ ছফার রাজনৈতিক প্রবন্ধসমগ্র দেখতে পারেন, আহমদ ছফা বঙ্কিমকে এভাবেই উল্লেখ করেছেন। তার আনন্দমঠ উপন্যাস একা ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছিল বিভাজনের এক শতাব্দী আগেই।
শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম, জয়া চ্যাটার্জির বাংলা ভাগ হল বা আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি যারা পড়েছেন তারা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য, যে সেসময়ের প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের বিভাজন একটা অমোঘ বাস্তবতা ছিল। দুঃখজনকভাবে, বাংলা ভাগের পর কোলকাতার যে মুহাজির মুসলমানদের বাংলাদেশ সম্মান দেয়, জীবিকা দেয় ও আশ্রয় দেয়, তারাই শেষমেশ জমিদারী হারানো বাবুদের বয়ানের সাথে মিলিয়ে দেশ বিভাজনের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন। মূলত এই শ্রেনীটাই বাংলা বিভাজনকে একটি ক্ষতিকর ঘটনা হিসেবে জাতীয় মননে স্থাপন করতে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন।
আমরা দেখি, বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের আগে কৃষকের জমির উত্তরাধিকারই ছিল না। আমাদের দাদার আমলের আগে অর্থাৎ পরদাদাদের কারো নিজের জমি ছিল না শুধুমাত্র কিছু মুষ্টিমেয় জমিদার পরিবার বাদে। কৃষক নিজের জমি ফিরে পেয়েছে মূলত পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলায় শিক্ষার হার বেড়েছে বঙ্গভঙ্গের পরে এবং তা পাকিস্তান আমলে আরো জোরদার হয়েছে। মূলত পাকিস্তান আমলেই প্রথম বাংলার চাষীর সন্তানেরা সরকারী চাকরি-প্রশাসনিক ক্ষমতার অংশ হয় প্রায় দুশো বছরের দাসত্বের পর।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে দেখবেন, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জিন্নাহর একনিষ্ঠ ভক্ত, জিন্নাহর মৃত্যুতে তিনি ফুপিয়ে কেদেছিলেন। অথচ আওয়ামী লীগের লোকজনকে এখন ধারনা দেয়া হয়, সব নষ্টের গোড়া হল জিন্নাহ।
পাকিস্তান আন্দোলনের সাফল্যের ব্যাপারে আমরা যদি কাউকে একচেটিয়া ক্রেডিট দেই, তিনি হবেন মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ। তার ইস্পাত-দৃঢ় মনোবল ছাড়া পাকিস্তান আন্দোলন কোনভাবেই সফল হতে পারতো না।
পাকিস্তানের ধারনাটা ইকবালের, কিন্তু তা বাস্তবায়নে সম্মুখে জিন্নাহ ছিলেন সবার আগে, আর এই আন্দোলনকে জনপ্রিয়করনে অগ্রনী ছিলেন শের ই বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং আব্বাসউদ্দীন। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক তৎপরতায় এখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরও অনস্বীকার্য ভুমিকা ছিল, আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
তো দেখা যাক, আল্লামা ইকবাল জিন্নাহ সম্পর্কে কি বলেছেন!!
"There is only one way out. Muslims should strengthen Jinnah's hands. They should join the Muslim League. Indian question, as is now being solved, can be countered by our united front against both the Hindus and the English. Without it, our demands are not going to be accepted. People say our demands smack of communalism. This is sheer propaganda. These demands relate to the defense of our national existence.... The united front can be formed under the leadership of the Muslim League. And the Muslim League can succeed only on account of Jinnah. Now none but Jinnah is capable of leading the Muslims."
-Allama Iqbal
আজকে সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য খোদার রহমত হয়ে দুনিয়াতে আসা মানুষটার জন্মদিন, যাকে এতদিন গেরুয়া মিডিয়ার প্রচারনায় বাংলাদেশের মানুষ ভুল বুঝেছিল।
এনআরসি-সিএএ আসার আগ পর্যন্ত যে জিন্নাহকে মানুষ মনে করতো দানব, এখন তারা বুঝতে পারছেন জিন্নাহ আসলে কি করে গেছেন। বাংলাদেশের এই মানচিত্র আমরা ব্রিটিশের কাছ থেকে আদায় করেছি সাতচল্লিশে, একদিক থেকে এই মানচিত্র জিন্নাহর উত্তরাধিকারও বটে।
এই লোকটা না থাকলে হয়তো এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়য়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে দিন কাটানোর প্রস্তুতি নিতে হত নয়তো রোজ ঘুম থেকে উঠে দাঙ্গা লাগলে মা বোনকে কিভাবে বাচাবো সেই কথা ভাবা লাগতো।
আল্লাহ কায়েদে আযমের ভুলগুলি ক্ষমা করে তাকে বেহেস্ত নসীব করুন। নিজের যক্ষ্মার কথা গোপন করে চুপচাপ মুসলিমদের স্বাধীন ভুখণ্ড প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া এই মানুষটাকে আল্লাহ কবুল করুক।
ইকবালের স্বপ্ন ছিল, হিন্দুস্তানের যেখানে যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রত্যেক প্রদেশে একটা করে পাকিস্তান তৈরি করা। বিশেষভাবে জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি ও আগ্রা, মালাবার উপকূল ও আসাম এই পরিকল্পনার অংশ ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দরকষাকষিতে নেহরুর সাথে এডুইনা মাউন্টব্যাটেনের পরকীয়া সম্পর্কের প্রভাব পড়ায় শেষমেশ একচেটিয়াভাবে জেতে কংগ্রেস। সোহরাওয়ার্দী-শের ই বাংলাদের কাছ থেকেও শেষদিকে জিন্নাহ কোন সমর্থন পান নি, কিন্তু একাই হিমালয়সম সাহস নিয়ে পেরিয়ে গেছেন বাধার পুলসিরাত, আর আমাদের পূর্বপুরুষকে দুশো বছরের অপেক্ষার পর এনে দিয়েছেন জমির অধিকার, ইসলাম বুকে নিয়ে বেচে থাকার অধিকার, গরু কুরবানী দেয়ার অধিকার, মানুষ হিসাবে বিবেচিত হবার অধিকার।
আল মিলাদ, কায়েদে আযম জিন্নাহ!!
ছবি- পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসার পর গর্ভনর হাউসে কায়েদে আজমকে রিসিভ করেছেন মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন।

- Muhammad Sajal

পঠিত : ৩২৮ বার

মন্তব্য: ০