Alapon

শহীদ কারা? কাদের শহীদ বলবো?



‘শহীদ’ (شَهيد,) শব্দটি আরবি । তা এসেছে ‘শাহাদত’ শব্দ থেকে । এটি ইসলাম ধর্মের একটি আরবী পরিভাষা। ‘শাহাদত’ অর্থ হলো, সাক্ষ্য, সনদ, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। ‘শহীদের’ পারিভাষিক অর্থ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর মনোনীত দ্বীন( জীবনব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠার কাজে জীবন কুরবানী করে স্বীয় ঈমানের দাবির যে সত্যতা, সে সত্যতা পূরণের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করলো; তাকে বা তাদেরকেই শহীদ বলা হয় । আরবি ডিকশনারি ‘মু’জাম আল-অসীত’-এর লেখক ‘শহীদ’ শব্দের অর্থ করে লিখেছেন, “ শহীদ হচ্ছে তিনি, যিনি আল্লাহর পথে নিহত হওয়ার জন্য নিজকে পেশ করলেন” (আল মু’জাম আল-অসীত ১/৪৯৭)।
শহীদ বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যাকে কাফেররা হত্যা করে যেকোন কারণেই হোক। অথবা ইসলামী খিলাফতের বিরুদ্ধাচরণকারীর হাতে মৃত্যু অথবা কাফেরদের সাথে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে মুসলিমদের পক্ষে অংশগ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করা কে বলা হয় শহীদ।তাকে শহীদ এজন্য বলা হয় যে, সে জান্নাতে সরাসরি রক্ত মাথা অবস্থায় উপস্থিত হয়ে যায়। (ফিক্বহুল ইবাদাত, কিতাবুস সালাত, ১০ম অধ্যায়, জানাযা-১/১২৩)

চার মাজহাবের দৃষ্টিতে শহীদ :


হানাফি মাজহাবে শহীদ: হানাফি মাজহাবে শহীদ বলতে বুঝানো হয়েছে সেই মুসলিম ব্যক্তিকে, যিনি অত্যাচারিত বা নির্যাতিত অবস্থায় নিহত হয়েছে । চাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন অথবা কোনো বিদ্রোহী কিংবা কোনো শত্রু তাকে হত্যা করুক অথবা কো্নো চোর বা ডাকাত তাকে নিহত করুক’।
শাফেয়ী মাযহাব অনুযায়ী, ‘দুনিয়া ও আখিরাতের শহীদ হলেন, যিনি গনীমতের মাল গোপনে আত্মসাৎ অথবা মানুষের বাহবা কুড়ানোর উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কালিমার আহ্বান ব্যাপৃত করার উদ্দেশ্যে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন’।
হাম্বলী মাযহাবে বলা হয়েছে, ‘শহীদ তিনি, যিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার সময় নিহত হয়েছে’ ।
মালিকি মাযাহাবের ভাষ্যমতে, ‘শহীদ ওই ব্যক্তি, যাকে কোনো কাফির যোদ্ধা হত্যা করেছে অথবা মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে লড়াইয়ে মারা গিয়েছে’ । (কিতাবুল ফিকহ ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ ১/৫২৭-৫২৯)

আসহাবে রাসুল শহীদ বলতে যাদেরকে বুঝতেন? :

আসুন আমরা একটু দেখি যে, সাহাবায়ে কেরাম কাঁদেরকে শহীদ বলে মনে করতেন। একদিন রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কাদেরকে শহীদ বলে গণ্য করো? সাহাবায়ে আজমাইনের জবাব ছিলো কী ?
তাঁরা বললেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে নিহত হয় সেই তো শহীদ।" (মুসলিম ৪৮৩৫)

