Alapon

তওহিদূল হাকিমিয়া



তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে

শরিয়াহ দ্বারা শাসনের আবশ্যকতা এবং এ সম্পর্কে সৃষ্ট বিভ্রান্তির অপনোদনে অতীত ও বর্তমান আলিমগণের বক্তব্যের সংকলন ।

সংকলন ॥ আকিল আহমাদ রাদি

শারয়ি সম্পাদনা ॥ শাইখ মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির

প্রকাশকাল

রবিউল আওয়াল- ১৪৩৯ -ডিসেম্বর- ২০১৭

প্রকাশনায় ইমাম পাবলিকেশন্স লিমিটেড

www.imampub.com

[email protected]

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

তারা কি জাহিলিয়্যাতের বিচার-ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম বিধান দানকারী কে?
(সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৫০)


প্রাককথন

সকল প্রশংসা আল্লাহর― যিনি আল-আফুয়্যু, আত-তাওয়াবু, আল-ওয়াহহাবু, আশ-শাকুরু। যিনি সমগ্র সৃষ্টির অধিপতি, সমস্ত কিছুর মালিক, মহিমান্বিত, গৌরবান্বিত, পরিপূর্ণ সম্মানের অধিকারী। যিনি সর্বশক্তিমান, প্রবল পরাক্রমশালী, অপ্রতিরোধ্য, প্রতাপান্বিত, সমুন্নত, আল-হাকাম, আল-হাকিম, পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। যিনি আল-আহাদ, আল-ওয়াহিদ, যিনি আল-আলা, আল-আলিয়্যু, যিনি সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ। যার কোন শরিক নেই, যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই, কোন কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, আমরা তাঁর কাছ থেকেই এসেছি এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাবো এবং তাঁর ইচ্ছে ব্যতীত কোন গতি, নিরাপত্তা, আশ্রয় নেই, নেই কোন শক্তি, সক্ষমতা কিংবা সামর্থ্য।

সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা আন-নাবিয়্যুর রাহমাহ, আন-নাবিয়্যুল মালহামাহ, আদ্ব-দ্বাহুক আল-ক্বাত্তাল, ইমামুল মুজাহিদিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ’র উপর, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সাহাবাদের উপর।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তার কোন শরিক নেই, রাজত্ব তাঁরই, হুকুমাত তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই, তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন শক্তি, সামর্থ্য, আশ্রয় নেই এবং মুহাম্মাদﷺতাঁর বান্দা ও রাসুল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি— মহান আল্লাহ সত্য, তাঁর নাবিﷺসত্য এবং তাঁর মনোনীত দীন ইসলাম সত্য। নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু জগতসমূহের একমাত্র অধিপতি আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার জন্যই।

আমিও আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয় আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং এ ব্যাপারে তাঁর কোন শরিক নেই, নিশ্চয় তিনি হলেন বিধানদাতা এবং তাঁর বিধান ছাড়া আর কোন বিধানের বৈধতা নেই। নিশ্চয় দীন ইসলাম একমাত্র সত্য জীবনবিধান, যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া আর কোন দীন গ্রহণ করবে কোনদিনই তা তার পক্ষে থেকে কবুল করা হবে না। সে ক্ষতিগ্রস্ত দুনিয়াতে এবং আখিরাতে।

আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা তাঁর কিতাবে আমাদের জানিয়েছেন―

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ۝ اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

সুতরাং যারা তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাঙবার নয়। আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরি করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।
সুরা আল-বাকারা, ২: ২৫৬-২৫৭

তিনি আরও বলেছেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো।
সুরা আন-নাহল, ১৬: ৩৬

الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا

যারা ঈমানদার তারা কিতাল করে আল্লাহর পথে। পক্ষান্তরে যারা কাফের তারা কিতাল করে শয়তানের পক্ষে। সুতরাং তোমরা কিতাল করতে থাকো শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে, (দেখবে) শয়তানের চক্রান্ত একান্তই দুর্বল।
সুরা আন-নিসা, ৪: ৭৬

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ

যারা তাগুতের ইবাদাত থেকে বিরত থাকার জন্য তাগুত থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্যে রয়েছে সুসংবাদ। অতএব, সুসংবাদ দিন আমার বান্দাদেরকে।
সুরা আয-যুমার, ৩৯: ১৭

তিনি আরও বলেছেন,

بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ

তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশ নিবে এবং কিছু অংশকে পরিত্যাগ করবে? যদি তাই কর তবে মনে রেখো, পৃথিবীতে তোমরা হবে চরম লাঞ্চিত, বঞ্চিত এবং আখিরাতে তোমাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা বাকারা, ২: ৮৫

فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকেই ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের আদেশ করেছেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ

আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন (আনুগত্য-কর্তৃত্ব) সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যই হয়ে যায়।
সুরা আল-আনফাল, ৮: ৩৯

রাসুলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন,

«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ فَمَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ فَقَدْ عَصَمَ مِنِّى مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ»

আমি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” সুতরাং যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এ সাক্ষ্য দিবে তাঁর জান-মাল আমার থেকে নিরাপদ। তবে ইসলামের কোনো হক ব্যতীত। আর তার অন্তরের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত।
সহিহ বুখারী, হাদিস: ২৭৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩৪

রসূল (ﷺ) আরো বলেছেন,

«لَتُنْقَضَنَّ عُرَى الإِِسْلاَمِ عُرْوَةٌ عُرْوَةٌ فَكُلَّمَا انْتُقِضَتْ عُرْوَةٌ تَشَبَّثَ النَّاسُ بِالَّتِي تَلِيهَا فَأَوَّلُهُنَّ نَقْضًا الْحُكْمُ، وَآخِرُهُنَّ الصَّلاَةُ»

ইসলামের দৃঢ় বন্ধনগুলো একটির পর একটি খুলে যাবে। যখনই একট বন্ধন খুলে যাবে, লোকেরা তার পরেরটিকে আঁকড়ে ধরবে। সর্বপ্রথম যে বন্ধন খুলে যাবে তা হবে শাসন, আর সর্বশেষটি হল সালাত।
মুসনাদ আহমাদ: ২২২১৪; ইবনু হিব্বান: ৬৭১৫; মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ১২২১১

يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ الصَّابِرُ فِيهِمْ عَلَى دِينِهِ كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ

এমন একটা সময় আসবে যখন ইমানদারদের জন্য ইমান ধরে রাখা হাতের মুঠোয় জলন্ত কয়লা ধরে রাখার মত কঠিন হবে।
সুনান তিরমিযি: ২২৬০, মিশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৬৭

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ - - « بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ»

আবু হুরাইরা রায়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ইসলামের সূচনা হয়েছে অপরিচিত নির্বাসিতের মত। পূনরায় একদিন তা নির্বাসিতে পরিণত হবে। সুতরাং সুসংবাদ গুরাবাদের জন্য।
সহিহ মুসলিম: ৩৮৯

নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ) সত্য বলেছেন।

বর্তমানে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের যে সময় উম্মাহ পার করছে এরকম ভয়াবহ সময় আর কখনো উম্মাহর ইতিহাসে আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিপর্যয়ের ফলশ্রুতিতে উম্মাহর বড় একটা অংশ এখন বিজয়ের স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গেছে। পুরো বিশ্বকে পদানত করা, আল্লাহর দীন ও শরিয়াকে পুরো পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার বদলে অনেকেই এখন লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন “কোন মতে টিকে থাকা” আর “খাপ খাইয়ে নেওয়া”-কে। প্রচন্ড দুর্দশা আর দীর্ঘ দিনের পরাজয়ের ফলশ্রুতিতে পরাজিত মানসিকতা তাদের মধ্যে জেঁকে বসেছ।

ফলে অপরিবর্তনীয়কে পরিবর্তনের, যে বিষয়গুলো নিয়ে আপোষ করা সম্ভব না সেগুলোর ক্ষেত্রে আপোষের একটা দর্শন উম্মাহর একটি অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছে। আর আপোষকামিতা ও পরাজিত মানসিকতার এই ব্যাধির অনেক উপসর্গের মধ্যে একটি হল শরিয়াহ দিয়ে শাসনের আবশ্যকতা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।

অনেক আয়াত, হাদিস, সালাফদের বক্তব্য এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়ার আয়িম্মা ও আলিমগণের বক্তব্য থেকে সন্দেহাতীতভাবে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা শাসন করা আবশ্যক; ফরয। শাসন ও আনুগত্যের ব্যাপারে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার সাথে কাউকে শরিক না করা, তাওহিদ ও ইমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি দীনের এমন একটি বিষয় যা সংশয়পূর্ণ কিংবা মতবিরোধ পূর্ণ না, বরং সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা দেখি, আজ অনেকের মধ্যে এ বিষয় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

এটি এমন একটি ফিতনা যা বহিঃশত্রুর আগ্রাসনের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে যখন উম্মাহর আরেকটি অংশ উম্মাহর বিজয়ের জন্য, উম্মাহর মর্যাদা, গর্ব ও সম্মানের দিনগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে তারা বিজয়ী হচ্ছে। এরকম একটি সময়ে পরাজিত মানসিকতার এবং অসম্মান ও অপমানের এই ফিকহের মোকাবেলায় সম্মান, মর্যাদা এবং শক্তির ফিকহকে উপস্থাপন করা এবং তার প্রতি আহ্বান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ কারণে দাওয়াহর ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্ব পাবার দাবি রাখে তার মধ্যে তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ অন্যতম। কারণ তাওহিদের সাথে আপোষ করে, আল্লাহর একত্বের সাথে আপোষ করে যে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়া হয়, সেটা কখনো মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর (ﷺ) আনীত ইসলাম না। পরিপূর্ণ তাওহিদের দাওয়াহ দেওয়ার জন্য আমরা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার কাছে দায়বদ্ধ। বিশ্বজগতের একচ্ছত্র অধিপতি যা নাযিল করেছেন, আমাদের কোন অধিকার নেই তাতে সংযোজন, বিয়োজন, সম্পাদন কিংবা পরিমার্জন করার। আমরা আদিষ্ট সত্য প্রকাশ করার জন্য। এটা মিল্লাতু ইবরাহিমের দাবি।

“অতএব আপনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করুন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।
সুরা আল-হিজর, ১৫: ৯৪

তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে বিদ্যমান বিভিন্ন বিভ্রান্তি দূর করা, শরীয়াতের বক্তব্য এবং এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অবস্থান তুলে ধরার মাধ্যমে, দাওয়াতি কাজের সাথে যুক্ত ভাইদের সাহায্য করার জন্য এ প্রচেষ্টা। আল্লাহ যেন আমার পক্ষ থেকে এই প্রচেষ্টা কবুল করেন। বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীরা যেসব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তার দলিলসহ জবাব এবং অতীত ও বর্তমানের হকপন্থি আলিমদের বক্তব্য খুঁজে পাবার ব্যাপারে, আল্লাহ চাইলে এ সংকলনটি উপকারী হবে। আর সাফল্য শুধুমাত্র আল্লাহরই পক্ষ থেকে। এতে যা কিছু কল্যাণকর আছে তা একমাত্র আল্লাহরই পক্ষ থেকে, আরা যা কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে তা আমাদের এবং শয়তানের পক্ষ থেকে।

এ সংকলনটি ভাইরা চাইলে নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারেন এবং প্রচার করতে পারেন। সম্পূর্ণ সংকলনটি অথবা কোন নির্বাচিত অংশ। এক্ষেত্রে এই অধমের নাম উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই। এটি আমার পক্ষ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সত্যকে উপস্থাপন এবং সাদাকাতুয যারিয়্যাহর একটি প্রচেষ্টা। একজন ভাই হিসেবে আমার শুধু দুটো অনুরোধ থাকবে—

প্রথমত: তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর বিষয়টিকে দাওয়াহর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং বিষয়টিকে খাটো করে না দেখা। ভাইদের প্রতি দ্বিতীয় অনুরোধ হবে তাদের দুয়াতে আমাকে স্মরণ রাখা। অনুরোধ থাকবে তাদের সুজুদে এবং মুনাজাতে আমাকে স্মরণ করার জন্য এবং আল্লাহ আল-ওয়াহহাব আল-ওয়াদুদের কাছে এই দুয়া করার জন্য, তিনি যেন তাঁর এই পাপী গোলামকে সে কাফিলাতে শামিল করেন যার নেতা হলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু।

ﺍﻟﻠﻬﻢ ﻫﻞ ﺑﻠﻐﺖ ﺍﻟﻠﻬﻢ ﻓﺸﻬﺪ


তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ

আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না।
সুরা ইউসুফ, ১২: ৪০

রাসুলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন,

« إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ»

নিশ্চয় আল্লাহ হচ্ছেন আল-হাকাম (বিচারক) এবং হুকুম (বিধান, আইন প্রণয়ন) হলো তাঁর অধিকার।
আবু দাউদ: ৪৯৫৭; সহিহ ইবনু হিব্বান: ৫০৪

“আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের একটি হলো হাকিমিয়্যাহ। যখনই কেউ কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য আইন প্রণয়ন করে, তখনই সে নিজেকে আল্লাহর বদলে এমন আরেক প্রভুর ভূমিকাতে বসিয়ে নেয় যার আইনের আনুগত্য ও অনুসরণ করা হয়। আর যারা এই আইন প্রণেতা বা আইন প্রণেতাগণের আনুগত্য করে, তারা আল্লাহর গোলামের পরিবর্তে আইন প্রণেতাদের গোলামে পরিণত হয়। তারা অনুসরণ করে আইন প্রণেতাদের সৃষ্ট দীনের, আল্লাহর দীন ইসলামের না। জেনে রাখুন আমার প্রিয় ভাইয়েরা, এটা আকিদার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। এটা হলো উলুহিয়্যাহ (একমাত্র আল্লাহকেই ইলাহ/উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা) এবং উবুদিয়্যাহর (একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব) প্রশ্ন। এটা হলো ইমান ও কুফরের প্রশ্ন। জাহিলিয়্যাহ এবং ইমানের প্রশ্ন। জাহিলিয়্যাহ কোনো নির্দিষ্ট সময় বা যুগ না, জাহিলিয়্যাহ হলো একটি অবস্থা।”

—সাইয়িদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ, ফি যিলালিল কুরআন।

“ইসলামি আইন (শরিয়াহ) দ্বারা শাসিত প্রতিটি দার (ঘর, ভূমি, অঞ্চল) হলো দারুল ইসলাম এবং কুফরি আইন দ্বারা শাসিত প্রতিটি দার হলো দারুল কুফর। আর এই দু’ধরনের নিবাস ছাড়া আর কোন শ্রেণিবিভাগের উল্লেখ নেই।”

—ইবনু কুদামা, আল-আদাবুশ শারিয়াহ।

সমগ্র সৃষ্টি জগতের মালিক, আরশের অধিপতি, যিনি আসমানসমূহকে সমুন্নত করেছেন কোন প্রকার খুঁটি ছাড়াই, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা, তাঁর গোলাম মানবজাতি এবং জিনজাতির উপর আবশ্যক করেছেন সম্পূর্ণভাবে তাওহিদে বিশ্বাস স্থাপন, শেষ নবি মুহাম্মাদ (ﷺ)

এর উপর বিশ্বাস স্থাপন, তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব আল-কুরআনের উপর বিশ্বাস স্থাপন, ইসলামকে দীন হিসেবে গ্রহণ এবং ইসলামি শরিয়াহর সম্পূর্ণ অনুসরণ। এ ব্যাপারগুলোকে আল্লাহ আমাদের ইচ্ছাধীন করেন নি। তিনি আমাদের উপর এগুলো বাধ্যতামূলক করেছেন। তিনি এগুলো কোনো স্থান-কাল-সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট করেন নি। কিয়ামত পর্যন্ত জিন ও মানবজাতির জন্য এ আদেশগুলো অবশ্য পালনীয়।

ঠিক যেভাবে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের জন্য আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বিভিন্ন বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তেমনিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যও বিভিন্ন বিধান তিনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ এ কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। যে মহান প্রতিপালক ঘুম থেকে ওঠার পর পুনরায় ঘুমাবার আগ পর্যন্ত ব্যক্তির প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তের ব্যাপারে, তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহর মাধ্যমে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছেন, যে এক ও অদ্বিতীয় অধিপতি দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের জন্য উত্তম নিয়ম ঠিক করে দিয়েছেন, তিনি মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালা, অপরাধ ও অপরাধীর শাস্তি, অর্থনৈতিক লেনদেনের নিয়ম, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নিয়ম, মুসলিমদের সাথে অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়সমূহের সম্পর্ক কি রকম হবে– এ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশনা দেন নি, এগুলো আমাদের খেয়ালখুশির উপর ছেড়ে দিয়েছেন, এমন কথা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই গ্রহণযোগ্য না।

আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ থেকে এ সত্য সুস্পষ্ট যে, ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নিয়ম ঠিক করে দিয়েছেন। এসব কিছু নিয়েই দীন ইসলাম। সম্পূর্ণ ও সর্বোত্তম জীবনাবিধান। যাতে অবকাশ নেই কোন রকম সংযোজন ও বিয়োজনের। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর কিতাবে বলেছেন,

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।
সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৩

এ বিষয়গুলো নিয়ে উম্মাহর মধ্যে কক্ষনোই কোন মতবিরোধ, মতপার্থক্য, সন্দেহ ও সংশয় ছিল না। কিন্তু আজ আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ, সুপ্রতিষ্ঠিত, সুসাব্যস্ত বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে এবং উম্মাহর বিশাল একটা অংশ সুস্পষ্ট এসব বিষয় নিয়ে সন্দেহে পড়ে গেছে। বর্তমানে ইসলামের যেসব অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো শরিয়াহ দ্বারা শাসনের আবশ্যকতা।

ইসলামের বাহ্যিক শত্রু– যায়নিস্ট ইহুদি, ক্রুসেডার খ্রিস্টান, উদারনৈতিক পুঁজিবাদি গণতন্ত্রী, বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রী, নাস্তিক ইসলামবিদ্বেষী, সেক্যুলার মানবতাবাদীরা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার নাযিলকৃত ও নির্ধারিত শরিয়াহকে বর্বর, মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক বিশ্বে অগ্রহণযোগ্য বলে মানুষের সামনে তুলে ধরার। এজন্য তারা ব্যবহার করছে ম্যাস মিডিয়া, পপুলার কালচার, প্রাচ্যবাদী, ওয়েস্টার্ন ইন্টেলেকচুয়াল এস্টাবলিশমেন্ট এবং মুসলিম বিশ্বে তাদের তোতাপাখিদের। ইসলামের বাহ্যিক শত্রুদের এ প্রচেষ্টার ইতিহাস বেশ পুরনো। তবে আধুনিক সময়ে শরিয়াহকে কেন্দ্র করে উম্মাহর ভেতর থেকেই আমরা এমন কিছু বক্তব্য এবং অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, যা এতোটা ব্যাপকভাবে উম্মাহর ইতিহাসে এর আগে দেখা যায় নি।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, উম্মাহর মধ্যে এমন কিছু দায়ি ও উলামার আবির্ভাব ঘটেছে যারা অপরিবর্তনীয়কে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। আধুনিকতা, অগ্রগতি এবং ক্রমপরিবর্তনশীল সময়ের সাথে তাল মেলানোর অজুহাতে তারা শরিয়াহ দিয়ে শাসনের আবশ্যকতাকে রহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ এর নাম দিচ্ছে শরিয়াহ সংস্কার (Shariah Reform), কেউ নাম দিচ্ছে শরিয়াহ পুনঃব্যাখ্যা (Reinterpreting the Shariah), কেউ একে বলছে আধুনিক সহনশীল ইসলাম (Modern Moderate Islam)।

আবার কেউ সরাসরি বলছে, শরিয়াহ দিয়ে শাসন করার আবশ্যকতা ছিল একটি নির্দিষ্ট সময় ও অঞ্চলের জন্য, কিন্তু বর্তমানে এই আবশক্যতা আর নেই। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, আরেকটি ধারার উদ্ভব ঘটেছে যারা শরিয়াহ ও সালাফদের অনুসরণের চাদরে নিজেদের ঢেকে নিয়ে, শরিয়াহর অপব্যাখ্যার মাধ্যমে শরিয়াহ ছাড়া অপর কিছু দিয়ে শাসনকারী শাসকের বৈধতা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা শাসকদের গোলাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর শরিয়াহ ছাড়া অপর কোন শরিয়াহ দ্বারা শাসনের বৈধতা দিচ্ছে।

বাংলাদেশেও শরিয়াহ নিয়ে এ দুটি ভ্রান্ত অবস্থানের পক্ষে বেশ প্রচার ও প্রচারণা চলছে। একদিকে শরিয়াহ এবং দীনের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তনের (Epistemological change regarding the Shariah) কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে যেকোন শাসকের আনুগত্য করা শরিয়াহর আবশ্যিক বিধান এবং যারা আনুগত্য করবে না তারা পথভ্রষ্ট খাওয়ারিজ।

তাই আজ আমরা শুনছি পাবলিকলি প্রচার করা হচ্ছে, আল্লাহর আইনের বিপরীতে অন্য কোন আইন দিয়ে শাসনকারী এবং সেই শাসকের আইন বাস্তবায়নকারীর সাথে সাধারণ একজন মুসলিমের পার্থক্য নেই। আজ আমরা এমন সব কথা শুনতে পাচ্ছি যেখানে এই মেসেজ দেওয়া হচ্ছে যে, আল্লাহর আইনের বদলে অন্য কোন আইন দিয়ে শাসন করা, তেমন বড় কোন সমস্যা না। আমরা দেখছি প্রচার করা হচ্ছে, শরিয়াহ দিয়ে তখনই শাসন করা হবে যখন অধিকাংশ জনগণ তা চাইবে, তার আগ পর্যন্ত শাসকের আনুগত্য করতে হবে। কেউ বলছেন, শরিয়াহ দিয়ে শাসন না করেও ইসলাম পালন সম্ভব, কেউ বলছেন মানবরচিত আইন দিয়ে শাসন করা, তেমন বড় কোন ব্যাপার না, আমাদের এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং ব্যক্তিগতভাবে ইমানের বিশুদ্ধতা অর্জন, আমল ঠিক করা, আরবি ভাষা শেখা, সঠিক উচ্চারণে কুরআন পড়তে শেখা, ফজরের সালাত জামায়াতে আদায় করা, সঠিক আকিদাহ শেখা ইত্যাদি বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিৎ।

এ কথাগুলো কোন সেক্যুলারিস্ট, কোন লিবারেল গণতন্ত্রী, কোন অ্যাগনস্টিক, কোন নাস্তিক, কোন কম্যুনিস্ট বলছে না, এটা বলছে এমন লোকজন যারা নিজেদের আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দীনের দায়ি বলে পরিচয় দেন। এ কথাগুলো বলা হচ্ছে না হলুদ মিডিয়ার টকশো, সংসদ ভবন কিংবা শাহবাগীদের মঞ্চ থেকে, বরং এরকম কথা বলা হচ্ছে মিম্বার থেকে! লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

নিশ্চয় এসব অবস্থান বাতিল। আল্লাহর দীন অপরিবর্তনীয়, তাঁর শরিয়াহ অপরিবর্তনীয়। দীন ইসলামের কোন আলাদা আলাদা সংস্করণ নেই। একটি ইসলাম রয়েছে যা প্রচার করেছেন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এবং যা সঠিকভাবে পালন করেছেন সালাফ আস-সালিহিন, আর এর বাইরে যা আছে তা বাতিল, গোমরাহি, জাহিলিয়্যাহ। আল্লাহ রাসুল (ﷺ) যে শরিয়াহ এনেছেন, তা দ্বারা শাসন করা, বিচার করা ইমান ও তাওহিদে বিশ্বাসী হবার আবশ্যক শর্ত এবং শরিয়াহ দ্বারা শাসনের বিধান এবং শরিয়াহতে পরিবর্তনের কোন অধিকার কারো নেই। শাসন আল্লাহর আইন দ্বারাই হতে হবে, এটি “লা ইলাহা ইল্লালাহ”–তে বিশ্বাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শাসন চলবে শুধুমাত্র আল্লাহর আইনে, এই বিশ্বাস ছাড়া তাওহিদ, অর্থাৎ আল্লাহর এককত্বে বিশ্বাস অসম্পূর্ণ। আর এই বিশ্বাসের নাম হলো তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ।

সারাজীবন মাজারপূজা, পীরপূজা, ব্যক্তিপূজা, নফসের পূজার বিরোধিতা করা ব্যক্তি, সারা রাত তাহাজ্জুদে কাটিয়ে দেয়া আর সারা বছর রোযা রাখা ব্যক্তিও যদি তাওহিদুল হাক্যিমিয়্যাতে আপোষ করে, তবে তার তাওহিদের বিশ্বাস কখনোই গ্রহণীয় হবে না। যদি কেউ আল্লাহর কুরআন, তার রাসুলের হাদিস সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও এই বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ ছাড়া, আল্লাহর নাযিল করা সংবিধান ছাড়া, অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা বৈধ, তবে সে কুফর ও শিরক করলো।

তাওহিদুল হাকিমিয়্যাতে বিশ্বাস করা ছাড়া, শাসন একমাত্র আল্লাহর আইনেই করতে হবে, এ বিশ্বাস ছাড়া কারো আকিদাহ শুদ্ধ হওয়া দূরের কথা, ইমানই থাকা সম্ভব না। এটি ইমানের মৌলিক বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি যিনা করে, হত্যা করে, মদ খায় সে গুনাহগার মুসলিম। এই কাজগুলো হারাম এবং এ কাজগুলো করার মাধ্যমে সে কবিরা গুনাহ করলো। কিন্তু যে ব্যক্তি শাসনের ব্যাপারে কাউকে আল্লাহর শরিক করে সে কুফর এবং শিরক করলো। এটা হালকাভাবে নেয়ার মতো কোন বিষয় না। যে আল্লাহ ব্যতীত আর কারো প্রতি সিজদাহ করে, যে আল্লাহ ব্যতীত আর কারো কাছে প্রার্থনা করে, যে আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জন্য পশু কুরবানি করে, আর যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আইনপ্রণেতা হিসবে মেনে নেয়, তাদের সবার অবস্থাই এক।

দীনের এরকম মৌলিক কোন বিষয়ে এরকম মারাত্মক বিচ্যুতি ছড়িয়ে পড়া নিঃসন্দেহে মুসলিমদের জন্য, এই উম্মাহর জন্য একটি ভয়াবহ ফিতনা। এটি নিছক কোন তাত্ত্বিক বিষয়ে মতপার্থক্য না, এটি দীনের কোন একটি শাখাপ্রশাখাগত বিষয়ে ইখতিলাফ না, এমনকি যেসব মৌলিক বিষয়ে উম্মাহর মধ্যে দীর্ঘকাল করে মতপার্থক্য হয়েছে, এটি তেমন কোন বিষয়ও না। যদি শরিয়াহ দ্বারা শাসনকে দীন থেকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে সেটা কিভাবে দীন ইসলাম বলে গণ্য হতে পারে? একারণে মুসলিমদের দায়িত্ব হলো সাধ্যমত এ বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা, এ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করা এবং সুস্পষ্ট সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা। আর এ উদ্দেশ্যেই এ সংকলনটি লিখিত হয়েছে।

এ সংকলনে মূলত ৪টি বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে—

১। তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ কী?

২। আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসনকারী শাসকের কাফির হবার ব্যাপারে আলিমগণের ইজমা

৩। “শরিয়াহ সংস্কার, শরিয়াহ পুনঃব্যাখ্যা, শরিয়াহ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন” -এর প্রতি আহ্বানকারীদের জবাব

৪। “শাসকমাত্রই তার আনুগত্য করা হলো শরিয়ার বিধান” –এ বিভ্রান্তির অপনোদন

প্রতিটি ক্ষেত্রেই চেষ্টা করা হয়েছে অতীত ও বর্তমানের আলিমগণের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিক অবস্থান তুলে ধরার এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের বিভ্রান্তি অপনোদনের। চেষ্টা করা হয়েছে নিজেদের পক্ষ থেকে যথসম্ভব কম কথা বলার। ফলশ্রুতিতে সমস্ত লেখাটিতে কিছুটা যান্ত্রিকতা এসেছে এবং লেখাটি সহজপাঠ্য হয় নি

তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর বিষয়টিকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করা বা বোঝানো যায় না– ব্যাপারটা এমন না। বরং এটি এমন একটি বিষয় যা মানুষের ফিতরাহ (Natural Disposition)’র সাথে সম্পৃক্ত। মানুষ ইন্টুইটিভ ভাবেই তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ সম্পর্কে বুঝতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, যখন আমরা নিজেদের ভাষায় এ বিষয়টি তুলে ধরবো তখনই এক দল মানুষ দাঁড়িয়ে যাবেন যারা আমাদের দিকে বিদয়াতি, খারিজি, জাহিল, বর্বর, চরমপন্থী ইত্যাদি বিশেষণ ছুঁড়ে দেবেন। একারণে আমরা আলিমগণের কথাগুলোই তুলে ধরেছি, যাতে করে যদি তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর দাওয়াহ দেওয়া এবং এ বিষয়ে সত্য তুলে ধরাকে কেউ বিদয়াহ, চরমপন্থা, অজ্ঞতা মনে করে তবে যেন তারা আমাদের সাথে সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়ার এই আলিমদেরকেও একই উপাধিতে ভূষিত করেন। পাশাপাশি এই দালিলিক সংকলনটি আল্লাহ চাইলে অপর দায়ি ভাইদের জন্য আরও সহজ ভাষায়, আরও সহজবোধ্য এবং সহজপাঠ্য লেখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সাফল্য শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকেই।

بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَى الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُهُ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ

“আমি সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি, অতঃপর সত্য মিথ্যার মস্তক চুর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, অতঃপর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।” [সুরা আল-আম্বিয়া, ২১: ১৮]


তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ বলতে আমরা কী বোঝাচ্ছি?

তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ বলতে আমরা আসলে কী বুঝাচ্ছি? মূলত আমরা তাই বলছি, যা বলেছেন সকল নাবি ও রাসুলগণ (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম)। আর তা হল— আল্লাহ হলেন এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরিক নেই, সমকক্ষ নেই, সাদৃশ্য নেই, মহাস্রষ্টা, তিনি চিরস্থায়ী, সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী, প্রকৃত কর্মবিধায়ক, তিনিই ইবাদাতের যোগ্য একমাত্র সত্ত্বা, ইবাদাত শুধুমাত্র তাঁরই জন্য, আনুগত্য শুধু তাঁরই জন্য, হুকুমাত শুধুমাত্র তাঁরই জন্য, সকল প্রশংসা শুধুমাত্র তাঁরই জন্য। আল্লাহ ব্যতীত আর কোন সাহায্যকারী নেই, কোন প্রভু নেই। আমরা তাই সাক্ষ্য দেই, যে সাক্ষ্য তিনি স্বয়ং তাঁর কিতাবে দিয়েছেন, যে সাক্ষ্য দিয়েছেন মালাকগণ এবং নাবি-রাসুলগণ আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম। আমরা আরও সাক্ষ্য দেই- রুকু, সিজদা, কসম, তাওয়াফ, সাদাকা, কুরবানি, দুয়া, আইন প্রণয়ন সব কিছু শুধুমাত্র আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার জন্য। সকল প্রকার ইবাদাত ও আনুগত্য তাঁর জন্যই, এতে তাঁর কোন শরিক নেই।

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ۝ لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোন শরিক নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১৬২-১৬৩

জগতসমূহের নিয়মাবলি এবং মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালার জন্য নির্ধারিত বিধানাবলি উভয়ই আল্লাহর আদেশের অন্তর্ভুক্ত। আসমান ও যমিনের দৃশ্য ও অদৃশ্য সকল কিছুই তাঁর আদেশ অনুসারে পরিচালিত হয় এবং এতে তাঁর কোন শরিক নেই। একইভাবে আইন প্রণয়ন ও বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র তাঁরই, তিনি তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তা নির্ধারণ করেন, এতে তাঁর কোন শরিক নেই। তাই আমরা ইবাদাতের ক্ষেত্রে কাউকে তাঁর শরিক করি না এবং হুকুমাতের ক্ষেত্রে, আইন প্রণয়ন ও বিধান দেওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রেও কাউকে তাঁর শরিক করি না।

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ

শুনে রেখো, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা।
সুরা আল-আরাফ, ৭: ৫৪

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ

আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না।
সুরা ইউসুফ, ১২: ৪০

তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া আর কোন বিধানদাতা নেই। যারা নিজেদেরকে আইন প্রণেতা এবং বিধানদাতা বানিয়ে নিয়েছে আমরা তাদের সকলের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতার ঘোষণা দেই। আমরা তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করি। তাদের উপর আমরা বিশ্বাস রাখি না। আমরা আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করি না। আমরা আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে মাওলা হিসেবে, ওয়ালি হিসেবে গ্রহণ করি না এবং আমরা ইসলাম ছাড়া আর কোন দীনকে স্বীকার করি না। যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অপরকে বিধানদাতা হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের অনুসরণ করে আল্লাহর অবাধ্যতায় এবং আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিধানদাতাদের বিধানের অনুসরণ করে– তারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য দীন গ্রহণ করেছে। শাইখ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল-মাকদিসির হাযিহি আকিদাতুনা গ্রন্থের আল্লাহর এককত্ব শীর্ষক অংশ থেকে গৃহীত। এ অংশে শাইখের বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করা হয় নি। বাক্যরীতি ও বাক্যের ক্রমধারা সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয় নি, মূল ভাব নেয়া হয়েছে।


তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ কি বিদয়াহ?

যারা বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন অজুহাতে তাওহিদুল হাকিমিয়্যার দাওয়াতের বিরোধিতা করেন তাদের মুখে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় যে— তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ বলে কোনো কিছু সাহাবা আজমাইনের সময়ে ছিল না, সুতরাং এটি একটি বিদয়াহ। আবার অনেকে বলেন, তাওহিদের শ্রেণিবিভাগ তিনটি— রুবুবিয়্যাহ, আসমা ওয়াস সিফাহ এবং উলুহিয়্যাহ। তোমরা নতুন চতুর্থ শ্রেণি কোত্থেকে আনছো?

এক্ষেত্রে জবাব দেবার আগে, আমরা দুটো প্রশ্ন করতে চাই।

প্রথম প্রশ্ন, তাওহিদের যে তিনটি শ্রেণিবিভাগের কথা আপনি বললেন, সেগুলোর এই নামগুলো কি সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইনের সময় প্রচলিত ছিল?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি কি ‘তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ’ শব্দ দু’টিকে নব-উদ্ভাবিত বলছেন? নাকি শব্দ দুটি দ্বারা যে ধারণাটিকে প্রকাশ করা হচ্ছে তাকে নবোদ্ভাবিত বলছেন?

যদি লোকটি সত্যবাদী হয় এবং জাহিল না হয়, তবে সে জানাবে যে, সাহাবা আজমাইনের সময়ে এই তিনটি নাম দিয়ে এই তিনভাবে তাওহিদের শ্রেণিবিভাগ করা হয় নি। বর্তমানে আমরা যে তিনটি শ্রেণিবিভাগ দেখি, মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি শতাব্দিতে এভাবে তাওহিদের শ্রেণিবিভাগ শুরু হয়। ইবনু জারির আত-তাবারি রাহিমাহুল্লাহ এ তিনটি শ্রেণিবিন্যাসের কথা উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে শায়খ বকর আবু যায়িদ ‘আর-রাদ্দু আলাল মুখালিফ’ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠক সেখানে দেখে নিতে পারেন। অন্যদিকে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ তাওহিদকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন— ১. তাওহিদুল মারিফাতি ওয়াল ইসবাত, ২. তাওহিদুল কাসদ ওয়াত তালাব। ইবনু তাইমিয়্যাহকৃত এ শ্রেণিবিভাগে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ও তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত ছিল তাওহিদুল মারিফাহ ওয়াল ইসবাত এর অন্তর্ভূক্ত।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাওহিদের শ্রেণিবিন্যাস করার বিষয়টি শুরু হয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি শতাব্দিতে। তাহলে কি আমরা বলবো, ইবনু জারির আত-তাবারি ও তার সময়কালের ইমামগণ তাওহিদের এ শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে দীনের মধ্যে নতুন কোন কিছু উদ্ভাবন করেছিলেন? যেহেতু সাহাবাদের সময়ে এই শ্রেণিবিন্যাস ছিল না? আবার ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ তাওহিদকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন। তাহলে কী আমরা বলব, ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ সাহাবাদের মানহাজ থেকে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি শতাব্দির সালাফদের অবস্থান থেকেও বিচ্যুত হয়েছেন?

মূলত সাহাবাদের তাওহিদের ব্যাপারে যে ‘বুঝ’ ছিল, হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দির সালাফগণ এবং ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ তার সাথে কোন কিছু নিজে থেকে যোগ করেন নি। কিন্তু এটাও সত্য যে, সাহাবাদের সময়ে এভাবে তিনভাগে ভাগ করে, এই তিনটি নাম দিয়ে তাওহিদ শেখানো হত না।

ব্যাপারটা হল— ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহর সময়ে প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল বিশেষভাবে তাওহহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতকে সংজ্ঞায়িত করার। কারণ সে সময় আল্লাহর সিফাত অস্বীকারকারী ও তাহরিফকারীদের ফিতনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। একারণে প্রয়োজনের তাগিদে সাহাবা আজমাইনের তাওহিদের বুঝকেই ইবনু তাইমিয়্যাহ দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছিলেন, তাওহিদুল মারিফাহ ওয়াল ইসবাত নামক শ্রেণির মাধ্যমে বিশেষভাবে তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতের গুরুত্ব ও এ ব্যাপারে সঠিক অবস্থান তুলে ধরার জন্য। যদি মানুষের মধ্যে তাওহিদের ব্যাপারে সাহাবাদের সেই বুঝ থাকতো, তবে এই শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজন হত না, কিন্তু যেহেতু মানুষের মধ্যে তা ছিল না তাই এরকম শ্রেণিবিন্যাস করাই ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু এ কারণে কেউ বলতে পারবে না যে, ইবনু তাইমিয়্যাহ নতুন কোন জিনিস তাওহিদের মধ্যে এনেছেন। তেমনিভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি শতাব্দির সালাফগণও দীনের মধ্যে কোন কিছু উদ্ভাবন করেন নি। তারা শুধু এটুকু বলেছেন যে, রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ এবং আসমা ওয়াস সিফাতে বিশ্বাস, এই তিনটি অংশ নিয়েই গঠিত তাওহিদের পূর্ণ বিশ্বাস।

একইভাবে আমরাও নতুন কোন কিছু তাওহিদ আনছি না, আমরা শুধুমাত্র তাওহিদের যে অংশটি ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে সেটি তুলে ধরার জন্যই এ দিকটির উপর জোর দিচ্ছি। আর ব্যাপারটি এমন না যে আমরা নিজেরা মনগড়াভাবে তাওহিদের এ শ্রেণিবিন্যাস করছি। বরং সালাফদের থেকে এ পদ্ধতিটি প্রমাণিত ও সুসাব্যস্ত। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ’র নাতি এবং প্রাক্তন সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ রাহিমাহুল্লাহ তাওহীদকে চারভাগে ভাগ করেছিলেন। শাইখ সালিহ আল-ফাওযানও চারভাগে ভাগ করেছেন।

যদি বলা হয়, তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ এ শব্দ দুটিকে নব-উদ্ভাবিত বলা হচ্ছে, তবে আমরাও স্বীকার করি যে, এ দুটো শব্দ নব উদ্ভাবিত। কুরআন ও সুন্নাহতে এ শব্দাবলি এভাবে নেই। তবে শুধুমাত্র এটাই যদি বিদয়াহ হবার জন্য যথেষ্ট হয় তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আ, উসুলুল ফিকহ, উসুলুল হাদিস, আহাদ, মাশহুর, উলুমুল কুরআন, উসুলুত তাফসির― এ শব্দগুলোও এভাবে কুরআন ও সুন্নাহতে নেই। তাহলে কি এগুলোকেও বিদয়াহ বলা হবে? তাওহিদুল আসমা ওয়াস-সিফাত কুরআনে নেই, হাদিসে নেই, সাহাবাদের সময় এরকম কোন পরিভাষা প্রচলিত ছিল না, তবে কি আমরা এটাকেও বিদয়াহ বলবো? স্বয়ং আকিদাহ শব্দটি কুরআনে তো দূরে থাক, কোন জাল হাদিসেও নেই, তবে কি আমরা আকিদাহ নিয়ে যারা কথা বলে, সহিহ আকিদাহর দাওয়াহ দেয় তাদেরকেও মুবতাদি বলবো?

সুতরাং শুধু এই শব্দাবলি এভাবে কুরআন-হাদিসে না আসার, কারণে এই শব্দাবলির দ্বারা যে ধারণাটি প্রকাশ করা হয় সেটা বিদয়াতে পরিণত হয় না, যেমন তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত বিদয়াহ না। যদি দীনের মধ্যে নতুন কোন ধারনার উদ্ভব না করা হয় তাহলে দীনের মধ্যে বিদ্যমান কোন বিষয়কে ভালোভাবে উপস্থাপন কিংবা ব্যাখ্যা করার জন্য তার শ্রেণিবিভাগ করা কিংবা কোন নতুন শব্দাবলি ব্যবহার করাতে কারো আপত্তি থাকার কথা না। কারণ শুধু নতুন পরিভাষা বা শ্রেণিবিন্যাস করার কারণে যদি কোন কিছুকে বাদ দিতে হয় তাহলে ইসলামের সমস্ত উসুল-শাস্ত্রও বাদ দিতে হবে।

আর যদি কেউ বলে, ‘ঠিক আছে, বুঝলাম এটা বিদয়াহ না, কিন্তু শুধু হাকিমিয়্যাহর দাওয়াহ দেওয়াটা কেমন ব্যাপার?’ তবে সেক্ষেত্রে জবাব হবে— আমরা শুধুমাত্র হাকিমিয়্যাহর দাওয়াহ দিচ্ছি না, আমরা এটাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারণ এ ব্যাপারে উম্মাহর মধ্যে বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতা চরম রূপ ধারণ করেছে, অথচ এ ব্যাপারে কথা বলার মতো দায়ি বা আলিম দুঃখজনকভাবে আজ কম। যদি পরিস্থিতির বিবেচনায় ইবনু তাইমিয়্যাহর তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতকে গুরুত্ব দেওয়া, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের বিশেষভাবে তাওহিদুল ইবাদাহকে গুরুত্ব দেওয়া বিদয়াহ না হয়, তবে তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিদয়াহ হবে না। এটা শুধুমাত্র পরিস্থিতির বিবেচনায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। বিশেষত যখন আলিম অনেক থাকা সত্ত্বেও তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ নিয়ে কথা বলার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ ব্যাপারে উপসংহার হিসেবে শাইখ আবু বাসির আত-তারতুসির বক্তব্য তুলে ধরছি―

তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ অর্থ হলো বিচার (হুকুম) এবং আইন প্রণয়নের (তাশরি) অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার। আধিপত্য, রাজত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং সৃষ্টির বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কোন শরিক নেই, তেমনিভাবে বিচার (হুকুম) এবং আইন প্রণয়ণের (তাশরি) ক্ষেত্রেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কোন শরিক নেই।

যেমন আল্লাহ বলেছেন,

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ

আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না।
সুরা ইউসুফ, ১২: ৪০

وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ وَهُوَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

আল্লাহ বিধান দেন, আর তাঁর বিধান পশ্চাতে নিক্ষেপ করার কেউ নেই।
সুরা আর-রাদ, ১৩: ৪১

وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

তিনি নিজ বিধানের কর্তৃত্বে কাউকে শরিক করেন না।
সুরা আল-কাহফ, ১৮: ২৬

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

তারা কি জাহিলিয়্যাতের বিচার-ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম বিধান দানকারী কে?
সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৫০

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ

তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন- তার সঠিক বিধান তো আল্লাহরই নিকট।
সুরা আশ-শূরা, ৪২: ১০

আল্লাহ আরও বলেছেন,

وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

যদি তোমরা তাদের (মুশরিকদের) আনুগত্য কর, তবে তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১২১

এছাড়াও আরও অনেক মুহকাম (সুস্পষ্ট) আয়াত দ্বারা তাওহিদের এ শ্রেণিটি (অর্থাৎ তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ) প্রমাণিত এবং এও প্রমাণিত যে, তাওহিদুল হাকিমিয়্যাতে বিশ্বাস করা ব্যতীত কারো ইমান গ্রহণীয় হবে না।

এছাড়া রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর সহিহ হাদিসে আছে—

«إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ»

নিশ্চয় আল্লাহ হচ্ছেন আল-হাকাম (বিচারক) এবং হুকুম (বিধান প্রণয়ন) হলো তাঁর অধিকার।
সুনান আবি দাউদ: ৪৯৫৭; সুনান নাসায়ি: ৫৩৮৭; ইবনু হিব্বান: ৫০৪; সনদ সহিহ।

প্রশ্ন হলো, তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ কি তাওহিদের আলাদা একটি শ্রেণি, নাকি এটি তাওহিদুল উলুহিয়্যার অন্তর্ভুক্ত? আমি (তারতুসি) বলি, এটি পৃথক শ্রেণি নয়, তবে তাওহিদুল হাকিমিয়্যার বিশ্বাসের মধ্যে এমন বিষয় আছে যা তাওহিদুল উলুহিয়্যার অন্তর্ভুক্ত, এর ভেতরে এমন বিষয় আছে যা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত, আবার এর মধ্যে এমন বিষয়ও আছে যা তাওহিদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু যখন আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত কুফর ও তাগুতের সংবিধান দিয়ে শাসনের শিরক উম্মাহর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাওহিদুল হাকিমিয়্যার কথা বলা এবং এর আবশ্যকতার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকারি হয়ে পড়ে। লোকেদের কাছে এও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় যে, তাওহিদুল হাকিমিয়্যার উপর বিশ্বাস আবশ্যক এবং একে বাদ দিয়ে তাওহিদুল উলুহিয়্যায় বিশ্বাস সম্ভব না।

ধরুন, আপনি দেখলেন কিছু লোক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রতি আনুগত্যকে শিরকের পর্যায়ে নিয়ে গেছে (যেমন পীরের প্রতি আনুগত্য, যা উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায়)। আপনি তাদের বললেন, توحيد الطاعة বা আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একচ্ছত্র অধিকারী বিশ্বাস করা আবশ্যক। এটা আপনাদের জন্য আবশ্যক যে, আপনারা আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো আনুগত্য করবেন না।

আপনার এ কথা সঠিক ও উপযুক্ত বলেই গণ্য হবে। এক্ষেত্রে আপনার বিরোধিতা করা এবং “তুমি এক নতুন তাওহিদ নিয়ে এসেছো, যাকে তুমি তাওহিদুত তায়াহ বলছো” বলা কিংবা “তুমি তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ ছাড়া নতুন এক তাওহিদ এনেছো” —বলা সমীচীন না, জায়িযও না।

অথবা ধরুন, আপনি দেখলেন কিছু লোক আল্লাহ ও নিজেদের মধ্যে অন্য কাউকে মধ্যস্ততাকারী (যেমন ওলি-আউলিয়া) হিসেবে নিয়েছে ও ভালোবাসার (মুহাব্বাহ) মাধ্যমে তাদের আল্লাহর সাথে শরিক করছে (অর্থাৎ এমনভাবে তাদেরকে ভালোবাসছে যেভাবে শুধু আল্লাহকে ভালবাসতে হবে) এবং আল ওয়ালা ওয়াল বারা’র দিক দিয়ে শিরক করছে (অর্থাৎ আল্লাহর পছন্দ ও অপছন্দের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক ছিন্ন করার নীতি গ্রহণের বদলে, কোন সৃষ্টির পছন্দ ও অপছন্দের ভিত্তিতে তা করছে)। সুতরাং এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আপনি তাদের বললেন, ভালোবাসার ক্ষেত্রেও তাওহিদে বিশ্বাস করতে হবে এবং ব্যক্তির কাছে সর্বাধিক প্রিয় হতে হবে আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহ। এটা কিন্তু তাওহিদুল উলুহিয়্যার জায়গায় নতুন কোন তাওহিদ আমদানি করা নয় এবং তাওহিদুল মুহাব্বাহ নিয়ে আপনার বক্তব্যও কোনভাবেই বিদয়াহ নয়।

যদি আপনি এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হন, তাহলে আপনি এটাও বুঝবেন, যারা তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ প্রচারের বিরোধিতা করে, তাদের দ্বারা এর বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হচ্ছে, যা কিছু বিরোধিতা করা হচ্ছে তার কোন ন্যায্যতা নেই। এ বিরোধিতার অন্তর্নিহিত কারণ হল তাওহিদের এ দিকটিকে ছোট করে দেখানো এবং তাওয়াগিতের দ্বারা তাওহিদের এই অবিচ্ছেদ্য অংশটির ব্যাপারে যে অস্বীকার ও সীমালঙ্ঘন হয়েছে সেটার পক্ষে ও এ ব্যাপারে নিজেদের নীরবতার পক্ষে সাফাই গাওয়া।

আর যদি আপনি তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ সম্পর্কে জানার জন্য কোনো বই পড়তে আগ্রহী হন, তবে জেনে রাখুন এ বিষয়ে বিপুল সংখ্যক কিতাবাদি রয়েছে, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বোচ্চ হল আল্লাহর কিতাব এবং তারপরে নাবির সুন্নাহর কিতাবসমূহ। এছাড়া রয়েছে ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইবনুল কাইয়িম, ইবনু আবদুল ওয়াহহাব এবং তার পৌত্রদের আকিদাহর কিতাবাদি –আল্লাহ তাদের সকলের উপর রহম করুন। সমসাময়িক কালের ব্যক্তিত্বদের মাঝে রয়েছে সাইয়িদ কুতুবের কিতাবসমূহ। বিশেষ করে ফি যিলালিল কুরআন, মায়ালিম ফিত তারিক, খাসাইসুত তাসাউউর এবং মুকাউয়িমাতুত তাসাউউর আল-ইসলামি।

একই সাথে তার ভাই মুহাম্মাদ কুতুবের কিতাবাদি পড়তে পারেন এবং এ বিষয়ের উপর খাসভাবে কিছু কিতাব রয়েছে। যেমন ভাই শাইখ আবু ইথার রচিত “তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ” এবং আমাদের ভাই শাইখ আবু মুহাম্মাদ আসিম আল-মাকদিসির কিতাবাদি ও রিসালাসমূহ। এ অধমেরও (তারতুসি) এ ব্যাপারে বেশ কিছু রচনা রয়েছে। কিতাব তো আছে অসংখ্য, কিন্তু কোথায় তাদের অধ্যয়নকারী এবং কোথায় তার উপর আমলকারী?


আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসনকারীকাফির হবার ব্যাপারে আলিমগণের ইজমা

আগেই বলা হয়েছে, আমরা এ সংকলনে শরিয়াহ ব্যতীত অপর কিছু দ্বারা শাসনকারী শাসকের কাফির হবার ব্যাপারে আলিমগণের ইজমা থাকার ব্যাপারে অতীত ও বর্তমানের আলিমগণের বক্তব্য তুলে ধরবো। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টি নিয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়ালা জামায়ার আলিমগণের অগণিত বক্তব্য রয়েছে, যেগুলো থেকে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়—

১। শরিয়াহ দ্বারা শাসন করা আবশ্যক।

২। যে শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে না এবং আল্লাহর বিধান বাতিল করে নিজে আইন প্রণয়ন করে সে কাফির।

৩। যে আল্লাহর বিধানের বদলে আইন প্রণয়নকারী কোন শাসকের আনুগত্য করে, আল্লাহর আইনের বদলে সৃষ্টির আইনকে বিধান হিসেবে পছন্দ করে ও গ্রহণ করে এবং আল্লাহর শরিয়াহর বদলে সৃষ্টির শরিয়াহ অনুসরণের আহ্বান জানায়, সে কুফর এবং শিরক করেছে।

এ পর্বে আমরা যাদের বক্তব্য তুলে ধরছি তারা হলেন—

ইমামুস সুন্নাহ আহমাদ ইবনু হাম্বল

আল্লামা কাযি ইয়ায

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ

ইমাম ইবনুল কাইয়িম

ইমাম ইবনু কাসির

আল্লামা বাদরুদ্দিন আইনি

শাইখ আব্দুল লতিফ ইবনু আব্দুর রাহমান

শাইখ মুহাম্মাদ আমিন আশ-শানকিতি

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ

শাইখ আহমাদ শাকির

শাইখ বিন বায

শাইখ ইবনু উসাইমিন

শাইখ আবদুর রাযযাক আফিফি

শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিল

শাইখ সুলাইমান বিন নাসির আল-উলওয়ান

সাইয়িদুনা ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু

সাইয়িদুনা ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু

এটুকুর পর আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এত অধিক সংখ্যক বক্তব্য রয়েছে যে, তা সংকলিত করা দুঃসাধ্য একটি কাজ। আশা করা যায়, আল্লাহ চাইলে যারা সত্যান্বেষী তাদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট হবে।

এ পর্বটি পড়ার সময় পাঠকের মনে হতে পারে বার বার একই কথার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, কারণ প্রজন্ম এবং শতাব্দি ভেদে আলিমগণ এ বিষয়ে আইডেন্টিকাল বক্তব্য দিয়েছেন এবং এটা এ বিষয়ে ইজমা থাকার আরেকটি প্রমাণ। আমি পাঠককে অনুরোধ করবো ধৈর্য ধরে, একটু কষ্ট হলেও আলিমগণের সবার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়ার, যাতে করে প্রথমত, এ ব্যাপারে কারো মধ্যে যেন কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকে। দ্বিতীয়ত, এ ব্যাপারে আলিমগণের অবস্থান কতোটা কঠোর তা অনুধাবন করা এবং আমাদের সময়ে যারা এ বিষয়ে শিথিলতা অবলম্বন করছে, নিরবতা পালন করছে ও এ বিষয়ে অপব্যাখ্যা করছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাদেরকে এই আলিমগণের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা।


ইমামুল সুন্নাহ আহমাদ ইবনু হাম্বাল-

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

তারা (ইহুদি-খ্রিস্টানরা) তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে আল্লাহ ব্যতীত তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সুরা আত-তাওবাহ, ৯: ৩১ এ আয়াতের তাফসিরে ইমামুস সুন্নাহ আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনু হাম্বাল আশ-শাইবানি রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“এই আয়াতের ব্যাপারে আদি ইবনু হাতিম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, তারা তো তাদের আলিম ও দরবেশদের ইবাদাত করতো না। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তখন বললেন— হ্যাঁ, অবশ্য তারা তা (আলেম ও দরবেশদের ইবাদাত) করেছিল। আল্লাহ যা হারাম করেছিলেন, আলেম ও দরবেশগণ তা হালাল সাব্যস্ত করেছিল, আর আল্লাহ যা তাদের জন্য হালাল করেছিলেন, তা আলেম ও দরবেশগণ হারাম সাব্যস্ত করেছিল। আর ইহুদি-খ্রিস্টানরা এ ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করেছিল। আর এভাবে তারা তাদের (আলেম ও দরবেশদের) ইবাদাত করেছিল।”
সুনানুত তিরমিযি: ৩০৯৫

হাদিসে বলা হয়েছে, যেহেতু তারা আনুগত্য করেছে, তাই এটা শিরক। কোথাও বলা হয় নি যে, ইহুদি-খ্রিস্টানরা বলেছিল, “আলেম ও দরবেশগণ হলেন আল্লাহর পাশাপাশি আমাদের প্রভু”। একজন প্রকৃত মুসলিম আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের ব্যাপারে খুশি থাকে। তার মনে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি কোন বিদ্বেষ থাকে না এবং সে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে, যদিও আল্লাহর আদেশ নিষেধ তার নিজের খেয়াল-খুশি, বা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, কিংবা তার নিজের দলের বা তার শাইখের কথার বিরুদ্ধে যায়।”
মাদারিজুস সালিকিন, ২/১১৮

এছাড়া ইমাম আহমাদ আরও বলেছেন,

“কোন বস্তু, যার হারাম হবার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে এবং তা মুসলিমদের মধ্যে সুবিদিত, আর তাতে বিভ্রান্তিরও কোন সু্যোগ নেই, কারণ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল আছে– যেমন শূকরের মাংস, যিনা ও অন্যান্য যেসব ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই– যদি এমন কোন বস্তুকে কেউ হালাল মনে করে, হালাল বলে বিশ্বাস করে, তবে সে কাফির। সালাত ত্যাগকারী যে কারণে কাফির, এই ব্যক্তিও সেই একই কারণে কাফির।”
আল মুগনি, ১২/২৭৬


আল্লামা কাযি ইয়ায-

প্রসিদ্ধ মালিকি আলিম কাযি ইয়ায ইবনু মুসা ইবনু ইয়ায ইবনু আমর আল-ইয়াহসাবি আল-আন্দালুসি রাহিমাহুল্লাহ আদি ইবনু হাতিমের হাদিস সম্পর্কে বলেন,

“কেউ ‘লা ইলাহা ইলাল্লালাহ’ বলার অর্থ সে ঈমান গ্রহণ করেছে- এটা প্রযোজ্য শুধুমাত্র সেসব লোকের ক্ষেত্রে যারা ইতিপূর্বে মুশরিক ছিল [অর্থাৎ কোন মুশরিক যখন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ সাক্ষ্য দেবে তখন সে ঈমান এনেছে বলে ধরে নেওয়া হবে]। কিন্তু যারা ইতিমধ্যেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিন্তু একই সাথে কুফরও করছে, এ সাক্ষ্য (শুধুমাত্র মুখে কালিমা উচ্চারণ) তাদের রক্ত ও সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট না।
আশ-শিফা, ২/২৩০-২৫০


শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ-

আল-ইমাম ওয়াল মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লার এ বিষয়ে বেশ কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হল। শাইখের বক্তব্য এবং শাইখের ছাত্র ইবনু কাসির ও ইবনুল কাইয়িমের বক্তব্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ উম্মাহর বর্তমান অবস্থার সাথে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে শুধুমাত্র শাইখদের সময়ই তুলনীয়, কারণ তাঁরা বেঁচে ছিলেন এমন এক সময়ে যখন তাতারদের আক্রমণে খিলাফাতের পতন ঘটেছিল, তাতাররা মুসলিমদের উপর কর্তৃত্বে আসীন হয়েছিল এবং তারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও আল্লাহর শরিয়াহ ব্যতীত মানবরচিত সংবিধান আল-ইয়াসাক দ্বারা শাসন করছিল।

১। আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করার ব্যাপারে ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য :

