Alapon

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং কিছু কথা...



চূড়ান্ত পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ৩য় পুরুষ পর্যন্ত মানুষের পরিচয়ের সূত্র টানা হয়ে থাকে। ধরুন আপনার জন্ম ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে। আপনার বাবা হায়দারের জন্ম ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে। আর আপনার দাদা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র জন্ম ১৯৩০ সালে বৃটিশ ভারতে।

এখন আপনি নিজের পরিচয়ের সূত্র ধরে আপনার বাবার দেশের জন্য কি উৎসব পালন করতে পারবেন? মানে, ১৪-ই আগষ্টে।

পালন করা দূষণীয় নয়। কারণ, এটা আপনার বাবার দেশ। এখন দুই দেশের শত্রুতা আপনাকে উৎসব পালনে বাঁধা দিতে পারবে না। কারণ, বাঁধা প্রদান 'জায়েজ' হবে না।

১. কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর জন্মবার্ষিকী পালন বা সেই দিন ফাতেহা পাঠ করা, না-করা এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার। তবে এটা স্পষ্ট থাকা জরুরি, শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাঙালি জাতির জনক হিশেবে পরিচিত অনুরুপ জিন্নাহ হচ্ছেন, "কায়েদে আজম - মহান নেতা" বা "বাবা-য়ে কউম বা জাতির পিতা।" ১৯৭১ না হলে বাঙালীদের কাছেও এটাই হতো তাঁর পরিচয়। কিন্তু এখন তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে গেছেন পাকিস্তানিদের কাছেই। তবে আমাদের বাপ-দাদারা পালন করতে দোষ নাই। ক্রিটিক করা সম্ভব?

২. দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে প্রথম আলাপ জিন্নাহ তোলেন নাই। তাঁর ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু কংগ্রেসের নেতাদের ভেতর মুসলিম বিদ্বেষ তাকে এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধ্য করেছে। তবে একটা সময় পরে সে এটা নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগেছে। তাই একবার বলেও ফেলেছে, পাকিস্তান আমার সৃষ্টি, মুসলিম লীগের না। মূল হোতা ছিল, কংগ্রেসের সরদার বল্লভ প্যাটেল। মৌলানা আজাদ খুব করে চেয়েছেন, ভাগ না হোক। গান্ধীজির-ও একই কথা। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু আর সরদার বল্লভ প্যাটেলের চাপাচাপিতে গান্ধীজি নরম হয়ে যান। অথচ তার লাশের ওপর ভর করে ভাগ করতে হবে বলে গান্ধীজি মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন।

মৌলানা আজাদের বর্ণনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু এখন সরদার প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন।

৩. জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ব্যাপারে কঠোরতার সাথে ভাষণ দিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একই বিষয় তুলে এনেছেন। কিন্তু তার বক্তব্যের পোশাক ভাষা হলেও দেহ ছিল ঐক্য। তিনি বারবার বলছিলেন, উর্দু-ই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কিছু না। কিন্তু তিনি ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে এ ঘোষণা দেন। এ থেকে সুস্পষ্ট বুঝে আসে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঐক্য। কারণ, ভাষার মাধ্যমে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার নজির আছে। আবার বিচ্ছিন্ন করার উদাহরণও বিস্তর। বৃটিশরা ভারত বর্ষে ঢুকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ফার্সি সরিয়ে এর জলজ্যান্ত প্রমাণ দিয়েছিল। সামান্য বুদ্ধি থাকলেও বুঝে আসবে বিষয়টা।

জিন্নাহ পাঞ্জাবের মানুষ ছিলেন। উর্দু জানতেন না। কিন্তু জিন্নাহ যা চাননি বা বাঙালী নেতারা যা বুঝেছিলেন তার ছিল মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। কিন্তু এই এক সূত্র ধরে এত মানুষের জীবন নিয়ে খেলার কোন মানেই ছিল না। আমাদের জাতীয় নেতারাও নিজেদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছিলেন। এটা সত্য, পাকিস্তান আমাদের থেকে অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এটাও সত্য। যা শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাষায় শুনে নিই—

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, "গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া যাবে না। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, বুঝতামও না।"

এ সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাঁদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি-না? বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন।

ঐ ফর্মুলায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ হবে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। শেখ মুজিবের বর্ণনা অনুযায়ী, ঐ গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে সেটি নির্ধারিত হবার বিষয়টি ফর্মুলায় উল্লেখ করা হয়েছিল।
এ ফর্মুলা নিয়ে শরৎ বসু গান্ধীর সাথে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করতে যান।

শরৎ বসুকে উদ্ধৃত করে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, এ ফর্মুলা নিয়ে মি. জিন্নাহর কোন আপত্তি ছিলনা, যদি কংগ্রেস রাজি থাকে।

অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছিল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোন ফর্মুলা মানতে পারবে না।

