Alapon

আন্দালুসের পতন একদিনে হয়নি


আন্দালুসের পতন একদিনে হয়নি। সমৃদ্ধ শহর টলেডোর পতন হয় ৪৭৮ হিজরিতে (১০৮৫ খ্রিস্টাব্দ)। কর্ডোভার পতন হয় ৬৩৩ হিজরিতে (১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ)। আন্দালুসে মুসলিম শাসিত সর্বশেষ শহর গ্রানাডার পতন ঘটে ৮৯৭ হিজরিতে( ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে) এবং এর মধ্য দিয়েই মুসলমানদের হাতছাড়া হয় আন্দালুস। মুসলমানদের উপর নেমে আসা অন্যসব বিপর্যয়ের মত আন্দালুসের পতনেও ক্রিয়াশীল ছিল পুরনো দোষত্রুটি। কোরআনুল কারিম পতনের যে কারণ নির্দেশ করেছে তার ব্যত্যয় ঘটেনি আন্দালুসের পতনেও।

আন্দালুসের পতন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখি সেখানে বেশ কিছু কার্যকারণ ছিল। যেমন,

১। গোনাহ ও অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়া।

যুগে যুগে মুসলমানদের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সমাজে গোনাহ পাপাচার বৃদ্ধি পাওয়া। এই বিষয়ে কোরআনুল কারিম বারবার সতর্ক করছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

وَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُواْ فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا

যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন তাদের বিত্তবান লোকদের (ঈমান ও আনুগত্যের) হুকুম দেই, কিন্তু তারা তাতে নাফরমানিতে লিপ্ত হয়, ফলে তাদের সম্পর্কে কথা চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং আমি তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলি। (১)

ইবনু কাসির রহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন, এর অর্থ তাদেরকে আনুগত্যের আদেশ দেয়া হলেও তারা পাপাচারে নিমজ্জিত হয় এবং শাস্তির যোগ্য হয়। (২)

আন্দালুসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি সেখানে পাপাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইবনু হাইয়ান কুরতুবি দুঃখের সাথে স্বীকার করেছেন এই বাস্তবতা। আন্দালুসের পতনের সূচনা দেখেছিলেন তিনি। তিনি লিখেছেন, তাদের মন-মগজ নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে মূর্খতা, মন-মগজ দখল করেছে মিথ্যাচার। পাপাচার ও দোষত্রুটি তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ফলে তারা না হয়েছে হেদায়েতের পথের মুত্তাকি, আর না হয়েছে গোমরাহির বিরুদ্ধে শক্তিশালী।(৩)

আন্দালুসের সমাজে পাপাচারের নানা ধরন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষদিকেই সেখানে মদপানের অভ্যাস গড়ে উঠে। শাসকদের অনেকেই মদপান করতেন। এমনকি হাকাম বিন হিশাম উমাবী (শাসনকাল ১৮০-২০৬ হিজরী) মদপানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার কারণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাঝেও মদপানের অভ্যাস গড়ে উঠে।(৪)

কয়েক শতাব্দী পরে মদপানের বিষয়টি সমাজে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠে যে নেককার মানুষরা মদপান না করলেও মদের আসরে বসে আড্ডা দিতেন, বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতেন এবং কোনো প্রতিবাদ করতেন না। যেমন, প্রখ্যাত যাহেদ আবুল হাসান জাফর বিন ইবরাহিম অনেক সময় মদের আসরে উপস্থিত হতেন।(৫) কবি সাহিত্যিকরাও ব্যাপকহারে মদপানে লিপ্ত হতেন। মদ নিয়ে তাদের রচিত অসংখ্য কবিতা এ কথার সাক্ষ্য দেয়। (৬)

সে সময় নানা অশ্লীলতাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ সম্পর্কের কথা জানা যায়। সমাজে বেপর্দা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রানাডার শাসক আবুল হাসান গালিব বিল্লাহ একজন খ্রিস্টান নারীর জন্য নিজের স্ত্রী সন্তানকেও ত্যাগ করেছিলেন (৭) এসবই নির্দেশ করে এমন একটি সমাজের, যা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল এবং পতনের অপেক্ষা করছিল।

২। অমুসলিমদের সাথে অতিরিক্ত মেলামেশা ও দহরম মহরম
মুমিনদের প্রতি কোরআনের নির্দেশনা হলো, অমুসলিমদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