“আমরা বলি, এমন কোন দল/ফিরকা/জামায়াহ যা ইসলামের তর্কাতীত, সন্দেহাতীত, অনস্বীকার্য এমন কোন বিধান ত্যাগ করে, যার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর প্রজন্মের পর প্রজন্ম একমত; তবে বিধান ত্যাগকারী সেই দলের বিরুদ্ধে ইমামদের ইজমা অনুযায়ী যুদ্ধ করা আবশ্যক। এমনকি যদি তারা দুটি কালিমার (আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ) সাক্ষ্য দেয় তবুও।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, খন্ড ৪, জিহাদ অধ্যায়।

“সুতরাং তারা যদি শাহাদাতাইন (দুই কালিমা) উচ্চারণও করে, কিন্তু দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় থেকে বিরত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, যতক্ষণ না তারা সালাত আদায় করবে। আর যদি তারা যাকাত দানে বিরত থাকে, তবে যাকাত দেয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। একইভাবে যদি তারা রামাদানে সিয়াম পালনে বিরত থাকে, কিংবা আল্লাহর ঘরে হজ করা থেকে বিরত থাকে, কিংবা অশ্লীলতা-ফাহিশা নিষিদ্ধে অস্বীকৃতি জানায়, অথবা যিনা বা জুয়া, মদ্যপান এবং ইসলামি শরিয়াতের অন্যান্য যেসব কাজ ও জিনিস নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো নিষিদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়, কিংবা তারা যদি জান-মাল-সম্মান, ব্যবস্থাপনা, বিচার ও মীমাংসার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর আইন প্রয়োগে অস্বীকৃতি জানায়, কিংবা তারা যদি ভালো কাজে সাহায্য ও মন্দ কাজে বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকে, কিংবা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কাফিররা অবনত মস্তকে জিযিয়া দেয়– তবে এই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সুতরাং এমন সব ক্ষেত্রে যখন দীনের কিছু অংশ আল্লাহর জন্য আর কিছু অংশ অন্যদের জন্য করে ফেলা হয়, মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করা যতক্ষণ না শুধুমাত্র আল্লাহর দীন সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, খন্ড ৪, জিহাদ অধ্যায়।

এটা হল মুরতাদদের ব্যাপারে শাইখুল ইসলামের বক্তব্য। এখানে শাইখ স্পষ্টভাবে শরিয়াহ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা, শরিয়াহ দিয়ে শাসন প্রত্যাখ্যানকারীদের মুরতাদদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও তারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং শাহাদাহ উচ্চারণ করে, তবুও। আর যেসব আলেম এসব শাসকের আনুগত্যের কথা বলে তাদের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লার বক্তব্য হলো :

“যদি কোন শাইখ কুরআন ও সুন্নাহ হতে অর্জিত শিক্ষা অনুযায়ী আমল ত্যাগ করে এবং এমন বিচারকের অনুসরণ করে, যে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (ﷺ)এর শিক্ষা অনুযায়ী বিচার করে না, সে তখন একজন ধর্মত্যাগী কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে, যে দুনিয়াতে ও আখিরাতে শাস্তি পাবার উপযুক্ত। এই হুকুম সে সমস্ত আলিমগণের বেলায়ও প্রযোজ্য যারা ভয়ের কারণে মোংগলদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে লাভবান হতে চেয়েছিল। এই উলামারা অজুহাত দিয়েছিল মোংগলদের মধ্যে কেউ কেউ কালিমা পড়ছিল, আর তাই তারা মুসলিম।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, খন্ড ৩৫, পৃ. ৩৭৩

২।

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হিদায়াহ ও সত্য দীন সহকারে, যেন এ দীনকে অপরাপর দীনের উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।”
সুরা আত-তাওবাহ, ৯: ৩৩

শরিয়াহ এবং ইসলামের অবিচ্ছেদ্য সূত্র সম্পর্কে এই আয়াতের আলোকে শাইখুল ইসলাম বলেন, “ইসলাম অর্থ সম্পূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। সুতরাং যে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং একই সাথে আল্লাহ ব্যতীত আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে সে একজন মুশরিক। আর যে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করে না, সে ঔদ্ধত্যের কারণে আল্লাহর ইবাদাত করে না। মুশরিক এবং এই উদ্ধত ব্যক্তি, দুজনই কাফির।

একমাত্র আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল, আপনি শুধুমাত্র আল্লাহরই আনুগত্য করবেন। এটাই হল দীন ইসলাম, আর এছাড়া অন্য কিছু আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। আর এই আনুগত্যের শর্ত হল সকল সময়ে আল্লাহর আনুগত্য করা এবং আল্লাহ যেসময়ে যে কাজের আদেশ দিয়েছেন, সে সময়ে সে কাজ করা।” মাজমু আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ৩, পৃ. ৯১

৩। ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেছেন :

“যদি কেউ মনে করে, নবি (ﷺ) এর দিকনির্দেশনার চাইতে তার নিজের দিকনির্দেশনা উত্তম, কিংবা সে যদি মনে করে আউলিয়াদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছেন যাদের জন্যে শরিয়াহর গন্ডির বাইরে যাওয়া জায়িয, যেমন খিযির মুসা আলাইহিস সালামের শরিয়াহর বাইরে ছিলেন– তবে সে ব্যক্তি কাফির। তাকে তাওবাহ করতে বলতে হবে এবং হত্যা করতে হবে (যদি তাওবাহ না করে)। কারণ মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াহ ও রিসালাত বৈশ্বিক ছিল না, তাই খিযির বাধ্য ছিলেন না মুসা আলাইহিস সালামের শরিয়াহর অনুসরণে (তাঁদের উভয়ের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। (মুসা আলাইহিস সালামের নবুওয়্যাত ও রিসালাত ছিল একটি কওমের উপর সীমাবদ্ধ, কিন্তু নাবি মুহাম্মাদ (ﷺ)এর রিসালাত বৈশ্বিক। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য নবি মুহাম্মাদ (ﷺ) -কে রাসুল হিসেবে মেনে নেওয়া এবং তাঁর [আল্লাহর] আনীত শরিয়াহর অনুসরণ করা ফরয)।”
ড. আবদুর রাহমান ইবনু সালিহ আল-মাহমুদ রচিত “মানবরচিত আইন বনাম শরিয়াহ” কিতাবের ১৭০ পৃ.

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ ۝ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“হে কারাগারের সঙ্গীরা! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভালো, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদাত করছ, যা তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এসবের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”
সুরা ইউসুফ, ১২: ৩৯-৪০

এ আয়াতদ্বয়ের ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেন, “বিধান শুধুমাত্র আল্লাহর এবং তাঁর রাসুলগণ (আলাইহিমুস সালাম) তাঁর পক্ষ হয়ে তা পৌঁছে দিয়েছেন। রাসুলদের সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সিদ্ধান্ত এবং রাসুলদের আনুগত্য করাই আল্লাহর আনুগত্য করা। কোন রাসুল যে কাজের আদেশ দেন, বা যে সিদ্ধান্ত দেন, বা দীনের মধ্যে যা যুক্ত করেন, সেগুলোর অনুসরণ করা এবং রাসুলের আনুগত্য করা মানুষের উপর বাধ্যতামূলক, কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে এরূপই নির্ধারণ করেছেন।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, ৩৫/৩৬১-৩৬৩; আরও দেখুন : ৩৭২-৩৮৩ পৃ.

৫। তিনি আরও বলেন,

“এটি ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে আল্লাহর শরিয়াহ ছাড়া অন্য কিছু অনুসরণকে বৈধতা দেয়, সে কাফির। আর তার কুফর হল ঐ ব্যক্তির কুফরের ন্যায় যে কিতাবের কিছু আয়াত বিশ্বাস করে আর কিছু আয়াত অস্বীকার করে।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, ২৮/৫২৪


আল্লামা ইবনুল কাইয়িম-

ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“নস ও ইজমার বক্তব্য হলো দীন ইসলামের আগমনের ফলে পূর্বের সকল ধর্ম/মতবাদ রহিত হয়ে গেছে। তাই যে কুরআন ছেড়ে তাওরাত ও ইঞ্জিলে যা আছে তার অনুসরণ করবে, সে কাফির। আল্লাহ তাওরাত ও ইঞ্জিলের সকল বিধান রহিত করে দিয়েছেন এবং রহিত করে দিয়েছেন অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের সকল বিধানকে। তিনি জিন ও মানুষ, এই দুই জাতির উপর ইসলামের বিধান মানাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলাম যা নিষিদ্ধ করেছে তা ছাড়া আর কিছুই নিষিদ্ধ না। আর ইসলাম যা আবশ্যক করেছে এর বাইরে আর কিছুই আবশ্যক না।”
আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ১/২৫৯

ইবনুল কাইয়িম তুলে ধরেছেন যে, আলিমগণের ইজমা হলো কুরআন ব্যতীত অন্য আসমানি কিতাবের মাধ্যমে প্রাপ্ত শরিয়াহর অনুসরণকারীও কাফির। তবে সে ব্যক্তির কী অবস্থা যে মানবরচিত সংবিধানের অনুসরণ করে? আর সে শাসকের কী হুকুম হবে, যে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম করে? যে আল্লাহর শরিয়াহকে বাতিল ঘোষণা করে এবং নিজের ইচ্ছেমতো শরিয়াহ বানিয়ে নেয়?


আল্লামা হাফিয ইবনু কাসির-

এই বক্তব্যটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাইল ইবনু উমার ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে এই ফাতাওয়ার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে, মাযহাব-মানহাজ নির্বিশেষে গোটা উম্মাহ একমত। দ্বিতীয়ত, যে প্রেক্ষাপটে ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই ফাতাওয়া দিয়েছিলেন, তার সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সুগভীর ও মৌলিক সাদৃশ্য বিদ্যমান। তিনি বলেন,

“যে রাজকীয় বিধানসমূহের দ্বারা তাতাররা শাসনকার্য পরিচালনা করে, এগুলো গৃহীত হয়েছে তাদের রাজা চেঙ্গিস খানের রচিত সংবিধান ‘আল-ইয়াসিক’ থেকে। চেঙ্গিস খান এই সংবিধান রচনা করেছিল বিভিন্ন শরিয়াহ থেকে নানা আইন একত্রিত করে। এখানে ইহুদি, নাসারা, ইসলামি শরিয়াহ সবগুলো থেকেই কিছু কিছু গ্রহণ করা হয়েছে এবং সাথে আরো অন্যান্য উৎসসমূহ থেকেও। এছাড়া এই কিতাবে চেঙ্গিস খানের নিজের চিন্তাপ্রসূত নানা মনগড়া আইনও আছে। আর এভাবে চেঙ্গিসের উত্তরসূরিরা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের (ﷺ)সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনের বদলে এই কিতাবের আইনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং অনুসরণ করেছে। যারা এরকম করে তারা কাফির এবং তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ যুদ্ধ করতে হবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ)যা নির্ধারণ করেছেন তদানুযায়ী শাসন করার দিকে ফিরে আসে। যাতে করে, ছোট বা বড়, কোন বিষয়েই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া আর কারো বিধান না চলে।”
তাফসির ইবনু কাসির, ২/৬৩-৬৭, সুরা মায়িদা ৪০-৫০ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য।

একই সাথে তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াতে এই বিষয়ে কী বলেছেন বিবেচনা করুন :

“অতএব কেউ যদি খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (ﷺ)এর উপর নাযিলকৃত শরিয়াহ ছেড়ে, পূর্বে নাযিলকৃত অন্য কোন শরিয়াহ দ্বারা বিচার করে ও শাসনকার্য চালায়, যা রহিত হয়ে গেছে, তবে সে কাফির হয়ে গেছে। তবে (চিন্তা করুন) সেই ব্যক্তির অবস্থা কি রূপ যে আল-ইয়াসিকের ভিত্তিতে শাসন করে এবং একে ইসলামি শরিয়াহর উপর স্থান দেয়? এরকম যেই করবে সে মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী কাফির।”
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ত্রয়োদশ খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৯

২।

وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ
“যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।”
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১২১

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন— যদি তুমি আল্লাহর বিধান ও তাঁর শরিয়াহকে ত্যাগ করে অন্য কারও বক্তব্য (বিধান, আইন, সংবিধান) গ্রহণ কর, তবে জেনে রাখ, এটাই প্রকৃত শিরক। কারণ আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছিল।’
সুরা আত-তাওবাহ, ৯: ৩১


ইমাম তিরমিযি রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসির করেছেন আদি ইবনু হাতিম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ঘটনার দ্বারা। আদি ইবনু হাতিম রাদিয়াল্লাহু আনহুর সামনে এই আয়াত পড়া হলে তিনি এই আয়াতের ব্যাপারে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! ইহুদি-খ্রিস্টানরা তো তাদের আলেম ও দরবেশদের ইবাদাত করতো না।” রাসুলুল্লাহ (ﷺ)উত্তর দিলেনঃ “হ্যাঁ, অবশ্যই তারা তা করেছে। তারা তাদের আলেম ও দরবেশদের হারামকৃত বিষয়কে হারাম বলে মেনে নেয় এবং হালালকৃত বিষয়কে হালাল বলে স্বীকার করে নেয়। এই হচ্ছে তাদের (পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদিগ) ইবাদাত করা।”
তাফসির ইবনু কাসির, সুরা তাওবাহ ৩১ নং আয়াতের তাফসির

অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টানদের জন্য আল্লাহ যা হারাম করেছিলেন, আলেম ও দরবেশগণ তা হালাল সাব্যস্ত করেছিল এবং ইহুদি-খ্রিস্টানরা তাদের আলেম-দরবেশদের আনুগত্য করে, তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর আল্লাহ যা তাদের জন্য হালাল করেছিলেন, তা আলেম ও দরবেশগণ হারাম সাব্যস্ত করেছিল এবং ইহুদি-খ্রিস্টানরা তাদের আলেম-দরবেশদের আনুগত্য করে, তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর এটাই আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদাত করা।


আল্লামা বাদরুদ্দিন আল-আইনি-

আল্লামা বাদরুদ্দিন আল-আইনি রাহিমাহুল্লাহ বলেন—

“যে ব্যক্তি নবিদের শরিয়াহর বদলে নিজে শরিয়াহ তৈরি করলো, তার শরিয়াহ বাতিল। আর এ ধরনের লোকের অনুসরণ হারাম।
আল্লাহ বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ

‘তাদের কি এমন শরিক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে এমন বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?’
সুরা আশ-শুরা, ৪২: ২১।

এ কারণে ইহুদি এবং নাসারারা কাফিরে পরিণত হয়েছিল। তারা বিকৃত শরিয়াহ আঁকড়ে ধরেছিল আর আল্লাহ মানবজাতির উপর বাধ্যতামূলক করেছেন মুহাম্মাদ (ﷺ)এর শরিয়াহর অনুসরণ করা।”
উমদাতুল কারি শারহু সাহিহিল বুখারি, খন্ড ২৪, পৃ. ৮১


শাইখ আব্দুল লতিফ ইবনু আব্দুর রাহমান-

বেদুঈনদের পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি, আচার-প্রথার ব্যাপারে শাইখকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যেগুলো তখনও বেদুঈনদের মাঝে চালু ছিল। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলে, যারা এসব রীতিনীতি ও আচার-প্রথার ভ্রান্ত হওয়া সম্পর্কে অবগত হবার পরও এগুলোর অনুসরণ করে, তাদের কি কাফির বলা যাবে? তিনি জবাবে বলেছিলেন,

শরিয়াহর বিধান জানা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিচারের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুল (ﷺ)এর সুন্নাহ ব্যতীত আর কোন কিছুর দ্বারস্থ হয়, সে কাফির। আল্লাহ বলেন, ‘যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির’।” আল্লাহ আরও বলেন, ‘তারা কি আল্লাহর দীনের পরিবর্তে অন্য দীন তালাশ করছে?’
আদ-দুরারুস সানিয়াহ, ৮/২৪১, একই সাথে ৮/২৭১-২৭৫ প্রথম সংস্করণ ১৩৫৬ হিজরিতে প্রকাশিত।


শাইখ মুহাম্মাদ আমিন আশ-শানকিতি-

আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কোন আইন দিয়ে শাসন করা কুফর এবং শিরক হবার ব্যাপারে শাইখ শানকিতি বলেন,

“সুস্পষ্ট নুসুস দ্বারা প্রমাণিত সন্দেহাতীত সত্য হল, যারা শয়তানের প্রণীত ও মানুষের মুখ দ্বারা প্রকাশিত মানবরচিত আইনের অনুসরণ করে ঐ আইনের বদলে, যার রচয়িতা হলেন আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা এবং যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রাসুলগণের (ﷺ) মুখে- তাদের কুফর এবং শিরকের ব্যাপারে কার কোন সন্দেহ নেই, শুধু ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার দৃষ্টিশক্তি আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং যাকে তিনি ওহির উজ্জ্বল আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন।
তাফসির আদওয়াউল বায়ান, খন্ড ৪, পৃ. ৯০-৯২

সুরা তাওবার ৩১ নং আয়াতের ব্যাপারে তিনি বলেছেন—

“সুতরাং এখানে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা মুশরিকে পরিণত হয়েছিল আইনপ্রণেতাদের প্রতি আনুগত্যের কারণে। কারণ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত, আল্লাহর আইনকে বাদ দিয়ে অন্য যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তার অনুসরণ হল আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা। আর প্রকৃতপক্ষে এসব আইন তৈরিই হয়েছে শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে, শয়তানের আনুগত্যের জন্য।” তাফসির আদওয়াউল বায়ান, খন্ড ৪, পৃ. ৬৫

وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ

“যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।” সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১২১। এই আয়াতের ব্যাপারে শাইখ বলেন—

“নিশ্চয় এটা হল সরাসরি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ফাতাওয়া, রহমানের শরিয়াহর বিরুদ্ধে গিয়ে যে ব্যক্তি শয়তানের শরিয়াহর অনুসরণ করবে সে মুশরিক, যে আল্লাহর সাথে শিরক করেছে।”

আর এটা হল তার ব্যাপারে ফায়সালা যে ব্যক্তি অন্য শরিয়াহর অনুসরণ করেছে, তবে যে নতুন শরিয়াহ বানিয়ে নেয়, অর্থাৎ আইন প্রণয়নকারীদের ব্যাপারে ফায়সালা কি হতে পারে?


শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ-

আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য আইন দিয়ে শাসনের ব্যাপারে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ বলেন,

“এই ধরনের অনেক কোর্টই (যেখানে আল্লাহর শরিয়াহ ব্যতীত কোন বাতিল শরিয়াহ দ্বারা বিচার করা হয়) এখন মুসলিমদের শহরগুলোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। যেগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুসম্পন্ন। এগুলোর দরজা উন্মুক্ত এবং একের পর এক মানুষ সেখানে ভীড় জমাচ্ছে। তাদের বিচারক তাদের মধ্যে বিচার ফায়সালা করছে, যা কিনা কিতাব ও সুন্নাহর সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। ঐ মিথ্যা শরিয়াহর বিচার তাদের মানতে বাধ্য করা হয়। আল্লাহর শরিয়াহ প্রতিস্থাপন করে তাদের উপর এটা আরোপ করা হয়। তাহলে আর কোন কুফর এই কুফর থেকে বেশি বিস্তৃত ও স্বচ্ছ হবে? এটা মুহাম্মাদ (ﷺ) যে আল্লাহর রাসুল— এই সাক্ষ্যের বিরোধিতা করার চেয়েও একধাপ বেশি।” তাহকিমুল কাওয়ানিন, পৃ. ৭; ১৯৬০ সালে শাইখ এই বক্তব্য দেন।

“যখন কোন শাসক কিংবা বিচারক আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার করে এবং একথা অস্বীকার করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ) এরই শুধুমাত্র অনুসরণ করতে হবে (বিশেষ করে শাসন ও বিচারে)... তবে এটা আল্লাহর নাযিলকৃত শরিয়াহর বিধান অস্বীকার বলে গণ্য হবে– ইবনু জারিরও এই মতই দিয়েছেন। এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আলিমগণের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মূলনীতি, যার ব্যাপারে ঐক্যমত্য রয়েছে— যদি কেউ দীনের কোন মূলনীতি অস্বীকার করে, কিংবা ইজমা আছে এমন কোন ক্ষুদ্র বিষয়ও অস্বীকার করে, কিংবা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)থেকে সন্দেহাতীতভাবে বর্ণিত কিছু অস্বীকার করে, যদি সে একটি অক্ষরও অস্বীকার করে তবে সে কাফির। তার কুফর তাকে ইসলামের গন্ডি থেকে বের করে দিয়েছে।

আর যখন কোন শাসক বা বিচারক স্বীকার করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ) এর বিধান তথা শরিয়াহ সত্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে বিচার করে এই মনে করে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর আনীত বিধানবলির চাইতে অন্য কারো বিচার উত্তম এবং মানুষের মাঝে বিচার ও মীমাংসার জন্য অধিক উপযোগী। যদি সে এরকম মনে করে পুরোপুরিভাবে অথবা এ অর্থে যে, সময়ের পরিক্রমার ফলে পরিস্থিতি এবং অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, যে কারণে অন্য আইন এখন অধিক প্রযোজ্য– তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা কুফরি। কারণ এর ফলে স্রষ্টার বিধানের উপরে সৃষ্টির বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সৃষ্টির সস্তা দর্শন এবং চিন্তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে আল-হাকাম, আল-হামিদ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বিধানের উপরে।”
তাহকিমুল কাওয়ানিন, পৃ. ৫; আরও দেখুন: মাজমু আল-ফাতাওয়া ২৭/৫৮ ।


শাইখ আহমাদ শাকির-

“আল্লাহর বিধান ছাড়া শাসন করা নিশ্চিত কুফর এবং এতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামের অনুসারী কোন ব্যক্তির এই ব্যাপারে কোন প্ররোচনা বা কোন অজুহাতের সুযোগ নেই। সে যেই হোক, ইসলামের উপর তাকে আমল করতে হবে। আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
উমদাতুত তাফসির, সুরা আল-মায়িদাহ, আয়াত ৫০

আল্লামা আহমাদ শাকিরের এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ বক্তব্য ও বিশ্লেষণ আছে, যার কিছু অংশ পরবর্তীতে উল্লেখ করা হবে।


শাইখ বিন বায-

“...অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে, আচার, হুদুদ (ইসলামি দণ্ডবিধি) বা এরূপ অন্য কোন বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ছাড়া অন্য কোন আইনে শাসন করা অনুমোদনযোগ্য, সেই (ব্যক্তির এই কাজ) ইমান বিনষ্টকারী (নাকিদুল ইমান) চতুর্থ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে। এমনকি, যদি এটাকে শরিয়াহর চেয়ে উত্তম বলে বিশ্বাস নাও করে, তবুও অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, এর অনুমতি দান করে সে আল্লাহর ঘোষিত নিষিদ্ধ কাজকে বৈধ করেছে। আর ব্যভিচার, মদ, সুদ, এবং আল্লাহর শরিয়াহ ব্যতীত অন্য আইনে শাসন করার মতো ধর্মের নিষিদ্ধ জিনিসকে যে সিদ্ধ (হালাল বা বৈধতা প্রদান) করবে, মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী সে কাফির।”
দাওয়াহ, গবেষণা ও ইফতা, সাউদি আরবের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রচারিত The Islamic Research Magazine, ইস্যু- ৭, পৃষ্ঠা ১৭-১৮।

শাইখ বিন বায তার نقد القومية العربية على ضوء الإسلام والواقع নামক রিসালায় মানবরচিত আইনের বর্ণনায় লিখেছেন— “এটা হচ্ছে বিরাট দুষ্কৃতি, সুস্পষ্ট কুফর এবং ধর্মত্যাগের ঘোষণা (রিদ্দাহ)।”

“আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে যে শাসন করে এই ভেবে যে, তার এই নিয়ম আল্লাহর নাযিলকৃত নিয়মের চেয়ে উত্তম, সে সকল মুসলিমের মতে কাফির। একইভাবে যে আল্লাহর আইন ব্যতীত মানবরচিত আইন দিয়ে শাসন করে এবং মনে করে এটা (মানবরচিত আইন দিয়ে শাসন) জায়িয– সেও কাফির। যদি সে বলে, ‘মানবরচিত আইন অপেক্ষা শরিয়াহ দিয়ে শাসন করা উত্তম’– তাও সে কাফির। সে কাফির, কারণ আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করছেন, সে তা জায়িয গণ্য করছে।”
মাজমুয়ু ফাতাওয়া ইবনু বায, ৪/৪১৬ ।


শাইখ ইবনু উসাইমিন-

যে শাসক ইসলামি শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোন আইন দ্বারা শাসন করে তার কাফির হওয়া সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্য—

“যে শাসক ইসলামি শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোন আইন দ্বারা শাসন করে, তারা এসব আইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দীনকেই প্রতিস্থাপিত করে নেয়। যারা এরকম করে তারা কুফরি করেছে যদিও তারা সালাহ আদায় করে, সিয়াম পালন করে, যাকাত দান করে এবং হজ পালন করে। এরা হল কাফির, কারণ তারা জানে তারা যে আইন দ্বারা শাসন করে তা আল্লাহর আইন না এবং তারা আল্লাহর আইন থেকে বিচ্যুত হয়েছে।”

তারপর তিনি সুরা নিসার নিম্নোক্ত আয়াতটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন :

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অতএব, (হে নাবি!) তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬৫

এরপর শাইখ বলেন—

“তাই অবাক হবেন না যখন আমরা এরকম শাসককে কাফির বলবো, যদিও তারা সালাহ আদায় করে, সিয়াম পালন করে, যাকাত দান করে এবং হজ পালন করে। কারণ যারা কুরআনের কিছু অংশে অবিশ্বাস করলো, তারা সম্পূর্ণ কিতাবকেই অবিশ্বাস করলো। আল্লাহর আইন থেকে যা নিজের পছন্দ হচ্ছে সেটা গ্রহণ করা আর যা পছন্দ হচ্ছে না তা বর্জন করা- এরকম করার কোন অবকাশ নেই। এরকম করা হল কুফর। আর যে এরকম করলো সে নিজের খেয়াল-খুশিকে অনুসরণ করলো এবং নিজের খেয়াল খুশিকে নিজের রব হিসেবে গ্রহণ করলো। ‘আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশিকে স্বীয় ইলাহ স্থির করেছে?’
সুরা আল-জাসিয়া, ৪৫: ২৩

...আজকের কথিত মুসলিম শাসকরা, আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর শরিয়াহকে এমন আইনের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছে যা সরাসরি আল্লাহর আইনের বিরোধি। তারা আল্লাহর আইনের পরিবর্তে আল্লাহর শত্রুর আইন গ্রহণ করেছে। আল্লাহর শত্রুর দ্বারাই এসব আইনের পত্তন হয়েছিল, তারপর লোকেরা এসব আইনের অনুসরণ করেছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার হল, লোকেদের ইলমের অগভীরতা আর দীনের ব্যাপারে দুর্বলতার কারণে আমরা দেখতে পাই, যদিও তারা জানে এসব আইন (গণতন্ত্র, আধুনিক সংবিধানের ধারণা) তৈরি হয়েছিল কিছু মানুষের দ্বারা কয়েকশো বছর আগে, মুসলিম উম্মাহর থেকে অনেক দূরবর্তী অন্য এক মহাদেশে, অন্য জাতিদের জন্য, তবুও তারা এসব আইনকে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, অথচ এসব আইন ও বিধান মুসলিমদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত না। এদের ইসলাম কোথায়? এদের ইমান কোথায়? নাবি মুহাম্মাদের (ﷺ)আনীত দীনের ব্যাপারে নিশ্চয়তা কোথায়? তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল সমগ্র মানবজাতির প্রতি রাসুল হিসেবে। আর তাঁর রিসালাহ, তাঁর আনীত দীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মানবজাতির সকল বিষয়।

অনেক অজ্ঞ-জাহিল লোকেরা বলে, শরিয়াহ হল শুধুমাত্র ইবাদাত, ব্যক্তিগত জীবন, বিয়ে আর উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে। কিন্তু তারা ভুলে যায় শরিয়াহ হল সব কিছুর জন্য। যদি আপনি এর প্রমাণ চান তবে কুরআনের সবচেয়ে লম্বা আয়াতগুলো খুঁজে বের করুন, দেখবেন এগুলো হলো মুয়ামালাত (লেনদেন) সংক্রান্ত। তাহলে কিভাবে কেউ বলতে পারে আল্লাহর শরিয়াহ হল শুধু ইবাদাত ও ব্যক্তিগত জীবনের জন্য? এটা তো অজ্ঞতা ও গোমরাহি...।

তিনটি শর্ত পূরণ করা ব্যতীত কেউ মুমিন হতে পারবে না :

১) সে সকল বিষয় আল্লাহর রাসুলকে (অর্থাৎ তাঁর আনীত শরিয়াহ, কুরআন ও সুন্নাহকে) বিচারক হিসেবে মেনে নেবে।

২) রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সিদ্ধান্ত ও বিচারের ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ থাকতে পারবে না।

৩) সে সম্পূর্ণভাবে এর প্রতি (দীন ইসলাম, আল্লাহর শরিয়াহ) আত্মসমর্পণ করবে, যাতে সে হিদায়াহ পেতে পারে।

এ তিনটি শর্ত পূরণ হলেই একজন ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে। অন্যথায় সে ইমানহারা হবে অথবা তার ইমান অপূর্ণ থাকবে।”