তাহলে বুঝা গেলো যে, শহীদ শব্দটা ধর্মের পক্ষের শব্দ। ধর্মীয় শব্দ। এবং তা ইসলাম ধর্মের নিজস্ব শব্দ। আমরা এ-ও বুঝতে পারলাম যে, শহীদ বলা হয় তাঁকে, যিনি আল্লাহর রাস্তায় জীবন দেন, যিনি আল্লাহর দ্বীনের জন্যে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে জীবন দেন। যেই মুসলিম সত্য-ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় জীবন দেন তিনি শহীদ। এছাড়াও একজন মুসলিম যদি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি শহীদ, যদি কেউ এক্সিডেন্ট হয়ে মারা যান তিনি শহীদ।
কারা শহীদ না?:
কিন্তু কেউ যদি সেকুল্যারিজম প্রতিষ্ঠার জন্যে জীবন দেন তিনি শহীদ না। কেউ যদি ইসলাম এবং মুসলমানদের সাথে শত্রুতা থেকে জীবন দেন তিনি শহীদ না। কোনো মুনাফিক শহীদ হতে পারেনা। বরঞ্চ আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য বিধানের প্রতি আনুগত্য করে, ভিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মারা যাবার জন্যে আল্লাহর আজাবে সে পাকড়াও হবে। কোনোতা ধর্মনিরপক্ষেতাবাদী, সমাজতন্ত্র কিংবা জাতীয়তাবা্দী শহীদ না। এসব ইসলামে হারাম। নিষিদ্ধ। একজন মুসলিম সচেতনভাবে এসবের জন্যে সংগ্রাম করতে পারেনা। আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুই গ্রহণীয় নয়। সুতরাং যে কাউকে শহীদ বলা থেকে বিরত থাকুন। শহীদ বলতে সাবধান থাকুন। শহীদ শব্দটার ওজন অনেক। এটা কুরআনুল কারিমের শব্দ। গীতা বা উপনিষদের শব্দ না। সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের সাথে শহীদ শব্দের প্রয়োগ করবেন না। আল্লাহ শহীদদের নিজের থেকে রিজক দেন, তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। পবিত্র কুরআনুল কারিম আমাদের জানাচ্ছে, وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ "যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে তোমরা তাদেরকে মৃত মনে কর না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিক প্রাপ্ত”। (সূরা-৩ আল-ইমরান:১৬৯)। কিন্তু আল্লাহর বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী, কুফু/রি ও শিরকককারী কি এ মর্যাদা পাবেন? কস্মিণকালেও না!
অন্যত্র আল্লাহ রব্বুল আলামিন স্পষ্টত শহীদদেরকে মৃত বলতেও নিষেধ করেছেন।
وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِنْ لَا تَشْعُرُونَ [٢:١٥٤ অর্থাৎ 'আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।' (সূরাহ আল বাক্বারা : ১৫৩)।

শহীদদেরকে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের হাদিস :


مَا أَحَدٌ يَدْخُلُ الجَنَّةَ يُحِبُّ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الدُّنْيَا، وَلَهُ مَا عَلَى الأَرْضِ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا الشَّهِيدُ، يَتَمَنَّى أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الدُّنْيَا، فَيُقْتَلَ عَشْرَ مَرَّاتٍ لِمَا يَرَى مِنَ الكَرَامَةِ 'কোনো জান্নাতী এটা চাবে না যে, তাকে আবার দুনিয়াতে পাঠানো হোক, যদিও তাকে সারা পৃথিবীর মালিক বানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু একজন শহীদ তাঁর জান্নাতী মর্যাদা প্রত্যক্ষ করে কামনা করতে থাকবে, তাকে অন্তত দশবার দুনিয়াতে পাঠানো হোক, যেন প্রতিবার সে শহীদ হয়ে আসতে পারে।' বুখারী, হাদীস নং ২৮১৭
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও শহীদী মৃত্যুর তামান্না করতেন। وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ… لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ
'ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার বড় ইচ্ছে হয়, আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হবো! আমাকে জীবিত করা হবে, আবার আমি নিহত হবো! পুনরায় আমাকে জিন্দা করা হবে এবং আমি আবার আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দিবো!' (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭২২৬)
এই যে শহীদদের এতো এতো মর্যদা, কিন্তু আল্লাহর বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী, কুফু/রি ও শিরকককারী কি এ মর্যাদা পাবেন? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কিংবা জাতীয়তাবাদীরা কি সেই একই মর্যদা পাবেন? কস্মিণকালেও না!

যা-ইহোক, মোটের ওপর সেকুলারিজমের ধারক-বাহকরা, সমাজতন্ত্রীরা নৈতিকভাবে অসৎ। এরা সারাদিন ধর্মকে একহাত দেওয়ার পরেও দিনশেষে ধর্মের ঘরেই আশ্রয় নেয়। কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রী-সেকুলারদের সবচেয়ে বড়ো পরাজয় এটিই যে, এরা ঘুরেফিরে ধর্মের কাছেই আশ্রয় নিতে হয়। ধর্মের কোলেই মাথা রাখে। সারাক্ষণ ধর্মের পিণ্ডি চটকালেও ধর্ম ছাড়া এরা অচল! তারা তাদের দলের ভগবান চক্রবর্তী মারা গেলেও তাকে বলে 'শহীদ ভগবান চক্রবর্তী'। এরা ধর্মনিরপেক্ষতার সবক দিলেও শেষমেষ নিজেরাই নিরপেক্ষ থাকতে পারেনা। এদের কোনো কমরেড কোনোভাবে খুন হলেও এরা তাকে শহীদ বলে চালিয়ে দেয়। শেষ পর্থযায়ে আবারো বলি; শহীদ শব্দটি ধর্মের পক্ষে। ধর্মের পরিভাষা, ধর্মনিরপক্ষতার না।

আল্লাহর দ্বীন আল-ইসলামে শহীদের মর্যাদা অত্যন্ত ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ। এটি নিরেট একটি ইসলামি পরিভাষা। কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিভাষা নয়। সুতরাং শহীদের মর্যাদা লাভের জন্য প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে মুসলিম হতে হবে। কোনো নাস্তিক-কমিউনিস্ট-জাতীয়তাবাদী-সমাজতন্ত্রী-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী কখনোই শহীদ না। ইসলামের দৃষ্টিতে এহেন ব্যক্তিদের শহীদ বলা জায়েজ নেই।

~ রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ১১৬৩ বার

মন্তব্য: ০