لاَ يَرْقُبُونَ فِي مُؤْمِنٍ إِلاًّ وَلاَ ذِمَّةً وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُعْتَدُونَ

তারা মর্যাদা দেয় না কোন মুসলমানের ক্ষেত্রে আত্নীয়তার, আর না অঙ্গীকারের। আর তারাই সীমালংঘনকারী।(৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

হে মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।(৯)

আন্দালুসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানে ঠিক এই বিষয়টিই হয়েছিল। বিভিন্ন সময় শাসকরা অমুসলিম শাসকদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জারাগোজা শহরের অধিপতি ইমাদুদ্দৌলা ক্ষমতায় এসেছিলেন কাফেরদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তিনি ভুলে গেলেন প্রতিশ্রুতি। খ্রিস্টানদের সাথে তিনি গড়ে তুললেন সম্পর্ক, যে সম্পর্কে আন্দালুসের রাজনৈতিক স্বার্থের দিকটি অবহেলিত রেখে প্রাধান্য দেয়া হলো ব্যক্তিগত স্বার্থকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠে যে জনগণ বাধ্য হয়ে মুরাবিতিনদের সাহায্য চায়।(১০)

গ্রানাডার শাসক আবদুল্লাহ বিন বালকিন মুসলিম শাসনাধীন ইশবিলিয়া দখলের জন্য সাহায্য চান খ্রিস্টানদের। পরে খ্রিস্টান সেনাদের সাথে নিয়ে তিনি হামলা চালান ইশবিলিয়ায়।(১১)

৩। পার্থিব জীবন নিয়ে ব্যস্ততা ও জিহাদি চেতনার বিলুপ্তি।
প্রাচুর্যতার যুগে প্রবেশের সাথে সাথে আন্দালুসে পার্থিব জীবনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি দেখা যায়। একই সাথে হ্রাস পায় উম্মাহর প্রতি দরদ ও কল্যাণচিন্তা। মূলত এতই ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যারা ভোগ বিলাসিতা ও প্রাচুর্যে ডুবে যায়, সংগ্রামবিহীন জীবন হয়ে উঠে তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোরআনে বারবার এই বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে এভাবে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انفِرُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الأَرْضِ أَرَضِيتُم بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الآخِرَةِ إِلاَّ قَلِيلٌ - ​​إِلاَّ تَنفِرُواْ يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلاَ تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

হে মুমিনগণ, তোমাদের কী হল যে, যখন তোমাদেরকে বলা হয় আল্লাহর পথে অভিযানে ব্যের হও, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাও। তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট আছ? (যদি তাই হয়) তাহলে (স্মরণ রেখো) আখিরাতের পরিবর্তে পার্থিব জীবনের আনন্দ অতি সামান্য। তোমরা যদি অভিযানে ব্যের না হও তবে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থানে অন্য কোনো জাতিকে আনয়ন করবেন এবং তোমরা তার কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ন ক্ষমতা রাখেন।(১২)

আন্দালুসের ইতিহাসে আমরা দেখি আবদুর রহমান আন নাসিরের যুগে জনগণ একের পর এক জিহাদি অভিযান দেখে অভ্যস্ত ছিল, সে সময় শাসকরা প্রতিবছর নিয়ম করে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অভিযান পরিচালনা করতেন। কিন্তু পরের দিকে এসে এই ধারা রক্ষা হয়নি। জনগণ, শাসক ও সেনাবাহিনী সবাই হয়ে উঠেছিল বিলাসী জীবনের ক্রেতা। মূলত তাদের এই গাফলত তাদের পতন তরান্বিত করেছিল।