শাইখ আবদুর রাযযাক আফিফি-

‘আল-হুকমু বিগাইরি মা আনযালাল্লাহ’ শীর্ষক রচনায় সূচনা বক্তব্যের পর শাইখ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে যারা শাসন করে এবং শাসকদের প্রকারভেদ উল্লেখ করেছেন। প্রথম দুটি প্রকার উল্লেখের পর তিনি বলেছেন :

“তৃতীয় প্রকারের শাসক হল সেই শাসক, যে মুসলিম হবার দাবি করে (অর্থাৎ মুখে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে) এবং শরিয়াহর বিধানবলি সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও সে আইন প্রণয়ন করে ও বিচার ব্যবস্থা তৈরি করে এবং মানুষকে বাধ্য করে এই ব্যবস্থার অনুসরণ করতে, যদিও সে জানে এই বিচার ব্যবস্থা এবং এসব আইন শরিয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। এরকম ব্যক্তি কাফির; যে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে গেছে।

একই হুকুম তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা বিচার ও আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন সংসদ কিংবা আইনসভা তৈরির নির্দেশ দেয় এবং বাধ্য করে আইনসভা-সংসদ এবং এদের প্রণীত আইনের অনুসরণের, যদিও তারা জানে এগুলো (এই আইনসভা এবং তাদের প্রণীত আইন) শরিয়াহবিরোধী। একইভাবে যে ব্যক্তি এগুলোর ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিচার করে এবং প্রয়োগ করে তার ক্ষেত্রেও একই হুকুম প্রযোজ্য। আর যারা এক্ষেত্রে জেনে-বুঝে, স্বেচ্ছায় তাদের আনুগত্য করে এবং আল্লাহর শরিয়াহ ছাড়া এসব আইন দ্বারা বিচার আকাঙ্ক্ষা করে তাদের ক্ষেত্রেও একই হুকুম প্রযোজ্য। তারা আল্লাহর হুকুম, আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দোষে দোষী।”
শুবাহাত হাওল আস-সুন্নাহ এবং হুকমু বি গাইরি মা আনযালাল্লাহ, পৃ. ৬৪-৬৫, দারুল ফাদিলাহ: ১৪১৭।


শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিল-

“শাসনের ক্ষেত্রে শিরকের ৫ম উদাহরণ (শাইখ তার বক্তব্যে এর আগে আরও কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন) হল আল্লাহর শরিয়াহ ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা শাসন করা। যেমন- যারা প্রকাশ্যে মহিলাদের হিজাব ছাড়া চলাচলকে হালাল করে আইন বানাতে চায়, কিংবা যারা সমাজে সুদকে বৈধতা দিয়ে আইন পাশ করাতে চায়, কিংবা যারা, চার বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করতে চায় (শাইখের উদাহরণগুলোর মাধ্যমে বিশেষভাবে আরব উপদ্বীপের দেশগুলোর দিকে ইঙ্গিত করছেন)– এ রকম যেকোন কিছুর দিকে আহ্বান করা শিরকুল আকবার- যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। কারণ এধরনের আহ্বান শুধুমাত্র সে অন্তর থেকেই নিঃসৃত হতে পারে যা এসব ব্যাপারে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অপর কোন বিধানকে উত্তম মনে করে এবং সেসব বিধান কামনা করে। তার এই মৌখিক আহ্বানের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে তার এই বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে। আর এথেকে আল্লাহর বিধানসমূহের প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ পায়। এ হল বড় শিরক। এরকম আহ্বান জানানো লোকগুলো বেশিরভাগ সময় মুনাফিকও হয়ে থাকে। কারণ আপনি দেখবেন সে আপনার কাছে দাবি করবে সে মুসলিম এবং সে মুসলিম উম্মাহর সমর্থক। আর দেখবেন সে তার জুমু’আর সালাত পড়ার ছবি এনে প্রমাণ দিতে চাইবে সে পাক্কা মুসলিম।

যদি কোন মুজতাহিদ (ইজতিহাদের) ভুলবশত এমন বস্তুকে হারাম বলে মত দেন যা আসলে হালাল, কিংবা উল্টোটা, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়। একজন মুজতাহিদ নানা কারণে এমন ভুল করতে পারেন। আলিমগণ এরকম অনেক কারণ লিপিবদ্ধ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা হয়, কোন একটি নির্দিষ্ট হাদিস মুজতাহিদের জানা ছিল না। ইজতিহাদ করার সময় মুজতাহিদ হারাম একটি ব্যাপারকে হালাল মনে করেছিলেন, কারণ ঐ ব্যাপারটি হারাম হওয়া সংক্রান্ত হাদিসটি তিনি জানতেন না। একজন আন্তরিক, সম্মানিত, মুজতাহিদের ভুল শিরক না, কুফর না, এমনকি গুনাহও না। প্রকৃতপক্ষে তিনি এর জন্য পুরষ্কার পাবেন। একটি পুরষ্কার। [আন্তরিক মুজতাহিদ সঠিক ইজতিহাদের জন্য ২টি ও ভুল ইজতিহাদের জন্য ১টি পুরষ্কার পান]। কিন্তু যে ব্যক্তি জেনেশুনে নবি (ﷺ) এর পথ ব্যতীত অন্য কিছুর অনুসরণ করে, সে শিরক করলো।

মাজমু আল-ফাতাওয়ার তৃতীয় খন্ডে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেছেন, যখন কেউ হালালকে হারাম করে, কিংবা উল্টোটা করে, কিংবা আল্লাহর শরিয়াহকে প্রতিস্থাপিত করে অন্য কোন শরিয়াহ দ্বারা, তাহলে ফকিহগণের এ ব্যাপারে ইজমা আছে, সে ব্যক্তি হল কাফির। মাজমু আল-ফাতাওয়ার ৩৫তম খন্ডে তিনি এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত উলামার কথাও বলেছেন। ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেছেন, যখন কোন আলিম কুরআন ও সুন্নাহর ইলম ছেড়ে, এমন কোন শাসকের অনুসরণ করে, যে অবস্থান নেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধানসমূহের বিরুদ্ধে– তবে সে আলিম দুনিয়াতে ও আখিরাতে শস্তি পাবার যোগ্য এবং সে মুরতাদ।

ইমাম ইবনু কাসির আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ১৩তম খন্ডে বলেছেন, যে নবি মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর নাযিলকৃত শরিয়াহ ছেড়ে অন্য কোন শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে সে কাফির। ইবনু কাসিরের একথার অর্থ হল, যদি কেউ কুরআন ও সুন্নাহ ছেড়ে তাওরাত ও ইঞ্জিল দ্বারা শাসন করে তবে সে কাফির। অতঃপর ইবনু কাসির বলেছেন, যদি এটা হয় তাওরাত এবং ইঞ্জিল দিয়ে শাসনকারীর ব্যাপারে হুকুম– ইঞ্জিল, তাওরাত তো একটি সময়ে -এগুলো (মানুষকর্তৃক) বিকৃতি সাধনের আগে এবং এগুলো (আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী) রহিত হবার আগে- আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত শরিয়াহ ছিল। যদি এগুলো দ্বারা শাসন করাই আজ কুফর হয়ে থাকে, কারণ এগুলোকে রহিত করা হয়েছে (কুরআন নাযিলের মাধ্যমে) তাহলে চিন্তা করুন যারা অন্য (মানবরচিত) আইন দ্বারা শাসন করে তাদের ব্যাপারে কী হুকুম হবে? যারা এমন করে, তারা ইজমা অনুযায়ী কাফির।

আল্লামা শানকিতি আদওয়া আল-বায়ানে এ ব্যাপারে কিছু দলিল পেশ করার পর বলেছেন, যারাই কোন মানবরচিত বিধানের অনুসরণ করবে– এ অসাধারণ উক্তিটির দিকে লক্ষ্য করুন– যে ব্যক্তিই শয়তানদের দ্বারা রচিত হবার পর মানুষের মুখ হতে নিঃসৃত, মানবরচিত বিধানের অনুসরণ করবে ঐ শরিয়াহকে বাদ দিয়ে যার রচয়িতা আল্লাহ এবং যা রাসুলুল্লাহর (ﷺ) মুখে প্রকাশ পেয়েছে – কোন সন্দেহ নেই সে হল কাফির এবং মুশরিক। আর এ ব্যাপারে শুধু সে ব্যক্তিই সন্দিহান হবে আল্লাহ যার দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং ওহীর উজ্জল আলোর প্রতি তাকে অন্ধ করে দিয়েছেন।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম সুরা নিসার এই আয়াত উল্লেখ করেছেন-
“অতএব, আপনার রবের কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক বলে গ্রহণ না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।” [৪: ৬৫]

তারপর (এ আয়াতের ব্যাপারে) মন্তব্য করেছেন, যারা নবি (ﷺ) -কে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের বিবাদ-মোকদ্দমার ব্যাপারে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ তাদের ইমানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটা হল কসমের সাথে প্রত্যাখ্যান।


শাইখ সুলাইমান বিন নাসির আল উলওয়ান-

তাওহিদ অর্থ হল শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাত করা। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে সে শিরক এবং মুশরিকদের প্রতি বারায়াহ [বিদ্বেষ, শত্রুতা, সম্পর্কছিন্নতা, ঘৃণা] প্রদর্শন করে। আর যে শিরক ও মুশরিকদের প্রতি বারায়াহ প্রদর্শন করে না সে মুসলিম হতে পারে না।

‘ইমান বিধ্বংসী ১০টি বিষয়’– এ শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, এই দশটি বিষয়ের একটি হলঃ যে ব্যক্তি কাফির আসলি [অর্থাৎ কুরআনে যাদের কাফির বলা হয়েছে] ও মুশরিকদের কুফফার ঘোষণা করে না, কিংবা তাদের কুফরের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে সে নিজেও কাফির।

তাই ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুশরিকরা যে কুফর করেছে আমরা তা বিশ্বাস করি। একারণে তাদের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা, শত্রুতা পোষণ করি ও প্রদর্শন করি। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন,

فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ

“অতঃপর তিনি (ইবরাহিম) যখন তাদেরকে এবং তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করত, তাদের সবাইকে পরিত্যাগ করলেন...।”
সুরা মারইয়াম, ১৯: ৪৯

وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ

“তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং (পৃথক হলে) তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদাত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয়গ্রহণ করো।”
সুরা আল-কাহফ, ১৮: ১৬

وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي

“আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর তাদেরকে; আমি আমার পালনকর্তার ইবাদত করব।”
সুরা মারইয়াম, ১৯: ৪৮

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“তোমাদের জন্যে ইবরাহিম ও তাঁর সাথিদের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে।”
সুরা আল-মুমতাহিনাহ, ৬০: ৪

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আরও বলেছেন,

وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

“তিনি নিজ বিধানে কাউকে শরিক করেন না।” সুরা আল-কাহফ, ১৮: ২৬

অতএব শিরক এবং মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, নিজেদের দূরে সরিয়ে নেওয়া আমাদের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব। আর ভাববেন না শুধুমাত্র মাজার পূজা, আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি প্রার্থনা করা, কিংবা আল্লাহ ব্যতীত অপরের কাছে সাহায্য, ক্ষমা, চিকিৎসা ইত্যাদি চাওয়ার মাধ্যমেই শুধু আপনি শিরকে পতিত হতে পারেন। অবশ্যই এ সবগুলোই শিরক এবং এগুলোর শিরক হবার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, তবে এগুলো ছাড়াও অন্যান্য শিরক আছে। যেমন শিরক আল-মুহাব্বাহ [আল্লাহ ব্যতীত অপরকে ভালোবাসার মাধ্যমে শিরক], শিরক আত-তায়াহ [আল্লাহ ব্যতীত অপরের আদেশের অনুসরণ ও আনুগত্যের শিরক] এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছে তদানুযায়ী শাসন না করার শিরক,
কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন,-

“তিনি নিজ বিধানে কাউকে শরিক করেন না।”
সুরা আল-কাহফ, ১৮: ২৬

সুতরাং যে অভিশপ্ত মানবরচিত আইন দ্বারা শাসন করে, সে মুশরিক এবং কাফির।

আল্লাহ বলেছেন,

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”
সুরা ইউসুফ, ১২: ৪০

যার অর্থ, আল্লাহ ব্যতীত আর কারো আইন প্রণয়নের অধিকার নেই। আল্লাহ আরও বলেন,

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।” সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪

অতএব এসব মুশারইন (মিথ্যা আইনপ্রণেতা)-দের উপর অবিশ্বাস করা, তাদের প্রত্যাখ্যান করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

“যদি কেউ কোন হারাম বস্তুকে– যা হারাম হবার ব্যাপারে ঐক্যমত আছে- হালাল সাব্যস্ত করে, কিংবা হালাল বস্তুকে– যা হালাল হবার ব্যাপারে ঐক্যমত আছে- হারাম সাব্যস্ত করে, তবে ফকিহগণের ইজমা অনুসারে কাফির।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, ৩/২৬৭

ইমাম ইবনু হাযম বলেছেন,-

যে বিষয়ে কুরআনের কোন আয়াত বা হাদিস নেই, এমন বিষয়েও যদি কেউ তাওরাত কিংবা ইঞ্জিল দ্বারা বিচার করে, তবে সে একজন কাফির-মুশরিক, ইসলামে যার জন্য কোন জায়গা নেই। আর এ ব্যাপারে ফকিহগণের ইজমা আছে।”
ইহকামুল আহকাম ফি উসুলিল আহকাম, ৫/১৫৩

ইমাম ইবনু হাযম রাহিমাহুল্লাহ বলছেন, ফকিহগণ এ বিষয়ে একমত— যদি কেউ প্রকৃত (অবিকৃত) তাওরাত অথবা ইঞ্জিল দিয়েও শাসন করে তবে সে কাফির। (কারণ কিতাবগুলো শুধুমাত্র বনি ইসরাইলের জন্য নাযিল করা হয়েছিল) তবে আজকের শাসকদের ব্যাপারে হুকুম কী হবে, যারা শাসন করছে ইহুদি-নাসারা আর সেইসব অভিশপ্ত নাস্তিক, গণতান্ত্রিক আর সেক্যুলারিস্টদের আইন দিয়ে, যারা ইবলিসের চাইতেও বড় কাফির? ইবনু হাযম বলছেন, যে ব্যক্তি কুরআন ছেড়ে অবিকৃত তাওরাত আর ইঞ্জিল দিয়ে শাসন করবে তার কাফির হবার ব্যাপারে ফকিহগণের ইজমা আছে। আর যারা বুশের নীতি, অভিশপ্ত ন্যাটো আর জাতিসংঘের আইন আর নীতি দিয়ে শাসন করছে তারা কাফির না? সুবহানাল্লাহ,

مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
“তোমাদের কী হলো, তোমরা কেমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?”
সুরা আল-কালাম, ৩৬

আমাদের সময়ে এই গোমরাহির (অর্থাৎ যে আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করে না, তাকে কাফির মনে না করা) ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। আজকের স্বঘোষিত সালাফিদের মধ্যে ইরজা আছে। এরা হলো ইরজার সালাফ। এরা এমন সব লোক, সত্যকে বিলম্বিত করার ব্যাপারে যাদের রয়েছে ব্যাপক প্রেরণা ও উদ্দীপনা। আর তাই তারা বলে “এটা হল কুফর দুনা কুফর।” আজকের স্বঘোষিত ইরজাগ্রস্থ সালাফিরা বলেন, আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন না করা হল, “কুফর দুনা কুফর”। কুফর দুনা কুফর হলো এমন কুফর যে কুফর করলে ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয় না। এটা সুস্পষ্ট গোমরাহি এবং বিচ্যুতি! যদি কোনো শাসক শরিয়াহর কিছু অংশ বাদ দেয়, কিংবা সম্পূর্ণ শরিয়াহ বাস্তবায়ন না করে, তবে একে বড় কুফর যে কুফর ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় বলা হয়।

আর একারণেই হাফিয ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ তার আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিতাবে চেঙ্গিস খান এবং যারা তাতারিদের আল-ইয়াসিক কিতাব দিয়ে শাসন করতো তাদের সম্পর্কে লিখেছেন—

“অতএব কেউ যদি খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (ﷺ) এর উপর নাযিলকৃত শরিয়াহ ছেড়ে, পূর্বে নাযিলকৃত অন্য কোন শরিয়াহ দ্বারা বিচার করে ও শাসনকার্য চালায়, যা রহিত হয়ে গেছে, তবে সে কাফির হয়ে গেছে। তবে (চিন্তা করুন) সেই ব্যক্তির হুকুম কী, যে আল-ইয়াসিকের ভিত্তিতে শাসন করে এবং একে ইসলামি শরিয়াহ’র উপর স্থান দেয়? এরকম যেই করবে সে মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী কাফির।”
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ত্রয়োদশ খন্ড, পৃ. ১১৮-১১৯

আমাদের সামনে আলিমগণের ইজমা আছে, আমাদের সামনে এই ইজমার ব্যাপারে ইবনু হাযম রাহিমাহুল্লাহর সাক্ষ্য আছে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ এবং হাফিয ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহর সাক্ষ্য আছে– আর এর বাইরে কী আছে? (অর্থাৎ আলিমগণের ইজমা আছে এবং ইজমা থাকার ব্যাপারে মহান আলিমগণের সাক্ষ্য আছে, তাহলে কিসে তোমাদের এ ব্যাপারে সত্য বলা থেকে বাধা দিচ্ছে?) কিসে তোমাদের বাধা দিচ্ছে? তোমাদের বাধা দিচ্ছে গোমরাহি, বিচ্যুতি, ইরজা, আর আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুল (ﷺ) এর সুন্নাহ নিয়ে খেলতামাশা।


সাহাবি জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু-

জালিলুল কাদর সাহাবি জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ (ﷺ)আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এটা (তরবারি) দিয়ে আঘাত করতে তাদেরকে, যারা ওটা (কুরআন) ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।”
মুসনাদ আহমাদ, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমু আল-ফাতাওয়ার ৩৫তম খন্ডে এটি উল্লেখ করেছেন।


সাইয়িদুনা ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-

একদা ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রিশওয়াহ (ঘুষ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বলেন— “এটা হচ্ছে সুহত (অবৈধ সম্পদ)।” তখন আবারো জিজ্ঞেস করা হয়, “না, আমরা বিচার ফায়সালার ব্যাপারে বলছি।” (অর্থাৎ প্রশ্ন নিছক ঘুষ গ্রহণ করার ব্যাপারে না, ঘুষের বিনিময়ে বিচার বদলে দেয়ার ব্যাপারে) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “এটাই হচ্ছে কুফর।”
তাফসির ইবনু কাসির, ৩/১১৯; ইবনু জারির তাবারি, ৩০/৪১৮, বর্ণনা নং ১২০৬১; ফাতহুল কাদির, ৩/৩১৩


সাইয়িদুনা ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-

১। হাসান ইবনু আবি রাবিয়া আল-জুরজানি {পূর্ণ নাম, ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু জা’জ। বর্ণনাকারী হিসেবে সত্যবাদী এবং বিশ্বাসযোগ্য বলে গৃহীত।} বর্ণনা করেছেন, আমরা আবদুর রাযযাক থেকে, তিনি মুয়াম্মার থেকে, তিনি ইবনু তাউস থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রশ্ন করা হলো এই আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে, “...আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুসারে যারা বিচার-ফায়সালা করে না, তাঁরাই কাফির।” সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪ ।জবাবে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, كفى به كفره “কুফরের জন্য এটাই যথেষ্ট।” {আখবারুল কুদাহ, খণ্ড ১, পৃ. ৪০-৪৫। বর্ণনাকারী হলেন মুহাম্মাদ ইবনু খালাফ ইবনু হাইয়ান, যিনি পরিচিত ওয়াকিয়া নামে। মৃত্যু: ৩০৬ হিজরি। তিনিই আখবারুল কুদাহ কিতাবটি রচনা করেছেন। ইবনু হাজার আসকালানি, খাত্তাবি এবং ইবনু কাসির– তাঁদের সকলের উপর আল্লাহ রহম করুন– ওয়াকিয়ার ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি বিশ্বাসযোগ্য”।}

যখন ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন, “কুফরের জন্য এটাই যথেষ্ট”, তখন আর এটাকে ছোট কুফর বলে গণ্য করা যাবে না। যেহেতু তিনি “যথেষ্ট” বলেছেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে তিনি এখানে বড় কুফর (কুফর আকবারকেই) বোঝাচ্ছেন।

২। ইবরাহিম ইবনুল হাকাম ইবনু যাহির তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেছেন সুদ্দি থেকে, তিনি বলেন― ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,

مَنْ جَارَ فِيْ الْحُكْمِ وَهُوَ يَعْلَمُ، وَمَنْ حَكَمَ بِغَيْرِ عِلْمِه، وَمَنْ أَخَذَ الرِّشْوَةَ فِيْ الْحُكْمِ، فَهُوَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ

“যে বিচারের ক্ষেত্রে জেনেশুনে স্বেচ্ছাচারিতা করে (অর্থাৎ নিজের ইচ্ছেমতো বিচার করে), জ্ঞান ছাড়া বিচার করে, কিংবা বিচারের ব্যাপারে ঘুষ গ্রহণ করে, সে কাফিরের অন্তর্ভুক্ত।” আখবারুল কুদাহ, পৃ. ৪১



তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ সংক্রান্ত কিছু আয়াতেরব্যাখ্যায় মুফাসসিরিনের বক্তব্য


এখানে আমরা প্রসিদ্ধ মুফাসসিরিনের কিছু বক্তব্য তুলে ধরবো, যাতে করে সুনির্দিষ্টভাবে কোন্ আয়াতসমূহের ভিত্তিতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর অতীত ও বর্তমানের আলিমগণ এ ঐক্যমতে উপনীত হয়েছেন তা সম্পর্কে পাঠক একটি ধারণা পেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখা প্রয়োজন এতো অধিকসংখ্যক বক্তব্য এ বিষয়ে আছে যে, তার সবগুলো একত্রিত করা দুঃসাধ্য। আশা করা যায় এখানে যা উদ্ধৃত হয়েছে পাঠক তা থেকে মোটামুটি একটি ধারণা পাবেন।


প্রথম আয়াত :

إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

“আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হিদায়াহ ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ নাবিগণ, রব্বানি ও আহবাররা এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের হিফাযাতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।”
সুরা আল-মায়িদাহ, ৫: ৪৪

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরিনের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো :

১। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু

সাহাবাদের মধ্যে ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা আছে যা দ্বারা বোঝা যায়, এই আয়াতের হুকুম সাধারণভাবে সকলের উপর প্রযোজ্য, শুধুমাত্র বনি ইসরাইলের ক্ষেত্রে না। আলকামা এবং মাসরুক থেকে বর্ণিত, তারা ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ঘুষের ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন। জবাবে ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘এটি হারাম বস্তুসমূহের অন্তর্ভুক্ত’। তারা তখন প্রশ্ন করলেন যখন বিচারককে ঘুষ দেওয়া হয় (বিচারের রায় পরিবর্তন করার জন্য)। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘এটা কুফর’। তারপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পড়লেন।
তাবারি, ১০/৩২১, বর্ণনা নং ১১৯৬০, ১১৯৬৩ এবং ১০/৩৫৭, বর্ণনা নং ১২০৬২

২। হাসান আল-বাসরি রাহিমাহুল্লাহ

হাসান আল-বাসরি

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

এই আয়াতের ব্যাপারে বলেছেন, ‘এই আয়াত নাযিল হয়েছিল ইহুদিদের ব্যাপারে, কিন্তু এর হুকুম আমাদের জন্যও প্রযোজ্য।’
তাবারি, ১০/৩৫৭, বর্ণনা নং ১২০৬০, দুররুল মানসুর, ৩/৮৮

৩। ইবরাহিম আন-নাখয়ি রাহিমাহুল্লাহ-

উপরোক্ত আয়াতের ব্যাপারে ইবরাহিম আন-নাখয়ি বলেছেন, এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল বনি ইসরাইলের ব্যাপারে, আর আল্লাহ এই উম্মাহকেও এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন (অর্থাৎ এই আয়াত এই উম্মাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)।”
তাফসির আব্দুর রাযযাক, ১/১৯১, তাবারি, ১০/৩৫৬-৩৫৭, বর্ণনা নং ১২০৫৮; দুররুল মানসুর, ৩/৮৭।

৪। সুফিয়ান আস-সাওরি রাহিমাহুল্লাহ-

সুফিয়ান আস-সাওরি সুরা মায়িদার ৪৪, ৪৫, ও ৪৭ নং আয়াতের ব্যাপারে বলেন, “প্রথমটি হল এই উম্মাহর জন্য (অর্থাৎ সেসব মুসলিমের জন্য যারা শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে না), দ্বিতীয়টি হল ইহুদিদের জন্য, তৃতীয়টি হল নাসারাদের জন্য।”
আখবারুল কুদাহ, খন্ড ১/৪০

এছাড়া লক্ষ্যণীয়, যারা শিরক এবং কুফরি করে করে কুরআনে অনেক জায়গাতে তাদেরকেও যালিম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন-

“তাদের কি এমন শরিক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? যদি চুড়ান্ত সিন্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ব্যাপারে ফয়সালা হয়ে যেত। নিশ্চয় যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
সুরা আশ-শুরা, ৪২: ২১

একারণে সকল মুশরিক ও কাফির মাত্রই যালিম এবং ফাসিক্ব, কিন্তু সকল যালিম ও ফাসিক্ব ব্যক্তিই মুশরিক বা কাফির না। সুতরাং এই তিনটি আয়াতের মধ্যে [আল-মায়িদা ৪৪, ৪৫, ৪৭] কোন সংঘর্ষ নেই। আল্লাহর শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করা ব্যক্তি একই সাথে যালিম, ফাসিক এবং কাফির।

৫। সুদ্দি রাহিমাহুল্লাহ

সুদ্দি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী যে শাসন করে না এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তা ত্যাগ করে, সজ্ঞানে শরিয়াহ ব্যতীত অন্যকিছু দ্বারা বিচার করে, সে কাফিরদের একজন।”
তাবারি, ১০/৩৫৭, বর্ণনা নং ১২০৬২

৬। আবু আব্দুল্লাহ আল-কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ-

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী যে শাসন করে না এবং সে এর মাধ্যমে কুরআনকে অস্বীকার (জুহুদ) ও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান (রদ) করে, সে কাফির। এটাই হল ইবনু আব্বাস এবং মুজাহিদের বক্তব্য, যে এই আয়াত আম-ভাবে প্রযোজ্য। ইবনু মাসউদ এবং হাসানও বলেছেন ‘এই আয়াত আমভাবে সবার উপর প্রযোজ্য, যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী শাসন করে না– হোক তারা মুসলিম, ইহুদি, কিংবা অন্য কোন ধরনের কুফফার।’
জামিউল আহকাম, ৫/১৯০

৭। আবু বাকর আল-জাসসাস রাহিমাহুল্লাহ-

“যারা আল্লাহর বিধানাবলি থেকে এবং রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর নির্দেশাবলি থেকে কোন কিছু বাদ দেয়, অস্বীকার করে বা প্রত্যাখ্যান করে, তা যত ছোটই হোক না কেন, তাদেরকে এ আয়াতে ইসলাম ত্যাগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার এই প্রত্যাখ্যান কোন বিধান তার মনঃপুত না হওয়া, কিংবা (শরিয়াহর প্রতি) বিদ্বেষ কিংবা কোন বিধান মেনে নিতে অনিচ্ছা- যে কারণেই হোক না কেন, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে।

যাকাত অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইনের অবস্থানের সাথে এই অবস্থানই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম শুধুমাত্র যাকাত অস্বীকারকারীদের মুরতাদ ঘোষণা করেই থেমে থাকেন নি, বরং তাদেরকে হত্যা করেছেন এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের গানিমাহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর কারণ হল, আল্লাহ সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন যে যারা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর বিচার (হুকুম) ও শাসনের অনুসরণ করে না, তারা আহলুল ইমানের অন্তর্ভুক্ত না (অর্থাৎ তারা কাফির)।”
আহকামুল কুরআন, ৩/১৮১

৮। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ-

আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা ব্যক্তি যে তাগুত ও কাফির তা উপস্থাপনের জন্য শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর আয়াত ব্যবহার করেছেন—

“তৃতীয় প্রকারের তাগুত হল সে ব্যক্তি যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করে। আর এর দলিল হল আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার এই আয়াত।”
মা’নাত তাগুত, দুরারুস সানিয়্যাহ, ১/১০৯-১১০


দ্বিতীয় আয়াত :

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ

‘বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! এসো এমন একটি বিষয়ের দিকে, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান। (তা এই যে) আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করব না, তাঁর সাথে কোন শরিক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে রব বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, তোমরা সাক্ষী থাকো আমরা তো মুসলিম আত্মসমর্পণকারী।’
সুরা আলি ইমরান, ৩: ৬৪

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ তুলে ধরেছেন যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে হালাল-হারাম নির্ধারণকারী (আইনপ্রণেতা/বিধানদাতা) হিসেবে গ্রহণ করা কুফর ও শিরক ।

১। আবু আব্দুল্লাহ আল-কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ-

তিনি বলেন, ‘একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না’– এই আয়াতে ‘রব হিসেবে গ্রহণ না করার’ অর্থ হলো, আল্লাহ যা হালাল করেছেন এটা ছাড়া আর কিছু হালাল বা হারাম (বৈধ ও অবৈধ) করার ব্যাপারে আমরা আর কারো অনুসরণ করবো না। এটি এই আয়াতের অনুরূপ– ‘ইহুদি ও নাসারারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে আল্লাহ ব্যতীত’ যার অর্থ হল আল্লাহ যা হারাম ও হালাল করে নি, পন্ডিত ও সংসারবিরাগিরা তা হালাল ও হারাম করেছিল আর ইহুদি-নাসারারা এতে তাদের অনুসরণ করেছিল, আর এই অনুসরণের মাধ্যমে তারা পন্ডিত ও সংসারবিরাগিদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছিল।”
তাফসির আল-কুরতুবি, ৪/১০৬