ঐ ফর্মুলা নিয়ে শরৎ বসু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফেরত এসেছিলেন বলে উল্লেখ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, "শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের তবে আমি এটা বলছি না, শুধু ভাষার জন্য-ই জল ঘোলা হয়েছিল। ভাষা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যানার। শেখ মুজিব নিজেও কি সুস্পষ্টভাবে স্বাধীন বাংলা চেয়েছিলেন নাকি শুধু জুলুমের নিপাত যাক এটাই চেয়েছিলেন? বিষয়টা বোঝার জন্য ৭-ই মার্চের ভাষণটা ভালো করে শুনে নিবেন। তাছাড়া এখনকার মতো ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালীরা ভিনদেশী কারো নেতৃত্ব মানতে নারাজ। কিন্তু তাদেরকে মানাতে উঠেপড়ে লেগেছিল মুসলিম লীগের নেতারা। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েই কিন্তু নেতা হওয়ার উপযুক্ত সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আনা হলো। আর কলকাতা হাত ছাড়া হলো। এক্ষেত্রে জিন্নাহ ভুল করেছিলেন। মৌলানা আজাদ কি বলেছিলেন শুনি— এমনটি যে ঘটবেই, পাকিস্তানের জন্মের অব্যবহিত পূর্বেই দিব্যদৃষ্টিতে তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের একান্ত দূরদর্শী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ।

সে সময়েই তিনি নিরাবরণ স্পষ্টভাষায় লিখেছিলেন-
‘আরেকটা বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি জানেন না, বাংলাদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে। ...বাংলাদেশের পরিবেশ এমনই যে, বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং তখনই বিদ্রোহ করে, যখন ...তাদের অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। যতদিন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী জীবিত আছেন, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি তাদের বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু ওরা যখন থাকবেন না, তখন যে কোনো ছোট ছোট ঘটনায় ওদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার থেকে একেবারে আলাদা। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এখন তাদের মনে যে উষ্ণতা আছে, তা পরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে এবং বিরোধ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠবে। তখন বাইরের শক্তিগুলো এতে ইন্ধন জোগাবে ও একসঙ্গে এই ভূখন্ড আলাদা হয়ে যাবে।

রেসকোর্সের ভাষণে জিন্নাহ সতর্ক করে বলেছিলেন- the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language.
Anyone who mislead you is really the enemy of Pakistan. Without state language, no nation can remain tied up solidly together and function. Look at the history of every government judgment substitute language. Therefore, so far as the State language is concerned, Pakistan's state language shall be Urdu

এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, কমিউনিস্ট আন্দোলন। প্রতিটা দেশে তারা নিজেদের গোপন তৎপরতা চালিয়েছিল। তুরস্কেও করেছিল। ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশেও চালিয়েছে। নিরঙ্কুশভাবে কমিউনিজমকে মন্দের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি না। কিন্তু তারা অতিরিক্ত ভালো চাইত খারাপ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে। এটা অবশ্যই সংশোধনীয়। কমিউনিস্ট ও বিদেশি চর থেকে সতর্ক করেছিলেন জিন্নাহ। এসব থেকে একটা বিষয়-ই সুস্পষ্ট হয়- তিনি ঐক্য চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থতার কারণে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই পরবর্তীরা। পাকিস্তানের হিস্টোরিয়ান আয়েশা জালালও একই কথা বলেন, জিন্নাহর উদ্দেশ্য সৎ ছিল কিন্তু এপ্রোচে ভুল ছিল।

জিন্নাহকে নিয়ে পড়ার ও লিখার অনেক কিছু আছে। তবে একটা তথ্য যা ওপরের লাইনটার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৬-ই ডিসেম্বর বিবিসি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তরুনদের কাছে দুই দেশ ও ৭১ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন রেখেছিল। তখন বাঙালীদের উন্নাসিকতা আমাকে মনঃক্ষুণ্ন করেছে। বিশেষ করে একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো পাকিস্তান সম্পর্কে আপনি কি জানেন? সে বলল, যে দেশ আমাদেরকে হত্যা করেছে, ওয়ার করেছে তাদের নিয়ে জানার কেন আগ্রহ-ই তৈরী হয়নি আমার।
অথচ পাকিস্তানিরা ছিল পজিটিভ।

শেষ কথাঃ লেখায় অস্পষ্টতা থাকলে বলবেন। উত্তর দেবার চেষ্টা করব। আমাকে আরও তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারেন। লেখাটা আজই লিখলাম। কিন্তু দু'দিন আগে ২৫ তারিখে পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর জন্মবার্ষিকী ছিল। আমার দেশ যেমন সত্য তেমন আমার সত্য-ও একটি সত্য। আমি সত্যকে ভালোবাসি।

তথ্য সূত্রঃ বিভিন্ন আর্টিকেল ও নিবন্ধ। (আর ব্যাক্তিগত পর্যবেক্ষণ)

পঠিত : ৬৭২ বার

মন্তব্য: ০