৪। শাসকদের অযোগ্যতা

আন্দালুসের শাসকদের জীবনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুরুর দিকের শাসকদের চেয়ে পরের দিকের শাসকরা অযোগ্য ছিলেন। মূলত এতই ইতিহাসের এক স্বাভাবিক বাস্তবতা। উমাইয়া ও আব্বাসি যুগেও আমরা দেখি শুরুর দিকের শাসকদের চেয়ে পরের দিকের শাসকরা দূর্বল ছিলেন। নিজেদের অজান্তেই তারা রাজত্বের ভিত দূর্বল করে ফেলেছিলেন। আন্দালুসেও এই বিষয়টিই হয়েছিল। যে আব্দুর রহমান আদ দাখিলের হাত ধরে আন্দালুসে মুসলিম শাসনের ভিত শক্তপোক্ত হয়, তার নাতী হাকাম বিন হিশাম মাত্রাতিরিক্ত জুলুম ও অত্যাচারের মাধ্যমে তা দূর্বল করে ফেলেন। মুতামিদ বিন আব্বাদের ক্ষেত্রে আমরা দেখি তিনি রাজকার্য পরিচালনার নানা যোগ্যতার অধিকারী হলেও নিজের বিলাসী চরিত্র ও ইন্দ্রিয়নির্ভর পাপাচারের কারণে শাসন ক্ষমতা সুসংহত করার পরিবর্তে দূর্বল করে ফেলেন।

গ্রানাডার সর্বশেষ শাসক আবু আবদুল্লাহর ক্ষেত্রেও আমরা দেখি তিনি ছিলেন একজন অযোগ্য, দূর্বল শাসক। খ্রিস্টান শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজত্ব রক্ষার মত সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনোটিই ছিল না তার। এমনকি মুসা বিন আবি গাসসানের জ্বালাময়ী ভাষণ ও জিহাদি কর্মকান্ড দেখেও উদ্দীপ্ত হননি তিনি।(১৩)

লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিবের কলমে ফুটে উঠেছে সে সময়কার শাসকদের বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন, তাদের মাঝে ছিল না শাসন চালানর যোগ্যতা, কিংবা দক্ষতা। তারা কোনো শহর কেড়ে নিয়েছেন, কিছু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন, সাথে সাথে সেনাবাহিনী গঠন করে বিভিন্ন লকব আর উপাধি নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন। কবি সাহিত্যিকরা তাদের প্রশংসা করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কাগজ শেষ করেছে, জ্ঞানীরাও তাদের দ্বারে অপেক্ষা করে কৃপা কুড়িয়েছেন, আর শাসকরা ব্যস্ত ছিল নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায়। তাদের অবস্থা তো এমন ছিল যদি উমর ইবনে আবদুল আজিজ তাদের কাছে আসতেন, তাহলে তার সাথে তারা সাক্ষাতও করতো না। নসিহতগ্রহন তো পরের কথা। এভাবেই তারা শাসন করেছেন দিনের পর দিন, আর জাতির সামনে রেখে গেছেন হতাশার পথ। অবশ্য অহংকার প্রকাশে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। এজন্যই তারা নিজেদের উপাধি দিতেন বাহারি নামে। যেমন, মুতামিদ, মুতাযিদ, মানসুর, নাসির, মুওয়াফফাক, মুসতাকফি, মুস্তাযহির, মুসতাইন, মুরতাযা ইত্যাদি। (১৪)

টীকা
১। সুরা বনী ইসরাইল, ১৬
২। তাফসিরে ইবনে কাসির, ৩/৩৩।
৩। আয যখিরা, ৫/১৮৯।
৪। নিহায়াতুল আরব, ২৩/২১৭। তবে ইতিহাসবিদ ইবনু সাইদ মাগরেবির বর্ননা থেকে জানা যায় মৃত্যুর দুবছর আগে তিনি তওবা করেন এবং সকল জুলুম অত্যাচার ছেড়ে নিজের সবচেয়ে যোগ্য শাসককে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন। দেখুন, আল মুগরিব ফি হুলাল মাগরিব, ১/৪৩।
৫। নাফহুত তিব, ৩/২৫৮।
৬। এমন কিছু কবিতার জন্য দেখুন, আল মুগরিব ফি হুলাল মাগরিব, ১/৩৪৯। নাফহুত তিব, ৩/৪৫২। খরিদাতুল কসর, ১৫/৫৬৫।
৭। বিস্তারিত জানতে দেখুন, নাফহুত তিব, আয যখিরা।
৮। সুরা তাওবা, ১০।
৯। সুরা মায়েদা, ৫১।
১০। বিস্তারিত জানতে দেখুন, তারিখু ইবনি খালদুন, ৬/২৫০।
১১। আমালুল আলাম, ২৩৪।
১২। সুরা তাওবা, ৩৮-৩৯।
১৩।দাওলাতুল ইসলাম ফিল আন্দালুস, ৭/২৫৪।
১৪। আমালুল আলাম, ১৪৪।

(একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত)

পঠিত : ৬৫৯ বার

মন্তব্য: ০