২। আল্লামা ইবনু হাযম রাহিমাহুল্লাহ-

ইবনু হাযম এ ব্যাপারে উত্থাপিত একটি আপত্তি উল্লেখ করে তার জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কেউ যদি বলে, ইহুদি আর নাসারারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এটা কিভাবে হতে পারে, যখন তারা (ইহুদি ও নাসারা) এ কথা অস্বীকার করছে?” (অর্থাৎ, যেহেতু তারা মুখে বলছে তারা আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করে না, তাহলে কিভাবে তাদের ব্যাপারে এটা বলা যায় যে তারা এটা করছে?) এর জবাবে আমরা বলি– আল্লাহ সকল শক্তির উৎস, বস্তুসমূহের নামকরণ এবং প্রকারভেদ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তাঁর এখতিয়ারভুক্ত। যখন ইহুদি ও নাসারারা তাদের পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের হারামকৃত বিষয়কে হারাম হিসেবে গ্রহণ করলো এবং তাদের হালালকৃত বিষয়কে হালাল হিসেবে গ্রহণ করলো– তখন বাস্তবিক অর্থে এর মাধ্যমে তারা পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করলো, আর প্রায়োগিক দিক দিয়ে রব হিসেবে তাদের ইবাদাত করলো। তাই আল্লাহ এ কাজকে “আল্লাহ ব্যতীত অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করা”– বলে অভিহিত করলেন, আর এ কাজ নিশ্চিতভাবেই শিরক।”
আল-ফাসল, ইবনু হাযম, ৩/২৬৬, সম্পাদিত সংস্করণ।

৩। জারির আত-তাবারি রাহিমাহুল্লাহ-

“আল্লাহকে ছাড়া কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না” এ শব্দাবলির ব্যাপারে আত-তাবারি বলেন, “এখানে আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম (অবৈধ) এবং আল্লাহ হারামকৃত বিষয়কে হালাল (বৈধ) করা নেতাদের আনুগত্য করাকে ‘রব হিসেবে গ্রহণ করা’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে নেতাদের আনুগত্য করা এবং যা থেকে আল্লাহ বিরত থাকতে বলেছেন নেতাদের নির্দেশের কারণে তা থেকে বিরত না থাকাই হল আল্লাহর পরিবর্তে তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করা। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ ‘ইহুদি ও নাসারারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদিগকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে আল্লাহর পরিবর্তে...।’
তাফসির আত-তাবারি, ৬/৪৮৮, আহমাদ শাকির সম্পাদিত।

তিনি ইবনু জুরাইজ থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না’- এর অর্থ হল আমরা একে অপরের আনুগত্যের কারণে আল্লাহর অবাধ্যতা করবো না এবং নেতা ও শাসকদের আনুগত্য করা (শরিয়াহর বিরোধিতার ক্ষেত্রে) আল্লাহ ব্যতীত অপরকে রব হিসেবে গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত– যদিও এসব শাসকদের ইবাদাত না-ও করা হয়, এবং তাদের কাছে দুয়া না-ও করা হয়।”
তাফসির ইবনু আবি হাতিম, পৃ. ৩১৮, বর্ণনা নং ৬৯৮


তৃতীয় আয়াত :

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا

“তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা মান্য করে জিবত ও তাগুতকে এবং কাফিরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে।”
সুরা আন-নিসা, ৪: ৫১

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরিনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় আল্লাহ ব্যতীত কাউকে বিধানদাতা হিসেবে গ্রহণ করা হলে সে তাগুত বলে গণ্য হবে।

১। তাবারি-

তাগুতের সংজ্ঞার ব্যাপারে তাবারি রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“আমার মতে তাগুতের সঠিক সংজ্ঞা হলো, যা কিছুকে আল্লাহর স্থানে বসানো হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে যা কিছুর ইবাদাত করা হয়, উপাসনাকারীর নিজ ইচ্ছায় কিংবা যাকে উপাসনা করা হচ্ছে তার জোর জবরদস্তির কারণে, সেটাই তাগুত। যার উপাসনা করা হচ্ছে সেটা কোন মানুষ হোক, শয়তান হোক, কোন মূর্তি বা পাথর হোক।”
তাফসির আত-তাবারি, ৫/৪১৯; ৮/৪৬৫

এটাই তাগুতের সর্বাধিক পরিপূর্ণ সংজ্ঞা। ইমাম মালিকের মতও এটিই, তার মতে আল্লাহ ব্যতীত যা কিছুর ইবাদাত করা হয় তাই তাগুত। কুরতুবিও এই মত গ্রহণ করেছেন।

২। ইবনু তাইমিয়্যাহ-

মাজমু আল-ফাতাওয়ায় সুরা মায়িদার ৫১ নং আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“কাফিরদের বন্ধু বা মিত্র হিসেবে গ্রহণ করার একটি বাহ্যিক প্রকাশ হল আল্লাহর কিতাব ছেড়ে কাফিরদের কিছু দর্শন, মতাদর্শ গ্রহণ করা ও বিশ্বাস করা কিংবা তাদের আইন দিয়ে শাসন করা।
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেছেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلَاءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا

‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা মান্য করে জিবত ও তাগুতকে এবং কাফিরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে।’
মাজমু আল-ফাতাওয়া, ২৮/১৯১

৩। আবদুর রহমান আস-সাদি-

শাইখ সাদি ‘জিবত’ এবং ‘তাগুত’ সম্পর্কে বলেছেন, “এটা হল আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছু বা কোন সত্ত্বার যেকোন ধরনের ইবাদাতে বিশ্বাস কিংবা আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান দ্বারা বিচার করা– জাদু, জ্যোতিষী, ভাগ্যগণনা, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর উপাসনা এবং শয়তানের আনুগত্য– এসব কিছুই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।”
তাফসির আস-সাদি, ১/৩৫৮


চতুর্থ আয়াত :

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا

“আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবি করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। অথচ তারা তাদের মোকদ্দমা তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায়।
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬০-৬১

১। তাবারানি-

তাবারানি বর্ণনা করেছেন যে, ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আবু বারযাহ আল-আসলামি ছিল একজন যাদুকর। ইহুদিরা তাদের মোকদ্দমার মীমাংসা তার দ্বারা করিয়ে নিত। একটি ঘটনায় কিছু মুসলিমও তার নিকট দৌড়িয়ে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা উক্ত আয়াত নাযিল করেন।
{তাবারানি, আল-মুজাম আল-কাবির, ১১/৩৭৩, হাদিস নং ১২০৪৫। মাজমা আয-যাওয়ায়িদ, ৭/৬, তিনি বলেন তাবারানী এটা বর্ণনা করেছেন এবং এর বর্ণনাকারীরা হল আস সাহিহ-এর বর্ণনাকারী; ওয়াহিদি উল্লেখ করেছেন আসহাব আন-নুযুল, পৃঃ ১৬০ তে (এবং যোগ করেছেন আবু বারযাহ একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন এবং এই ঘটনা তিনি মুসলিম হবার আগেকার) ফাতহুল বারি, ৫/৩৭, প্রথম সালাফিয়্যাহ সংস্করণ।}

২। ইবনুল কাইয়িম-

ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যা এনেছেন (শরিয়াহ) তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং তার বদলে অন্য কিছু গ্রহণ করাকে আল্লাহ এখানে নিফাকের মূল নির্যাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।”
মুখতাসার আস-সাওয়ায়িক, ২/৩৫৩

তাইসির আল-আযিয আল-হামিদে উল্লেখিত আছে, ইবনুল কাইয়িম বলেছেন, “এখান থেকে বোঝা যায় যাকে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা বিচারের প্রতি আহ্বান করা হল, এবং সে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলো, সে মুনাফিক্বদের অন্তর্ভুক্ত। এই আয়াতের ‘ইয়াসুদ্দুন’ হল একটি অকর্মক ক্রিয়া (যা এখানে ‘বিমুখ হওয়া’, ‘মুখ ফিরিয়ে নেওয়া’ হিসেবে অনূদিত হয়েছে) অর্থাৎ তাদের (শরিয়াহর বিচার থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বলা হচ্ছে, অন্য কাউকে শরিয়াহ দ্বারা বিচার করা থেকে বিরত রাখার কথা না। যদি শরিয়াহ থেকে নিজে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াকে আল্লাহ নিফাক বলে উল্লেখ করেন, তবে যে আরও অগ্রসর হয়ে নিজের কথা, প্রচারণা এবং কিতাবের মাধ্যমে অন্যদেরকেও কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা শাসন থেকে বিরত রাখতে চায় আর মুখে দাবি করতে থাকে, কল্যাণ এবং সম্মিলন ছাড়া সে আর কিছুই চায় না– এমন লোকের অবস্থা কী হবে? সে কি তার কথা এবং কাজের মাধ্যমে যে তাগুতের প্রতি সে বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করে তার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর সম্মিলন চায়?”
তাইসির আল-আযিয আল-হামিদ, পৃ. ৫৫৭

৩। ইবনু কাসির-

ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, “এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঐ সমস্ত লোকদের দাবি মিথ্যা প্রতিপন্ন করছেন, যারা মুখে স্বীকার করে যে, আল্লাহ তায়ালার পূর্বের সমস্ত কিতাব এবং এ কুরআনের উপর আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কিন্তু যখন কোন বিবাদের মীমাংসা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন তারা কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে না, বরং (শরিয়াহ ব্যতীত) অন্য কিছুর দিকে যায়।

এ আয়াতটি ঐ দুই ব্যক্তির ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যাদের মধ্যে কিছু মতভেদ দেখা দিয়েছিল। একজন ছিল ইহুদি এবং অপরজন ছিল আনসারি। ইহুদি আনসারিকে বলেছিলে, চলো আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ) –এর নিকট হতে এর মীমাংসা করিয়ে নেবো। আনসারি বলেছিল, চলো আমরা কাব ইবনু আশরাফের নিকট যাই।

এও বলা হয়েছে যে, এ আয়াতটি ঐ মুনাফিকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা বাইরে ইসলাম প্রকাশ করতো বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে জাহিলি যুগের বিধান দিয়ে বিচার করতে চাইতো। এছাড়া এ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অন্যান্য আরও কারণও উল্লেখ রয়েছে।

তবে আয়াতটির একটি ‘আম’ বা সাধারণ অর্থ রয়েছে যা আম-ভাবে প্রযোজ্য। এ আয়াতে ঐ ধরনের প্রত্যেক ব্যক্তির নিন্দা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসুল

(ﷺ)এর সুন্নাহ দ্বারা বিচার করা থেকে বিরত থাকে এবং অন্য কোন বাতিল বিধানের অনুসারে ফায়সালা গ্রহণ করে। এখানে এটাই হচ্ছে তাগুতের ভাবার্থ (অর্থাৎ এ আয়াতে তাগুত দ্বারা বোঝানো হয়েছে ঐ সবকিছুকে আল্লাহর বিধান ব্যতীত যার বিধান গ্রহণ করা হয়)। এ কারণে আল্লাহ বলেছেন- ‘অথচ তারা তাদের মোকদ্দমা তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়...’

আল্লাহ বলেছেন– “আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদ্দিকে এবং রসূলের প্রতি এসো, তখন আপনি মুনাফিকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে বিমুখ হয়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।”

“আপনার কাছ থেকে বিমুখ হয়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে” অর্থ হল তারা গর্ব ভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঠিক একইভাবে আল্লাহ অন্যত্র মুশরিকদের বর্ণনা দিয়েছেন—

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا

“তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব।”
সুরা লুকমান, ৩১: ২১

মুমিনের উত্তর এটা হতে পারে না। বরং তাদের উত্তর অন্য আয়াতে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে-

إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا

“মুমিনদেরকে যখন তাদের মধ্যে ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তাদের এ উত্তরই হয় যে, আমরা শুনলাম ও মানলাম।”
সুরা আন-নূর, ২৪: ৫১


পঞ্চম আয়াত :

وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبِّي عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ

“তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন– তার মীমাংসাতো আল্লাহরই নিকট। বলো, তিনিই আল্লাহ- আমার রব। আমি নির্ভর করি তাঁর উপর এবং আমি তাঁরই অভিমুখী।”
সুরা আশ-শূরা, ৪২: ১০

১। ইবনু কাসির-

ইবনু কাসির তার তাফসিরে বলেছেন— মুজাহিদসহ একাধিক সালাফ বলেছেন, এর অর্থ হলো, বিচারের জন্য আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসুল (ﷺ) এর সুন্নাহর দ্বারস্থ হও। মানুষের মধ্যে উত্থাপিত এবং উত্থাপিত হতে পারে এমন যেকোন মতবিরোধের ব্যাপারে, হোক তা দীনের মূলনীতির সাথে সম্পর্কিত কিংবা ক্ষুদ্র কোন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত, এই হল আল্লাহর নির্দেশ। সব বিষয়ে মীমাংসা এবং হুকুমের ভার কুরআন ও সুন্নাহর উপর অর্পণ করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন তার মীমাংসাতো আল্লাহরই নিকট।”

কুরআন ও সুন্নাহ যে সিদ্ধান্ত দেয় এবং যার সঠিক ও সত্য হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়, তাছাড়া আর যা কিছু আছে তা বাতিল ছাড়া আর কী হতে পারে? তাই আল্লাহ বলেছেন, “...তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যার্পণ করো— যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো।”
সুরা আন নিসা, ৪: ৫৯

এ থেকে বোঝা যায়, যে বিবাদপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসার (বিচারের) ভার কুরআন ও সুন্নাহর (অর্থাৎ শরিয়ার) প্রতি অর্পণ করে না, সে আল্লাহ এবং শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাসী না (অর্থাৎ সে কাফির)।”
তাফসির ইবনু কাসির, ১/৫১৮; আল-ইস্তিকামা সংস্করণ।


ষষ্ঠ আয়াত :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”
সুরা আল-বাকারা, ২: ২০৮

১। আত-তাবারি-

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আলিমগণের বিভিন্ন মত উল্লেখ করার পর ইমাম তাবারি রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“যদি প্রশ্ন করা হয়, ইমানদারদেরকে মুহাম্মাদ (ﷺ)এর অনুসরণ এবং তাঁর আনীত দীন ইসলামের অনুসরণের নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ কী বোঝাচ্ছেন? তবে এর জবাব হবে– এর অর্থ হল, আল্লাহর সকল বিধান মেনে চলা এবং তাঁর সকল আইন প্রয়োগ করা; এর মধ্যে কিছু গ্রহণ আর কিছু বর্জন না করা। যদি এই অর্থ গ্রহণ করা করা হয়, তবে ‘কাফফাতান’ শব্দটি (এখানে ‘পরিপূর্ণভাবে’ হিসেবে অনূদিত হয়েছে) একটি বিশেষণ যা ইসলামকে নির্দেশ করছে এবং এখানে এর অর্থ হল– তোমরা যারা মুহাম্মাদ (ﷺ)ও তিনি যা এনেছেন তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছো, তোমরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং এর কোন অংশ বাদ দিও না।”
তাফসির আত-তাবারি, ৪/২৫৫, আহমাদ শাকির সম্পাদিত।


সপ্তম আয়াত :

يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

“এবং তিনি নিজ হুকুম ও বিধান-কর্তৃত্বে কাউকে শরিক করেন না।”
সুরা আল-কাহফ, ১৮: ২৬

১। ইবনুল কাইয়িম-

যদিও কিছু মুফাসসিরিন (যেমন আন-নাসাফি এবং আল-বাইদাওয়ি) হুকমিহিকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বিচার হিসেবে, কিন্তু অধিকাংশই এর ব্যাখ্যায় দুটো অর্থকেই গ্রহণ করেছেন (শার এবং কাদর), ইবনু কাসির ও তাবারিও দুটি অর্থই গ্রহণ করেছেন। ইবনুল কাইয়িম এবং ইবনু সাদির মতো অনেকেই বলেছেন এর মধ্যে দুটি অর্থই অন্তর্ভুক্ত।
ইবনুল কাইয়িম, শিফাউল আলিল, পৃ. ২৮০; তাফসির আস-সাদি, ৫/২৭

২। আশ-শানকিতি-

আল্লামা শানকিতি বলেছেন, “এ আয়াতে (হুকমিহ) এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত হল, আল্লাহ একমাত্র হুকুমদাতা, যার প্রথম এবং প্রধান অংশ হল তাশরি (আইন প্রণয়ন)।”
তাফসির আদওয়া আল-বায়ান, ৪/৯০


অষ্টম আয়াত :

أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا

“তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন বিচারক (হাকাম) অনুসন্ধান করব, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন?”
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১১৪

১। কুরতুবি-

ইমাম কুরতুবি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “এখানে বলা হচ্ছে, ‘আমি কি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করবো, যখন তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি তাঁর কিতাবের আয়াতসমূহে বিধানসমূহকে সুস্পষ্ট করেছেন?’ শাব্দিকভাবে ও অর্থের দিক দিয়ে ‘আল-হাকাম’, ‘আল-হাকিম’ অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক ও জোরালো। তাই যিনি হক অনুযায়ী বিচার করেন তিনি ছাড়া আর কেউ হাকাম বলে অভিহিত হবার যোগ্য না। কারণ এটি হল শ্রদ্ধা ও প্রশংসার একটি বিশেষণ। অপরদিকে আল-হাকিম দ্বারা শুধু একটি কাজকে বোঝানো হয়। তাই হক ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে বিচার করা ব্যক্তিকেও হাকিম বলে অভিহিত করা যেতে পারে।”
তাফসির আল-কুরতুবি, ৭/৭০; আরও দেখুন: রুহুল মাআনি, ৮/৮।


নবম আয়াত :

إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ

“অনুসৃতরা যখন অনুসরণকারীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে এবং যখন আযাব প্রত্যক্ষ করবে আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক।”
সুরা আল-বাকারা, ২: ১৬৬

১। তাবারি-

এখানে তাদের কথা বলা হচ্ছে যাদেরকে মানুষেরা মহান আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছে, যাদের কথা আগের আয়াতে এসেছে-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا

‘আর মানবজাতির মধ্যে এমনো লোকও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে।’
সুরা আল-বাকারা, ২: ১৬৫

যাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল তারা অনুসরণকারীদের ত্যাগ করবে। এই আয়াতে এ ইঙ্গিত করা হলে, সুদ্দির ব্যাখ্যা সঠিক। তিনি বলেছেন, এখানে সমকক্ষ/সদৃশ (আনদাদ) দ্বারা ঐসব মানুষকে বোঝানো হয়েছে যাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে লোকেরা গ্রহণ করেছিল এবং যখন তারা আদেশ প্রদান করতো তখন লোকেরা তার আনুগত্য করেছিল। আর এদের অনুসরণের মাধ্যমে তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল। অন্যদিকে মুমিনরা আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তাঁকে ছাড়া অন্য সকলের অবাধ্যতা করে। আর এ আয়াতে শয়তানদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যারা তাদের মনুষ্য অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন/অস্বীকার করবে, এমন ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ এই আয়াতের প্রেক্ষাপট থেকে বোঝা যায় এখানে তাদের কথা বলা হচ্ছে, যারা অন্য মানুষদেরকে মহান আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে।
তাফসির আত-তাবারি, ৩/২৮


দশম আয়াত :

إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ

“নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি তদানুযায়ী মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যেভাবে আল্লাহ আপনাকে শিক্ষাদান করেছেন।”
সুরা আন-নিসা, ৪: ১০৫

১। তাবারি-

ইমাম তাবারি বলেছেন, “‘নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি’—অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি ‘সত্য কিতাব’ অর্থাৎ কুরআন– ‘যাতে আপনি তদানুযায়ী মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন ও আদেশ প্রদান করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান’– অর্থাৎ এই কিতাবে যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন তদানুযায়ী (ফায়সালা করেন ও আদেশ প্রদান করেন)।”
তাফসির আত-তাবারি, ৯/১৭৫

২। ইবনু আতিয়া-

ইবনু আতিয়া বলেছেন, ‘যা আল্লাহ আপনাকে শিক্ষাদান করেছেন’ এর অর্থ হল, (লোকেদের মধ্যে ফায়সালা এবং তাদেরকে আদেশ প্রদান করুন) শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী, ওহির উপর ভিত্তি করে এবং ওহির মূলনীতির আলোকে– আর আল্লাহ নাবিদের মাসুম/ভুলমুক্ত করেছেন (অর্থাৎ ওহির আলোকে নাবিগণ যে সিদ্ধান্ত দেন তা কখনো ভুল হবে না, আল্লাহ স্বয়ং এটা নিশ্চিত করছেন)।”
আল-মুহাররার আল-ওয়াজিয, ৪/২৪৫

উল্লেখিত আয়াতসমূহ ছাড়াও কুরআনের আরও বহু আয়াতে তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে এসেছে। এছাড়া যেসব আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেগুলো উল্লেখ করা হয়নি প্রতিটির ক্ষেত্রে মুফাসসিরিনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে যার সবগুলো উল্লেখ করা এখানে সম্ভব নয়। তবে যতটুকু উল্লেখ করা হয়েছে সত্যান্বেষী পাঠকের জন্য যথেষ্ট হবার কথা। যে শাসক আল্লাহর দীন দ্বারা শাসন করে না, সে কাফির -এটি দীনের মধ্যে সুসাব্যস্ত, সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুপ্রসিদ্ধ একটি সত্য এবং এ নিয়ে উম্মাহর মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। আর এ ব্যাপারে সমস্ত দলিল-প্রমাণের পরও যে ব্যক্তি প্রশ্ন তোলে তার জন্য শাইখ মুহাম্মাদ আমিন আশ-শানকিতির এ বক্তব্যই প্রযোজ্য—

“এ ব্যাপারে শুধু সেই ব্যক্তিই সন্দিহান হতে পারে, আল্লাহ যার দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং ওহির উজ্জল আলোর প্রতি তাকে অন্ধ করে দিয়েছেন।”


বিভ্রান্তির জবাব-

ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, আধুনিক সময়ে আল্লাহর শরিয়াহ দ্বারা শাসনের আবশ্যকতাকে মুসলিমদের ভেতর থেকে দুটি শ্রেণি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে এবং শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন ও শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করে এমন শাসককে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে। এ অংশে এ দুটি শ্রেণি থেকে উপস্থাপিত বক্তব্যের অপনোদন করা হবে।

শরিয়াহ সংস্কার/শরিয়াহ পুনঃব্যাখ্যা/শরিয়াহ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন [Shariah Reform, Re-interpretation of Shariah, Epistemological Change in persprective towards Shariah—“Moderate Modern Islam”] সংক্রান্ত বিভ্রান্তির জবাব

বর্তমান সময়ে শরিয়াহ নিয়ে সবচেয়ে দুঃখজনক এবং ভয়ঙ্কর যে বিচ্যুতি আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হল, একদল লোক প্রচার করা শুরু করেছে আজকের যুগে শরিয়াহ প্রযোজ্য না। এদের কারো কারো মতে শরিয়াহর কিছু অংশ আজ প্রযোজ্য আর কিছু অংশ যেমন– ইসলামি রাষ্ট্র, হুদুদ, জিহাদ, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, হিজাব ও নিকাব, দাড়ি, চার বিয়ের বৈধতা, সমাজে নারীদের চলাচল ও আচরণ এবং নারী ও পুরুষের পারস্পরিক ইন্টার‌্যাকশানের ইসলামি কোড অফ কন্ড্যাক্ট এবং এরকম আরও অনেক কিছু আজ আর প্রযোজ্য না। আবার কারো কারো মতে সম্পূর্ণ শরিয়াহই এখন আর প্রযোজ্য না। বরং আধুনিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি আর চেতনার পাল্লায় আমরা শরিয়াহকে পরিমাপ করবো, আর শরিয়াহর যা কিছু এগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে আমরা তা গ্রহণ করবো, বাকিগুলো বাদ দেব। তাদের ব্যাখ্যা হল এ বিষয়গুলো ছিল রাসুলুল্লাহ এর সময়ের জন্য নির্দিষ্ট, এগুলো এখন আর দীনের অংশ না, অথবা দীনের অংশ হলেও এখন আর প্রযোজ্য না।

মূলত কিছু পশ্চিমা ইসলামি অর্গানাইজেশন এবং কিছু আলিম, শরিয়াহ রিফর্ম, শরিয়াহর রি-ইন্টারপ্রিটেশান, আজকের যুগে শরিয়াহ প্রযোজ্য না, কিংবা শরিয়াহ নিয়ে মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গির জ্ঞানতাত্বিক ও কাঠামোগত আমূল পরিবর্তনের [epistemological change] প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করছেন। এদের মধ্যে আছেন তারিক রামাদান, হামযা ইউসুফ ও যাইতুনা ইন্সটিটিউট, ইয়াসির কাদি এবং আল-মাগরিব ইন্সটিটিউট ও মুসলিম ম্যাটারস ডট অর্গ, তাউফিক চৌধুরী, নুমান আলী খান এবং আল বাইয়িনাহ ইন্সটিটিউট, আইসিএনএ (ইকনা), আইএসএনএ (ইসনা) এবং অন্যান্য আরও অনেকে।

দুঃখজনকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশেও এরকম কিছু দায়ি এবং দাওয়াহ ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেছে যারা এমন কিছু বিষয় প্রচার করছে যা কুরআন, সুন্নাহ, সালাফ আস-সালিহিনের ইজমা, ১৪০০ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুফাসসিরিন, মুহাদ্দিসিন, ফুকাহা এবং উলামার ইজমা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা তাদের এসব নব-উদ্ভাবিত বক্তব্যের দিকে তাকাই, যা তারা হক বলে প্রচার করছে, অপরদিকে আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসুল (ﷺ) এর সুন্নাহ ও সালাফদের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের দিকে তাকাই, উভয়ের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তারপর আমরা তাকাই অ্যামেরিকান তথা ওয়েস্টার্ন পলিসির দিকে, CFR [Council On Foreign Relations], Trilateral Commission, RAND Corporation এর মতো প্রতিষ্ঠানের ইসলামের ব্যাপারে পলিসি সাজেশানের দিকে আর অবাক বিস্ময়ে দেখি, প্রথমটা পরেরটার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়।

যারা এরকম অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং প্রচার করছেন, যারা বলছেন শরিয়াহ দিয়ে শাসন আজকের সময়ে আবশ্যক না, কিংবা যারা বলছেন শরিয়াহ দিয়ে শাসন করা হবে যখন অধিকাংশ মানুষ তা চাইবে- কিংবা বলছেন ইসলামের কোন একটি বিধান, কোন একটি আহকাম, কোন একটি ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি যা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সময় প্রযোজ্য ছিল কিন্তু এখন তা আর প্রযোজ্য না– তাদের জবাবে ইমাম ইবনু হাযমের এই বক্তব্যই যথেষ্ট।


আল্লাহর বিধান পরিত্যাগ সম্পর্কে ইবনু হাযমের বক্তব্য-

আল্লামা আবু মুহাম্মাদ আলি ইবনু আহমাদ ইবনু সায়িদ ইবনু হাযম রাহিমাহুল্লাহ বলেন —
“আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের বলেছেন,

اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا

‘...আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’
সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৩

তিনি আরো বলেছেন,

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন (জীবনাবিধান) তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’
সুরা আলে-ইমরান, ৩: ৮৫

অতএব যে বলবে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কোন একটি বিধান আজ আর প্রযোজ্য না, অথবা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের পর বিধান বদলে গেছে, সে লোক তো ইতিমধ্যেই ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে নিজের দীন হিসেবে গ্রহণ করেছে। কারণ যেসব ইবাদাত, বিধান এবং হালাল বা হারামকৃত কাজ ও বস্তু এবং দীনের আবশ্যক বিষয় হিসেবে যা যা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সময় নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে, সেটাই হল ঐ ইসলাম যা দিয়ে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ আমাদের প্রতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদের জন্য পছন্দ করেছেন। এটাই ইসলাম, এছাড়া অন্য কোন ইসলাম নেই।

সুতরাং যে ইসলাম থেকে কোন কিছু ছেড়ে দেবে সে তো ইতিমধ্যেই ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। আর যে এর বাইরে (রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সময়ের ইসলামের বদলে) অন্য কিছু বলবে, সে ইতিমধ্যেই ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর কথা বলছে। এতে কোন সন্দেহ নেই, এর (ইসলামের) কোন অংশের ব্যাপারেই সন্দেহ নেই, কারণ আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যেই এই দীনকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেছেন।

আর যে দাবি করে কুরআনের কোন অংশ কিংবা কোন বিশ্বাসযোগ্য সহিহ হাদিস রহিত হয়ে গেছে (অর্থাৎ কোন আয়াত বা কোন বিষয় নিয়ে আয়াতসমূহ বা কোন হাদিস বা কোন বিষয় নিয়ে হাদিস এখন আর প্রযোজ্য না) এবং সে তার দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ আনতে পারে না, কিংবা এমন কোন দলিল আনতে পারে না, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় তার দাবি অনুযায়ী কোন আয়াত রহিত হয় গেছে —এমন ব্যক্তি হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার উপর মিথ্যারোপকারী এবং শরিয়াহ বর্জনের দিকে আহ্বানকারী। সে ইতিমধ্যেই ইবলিসের দিকে আহ্বানকারীতে পরিণত হয়েছে এবং সে আল্লাহর রাস্তায় চলার পথে মানুষকে বাধা দিচ্ছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন,

