Alapon

"লাল কেল্লা"



ইতিহাস ও অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন রেড ফোর্ট বা লালকেল্লা। খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত এ দুর্গটি ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। পুরনো দিল্লির যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই দুর্গটি মুঘল স্থাপত্য এবং চিত্রকলার উৎকর্ষতার এক অনন্য উদাহরণ। বৈচিত্র্যময় অলংকরণ আর বর্ণময় শৈল্পিক ব্যঞ্জনা কেল্লাটিকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করতে চাইলে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান কেল্লাটির নির্মাণকার্য শুরু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট স্থপতি উস্তাদ আহমদ লাহৌরী এবং উস্তাদ হামিদের উপর ভার পড়ে কেল্লা নির্মাণের। সুবৃহৎ এই কেল্লার নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় নেয় প্রায় ১০ বছর। ১৪টি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট এই কেল্লাটির প্রধান দুটি প্রবেশপথ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান দুটি শহর লাহোর এবং দিল্লির দিকে মুখ করে তৈরি করা হয়। যার একটি দিল্লি গেট অপরটি লাহোরি গেট।লাহোরি গেটের সম্মুখের চাঁদনী চৌক শহরের সবচেয়ে জনবহুল ও বৈচিত্র্যময় বিপণি।
ভারতের দিল্লীতে নেতাজী সুভাষ মার্গে অবস্থিত লাল কেল্লা ভবনটি মূলত লাল কেল্লা ও ১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত সেলিমগড় দুর্গের সমন্বয়ে গঠিত। দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণের প্রাচীর সেলিমগড় দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত। কেল্লার বিশাল প্রাচীর চতুর্দিকে কুমিরপূর্ণ পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। যমুনার জলে পরিখাগুলোয় পানি সিঞ্চন করা হতো।এই দুর্গে সম্রাটের পরিবারবর্গ বসবাস করায় সম্রাট শাহজাহান এর নাম দিয়েছিলেন কিলা-ই-মুবারক বা আশীর্বাদধন্য দূ্র্গ। পরবর্তীতে এটি ‘লাল কেল্লা’ বা ‘রেড ফোর্ট’ নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করে। সম্পূর্ণ লাল বেলে পাথর ও ইট দিয়ে তৈরি হওয়ায় কেল্লাটির নাম দেওয়া হয় লাল কেল্লা। কেল্লার বিভিন্ন অংশে চুনাপাথরের ব্যবহারে এর প্রকৃত রঙ ছিল শ্বেতবর্ণ। কিন্তু আবহাওয়া, জলবায়ু ও দূষণের প্রভাবে একসময় এই শুভ্রতা মলিন হতে থাকায় ইংরেজরা দুর্গের দেয়ালে লাল রং করে দেয়।লালকেল্লার বিশাল প্রাচীর পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
কেল্লার প্রবেশদ্বার হতে একটু সামনে এগুলেই চোখে পড়ে বিশাল নহবতখানা। এখানে নানা সুরের মূর্ছনায় স্বাগত জানানো হতো সম্রাটদের।দিওয়ান-ই-আম লালকেল্লার প্রধান দুটি মহলের অন্যতম। এটি মূলত একটি সভাগৃহ। মূল্যবান পাথর খচিত এবং সোনা-রুপার কারুকার্যে মোড়া 'ঝরোখা' নামের সিংহাসনে বসে সম্রাট জনসাধারণের সাথে মত বিনিময় করতেন। তিনদিকে খোলা এ মহলটির দেয়াল নানারকম ফুল লতা-পাতার নকশায় অলংকৃত।
অপর প্রধান মহলটি হলো দিওয়ান-ই-খাস। পুরোপুরি শ্বেতপাথরে মোড়া এ মহলটি ছিল সম্রাটের ব্যক্তিগত দরবারগৃহ। ফুলের নকশা বিশিষ্ট সাদা মার্বেল পাথরের পিলার,কারুকার্যময় মার্বেল পাথরে মোজাইক করা মেঝে এবং অপূর্ব সুন্দর নকশায় সজ্জিত দেয়াল এই মহলকে দিয়েছে অনন্য এক মাত্রা। এখানেই থাকতো কোহিনুর হীরা শোভিত সম্রাটের বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন।
সম্রাট পরিবারের কক্ষগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে নহর-ই-বেহিস্ত (স্বর্গোদ্যানের জলধারা) নামক নজরকাড়া এক ঝর্ণাধারা।দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণের শাহবুর্জ মিনারে যমুনা নদীর টলমলে জল টেনে তুলে এই জলধারাকে প্রাণবন্ত রাখা হতো। 'যদি পৃথিবীতে কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে তবে তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই' প্রাসাদের আভ্যন্তরীণ চমকপ্রদ কারুকার্যখচিত নকশাগুলো যেন এরই প্রতিচ্ছবি। মুঘল স্থাপত্য শৈলীর এক শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ এই সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণ। প্রাসাদের সর্বদক্ষিণে রয়েছে মুমতাজ মহল এবং রংমহল। সম্রাট পত্নী ও দাসীদের বাসস্থান রঙ মহলের দেয়াল নানারকম মূল্যবান পাথরের নজরকাড়া নকশায় অলংকৃত। সোনা-রুপার কারুকার্যে মোহনীয় সিলিংয়ের চমক শ্বেত পাথরের মেঝেতে স্বর্গীয় আবেশের সৃষ্টি করে।
কেল্লার পশ্চিমে রয়েছে সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরে নির্মিত তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোতি মসজিদ, যা ১৬৫৯ সালে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগত মসজিদ হিসেবে নির্মাণ করেন।কেল্লার উত্তরে রয়েছে হায়াত বক্স বাগ বা জীবন প্রদায়ী উদ্যান।মনমুগ্ধকর এ উদ্যানের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে পরস্পরছেদী দুটি জলধারা।
১৯১১ সালে লাল কেল্লার মমতাজ মহল এবং নহবতখানার অংশবিশেষ নিয়ে তৈরি করা হয় 'ইন্ডিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’। বর্তমানে কেল্লাটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে। পুরনো দিল্লির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এবং সর্ববৃহৎ স্থাপনা এই লালকেল্লা। কেল্লার প্রাঙ্গনে প্রতি বছর ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০৭ সালে ইউনেস্কো লাল কেল্লাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই লালকেল্লা প্রতিবছর অসংখ্য দর্শনার্থীকে তার নজরকাড়া সৌন্দর্য আর মুঘল স্থাপত্যের আভিজাত্য গাম্ভীর্যে বিমোহিত করে।

"লাল কেল্লা"
সংকলক: তাকিয়া বিনতে মিজান

পঠিত : ১১২৩ বার

মন্তব্য: ০