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ

‘নিশ্চয় আমি এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।’
সুরা আল-হিজর, ১৫: ৯

সুতরাং যে দাবি করে, কুরআন রহিত হয়ে গেছে (শরিয়াহ আজ আর প্রযোজ্য না, কুরআনের কোন অংশ, কোন আয়াত বা কোন হুকুম আজ আর প্রযোজ্য না), সে তো তার রবের ব্যাপারে মিথ্যাচার করেছে। সে দাবি করছে আল্লাহ স্বয়ং এই কিতাব নাযিল করার পর তা সংরক্ষণ করেন নি।”
আল-ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম, ১/২৭০-২৭১

অপরিবর্তনীয় কে পরিবর্তন করা যায় না। শরিয়াহ যেভাবে আছে, শরিয়ার যে ব্যাখ্যা এবং দৃষ্টিভঙ্গি সালাফদের থেকে আমরা পেয়েছি সেটিই একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। যুগ, সমাজ কিংবা শাসকের ইচ্ছা-পলিসির সাথে তাল মিলিয়ে আমরা শরিয়াহকে বদলাতে পারি না। একইভাবে আমাদের খেয়ালখুশি মতো, আমাদের সুবিধামতো শরিয়াহর সংস্কার, পুনঃব্যাখ্যা কিংবা শরিয়াহর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি না। শরিয়াহ নাযিল করা হয়েছে যাতে মানবজাতি এই শরিয়াহ অনুযায়ী নিজেদের বদলে নেয়। আমরা তার বদলে আমাদের পছন্দমত, আমাদের ইচ্ছেমত শরিয়াহকে বদলে নিতে, চেরিপিকিং করতে, মডিফাই করতে পারি না। যা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাতে হাত দেয়ার অধিকার আমাদের নেই। মুসলিমদের কাজ হল দুনিয়াকে শরিয়াহ-কমপ্লায়েন্ট বা শরিয়াহসম্মত বানিয়ে নেয়া। শরিয়াহকে দুনিয়া-কমপ্লায়েন্ট করতে চাওয়াটা মারাত্মক পর্যায়ের বিচ্যুতি। আমরা এমন বিচ্যুতিতে আপতিত হওয়া থেকে, পথহারাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে এবং যারা আল্লাহর ক্রোধের উদ্রেক করেছে তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।


শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত বিভ্রান্তির জবাব
-

প্রচলিত দ্বিতীয় বিচ্যুতিটি হল শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত। ইতিপূর্বে শরিয়াহকে পরিবর্তন, সংস্কার, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সংক্রান্ত যে বিভ্রান্তিটি আলোচিত হয়েছে তার সৃষ্টি হয়েছে ইসলামকে পশ্চিমা বিশ্বের মাপকাঠি অনুযায়ী একটি গ্রহণযোগ্য রূপ দেওয়ার জন্য। একারণে যা কিছু পশ্চিমা সেনসিবিলিটি, পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যায়, সেসব কিছু বাদ দেওয়া বা পুনঃব্যাখ্যা বা সংস্কারের একটি প্রবণতা মর্ডানিস্টদের মধ্যে দেখা যায়। আর শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত যে বিচ্যুতিটি, তা গড়ে উঠেছে মুসলিম ভূমিসমূহের শাসকদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য। এ বিচ্যুতিটি আমাদের দেশে অধিক প্রচলিত, বিশেষ করে যারা নিজেদের “আহলে হাদিস” দাবি করেন তাদের মধ্যে। দুঃখজনক বিষয় হল যদি আসলেই হাদিসের অনুসরণ করার মানসিকতা সব “আহলুল হাদিস” দাবিদারের মধ্যে থাকতো তবে এ বিষয় নিয়ে কোন কথা বলারই প্রয়োজন হতো না। কারণ এ ব্যাপারে শরিয়াহর বক্তব্য সুস্পষ্ট।

শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত এ বিভ্রান্তির প্রচারকদের বক্তব্য নিম্নরূপ—

“শাসকের আনুগত্য করতে হবে। শাসকের আনুগত্য করার আবশ্যকতা সাহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যতক্ষণ শাসক সালাত কায়েম রাখবে ততোক্ষণ তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া যাবে না। আনুগত্য করতে হবে। বিদ্রোহ করা যাবে না। এটাই শরিয়াহর বিধান।”

তাদের এই বক্তব্যের পক্ষে দুটি যুক্তি উপস্থাপিত হয়—

১) শাসকের আনুগত্যের হাদিস

২) ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর কুফর দুনা কুফর উক্তি

আমরা এ দুটো বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করবো এবং প্রমাণ করবো কোন কোন শারয়ি কারণে এ অবস্থান বাতিল। আমাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে আমরা যে দলিল প্রমাণগুলো পেশ করবো তা হল—

কোন্ শাসকের আনুগত্য করতে হবে— হাদিস থেকে তার প্রমাণ

কুফর দুনা কুফর সংক্রান্ত আলোচনা ও এর সঠিক ব্যাখ্যা

তাগুতকে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করার আবশ্যকতা

যে শাসক শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে না তার কাফির হবার ব্যাপারে ইজমা। (যা ইতিমধ্যে দলিল-প্রমাণ এবং অতীত ও বর্তমান আলিমগণের বক্তব্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে)


কোন্ শাসকের আনুগত্য করতে হবে?

একথা সত্য রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে শাসকের আনুগত্য করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে বেশ কিছু হাদিস আছে। যেমন—

১। হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে; তারপর আল্লাহ আমাদের জন্য মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ....আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে, যারা আমার হিদায়াতে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে, যাদের অন্তঃকরণ হবে মানবদেহে শয়তানের অন্তঃকরণ। রাবি বলেন, আমি বললাম, তখন আমরা কি করবো ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? তিনি বললেন, তুমি শুনবে এবং মানবে; যদিও তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সস্পদ কেড়ে নেয়া হয়।
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদিস নং ৪৬৩২ (ই.ফা)

২। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার আমিরের মধ্যে এমন কোন ব্যাপার প্রত্যক্ষ করবে, যা সে অপছন্দ করে তবে সে যেন ধৈর্যধারণ করে, কেননা যে ব্যক্তি জামায়াহ থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সরে গেল এবং এ অবস্হায় মৃত্যুবরণ করল সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুই বরণ করলো।’
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, ৪৬৩৭

৩। উম্মু সালামাহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, অচিরেই এমন কতক আমিরের উদ্ভব ঘটবে তোমরা তাদের চিনতে পারবে এবং অপছন্দ করবে। যে তাদের স্বরূপ চিনল সে মুক্তি পেল এবং যে তাদের অপছন্দ করল, সেও নিরাপদ হল। কিন্তু যে তাদের পছন্দ করল এবং অনুরসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হল)। লোকেরা জানতে চাইল আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব না? রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যতক্ষণ তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ততক্ষণ না।
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, ৪৬৪৭

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আসলেই হাদিস আছে, যেখানে বলা হয়েছে শাসকের আনুগত্য করতে, নিজের পছন্দে ও অপছন্দে, ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়, যদি শাসক যালিম হয়, যদি শাসক অত্যাচার করে তবুও, যদি জনগণ ও শাসক পরস্পরকে ঘৃণা করে, তবুও। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়— এই আনুগত্য কি সব শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? শাসক যদি কাফির, মুশরিক, মুরতাদ হয়? শাসক যা-ই দিয়ে শাসন করুক না কেন, বাইবেল-গীতা-অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন কিংবা অন্য কোন মানুষের তৈরি সংবিধান— তারপরও আনুগত্য করতে হবে? সে যদি আল্লাহ যা হারাম করেছেন সেটাকে হালাল করে (যেমন সুদ), কিংবা আল্লাহ যা হালাল করেছে তা হারাম করে (যেমন জিহাদ, হিজরত) তবুও কি তার আনুগত্য করতে হবে? রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কি আমাদের এই নির্দেশই দিয়ে গেছেন?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য আরও কিছু হাদিসের দিকে তাকানো যাক—

১। ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আমার দাদী থেকে শুনেছি, তিনি নবি (ﷺ) -এর বিদায় হজের ভাষণ দানকালে তাঁকে বলতে শুনেছেন, ‘যদি তোমাদের উপর একজন গোলামকেও কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালনা করে, তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে।’
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ: ৪৬০৬

২। ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন রাহিমাহুল্লাহর দাদী উম্মুল হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত। রাবি ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন বলেন, আমি তাকে বলতে শুনেছি― ‘আমি বিদায় হজে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে হজ আদায় করি। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তখন অনেক কথাই বলেছিলেন। এরপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, যদি তোমাদের উপর কোন হাত পা কাটা গোলামকেও আমির নিযুক্ত করা হয় (ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন বলেন) আমার ধারণা হয় তিনি (তার দাদী) আরও বলেছেন, কালো (অর্থাৎ কৃষ্ণকায় হাবশি গোলাম) আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে।’
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ: ৪৬১০

৩। ইবনু উমার (রাঃ) এর সূত্রে নাবি (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হচ্ছে শোনা ও মানা তার প্রতিটি প্রিয় ও অপ্রিয় ব্যাপারে- যে যাবৎ না তাকে আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ করা হয়। যদি আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ তাকে দেয়া হয় তাহলে তা শুনতে হবে না, মানতেও হবে না।’
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ: ৪৬১১

৪। আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) একটি বাহিনী প্রেরণ করেন এবং এক ব্যক্তিকে তার আমির নিযুক্ত করে দেন। সে একটা আগুন প্রজ্জ্বলিত করলো এবং তাদেরকে তাতে ঝাঁপ দিতে নির্দেশ দিল। একদল লোক তাতে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলো এবং অপর একদল বললো, আমরা (ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তো) আগুন থেকেই আত্মরক্ষা করেছি। (সুতরাং আগুনে ঝাঁপ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না)। যথা সময়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর দরবারে সে প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো। তখন তিনি যারা আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয়েছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তখন তোমরা যদি সত্যি সত্যি আগুনে ঝাঁপ দিতে তবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাতেই অবস্থান করতে। পক্ষান্তরে অপরদলকে লক্ষ্য করে তিনি উত্তম কথা বললেন। তিনি বললেন, আল্লাহর অবাধ্যতায় কোনো আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবলই সৎ কাজে।
সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ: ৪৬১৩

৫। উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা বাইয়াত হলাম। তিনি তখন আমাদেরকে যে শপথ করান তার মধ্যে ছিল— ‘আমরা শুনবো ও মানবো, আমাদের অনুরাগে ও বিরাগে, আমাদের সংকটে ও স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দিলেও, আর যোগ্য ব্যক্তির সাথে আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, ‘যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’
সহিহ মুসলিম: ৪৬১৯ (ই.ফা)

৬। আল্লাহর নাফরমানির কাজে কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবলমাত্র ন্যায়সঙ্গত কাজে।
বুখারি ৭২৫৭, মুসলিম: ১৮৪০

৭। আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন মানুষের আনুগত্য নেই।
মুসনাদ আহমাদ: ১০৯৮

৯। ইমরান বিন হুসাইন বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহর অবাধ্যতা করে এমন কারো প্রতি আনুগত্য নেই।”
মুসনাদ আহমাদ, ৫/৬৬; আলবানি সহিহ বলেছেন।

১০। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই।”
বুখারি: ৪৩৪০, মুসলিম: ১৮৪০, নাসায়ি: ৪২০৫, আবু দাউদ: ২৬২৫, আহমাদ, ১/১৩১

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যে সত্যবাদী রাসুল (ﷺ) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন শাসকের আনুগত্য করার তিনিই আনুগত্যের ব্যাপারে বেশ কিছু শর্তও আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন—

১। আল্লাহর কিতাব দ্বারা শাসন করা শাসকের আনুগত্য করতে হবে; সে অত্যাচারী হলেও, হাবশি, বিকৃত শরীরের গোলাম হলেও, তাকে আমাদের অপছন্দ হলেও, সে আমাদের প্রহার করলেও।

২। আনুগত্য হবে আল্লাহর বাধ্যতায়।

৩। আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।

৪। আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না শাসকের মধ্যে কোন প্রকাশ্য কুফরি দেখা যাবে এবং সে কাজ কুফরি হবার ব্যাপারে শরিয়ার সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।

এছাড়া স্বয়ং আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের আনুগত্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন—

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُوْلٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللّٰهِ

“বস্তুতঃ আমি এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়।”
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬৪

এই আয়াতটি এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে, কারণ ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহ কসম করে বলছেন রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে বিচারক এবং তাঁর আনীত শরিয়াহর শাসন মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত কেউ ইমানদারই হতে পারবে না। এখান থেকে সুস্পষ্ট আল্লাহ, রাসুলের প্রতি আনুগত্য ফরয করছেন এবং তা সংযুক্ত করেছেন ‘আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা’র সাথে। যদি খোদ রাসুলের ক্ষেত্রে আনুগত্য করা হবে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী বলে আল্লাহ আমাদের জানিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে কিভাবে শাসকের ক্ষেত্রে আল্লাহর বিরোধিতায় আনুগত্য থাকতে পারে?

এ কারণে শাসকের আনুগত্য সম্পর্কিত সকল হাদিস থেকে দুটো জিনিস স্পষ্টভাবে বোঝা যায়—

১। ‘শাসকের আনুগত্য করতে হবে’ এ আদেশ ঐ শাসকের ব্যাপারে প্রযোজ্য, যে শাসন করে কিতাবুল্লাহ তথা শরিয়াহ দ্বারা।

২। ‘শাসকের আনুগত্য করতে হবে’ এ আদেশ কোন কাফির-মুশরিক-মুরতাদ শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না।

আল্লাহ বলেন,

وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا

আল্লাহ সুব. মুমিনদের উপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার কাফিরদের জন্য রাখেন নি।
সুরা আন-নিসা, ৪: ১৪১

আল্লামা ইবনুল মুনযির রহ. বলেন,

“গ্রহণযোগ্য সকল আলিম এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, কাফিরের জন্য কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের উপর কর্তৃত্ব নেই।”
আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ২/৪১৪

মোল্লা আলি কারি রহ. বলেন,

“আলিমগণ একমত হয়েছেন যে, কোনো কাফির শাসনভার পেতে পারে না। যদি শাসক হবার পর তার উপর কুফর আপতিত হয়, তবে সে অপসারিত হবে। একই হুকুম বর্তাবে যদি সালাত কায়েম, সালাতের দিকে আহবান ছেড়ে দেয়, অথবা বিদয়াহ করে।”
মিরকাত, ১১/৩০৩

আর ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

“কাযি ইয়ায বলেছেন, আলিমদের ইজমা হল নেতৃত্ব (ইমামাহ) কখনো কাফিরের উপর অর্পণ করা যাবে না, আর যদি (কোন নেতার) তার পক্ষ থেকে কুফর প্রকাশিত হয় তবে তাকে হটাতে হবে...। সুতরাং যদি সে কুফর করে এবং শরিয়াহ পরিবর্তন করে অথবা তার পক্ষ থেকে গুরুতর কোন বিদয়াহ প্রকাশিত হয়, তবে সে নেতৃত্বের মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে, তার আনুগত্য পাবার অধিকার বাতিল হয়ে যাবে, আর মুসলিমদের জন্য আবশ্যক হয়ে যাবে তার বিরোধিতা করা, বিদ্রোহ করা, তার পতন ঘটানো এবং তার স্থলে একজন ন্যায়পরায়ণ ইমামকে বসানো― যদি তারা (মুসলিমরা) সক্ষম হয়। যদি একটি দল (তায়িফাহ) ব্যতীত অন্যান্য মুসলিমদের পক্ষে এটা করা সম্ভব না হয়, তবে যে দলের সক্ষমতা আছে তাদের জন্য এই কাফিরের (শাসকের) বিরোধিতা করা, বিদ্রোহ করা এবং তার পতন ঘটানো অবশ্য কর্তব্য। আর যদি শাসক কাফির না হয়ে শুধুমাত্র বিদয়াতি হয়, তবে এটা বাধ্যতামূলক হবে না, যদি তারা সক্ষম হয় তবে তারা তা করবে। আর যদি কেউই সক্ষম না হয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে বিদ্রোহ করা আবশ্যক না, তবে তখন মুসলিমদের সেই ভূমি থেকে অন্য কোথাও হিজরত করতে হবে, নিজেদের দীন হিফাযতের জন্য।”
শারহু সাহিহ মুসলিম, ১২/২২৯

সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, শাসকের আনুগত্যের হাদিসগুলোতে ঐ মুসলিম শাসকদের কথা বলা হচ্ছে যারা শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে। মুসলিম শাসক যদি শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে, তবে সে যদি ফাসিক হয়, যালিম হয় তবুও আল্লাহর বাধ্যতার ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু যে শাসক প্রকাশ্য কুফরি (كفر بواح) করে, আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দেয় এবং যে ‘আসলি কাফির’ অথবা কাফিরে পরিণত হয়েছে তার আনুগত্য যে করতে হবে না এটা হাদিস থেকেই প্রমাণিত।

যারা কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই শাসকের আনুগত্য করার কথা বলেন, তারা দলিল হিসেবে সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে পারেন—

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ أٰمَنُوْا أَطِيْعُوا اللّٰهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, নির্দেশ মান্য করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় তাদের।”

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত তাদের বিপক্ষে দলিল। ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসিরে উপরের হাদিসগুলো এনেছেন, এরপর স্পষ্টভাবে বলেছেন— আনুগত্যের বিষয়টি শুধুমাত্র আল্লাহর বাধ্যতা এবং ওহি অনুযায়ী শাসন-মীমাংসা এবং ফায়সালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া আল্লাহ এ আয়াতে বলেছেন, ‘ওয়া উলিল আমরি মিনকুম’ অর্থাৎ তোমাদের মধ্য থেকে যারা নেতৃস্থানীয়। আর এতো সুস্পষ্ট সত্য যে, কাফির, মুশরিক ও মুরতাদিন কখনোই মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত না।

সুতরাং হাদিস এবং কুরআন থেকে প্রমাণিত হয় আনুগত্য ঐ মুসলিম শাসকের ক্ষেত্রে আবশ্যক, যে শাসন করে শরিয়াহ দিয়ে। যে শাসক শরিয়াহর বদলে মানবরচিত কোন সংবিধান দিয়ে শাসন করে তার আনুগত্য করতে মুসলিমদের আদেশ করা হয় নি। বরং কাযি ইয়ায রাহিমাহুল্লার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট মুসলিমদের কর্তব্য হল এমন শাসকের বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করা।


কুফর দুনা কুফর

শাসকের আনুগত্যের পক্ষে আরেকটি অত্যন্ত দুর্বল কিন্তু কিছু কিছু বলয়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি অজুহাত হচ্ছে “কুফর দুনা কুফর” উক্তিটির অপব্যাখ্যা। এ অংশে আমরা দেখবো—

১। এ উক্তিটির সনদ বা বর্ণনাসূত্র কতটা সাহিহ?

২। কুফর দুনা কুফরের সঠিক ব্যাখ্যা কী?

৩। কুফর দুনা কুফর দিয়ে আদৌ আজকের শাসকদের বৈধতা দেয়া যায় কি না— এ ব্যাপারে আলিমদের বক্তব্য।

এ অংশটি পড়ার আগে শরিয়াহর কিছু পারিভাষিক শব্দ সম্পর্কে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

কুফর আসগর (كفر أصغر)— ছোট কুফর, যার কারণে মানুষ কাফিরে পরিণত হয় না।

কুফর আকবার (كفر أكبر)— বড় কুফর, যা মানুষকে কাফিরে পরিণত করে।

কুফর দুনা কুফর (كفر دون كفر)— ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র দিকে সম্বন্ধিত একটি উক্তি। কুফর দুনা কুফর হলো এমন কাজ, যা কুফর কিন্তু তা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। অর্থাৎ কুফর আসগর।


কুফর দুনা কুফর সংক্রান্ত বর্ণনা

হাকিম বলেছেন, আহমাদ ইবনু সুলাইমান আল-মাওসিলি আমাদের জানিয়েছেন, আলি ইবনু হারব আমাদের বলেছেন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনাহ আমাদের বর্ণনা করেছেন হিশাম ইবনু হুজাইর থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন তাউস থেকে, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,

“এটা ঐ কুফর না, যা তারা নির্দেশ করছে। এটা ঐ কুফর না যা ব্যক্তিকে মিল্লাহ (দীন ইসলাম) থেকে বের করে দেয়। ‘...যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।’ এটা কুফর দুনা কুফর (অর্থাৎ ঐ কুফর, যা কুফর আকবার অপেক্ষা কম বা নিম্ন পর্যায়ের)।”
মুসতাদরাক আল-হাকিম, ৩/৩৭৫

কুফর দুনা কুফর দ্বারা শাসকের আনুগত্যপন্থীরা কী বোঝায়?

যারা ‘কুফর দুনা কুফর’ উক্তিটিকে শাসকের আনুগত্যের স্বপক্ষে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চান, তাদের বক্তব্য হল— ‘আল্লাহর আইনদ্বারা শাসন না করা ব্যক্তির কুফর হল, কুফর আসগর। এ কারণে, যে শাসক আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করে না সে কাফির না এবং একারণে শাসকের আনুগত্যের হাদিস অনুসারে এসব শাসকদের আনুগত্য করা আবশ্যক। আর এটাই সাইয়িদুনা ইবনু আব্বাসের অবস্থান।’

ইতিমধ্যে আমরা যা উপস্থাপন করেছি তার আলোকেই এ অবস্থান বাতিল বলে প্রমাণিত হয়। কেননা—

প্রথমত, কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ এবং আলিমগণের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করা ব্যক্তি কাফির।

দ্বিতীয়ত, এই উক্তিটি ব্যবহার করা হয় সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর আয়াতের ব্যাপারে। কিন্তু যদি উক্ত আয়াতকে আমরা দলিল হিসেবে উপস্থাপন নাও করি, তবুও অন্যান্য আরও বহু আয়াত আছে যেগুলো সুস্পষ্ট এবং যেগুলোর মাধ্যমে শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করা ব্যক্তি কাফির ও শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোন শাসন কামনাকারী কাফির হিসেবে প্রমাণিত হয়।

তৃতীয়ত, শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত হাদিসসমূহের আলোচনায় আমরা দেখেছি, আনুগত্যের যে আদেশ হাদিস থেকে আমরা পাই তা প্রযোজ্য শুধুমাত্র শরিয়াহ দ্বারা শাসনকারী মুসলিম শাসকের ক্ষেত্রে। কুফর দ্বারা শাসনকারী কাফিরের ক্ষেত্রে নয়। আনুগত্য কেবল আল্লাহর বাধ্যতার ক্ষেত্রে, অবাধ্যতার ক্ষেত্রে নয়। বরং আলিমগণের ইজমা হল কাফিরকে শাসনভার দেয়া যাবে না। শাসক যদি কাফির হয় বা প্রকাশ্য কুফরি তার থেকে প্রকাশ পায় তবে তার বিরোধিতা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কর্তব্য।

যদিও এসব কারণে ‘কুফর দুনা কুফর’-এর আড়ালে বর্তমান শাসকদের বৈধতা দেয়ার এই দুর্বল প্রচেষ্টাকে সহজেই বাতিল বলে প্রমাণ করা যায়, তবুও আমরা কুফর দুনা কুফর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যাতে করে কারো মধ্যে এ বিষয়ে সংশয়ের ছিঁটেফোটাটুকুও না থাকে এবং অপব্যাখ্যাকারীদের অপব্যাখ্যা যেন তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে।



‘কুফর দুনা কুফর’ উক্তিটির বর্ণনাসূত্র কতটা গ্রহণযোগ্য?


প্রথমে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই বর্ণনাটির সানাদ সাহিহ হওয়া সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। যারা এই বর্ণনাটির সানাদ সাহিহ বলে মনে করেন না তাদের বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলঃ

১। হাকিম বলেছেন, আহমাদ ইবনু সুলাইমান আল-মাওসিলি আমাদের জানিয়েছেন, আলি ইবনু হারব আমাদের বলেছেন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনাহ আমাদের বর্ণনা করেছেন হিশাম ইবনু হুজাইর থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন তাউস থেকে, তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন…।

ইবনু আবি হাতিমও তার তাফসির গ্রন্থে একই সানাদে বর্ণনা করেছেন, হিশাম ইবনু হুজাইর বর্ণনা করেছেন তাউস থেকে, আর তাউস বর্ণনা করেছেন ইবনু আব্বাস থেকে।

বেশ কিছু কারণে এই বর্ণনাটি দুর্বল। প্রথম কারণ হল, এই সানাদে হিশাম ইবনু হুজাইর আছেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন, সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা, ইয়াহহিয়া ইবনু সায়িদ এবং অন্যান্যরা হিশাম ইবনু হুজাইরকে দুর্বল ঘোষণা করেছেন।
আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল, ১/৮৩; আল-জারহু ওয়াত তাদিল, ৩/ ২৫৯; তাহযিবুত তাহযিব, ৬/২৫; আল-কামিল ফি দুআফায়ির রিজাল, ১/১১৫, আদ-দুআফাউল কাবির, ৪/২৩৮, তাহযিবুল কামাল, ৩০/১৭৯

দ্বিতীয় কারণ হল, তাউস থেকে শুধুমাত্র হিশাম ইবনু হুজাইরই এই শব্দাবলি (অর্থাৎ ‘কুফর দুনা কুফর’)সহ বর্ণনা করেছেন, আর কোন বর্ণনাকারী এই শব্দাবলি বর্ণনা করেন নি। তাউসের সকল সঙ্গীদের মধ্যে শুধুমাত্র হিশাম ইবনু হুজাইর কর্তৃক তাউস থেকে এই শব্দাবলি বর্ণিত হওয়া আরেকটি দুর্বলতা। একে বলা হয় তাফাররুদ।

তৃতীয়ত, হিশামের এই বর্ণনা তার অপেক্ষা অধিক গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে আব্দুল্লাহ ইবনু তাউসের বর্ণনার সাথে। কারণ আব্দুলুল্লাহ ইবনু তাউস তার পিতা থেকে এটা বর্ণনা করেছেন, তিনি ‘কুফর দুনা কুফর’ এর পরিবর্তে বলেছেন, ‘এটা হল কুফর’।
তাফসির আবদুর রাযযাক, ১/১৮৬, জামিউল বায়ান, ১০/৩৫৬

যদি ‘কুফর দুনা কুফর’ এর সানাদ দুর্বলই হয়ে থাকে তাহলে কেন হাকিম একে সাহিহ বলেছেন এবং আলবানি বলেছেন, ‘বুখারি ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সাহিহ’?

সম্ভবত এরকম বলার পেছনে কারণ হল— হিশাম ইবনু হুজাইর থেকে সাহিহ বুখারি ও সাহিহ মুসলিমে বর্ণনা আছে। কিন্তু তার উপরে এই ইমামদ্বয় নির্ভর করেন নি। অর্থাৎ বুখারি ও মুসলিম অনেক ক্ষেত্রেই সাহিহ সানাদের হাদিস বর্ণনা করার পর সেগুলোর আগে অথবা পরে, আনুষঙ্গিক বর্ণনা হিসেবে একই হাদিসের ঐসব বর্ণনা এনেছেন যেটাতে একজন দুর্বল বর্ণনাকারী আছে। হিশাম ইবনু হুজাইর এরকম শুধুমাত্র একটি বর্ণনাসূত্রে সাহিহ বুখারিতে আছে এবং মাত্র দুটি বর্ণনাসূত্রে সাহিহ মুসলিমে আছে।

সাহিহ বুখারিতে আছে নবি সুলাইমান ইবনু দাউদ আলাইহিস সালামের হাদিসের সানাদে—

‘সুলাইমান আলাইহিস সালাম একদা বলেছিলেন, অবশ্যই আজ রাতে আমি নব্বইজন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব…।’ এটি বর্ণিত হয়েছে শপথের কাফফারা অধ্যায়ে। কিন্তু বিয়েশাদি অধ্যায়ে একই হাদিসের বর্ণনায় হিশাম ইবনু হুজাইরের বদলে আব্দুল্লাহ ইবনু তাউসকে রাখা হয়েছে।

একইভাবে, সাহিহ মুসলিমের শুধুমাত্র দুটি হাদিসের সানাদে হিশাম ইবনু হুজাইর আছে। আর ইমাম মুসলিম শুধুমাত্র তখনই হিশাম ইবনু হুজাইরের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন যখন একই হাদিসের অন্য সানাদে অন্য বর্ণনাকারী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রথম বর্ণনাটি হল সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর হাদিসটি, যা একেবারে একই শব্দাবলি এবং সানাদে বর্ণিত হয়েছে। ঠিক এর পরের বর্ণনাতেই হিশামের জায়গায় আব্দুল্লাহ ইবনু তাউস এসেছেন, যেমনটা সাহিহ বুখারিতে হয়েছে।

আর হিশাম ইবনু হুজাইর থেকে সাহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনাটি হল— আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস বলেন, মুয়াবিয়া আমাকে বললেন, ‘তুমি কি জান আমি মারওয়াতে কাঁচি দিয়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর মাথা থেকে চুল কেটেছিলাম?’ তখন আমি তাকে বললাম, ‘এটা আমাদের পক্ষে একটি যুক্তি...।’ ঠিক এর পরের বর্ণনাতেই সানাদে হিশামের জায়গায় হাসান ইবনু মুসলিম আছেন।

এ ব্যাপারে আরও জানার জন্য দেখুন— ‘খুলাসাতুল কাওলিল মুফহিম আলা তারাজিমি রিজালি জামিয়িল ইমাম মুসলিম’।

অতএব, যদিও হাকিম, আলবানি এবং আরও কেউ কেউ একে সাহিহ বলেছেন, কিন্তু তারা খুব সম্ভবত তা বলেছেন এ ব্যাপারগুলোর (বুখারি ও মুসলিমে সর্বমোট তিনটি বর্ণনার সানাদে হিশামের উপস্থিতি) উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এটা রাবিদের সাহিহ হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হবার নিশ্চিত পদ্ধতি না। এটা ইমাম বুখারি ও মুসলিম হিশাম থেকে শুধুমাত্র ঐসব বর্ণনা গ্রহণ করেছেন, যা অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত– এ থেকেও এটাই প্রতিভাত হয়।

শুধুমাত্র ইমাম হাকিমের তাহকিকের উপর ভরসা করা যথেষ্ট নয়— এ ব্যাপারটি আলোচিত হয়েছে ইবনু তাইমিয়্যাহর ‘কায়িদাতুন জালিলাহ ফিত তাওয়াসসুলি ওয়াল ওয়াসিলাহ’ পৃ. ১৭০-১৭১, ইবনুল কাইয়িমের ‘আল-ফারুসিয়্যাহ’ পৃ. ২৪৫ ও ২৭৬, ইমাম যাহাবির ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা” ১৭/১৭৫, ইবনু হাজারের ‘আন-নুকাত’ ১/৩১৪-৩১৮ এবং অন্যত্র।

দ্বিতীয়ত: ‘কুফর দুনা কুফর’ বর্ণনাটির আরেকটি দুর্বলতা হল— তাউস থেকে শুধুমাত্র হিশাম ইবনু হুজাইর এই শব্দাবলি বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ এটি তাফাররুদ (শুধুমাত্র একজন রাবি থেকে বর্ণিত)। তাউসের সকল সঙ্গীদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র হিশামই এ শব্দে বর্ননা করেছে। এটি একটি বড় দুর্বলতা। কারণ তাউসের সঙ্গী অন্যান্য বিখ্যাত বর্ণনাকারীরা, যেমন আমর ইবনু দিনার, আব্দুল্লাহ ইবনু তাউস (তাউসের ছেলে), ইবরাহিম ইবনু মাইসারাহ, আবু যুবাইর আল-মাক্কি এবং হাসান ইবনু মুসলিম ইবনু ইয়ান্নাক কেউই এটি বর্ণনা করেন নি। পাশাপাশি তাউসের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন (সাহিহ অথবা দুর্বল সূত্রে) এমন কোন বর্ণনাকারী (এবং তাদের সংখ্যা কয়েক ডজন) এই শব্দাবলি বর্ণনা করেন নি। তাদের মধ্যে আছেন— হাকাম ইবনু উতায়বাহ, আবদুল কারিম আল-জাযারি, ইবরাহিম আল-আখনাসি, সুলাইমান আত-তাইমি, হানযালা ইবনু আবি সুফিয়ান, উসামা ইবনু যায়িদ আল-লাইসি, হাবিব ইবনু আবি সাবিত, উবায়দুল্লাহ ইবনু ওয়ালিদ আল-ওয়াসিফি, সাদ ইবনু সিনান আশ-শায়বানি, সুলায়মান আল-আহওয়াল, আমর ইবনু কাতাদাহ, ইবরাহিম ইবনু ইয়াযিদ আল-খুযি, সুলাইমান ইবনু মুসা আদ-দিমাশকি, সায়িদ ইবনু হাসসান, আবু শুয়ায়িব আত-তায়ালিসি, সাদাকাহ ইবনু ইয়াসার, যাহ্হাক ইবনু মুযাহিম, আমির ইবনু মুসআব, আব্দুল্লাহ ইবনু আবি নাজিহ, আবদুল কারিম আবু উমাইয়াহ আল-বাসরি, আবদুল মালিক ইবনু জুরাইয়ি, আব্দুল মালিক ইবনু মাইসারাহ, আতা ইবনু আস-সায়িব, ইকরিমা ইবনু আম্মার, আবু আব্দুল্লাহ আশ-শামি, আমর ইবনু শুয়ায়িব, আমর ইবনু মুসলিম আল-জানাদি, কায়িস ইবনু সাদ, লাইস ইবনু আবি সুলাইম, মুজাহিদ ইবনু জাবর, ইবনু শিহাব আয-যুহরি, মুগিরাহ ইবনু হাকিম আস-সানয়ানি, মাকহুল আল-হুসালি, নুমান ইবনু আবি শায়বাহ, হানি ইবনু আইয়ুব, ওয়াহ্হাব ইবনু মুনাব্বিহ।

উপরোক্ত কোন রাবী ‘কুফর দুনা কুফর’ শব্দাবলি বর্ণনা করেন নি। সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই বর্ণনা ও শব্দাবলি প্রমাণিত নয়। কুফর দুনা কুফর’ বর্ণনার সনদ দুর্বল হওয়া সম্পর্কে শাইখুল মুহাদ্দিস আল্লামা সুলাইমান বিন নাসির আল-উলওয়ানের উপরোক্ত বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে তাঁর ছাত্র শায়খ হাইসাম সাইফ আদ-দীনের বক্তব্য থেকে

শাইখ সুলাইমান বিন নাসির আল-উলওয়ান ছাড়াও শাইখ আব্দুল আযিয ইবনু মারযুক আত-তারিফি, শাইখ আবু আইয়ুব আল-বারকাওয়ি এবং শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল গুলাইফা একই মত ব্যক্ত করেছেন।

এতদসত্ত্বেও ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে অপর একটি বর্ণনা আছে, যা পুরোপুরি এই বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। বর্ণনাটি নিম্নরূপ : হাসান ইবনু আবি রাবিয়া আল-জুরজানি বর্ণনা করেছেন, আমরা আব্দুর রাযযাক থেকে, তিনি মুয়াম্মার থেকে, তিনি ইবনু তাউস থেকে এবং তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন— ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হল আল্লাহর এই আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুসারে যারা বিচার-ফায়সালা করে না, তাঁরাই কাফির।’ জবাবে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, كفى به كفره “কুফরির জন্য এটাই যথেষ্ট।”
আখবারুল কুদাহ, খণ্ড ১, পৃ. ৪০-৪৫।

যখন ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলছেন, “কুফরের জন্য এটাই যথেষ্ট”, তখন আর এটাকে ছোট কুফর বলে গণ্য করা যাবে না। যেহেতু তিনি “যথেষ্ট” বলেছেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে তিনি এখানে বড় কুফর (কুফর আকবারকেই) বোঝাচ্ছেন।

ইবরাহিম ইবনুল হাকাম ইবনু যাহির তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেছেন সুদ্দি থেকে। তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন—

مَنْ جَارَ فِيْ الْحُكْمِ وَهُوَ يَعْلَمُ، وَمَنْ حَكَمَ بِغَيْرِ عِلْمِه، وَمَنْ أَخَذَ الرِّشْوَةَ فِيْ الْحُكْمِ، فَهُوَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ

“যে বিচারের ক্ষেত্রে জেনেশুনে স্বেচ্ছাচারিতা করে (অর্থাৎ নিজের ইচ্ছেমতো বিচার করে), জ্ঞান ছাড়া বিচার করে, কিংবা বিচারের ব্যাপারে ঘুষ গ্রহণ করে, সে কাফিরের অন্তর্ভুক্ত।” আখবারুল কুদাহ, পৃ. ৪১

এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কুফর দুনা কুফরের সানাদ সম্পর্কে কোন মতামত দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য না এবং আমাদের এ লেখার লক্ষ্যও এটা না। আমাদের উদ্দেশ্য হল এ উক্তিটির সানাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে যে মতপার্থক্য আছে, শুধুমাত্র তা উল্লেখ করা এবং পাঠককে জানানো। এ উক্তির সানাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং সানাদ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী পাঠক শাইখ হাইসাম সাইফ আদ-দীনের পেইজে এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন।

যদি কুফর দুনা কুফরের সানাদ সাহিহও হয়…

যেহেতু কিছু মুহাদ্দিসের নিকট ‘কুফর দুনা কুফর’ উক্তিটির সানাদ গ্রহণযোগ্য, সেহেতু আমরা এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়ে, দুটি সম্ভাবনাকেই যদি বিবেচনা করি এবং ধরেও নিই যে, ‘কুফর দুনা কুফর’ এর সানাদ সাহিহ তারপরও কি এটা ঢালাওভাবে সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর আয়াতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে? শুধুমাত্র এই একটি বর্ণনার ভিত্তিতে কি বলা যাবে, শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করা ছোট কুফর এবং এমন কুফর করলে ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হবে না? অন্যান্য আয়াত থেকে আমরা এ বিষয়ে যা জানতে পেরেছি তা কি শুধুমাত্র এই একটি উক্তির কারণে রহিত হয়ে যাবে?

যদি তাই হয়, তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর মুফাক্কিহ, মুফাসসির ও আলিমগণ কিভাবে এই ঐক্যমতে (ইজমা) পৌছালেন যে, আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন না করা ব্যক্তি কাফির? ইতিমধ্যে এই ইজমার অসংখ্য প্রমাণ আমরা দেখেছি। যদি আমরা ধরে নেই ‘কুফর দুনা কুফর’ এর সানাদ সাহিহ, সেক্ষেত্রে কিভাবে এই বক্তব্য এবং আলিমদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয় হবে? দুটি অবস্থা কি সাংঘর্ষিক হয়? আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা এমন না। এজন্য আমাদের তাকাতে হবে কুফর দুনা কুফরের সঠিক ব্যাখ্যার দিকে।


কুফর দুনা কুফরের সঠিক ব্যাখ্যা


ইমাম ইবনু কাইয়িম-

‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী শাসন না করার ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে দুই ধরনের কুফর হয়ে থাকে, কুফর আসগার ও কুফর আকবার। যদি শাসক শরিয়াহ দ্বারা শাসনের আবশ্যকতা স্বীকার করা সত্ত্বেও কোন একটি ক্ষেত্রে শরিয়াহ দ্বারা বিচার করা ত্যাগ করে এবং স্বীকার করে তার এই কাজ গুনাহ, এর জন্য সে শাস্তি পাবার যোগ্য, এজন্য সে ক্ষমা চায় তবে এটা হল কুফর আসগর। কিন্তু যদি সে মনে করে, আল্লাহ যা নাযিল করেছে তদানুযায়ী শাসন করা ফরয না এবং সে নিজের ইচ্ছে মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অথচ সে জানে আল্লাহ হচ্ছে আল-হাকিম, যদি সে এই বিশ্বাসে পতিত হয় তবে তা কুফর আকবার।’
বাদাউত তাফাসির, ২/১১২


শাইখ আব্দুল আযিয আত-তারিফি-

“(ধরুন) কোন ভূমিতে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হালাল আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হারাম। পরে দেখা গেল কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাসক আল্লাহর আইন প্রয়োগ করার ব্যাপারে ব্যর্থ হচ্ছে। সে আল্লাহর হালাল করা কোন বিষয়কে হারাম ঘোষণা করছে না, কিংবা আল্লাহর হারাম করা কোন বিষয়কে হালাল ঘোষণা করছে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে সে শরিয়াহর বিধান প্রয়োগ করছে না। যেমন সে হয়তো মদপানকারী বা যিনাকারীকে শাস্তি দিচ্ছে না, অথবা সে ঘুষ নিয়ে চোরকে শাস্তি দিচ্ছে না, যদিও এগুলো এসব অপরাধের শরিয়াহ নির্ধারিত শাস্তি (অর্থাৎ ঢালাওভাবে চুরির শাস্তি হাতকাটা, বা যিনাকারির রজম বন্ধ করা হচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে শাসক ও বিচারক দুনিয়াবি কারণে এগুলো প্রয়োগ করছে না)। এক্ষেত্রে তার ব্যাপারে বলা যায়, এটা হল কুফর দুনা কুফর, যা সালাফদের থেকে বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু যদি ব্যাপারটা হয় শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করার হয়, তবে এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই যে, এটা কুফর আকবার। কিছু মানুষ কুফর দুনা কুফরের নীতি প্রয়োগ করতে চায় (আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য) আইন প্রণয়ন (تشريع) এর ব্যাপারে। এটা কি গ্রহণযোগ্য? কোন মুসলিমের কাছেই এটা গ্রহণযোগ্য না। বরং এ কারণেই আল্লাহ শাসকের প্রতি আনুগত্যকে সংযুক্ত করেছেন শাসকের আল্লাহর শরিয়াহ দ্বারা শাসন করার সাথে। যেমনটা নাবি (ﷺ)বলেছেন, ‘যদি তোমাদের উপর কোন হাত পা কাটা গোলামকেও আমির নিযুক্ত করা হয় আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে।’
সাহিহ মুসলিম: ৪৬১০

সুতরাং শাসকের প্রতি আনুগত্য সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে আল্লাহর কিতাবের সাথে এবং ঢালাওভাবে ক্ষমতায় যেই আসুক তার আনুগত্য করার কথা বলা হয় নি।”


শাইখ আব্দুল্লাহ আল-গুনায়মান-

“ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে যে উক্তি (কুফর দুনা কুফর) বর্ণিত হয়েছে সেটা ঢালাওভাবে আল্লাহ ’র এই আয়াতের ব্যাপারে প্রযোজ্য না— ‘যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।’

এটা সম্ভবই না যে, আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে কাফির বলে ঘোষণা দেবেন আর আমরা তারপর বলবো— ‘না, এটা কুফর না।’ ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র উক্তিটি ব্যবহার করা যায় বিশেষ ও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে, যখন দুয়েক ক্ষেত্রে শাসক বা বিচারক আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী শাসন না করে অন্য কিছু দিয়ে শাসন করে। কিন্তু সে শরিয়াহকে স্বীকার করে এবং এও স্বীকার করে যে, শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করে সে ভুল করেছে ও তার শাস্তি পাওয়া উচিৎ। এ ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন তার কুফর হল ‘কুফর দুনা কুফর’। কিন্তু যখন কেউ ইসলামি শরিয়াহকে প্রতিস্থাপিত করে মানবরচিত আইন দিয়ে, কিংবা সে শরিয়াহর উপর অন্য কোন বিধানকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয় তখন তার ব্যাপারে কুফর দুনা কুফর বলা সঠিক নয়। কারণ প্রকৃতপক্ষে তার কুফর হল সেই পর্যায়ের কুফর যার ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।’

এছাড়া এর আগে আমরা এ আয়াতের কথা আলোচনা করেছি— ‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবি করে যে, যা আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে আমরা এসবের উপর ঈমান এনেছি...।’
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬০

তারপর আল্লাহ আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন এই লোকগুলো সম্পর্কে, ‘তারা তাদের মোকদ্দমা তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায়।’ অতএব এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, তাগুতের কাছে যে বিচার চাইবে তার ইমান থাকবে না। তারপর আল্লাহ এসব লোকের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন এবং তারপর বলেছেন, ‘অতএব, আপনার রবের কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক বলে গ্রহণ না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।’
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬৫

এই আয়াতে শরিয়াহর দ্বারা বিচারের ব্যাপারে কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে— আল-ইনকিয়াদ (আনুগত্য প্রদর্শন), আর-রিদ্বা (আন্তরিক সন্তুষ্টি) এবং তাসলিম (সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ) করা শরিয়াহর বিচারের প্রতি। যদি এই শর্তগুলোর কোন একটি কারো মধ্যে অনুপস্থিত থাকে, তবে সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না। তাহলে যে শাসন করছে মানবরচিত আইন দিয়ে, তার ব্যাপারে কিভাবে বলা যাবে এটা কুফর দুনা কুফর? এটা সম্ভবই না যে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) এরকম শাসকের ব্যাপারে কুফর দুনা কুফর বলেছেন এবং কোন আলিম— যে আল্লাহ যা বলছেন ও তাঁর নাবি (ﷺ)যা বলেছেন তা অনুধাবনে সমর্থ হয়েছে, সে এরকম কথা বলতে পারে না।

বরং ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই উক্তি প্রযোজ্য বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে। কোন ব্যক্তি যদি দুয়েকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী বিচার করা থেকে বিরত থাকে, দুনিয়াবি লোভ, প্রমোশন কিংবা চাকরি হারানোর ভয়ে, সেক্ষেত্রে তার ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, তা কুফর দুনা কুফর (কুফর, যা কুফর আকবার না)।


মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ-

সবশেষে তোলে ধরছি, আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিমের কুফর দুনা কুফর সংক্রান্ত ব্যাখ্যা; যার পরে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির কোন অবকাশই থাকে না।

যারা মনে করেন, যাদের বড় পদ নেই তারা আলিম হিসেবে গ্রহণযোগ্য না, তাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম ছিলেন বিন বাযের আগে সাউদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি এবং তিনি ছিলেন বিন বায, ইবনু জিবরিনসহ অনেকের শিক্ষক। আপোষহীন এই মহান শাইখ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ছাত্রদের তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ শিখিয়ে গেছেন এবং জনসাধারণের কাছে এ সত্য তুলে ধরেছেন। যারা বলতে চান তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে দাওয়াহ দেওয়া বিদয়াহ, আমরা তাদের আহ্বান জানাই মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিমকে আগে বিদয়াতি আখ্যায়িত করার জন্য।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম আলুশ শাইখ রাহিমাহুল্লাহ কুফর দুনা কুফরের সঠিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলেন—

“...কুফর দুনা কুফর হচ্ছে, যখন বিচারক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছু দিয়ে বিচার-ফায়সালা করে এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, এটা হচ্ছে কুফরি। সে বিশ্বাস করে যে আল্লাহর বিধান সত্য, কিন্তু কোন কারণে সে তা পরিত্যাগ করেছে। এরই পরম্পরায় যে আইন তৈরি করবে এবং অন্যদের এটা অনুসরণ করতে বাধ্য করবে, তখন সেটা কুফর (কুফর আকবার হবে)। যদিও সে একথা বলে, ‘আমরা গুনাহ করছি এবং নাযিলকৃত বিধানের বিচার ফায়সালা বেশি উত্তম’। তা সত্ত্বেও এটা এমন কুফর, যা দীন থেকে বের কর দেয়।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহিম, ২১/৫৮০

শাইখের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট ‘কুফর দুনা কুফর’ তখনই প্রযোজ্য যখন ব্যাপারটা কয়েকটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা বিচার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এটা প্রযোজ্য হয় ঐ শাসকের জন্য যে সাধারণত শরিয়াহ দিয়েই শাসন করে, কিন্তু হাতেগোণা দু-একটি ঘটনায় সে এর ব্যতিক্রম করে ফেলল। অবশ্যই সে মনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে শরিয়াহর শ্রেষ্ঠত্ব এবং শরিয়াহ দ্বারা শাসনের আবশ্যকতা। কিন্তু যখনই ব্যাপারটা تشريع বা আইন প্রণয়নের পর্যায়ে প্রবেশ করবে, তখনই সেটা কুফর আকবার হবে। যদি সেটা একটি আইনের ক্ষেত্রেও হয়। যদি শরিয়াহর একটি আইন কোন শাসক পরিবর্তন করে, অন্য সব বিষয়ে শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে, তবে সেটাই কুফর আকবার হবার জন্য যথেষ্ট। কারণ কেউ যদি কুরআনের একটি আয়াত অস্বীকার করে, আর বাকি সব স্বীকার করে তবে সে কাফির। পাঠক এখন চিন্তা করে দেখুন, বর্তমান সময়ের শাসকদের কুফর কি শুধুমাত্র تحكيم বা বিচার-ফায়সালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি তারা تشريعবা যথেচ্ছভাবে আইনও প্রণয়ন করে? মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে শাসন করা হয় মানবরচিত সংবিধান দ্বারা যেখানে খোলাখুলি ঘোষণা করা হয়— ‘সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, যা কিছু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তা বাতিল বলে গণ্য হবে’ তাহলে কিভাবে এক্ষেত্রে কুফর দুনা কুফর প্রযোজ্য হতে পারে? এমনকি আরব উপদ্বীপের যেসব ভূমি শরিয়াহ দ্বারা শাসিত হয় বলে দাবি করা হয়, সেখানেও রিবাকে বৈধতা দেওয়া হয় এবং অন্যান্য আইন পাশ করা হয় যা শরিয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ সেখানেও বিষয়টা তাহকিম বা কিছু ক্ষেত্রে শরিয়াহ অনুযায়ী বিচার না করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তাশরি বা আইন প্রণয়নের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর এটা কুফর দুনা কুফর না বরং কুফর আকবার, যা আল্লাহর কিতাব ও সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

এরপরও কিভাবে ‘কুফর দুনা কুফর’ এর অজুহাত দিয়ে মুরতাদ শাসকদের বৈধতা দেওয়া যেতে পারে? শুধুমাত্র আরব উপদ্বীপের শাসকদের না (যেহেতু এ শাসকরা অনেক ক্ষেত্রেই শরিয়াহ অনুযায়ী বিচার করে, তাই আমরা তাদের ক্ষেত্রে যারা বিভ্রান্তিতে পড়েছে তাদের কথা আপাতত ছেড়ে দিলাম) বরং মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য শাসকদেরকেও, যারা বিচার করছে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ-জাতিসংঘের আইন আর নিজ নিজ জাহেলি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি জগাখিচুড়ি সংবিধান দিয়ে, যেগুলোর সাথে আল্লাহ আল-হাকাম ওয়াল হাকিমের শরিয়াহর দূরতম কোন সম্পর্ক নেই?

مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ

তোমাদের কী হল? তোমরা এ কেমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?
সুরা আল-কালাম, ৬৮: ৩৬

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) ঢালাওভাবে শরিয়াহ পরিবর্তনকারী সকল শাসকের ব্যাপারে এ উক্তি করেছিলেন, তবুও কি এই উক্তি দ্বারা আদৌ আজকের শাসকদের বৈধতা দেয়া যায়?

যদি তর্কের খাতিরে, ইবনু মাসউদ (রাঃ)’র বক্তব্য উপেক্ষা করে, খোদ ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র অন্য বক্তব্য উপেক্ষা করে, কুফর দুনা কুফর সম্পর্কিত যে ভিন্ন বর্ণনা আছে তা উপেক্ষা করে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)থেকে তিন ধরনের বিচারকের মধ্যে দু’ধরনের বিচারকের জাহান্নামি হবার হাদিস উপেক্ষা করে, ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র বক্তব্য এবং এ ব্যাপারে আলিম এবং ফকিহগণের ইজমা উপেক্ষা করে, হাকিমিয়্যাহ এবং আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য আইন দ্বারা শাসন কুফর হওয়া সম্পর্কিত অন্য সকল আয়াত উপেক্ষা করে যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে, ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র উক্তি ‘কুফর দুনা কুফর’ সম্পর্কে সালাফি নামধারী বর্তমান সময়ের কিছু আলিম এবং দায়ি যে নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যা ১৪০০ বছর ধরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর কেউ দেয়নি— অর্থাৎ ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র কথার অর্থ ছিল সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর একটি বিশেষ অবস্থায় নাযিল হয়েছে, এটা সাধারণভাবে প্রযোজ্য না কিংবা এ আয়াতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের কুফরের কথা (ছোট কুফর) বলা হয়েছে বড় কুফর না, সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়?

এ ব্যাপারে প্রথমত, শাইখ সালিহ ইবনু উসাইমিন (একজন জনপ্রিয় ও সম্মানিত সালাফি আলিম) এর একটি উদ্ধৃতি আমি তুলে ধরছি। তিনি বলেন,

“একজন সাহাবার বক্তব্যের কোন অধিকার নেই আল্লাহ যা আম করেছেন, তা খাস করার।”
আল-উসুল মিন ইলমিল উসুল, পৃ. ৩৩-৩৪

প্রকৃতপক্ষে এটি ফিকহের একটি প্রসিদ্ধ উসুল, যার উপর ফকিহগণ একমত যে, আয়াত যা আমভাবে নাযিল হয়েছে, তার প্রয়োগ ঐ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট দ্বারা সীমাবদ্ধ হবে না। আল্লামা শাতিবি রাহিমাহুল্লাহ তার কিতাব আল-মুওয়াফিকাত এবং আল-ইতিসামে এই মূলনীতিটি উল্লেখ করেছেন—

العام لا يقصر على سببه

যা আম, তা আসবাবুন নুযুল বা নাযিলের প্রেক্ষাপটের সাথে সীমাবদ্ধ করা যাবে না।

মানসুখ ব্যতীত সকল মুহকাম আয়াতের ক্ষেত্রেই এই নীতিটি প্রযোজ্য এবং রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সময়কাল থেকেই এটা মেনে চলা হচ্ছে। কারণ সকল মুহকাম আয়াতই কোন না কোন নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতেই নাযিল হয়েছিল। কিন্তু তার মানে এই না যে, সে হুকুমগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বা নির্দিষ্ট কিছু লোকের জন্য প্রযোজ্য। অন্যদের জন্য না। বরং সকল মুসলিমই একমত যে, এগুলো ‘আমভাবে প্রযোজ্য। একমাত্র যারা গোমরাহিতে আপতিত এবং বাতিল ফিরকাগুলো ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে না।

সুতরাং যা কুরআন থেকে সুস্পষ্টভাবে কুফর হিসেবে প্রমাণিত, হাদিস থেকে প্রমাণিত, অন্য সাহাবার উক্তি থেকে এবং আলোচ্য সাহাবার অন্য উক্তি থেকেও প্রমাণিত― এসবের বিরুদ্ধে গিয়ে এই উক্তির এরকম অর্থ গ্রহণ করা একেবারেই অনুচিত। আর প্রকৃত সত্য হল, ইবনু আব্বাসের ব্যাপারে যা আরোপ করা হচ্ছে [অর্থাৎ শরিয়াহ দ্বারা শাসন না করে, শরিয়াহ বিরোধী আইন তৈরি করে এমন শাসককের কুফরকে তিনি ছোট কুফর বলেছেন] তা থেকে তিনি মুক্ত।

বরং এটি একটি নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যা, যা সেসব লোকেরা উদ্ভাবন করেছে যারা দুনিয়ার বিনিময়ে তাদের দীনকে বিক্রি করে দিয়েছে। আর এজন্য তারা সাইয়িদুনা ইবনু আব্বাস (রাঃ)’র একটি বিশেষ অবস্থায় হারুরিয়্যাহ খারিজিদের উদ্দেশ্যে বলা একটি বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করছে। খারিজিরা নিরপেক্ষ শরিয়াহ আদালত মেনে নেবার কারণে আলি, মুয়াবিয়া, আমর ইবনুল আস এবং আবু মুসা আল-আশয়ারি রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইনের উপর তাকফির করছিল। তাদের বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য, নিরপেক্ষ শরিয়াহ আদালত স্থাপন ও তার বিচার মেনে নেবার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর আয়াতকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করে খারিজিরা একে কুফর বলছিল। সাইয়্যিদিনা ইবনু আব্বাসের উক্তিটি ছিল এই প্রেক্ষাপটে। এর সাথে আজকের শাসকদের অবস্থার, আজকের পরিস্থিতির কী মিল আছে?

বরং যারা “কুফর দুনা কুফর” উক্তিটিকে শাসকদের বৈধতা দেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারাই প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ অবস্থায় বলা খাস উক্তিকে আমভাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। আর যদি সব দলিল প্রমাণের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা ধরে নেই ইবনু আব্বাস এই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তবে আমাদের মনে রাখতে হবে নাবি-রাসুলগণ আলাইহিমুস সালাম ছাড়া আর কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নন, আর আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে গিয়ে কোন সৃষ্টির ভুলের উপর কোন অনুসরণ নেই।

যারা সমস্ত দলিল-প্রমাণের বিরুদ্ধে গিয়ে এ বাতিল অবস্থানের উপর অটল থাকার জেদ ধরেন এবং এর মাধ্যমে শাসকদের বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, তাদের জন্য আল্লামা শাইখ আহমাদ শাকিরের এ কথাগুলোই যথেষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ—


শাইখ আহমাদ শাকিরের হুঁশিয়ারি

“আবু মিজলায এবং ইবনু আব্বাসের প্রতি খারিজিদের প্রশ্ন আজকের যুগের বিদয়াহর মত ছিল না, যেখানে আইন প্রণয়ন এবং মানুষের জান-মালের ব্যাপারে বিচার করা হয় এমন আইন দিয়ে যা আল্লাহর শরিয়াহবিরোধী। ...এধরনের কাজ হল আল্লাহর বিচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। এটা হল কুফর, আর আহলুল কিবলার কারো মধ্যে এ কাজ কুফরি হওয়া নিয়ে সন্দেহ নেই।

আজ আমরা যেখানেই অবস্থান করি না কেন, সব জায়গাতেই আল্লাহর বিধানসমূহকে ত্যাগ করা হচ্ছে। তাঁর কিতাবে এবং রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর সুন্নাহতে যে বিধানাবলি দেওয়া হয়েছে, তা ছেড়ে আজ আমরা অন্য বিধান গ্রহণ করছি, এবং শরিয়াহকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করছি।

যারাই ইবনু আব্বাস ও আবু মিজলাযের বক্তব্য [কুফর দুনা কুফর] ব্যবহার করে, সেগুলোর প্রেক্ষাপট বদলে দিয়ে আল্লাহর শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করাকে বৈধতা দিতে চায়, শাসকদের নৈকট্য অর্জন করতে চায়, এরকম ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অস্বীকারকারী। তাকে অবশ্যই তাওবাহ করতে হবে। যদি সে তাওবাহ করে, তবে তার কাজ ছোট কুফর গণ্য করা হবে। আর যদি সে তাওবাহ না করে তার এই বক্তব্যের উপর অটল থাকে এবং (শাসকদের) এসব বিধানকে গ্রহণ করে, তবে এটা তো সবার জানা কথাই যে, কুফরের উপর অটল থাকা কাফিরের সাথে কিভাবে বোঝাপড়া করতে হয়।”
তাখরিজ তাফসির আত-তাবারি, ১০/৩৪৯-৩৫৮


তাগুতকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার আবশ্যকতা

আল্লাহ ইরশাদ করেন,

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

সুতরাং যারা তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা ভাঙবার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।
সুরা আল-বাকারা, ২: ২৫৬-২৫৭

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো।
সুরা আন-নাহল, ১৬: ৩৬

তাওহিদের দুটি রুকনের প্রথমটি হল, “কুফর বিত-তাগুত” বা তাগুতকে অস্বীকার। আর দ্বিতীয় রুকনটি হল এবং “ইমান বিল্লাহ” তথা আল্লাহর প্রতি ইমান। মুমিন হতে হলে প্রথমে আমাদেরকে আল্লাহ ব্যতীত আর সব মিথ্যা ইলাহকে অস্বীকার করতে হবে, প্রত্যাখ্যান করতে হবে, অবিশ্বাস করতে হবে, এরপর একমাত্র ইলাহ হিসেবে, ইবাদাত ও আনুগত্যের যোগ্য একমাত্র সত্তা হিসেবে আল্লাহকে গ্রহণ করতে হবে। যেকোন একটি যদি পড়লে অপরটি পূর্ণ হবে না।


তাগুত কী?

طاغوت শব্দটির উৎপত্তি طغيان থেকে, যার শাব্দিক অর্থ হল “যথাযথভাবে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা”। পরিভাষায় তাগুত বলতে বোঝানো হয় এমন কিছু যা সীমালঙ্ঘন করে যেসব বিষয় শুধুমাত্র আল্লাহ ’র অধিকার এবং এখতিয়ারভুক্ত তা নিজের জন্য দাবি করে এবং আল্লাহ ’র সাথে নিজেকে অংশীদার দাবি করে।

আল্লাহ ব্যতীত যাদের বা যা কিছুর ইবাদাত, আনুগত্য, অনুসরণ এবং যাদের বা যা কিছুর প্রতি আত্মসমর্পণ করা হয় তার সবই তাগুত। ইমাম মালিক বলেছেন “আল্লাহ ব্যতীত যা কিছুর ইবাদাত করা হয় তাই তাগুত।” তাফসির ইবনু কাসির, সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য

ইতিপূর্বে আমরা শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ তাগুতের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা উল্লেখ করেছি, পাঠকের সুবিধার্থে তা এখানে আবার উল্লেখ করা হলো—

“আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না এমন কাজে আল্লাহর অবাধ্যতায় যার আনুগত্য করা হয়, সে হল তাগুত। যদি আপনি আল্লাহ যা জানিয়েছেন তার পরিবর্তে, এ ব্যক্তি বা সত্ত্বার বক্তব্য গ্রহণ করেন যা আল্লাহ আমাদের যা জানিয়েছেন তার সাথে সাংঘর্ষিক, কিংবা যদি আল্লাহর আদেশের বিপরীতে এই ব্যক্তির আদেশ মানা হয়– তবে সে তাগুত। একারণে যে ব্যক্তিকে বিশ্বাসীদের মধ্যে বিচার ফায়সালার জন্য নিযুক্ত/নির্ধারণ করার পর সে আল্লাহর আইনের বদলে অন্য কোন আইন দ্বারা শাসন করে, তাকে আল্লাহর কিতাবে তাগুত আখ্যায়িত করা হয়েছে।”
মাজমু আল-ফাতাওয়া, ২৮/২০১

ইবনুল কাইয়িম মাদারিজুস সালিকিনে তাগুতের সংজ্ঞা এবং প্রকারভেদের ব্যাপারে বলেছেন,

“তাগুত হল মিথ্যা বিধানদাতা। এই বিধান ইবাদাতের ক্ষেত্রে হতে পারে, শাসনের ক্ষেত্রে হতে পারে, বিচারের ক্ষেত্রে হতে পারে, আকিদাহর ক্ষেত্রে হতে পারে। অর্থাৎ তাগুত সে, যে এমন আইন, বিধান, ইবাদাত প্রণয়ন করে যা আল্লাহ বনী আদমের জন্য নির্ধারণ করেন নি এবং যেগুলো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেগুলোর বিরোধী। তাগুত শব্দের উৎপত্তি তুগইয়ান থেকে, যার অর্থ হল ‘যথাযথভাবে নির্ধারিত যে সীমা, তা লঙ্ঘন করা।’

তাগুত তিনভাবে প্রকাশ পেতে পারে—

১। ইবাদাতের ক্ষেত্রে

২। আইন প্রনয়ণের ক্ষেত্রে

৩। আনুগত্যের ক্ষেত্রে

ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহর মতে তাগুতের পাঁচটি প্রধান প্রকার আছে—

১। ইবলিস।

২। আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদাত করা হয় এবং সে এতে সন্তুষ্ট। খৃস্টানরা ইসা এর ইবাদাত করার কারণে তিনি তাগুত বলে গণ্য হবেন না, কেননা তিনি এতে সন্তুষ্ট নন।

৩। যে মানুষকে আহ্বান জানায় তার ইবাদাত করার জন্য (ফিরাউন, নমরুদ)।

৪। যে দাবি করে তার কাছে গাইবের ইলম আছে (পীর, যাদুকর, ভবিষ্যদ্বক্তা)।

৫। যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী শাসন না করে অন্য কিছুর ভিত্তিতে শাসন করে।

এব্যাপারে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা হল শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের ব্যাখ্যা, যা তিনি معني الطاغوت নামক রিসালায় উল্লেখ করেছেন। যখন দীনের এই মৌলিক বিষয়টি— অর্থাৎ কুফর বিত-তাগুত নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, আল্লাহর ইচ্ছায় শাইখ তখন সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার এবং কোন ভয়ভীতি ছাড়া সত্যের প্রতি আহ্বানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আল্লাহ যেন এই মহান ইমাম এবং মুজাদ্দিদের উপর রহম করেন।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

১. প্রথম প্রকার তাগুত হল ইবলিসঃ সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাতের দিকে আহব্বান করে। (সুরা ইয়াসিন, ৩৬: ৬০)

২. দ্বিতীয় প্রকারের তাগুত হল স্বেচ্ছাচারী বিচারক, যে আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করে। এর পক্ষে দলিল হল আল্লাহ ’র এই আয়াত—

“আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবি করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ইমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে। তারা তাদের মোকদ্দমা তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়…।” (
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬০)

৩. তৃতীয় প্রকারের তাগুত হল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করে। এর দলিল হল আল্লাহ ’র এই আয়াত—

“অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদানুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই কাফির।”
(সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪)

৪. চতুর্থ প্রকারের তাগুত হলঃ যে ‘ইলমুল গায়িব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের দাবি করে।

৫. পঞ্চম প্রকারের প্রকারের তাগুত হলোঃ আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত/উপাসনা করা হয় এবং এতে সে খুশি থাকে।
আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, ১/১০৯-১১০

শাইখুল মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের এই ব্যাখ্যা এবং প্রকারভেদ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। একারণে যারা নিজেদের শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব এবং তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ এবং ইমাম ইবনু কাইয়িমের অনুসারী দাবি করেন, তারাই যখন শাইখদের এ কথাগুলো ভুলে যান তখন সত্যি অবাক হতে হয়। পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবেন শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব তৃতীয় প্রকারের তাগুতের ব্যাপারে তার বক্তব্যের স্বপক্ষে দলিল হিসেবে এনেছেন সুরা মায়িদার ৪৪ নম্বর আয়াতকেই।

উপরের বক্তব্য থেকে দেখা যায় যে শাসক আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করে না এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর পরিবর্তে তার অনুসরণ করা হয় সে কাফির তো বটেই তাগুতও। এটাই ইবনু তাইমিয়াহ, ইবনু কাইয়িম, ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের বক্তব্য।

আর যদি আমরা আইন প্রণয়নের দিকে তাকাই? যখন কোন শাসক কোন ব্যাপারে আল্লাহ যে বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা পরিবর্তন করছে, আল্লাহর আইনকে বাতিল বলে ঘোষণা করছে আর নিজসৃষ্ট আইন মানাকে আবশ্যক করেছে তখনই সে সীমালঙ্ঘন করেছে এবং আনুগত্যের ব্যাপারে আল্লাহ ’র পরিবর্তে নিজেকে বসিয়ে নিয়েছে। যখন আল্লাহ বলেছেন যিনার শাস্তি রজম, শাসক যিনার শাস্তি হিসেবে রজমকে বাতিল করছে; যখন আল্লাহ বলেছেন রিবা হারাম, আর শাসক বলছে রিবা হারাম হবার বিধান বাতিল, ৭ বা ১০% পর্যন্ত রিবা হালাল; যখন আল্লাহ বলেছেন “ওয়ামা লাকুম লা তুকাতিলুনা ফি সাবিলিল্লাহ” আর শাসক বলছে অমুক জায়গায় যদি কেউ যেতে চায় তবে আমরা তাকে বন্দি করবো, শাস্তি দেবো; কারণ সে অপরাধী! তখন কি সেটা ছোট কুফর? তখন কি সে শাসক আমিরুল মুমিনিন, নাকি রুউসুত তাওয়াগিত?

ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করুন— কেউ আপনাকে এসে বললো, আজ থেকে মাগরিবের সালাত আর ৩ রাকায়াত পড়া যাবে না, এখন থেকে ১৩ রাকাত পড়তে হবে। শুধু এটা বলেই সে ক্ষ্যান্ত হল না, বরং এটাকে আইন করে বাধ্যতামূলক করে দিল এবং যারা তার অবাধ্যতা করে আল্লাহর বাধ্যতা করলো সে তাদের শাস্তি দেয়া শুরু করলো, এমন ব্যক্তি কি মুসলিম? তার আনুগত্য করতে হবে? সে তো তখনই কাফির হয়ে গেছে যখন সে মাগরিবের সালাত ৩ রাকায়াত হওয়াটা অস্বীকার করেছে। আর যখন সে আল্লাহর যা নির্ধারণ করেছেন তা বাতিল দাবি করে নিজে থেকে কিছু এনেছে এবং তা আবশ্যক করেছে, আইন প্রণয়ন করেছে আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে এবং মানুষ এতে তার আনুগত্য করেছে তখন সে তাগুতে পরিণত হয়েছে। যদি সে জানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ)

এক্ষেত্রে ৩ রাকায়াত নির্ধারণ করেছেন, তবে এটাই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে তার জন্য আর কোন অজুহাত নেই।

যদি কেউ কুরআনের একটি আয়াতও অস্বীকার করে তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির। যদি ইমান আনার পর কোন ব্যক্তি তা করে, তবে সে মুরতাদ। অথচ যারা পুরো শরিয়াহকে অস্বীকার করলো, নিজে অস্বীকার করার পর মানুষের জন্য শরিয়ার অনুসরণ হারাম করে দিলো, শরিয়ার প্রতি আহ্বান করাকে অপরাধ বলে আখ্যায়িত করলো, আল্লাহর শরিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজে শরিয়াহ তৈরি করলো এবং তার অনুসরণ মানুষের উপর ফরয (আবশ্যক) করলো— তার কুফর কি ছোট কুফর? তার আনুগত্য করতে হবে? সারাদিন পীরপূজা শিরক, মাযারপূজা শিরক, কবরপূজা শিরক, মূর্তিপূজা শিরক বোঝালেন আর রাষ্ট্রীয় শিরকের ব্যাপারে এসে নিরব হয়ে গেলেন? পীর-কবর-মূর্তি-মাজারের ব্যাপারে গর্জন করলেন আর শাসকের ব্যাপার আসাতে গলা শুকিয়ে গেল? আল্লাহর নবি (ﷺ)এর হাদিসের, নাবির সাহাবার কাওলকে অপব্যাখ্যা শুরু করলেন? কুরআনকে পেছনে ছুড়ে দিলেন?

أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَوْهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

“তোমরা কি তাদের ভয় পাও? আল্লাহই তোমাদের ভয়ের অধিক হকদার, যদি তোমরা মুমিন হও।”
সুরা আত-তাওবাহ, ৯: ১৩

যেখানে আল্লাহ আমাদের বলেছেন তাগুতকে বর্জন করতে, সেখানে তাগুতের আনুগত্যের প্রশ্নই আসে না। যারা এরকম বলছে, তাদের মধ্যে যারা জাহিল তাদের জাহালাহ তাদের জন্য ওযর। কিন্তু যারা জেনেশুনে, নিজেদের আহমাদ ইবনু হানবাল, ইবনু তাইমিয়্যাহ এবং ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের পথের অনুসারী দাবি করেও, তাগুতের সংজ্ঞা জেনেও, উলামা-মুফাসসিরিন-মুহাদ্দিসিন-মুফাক্কিহিনের ইজমা সম্পর্কে জেনেও, নাওয়াকিযুল ইমান সম্পর্কে জেনেও, ইমানের অর্থ হল অন্তরে বিশ্বাস, মুখে ঘোষণা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল— এসব জেনেও বলছেন এমন শাসকের আনুগত্য করতে, যে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত, রাসুলুল্লাহর একটি সাহিহ হাদিস না, বরং সমস্ত শরিয়াহ অস্বীকার করে, সমগ্র শরিয়াহ অবৈধ ঘোষণা করে, বাতিল ঘোষণা করে এবং আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে নিজে আইন তৈরি করে এবং সে আইন অনুযায়ী শাসন করে, শুধুমাত্র শাসকের অত্যাচারের ভয়ে— তাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং তাওবাহ করা। তাগুতের প্রতি আহ্বানকারী হবেন না। আল্লাহর আয়াতসমূহকে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করবেন না। কিতাবের কিছু অংশ গ্রহণ আর কিছু অংশ ত্যাগ করবেন না। যদি আপনি দুর্বল হন, তবে চুপ থাকুন, ইনশাআল্লাহ কিয়ামতের দিনে আপনার দুর্বলতা আপনার পক্ষে ওযর হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু তাগুতকে বৈধতা দেবেন না, কাফির-মুরতাদের পক্ষাবলম্বনকারী হবেন না, আল্লাহর রাসুল (ﷺ)এর হাদিসের অপব্যাখ্যা করবেন না।
আল্লাহ ’র এই বাণী স্মরণ করুন—

فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

“অতএব তোমরা মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় করো এবং স্বল্পমূল্যে আমার আয়াতসমূহ বিক্রি করে দিয়ো না। আর যে আল্লাহর নাযিলকৃত (শরিয়াহ দ্বারা) বিচার-ফায়সালা করে না, সে-ই কাফির।”
সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪


শেষ কিছু কথা

উপসংহার হিসেবে শাইখ মুস্তাফা কামাল মুস্তাফা আবু হামযা আল-মিসরি (ফাকাল্লাহু আসরাহ)’র কিছু কথা তুলে ধরছি―

“শরিয়াহর অবস্থান হল, জনগণ আর শাসক চুক্তিবদ্ধ। ইসলামে যেকোন চুক্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই এমন দুটি পক্ষ থাকতে হবে যারা চুক্তিবদ্ধ হবে, পাশাপাশি আরেকটি পক্ষ থাকতে হবে, যারা এই চুক্তির সাক্ষী হিসেবে থাকবে। এক্ষেত্রে এই তিনটি পক্ষ হল, জনগণ, শাসক এবং সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। চুক্তিতে অবশ্যই একটি মূল বিষয়বস্তু থাকবে, যার ভিত্তিতে চুক্তিটি সংঘটিত হবে। ইসলামে শাসক ও জনগণের মধ্যে এই চুক্তির মূল শর্ত তথা ভিত্তি হল শরিয়াহ (অর্থাৎ শরিয়াহ দ্বারা শাসন করা)। আল্লাহ নিজে এই চুক্তির সাক্ষী।

এই চুক্তির মাধ্যমে শাসককে আল্লাহর পবিত্র বিধান এবং নির্দেশিকা যথাসম্ভব কায়েমের দায়িত্ব দেয়া হয়। আল্লাহ হচ্ছেন এক্ষেত্রে জনগণ, শাসক এবং শরিয়াহর মধ্যে সেতুবন্ধন স্বরূপ (অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব তথা জবাবদিহিতা এবং আনুগত্যের মাধ্যমে শাসক ও জনগণ একে অপরের সাথে যুক্ত); কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই এভাবে তাঁর দীন এবং শরিয়াকে সাজিয়েছেন, আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন এবং তিনি এটা আনুগত্যের শপথের [সেই শাসকের প্রতি যে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করে] বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছেন এবং এ জন্য তাঁর কাছে প্রতিদান আছে।

তিনি জনগণকে অনুমতি দিয়েছেন তাদের শাসক নির্ধারণ করার, যে শরিয়াহ কায়েম করবে। তিনি শাসককে আদেশ করেছেন আল্লাহর আইন দিয়ে মানুষকে শাসন করার। এক্ষেত্রে আল্লাহ দুনিয়াতে শাসককে অধিকার দিয়েছেন অবাধ্যদের শাস্তি দেবার, যতক্ষণ সে দুনিয়াতে আল্লাহর শরিয়াহ অনুযায়ী কাজ করছে। আল্লাহ জনগণকে সতর্ক করেছেন, শাসক যদি শরিয়াহ দিয়ে না শাসন করে তবে যেন শাসকের আনুগত্য না করা হয়। আর এক্ষেত্রে শাসকের অন্ধ অনুসরণ হচ্ছে এমন একটি কাজ, যা শিরকুল আকবার (বড় শিরক)। জনগণ এবং শাসকের মধ্যে এই চুক্তিটিকে বলে বাইয়াহ।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শাসক যদি শরিয়াহ দিয়ে শাসন না করে তাহলে বাইয়াহর আর বৈধতা থাকে না, কারণ শাসক নিজেই এই ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ইসলামি আইনে, জনগণকে এরকম শাসককে পরিবর্তন করে ফেলতে হবে ন্যায় ব্যবস্থা এবং ইনসাফ [অর্থাৎ ইসলামি শরিয়াহ] প্রতিষ্ঠার জন্য। যদি জনগণ এমনটা করতে অস্বীকার করে, আর সেনাবাহিনীও শাসককে সমর্থন করে, তবে সে ভূমিটি সম্পূর্ণ দারুল হারব হয়ে যায়। আর এই অবাধ্যতার মাধ্যমে সৃষ্টি মালিকুল মুলককে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করে। হকপন্থী আলিমদের উচিত তখন এই শাসককে মুরতাদ ঘোষণা করা এবং এই শাসকের অনুগত দলকে আল্লাহর দৃষ্টিতে কাফির দল [তাইফাতুল কুফর, দলগতভাবে] ঘোষণা করা। এই দলের সকলেই আল্লাহর শত্রু না এবং তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা নিশ্চিতভাবে শুধু পাপী [কবিরা গুনাহগার]। জিহাদ তখন সকল মুসলিমের জন্য ফরয, যতক্ষণ না সঠিক শাসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং শরিয়াহ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হচ্ছে।

আপনারা আজকের শাসকদের দিকে তাকালে দেখবেন, এরা সবাই শাসন করছে ‘চুক্তি’ সম্পূর্ণভাবে ভঙ্গ করে। শরিয়াহ দিয়ে শাসন না করার কারণে তারা নিজেরাই এই চুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছে। তারা কোন বৈধতা ছাড়াই শাসন করছে। তারা হয়ত আমাদের ভাষায় কথা বলে, আমাদের মতই হয়ত গায়ের চামড়া, এমনকি চাপে পড়লে সুবিধা অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহ থেকে হয়ত আমাদের মতই দলিল দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ছুরিতে সর্বদা মুসলিমদের রক্ত লেগেই থাকে, আর তাদের হাত সর্বদা কুফফারদের মিষ্টি খাওয়াতেই ব্যস্ত। এর পাশপাশি তাদের পক্ষ থেকে কুফফারকে দেয়া আরো অন্যান্য সুবিধা দেয়া তো আছেই। যেমন মুসলিমদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো কুফফারদের হাতে তুলে দেয়া, অথবা মুসলিম নারীদের পণ্য হিসেবে কুফফারদের কাছে বিক্রি করে দেয়া। ইসলামের বিরুদ্ধে এই অনবরত যুদ্ধে এসব প্রশাসনের কিছু দুনিয়ালোভী দরবারি শাইখ বা আলিমও আছে। এরা উৎসাহের সাথে যালিমের গুণগান গেয়ে বেড়ায়, আনুগত্য করতে বলে, আর শাসকের স্বপক্ষে ব্যালেট বক্সে ভোটও দেয়। এমনকি যদি শাসকরা গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, প্রকাশ্যেই কুফরি উচ্চারণ করে এবং কুফরি সংঘটন করে তবুও এসব বেতনভোগী, দুনিয়ালোভী আলিমরা শাসকের দাসত্ব থেকে নিবৃত্ত হবে না।”


পরিশিষ্ট

সবশেষে আমরা বলতে চাই, উম্মাহর কোন অংশকে কাফির বলে ঘোষণা করা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। একই সাথে দুনিয়ার লোভে, ভয় বা ভীতির বশবর্তী হয়ে কাফিরকে কাফির বলে চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকা, তাগুতের আনুগত্য এবং কুফরের বৈধতা দেয়া থেকেও আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমরা স্পষ্ট করে তাই বলি যা আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহই একমাত্র বিধানদাতা, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই। তিনি যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা যারা শাসন করে না, আল্লাহর কসম! আল্লাহর ইযযতের কসম! তারা কাফির। এমন শাসকের প্রতি কোন আনুগত্য থাকার প্রশ্নই আসে না। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম ভূখণ্ড বলে স্বীকৃত কোন দেশের কোন শাসকই শরিয়াহ দ্বারা শাসন করে না এবং একারণে শরয়িভাবে তাদের আনুগত্য করার পক্ষে কোন বিধান খুঁজে বের করা সম্ভব না। বরং এসব মুরতাদ, মুশরিক, কুফফার ও তাওয়াগিতের পতন ঘটিয়ে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করা উম্মাহর দায়িত্ব।

একই সাথে আমরা এই বাস্তবতাও স্বীকার করি যে, উম্মাহর সর্বসাধারণের মাঝে এ ব্যাপারে সঠিক বুঝের অভাব আছে। একারণে এসব শাসকদের তাগুত এবং এসব ভূখণ্ডকে দারুল কুফর বলে চিহ্নিত করা হলেও, আমরা সাধারণ মুসলিমদের কুফরি শাসন এবং তাগুতের অধীনস্ত হবার কারণে তাকফির করি না। আমরা এরকম ঢালাও তাকফির থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। মুসলিমদের রক্ত হালাল করার চেয়ে, নিজেদের রক্তের শেষ বিন্দুটুকুও প্রবাহিত করা সহস্রগুণ উত্তম। বরং আমরা বলি, আমাদের দায়িত্ব হল তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ এবং উম্মাহর ফরয দায়িত্বগুলো সম্পর্কে উম্মাহকে সচেতন করা, আর যারা আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে কাজ করছেন তাদের ব্যাপারে উম্মাহকে সঠিক ধারণা দেওয়া ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের জবাব দেওয়া এবং তাদের সৃষ্ট বিভ্রান্তির নিরসন করা; যাতে করে সত্য সুস্পষ্টভাবে সকলের সামনে ফুটে উঠে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান, সাধারণ মুসলিমদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ও আহ্বান তুলে ধরার জন্য এবং সমাপনী বক্তব্য হিসেবে আমরা এখানে শাইখ আলি বিন খুদাইর বিন ফাহাদ আল-খুদাইরের একটি বক্তব্য তুলে ধরছি। আমরা আল্লাহর কাছে দুয়া করি, তিনি যেন আমাদের এই প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং এতে বারাকাহ দান করেন। সাফল্য শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই।

শাইখ আলি আল-খুদাইরের ভাষ্য

যেসব শাসক আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা শাসন করে, হোক তা মানবরচিত আইন কিংবা প্রচলিত রীতিনীতি বা প্রথা, তারা কুফফার-মুশরিকিন। আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

“...তিনি নিজ হুকুমে/আইন প্রণয়নের কর্তৃত্বে কাউকে শরিক করেন না।”
সুরা আল-কাহফ, ২৬

তিনি আরও বলেছেন,

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ

“হুকুম (বিধান-কর্তৃত্ব) শুধুমাত্র আল্লাহর।”
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ৫৭

আর আলিমদের ইজমা হল, শাসকদের এই কুফর হল কুফর আকবার (যা ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করে)। ইবনু কাসির এবং তাঁর সমসাময়িক আহলুস সুন্নাহর অন্যান্য আলিমগণ এই ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

“আর যে আল্লাহর নাযিলকৃত (শরিয়াহ দ্বারা) বিচার-ফায়সালা করে না, সে-ই কাফির।”
সুরা আল-মায়িদা, ৫: ৪৪

তিনি আরও বলেছেন,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا

“আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবি করে যে, যা আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবর্তীণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ইমান এনেছি। অথচ তারা তাদের মোকদ্দমা তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায়।
সুরা আন-নিসা, ৪: ৬০-৬১

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ

‘তাদের কি এমন শরিক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে এমন বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?’
সুরা আশ-শুরা, ৪২: ২১

আর আজকের অবস্থা এরকমই। আমরা দেখি শাসকরা শাসন করছে মানবরচিত আইন দ্বারা, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা এসব আইনকে অন্য নাম দিচ্ছে। কিন্তু আমরা এসব নামের দিকে তাকাই না, বরং আমরা তাকাই এসব আইন-বিধানের বাস্তবতা ও অর্থের দিকে।

যদি কোন বিচারক কোন একটি ক্ষেত্রে শরিয়াহ ত্যাগ করে নিজের খেয়াল-খুশি অনুসারে (মানবরচিত সংবিধান, নিয়ম, ব্যবস্থা, প্রথা ও রীতিনীতি অনুসারে না) বিচার করে, সেক্ষেত্রে এ হল কুফর দুনা কুফর (এমন কুফর, যা ব্যক্তিকে মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয় না)। কারণ হাদিসে আমরা দেখি— “তিন প্রকারের বিচারক আছে। যাদের দুই প্রকার জাহান্নামে যাবে আর এর প্রকার যাবে জান্নাতে। জান্নাতি সে-ই, যে সত্য জানে এবং সত্যের দ্বারা বিচার করে। এমন বিচারক যে তার মূর্খতা দিয়ে মানুষের মধ্যে বিচার করে সে জাহান্নামে যাবে। যে সত্য জানে কিন্তু সত্য থেকে বিমুখ, সেও জাহান্নামে যাবে।”

‘আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়ার জন্য এই শাসকদের ব্যাপারে আমাদের কি করা উচিত?’ এ প্রশ্নের জবাবে শায়খ বলেন, মানবরচিত আইন দ্বারা পরিচালিত তাগুতের আদালতে যাবেন না এবং মিল্লাতু ইবরাহিমের অনুসরণ করুন। মিল্লাতু ইবরাহিম হল—

إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

“তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদাত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের ও আমাদের মধ্যে থাকবে চিরশত্রুতা।”
সুরা আল-মুমতাহিনাহ, ৬০: ৪

আর আল্লাহর এই আয়াতে উপর আমল করুন—

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ

‘অতএব আপনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করুন, যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।’
সুরা আল-হিজর, ১৫: ৯৪

আল্লাহ বলেছেন,

اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ

‘আপনি সেই পথ অনুসরণ করুন, যার আদেশ আপনার রবের পক্ষ থেকে আসে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।’
সুরা আল-আনয়াম, ৬: ১০৬

আল্লাহ আরও বলেছেন,

قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ ۝ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ

বলুন, হে কাফিররা! তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদাত করি না।
সুরা আল-কাফিরুন, ১০৯: ১-২

আপনাকে অবশ্যই এসব শাসকদের ঘৃণা করতে হবে এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে হবে, আর তাদের প্রতি কোন বন্ধুত্ব বা আনুগত্যের মনোভাব পোষণ করা যাবে না।

আল্লাহ বলেছেন,

لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ

‘যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচারণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়।’
সুরা আল-মুজাদালা, ৫৮: ২২

আর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে সাধ্যমত, তাদের ফিতনা প্রতিহত করতে হবে এবং হিজরতের মাধ্যমে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ

‘হে নাবি, কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করুন এবং মুনাফিকদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন।’
সুরা আত-তাওবাহ, ৯: ৭৩

আর যদি আপনি এগুলো করতে অসমর্থ হন, তবে আল্লাহর নিদেশ আসার আগ পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করুন এবং এ সময়ে আপনি যদি অস্ত্রের জিহাদে অসমর্থ হন তবে অন্য কোন উপায়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে শামিল হোন।

فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا

অতএব আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সাথে এর (কুরআনের) সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করুন।
সুরা আল-ফুরকান, ২৫: ৫২

سُبْحَانَكَ اَللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ

পঠিত : ২৫০৪ বার

মন্তব্য: ০