Alapon

ফিরে দেখে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন



৫ জানুয়ারী ২০১৪ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচন। যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ টি আসনে বিনা ভোটেই প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়। আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতার আসার কিছু সময় পর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল নিয়ে কথা বলতে থাকে। সংসদে আওয়ামীলীগের দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সংসদে বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। একইসাথে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিল পাশ করে। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে। মূলত এর পর থেকেই দেশে একটি অস্থিতিশীল এবং ভীতিকর অবস্থা তৈরী হয়।

এরপর ২০১৩ সালে ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করা হয়। তফসিল ঘোষনার পর থেকে দেশে বিশৃঙ্খলময় পরিস্থিতি তৈরী হয়। প্রায় সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তফসিল ঘোষনার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সহিংসতায় ১২৩ জন নিহত হয়। এর মধ্যে শুধু ভোটের দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারী নিহত হয় ১৯ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই পুলিশের ‍গুলিতে নিহত হয়।

১৫৩ টি আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরও অন্যান্য যেসব আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, সেগুলোতে যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তাও নয়। বাকি আসনগুলোর নির্বাচনে জাল ভোট, ভোট ডাকাতি, ব্যালট ছিনতাই এবং কারচুপির ব্যাপক ঘটনা ঘটে। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত। কতক আসনে স্বয়ং পুলিশকেই জাল ভোট প্রদানে দেখা যায়। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে প্রায় প্রায় ৫০ টি আসনের ৫৮৩ টি কেন্দ্রে জাল ভোটের ঘটনা ঘটে। ৪০ টি আসনের ৩৬৪ টি ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়। ৫০ টি আসনের ৫৮৯ টি কেন্দ্র দখল করা হয় এবং ২০ টি আসনে ৩৪৫ টি কেন্দ্রে ভোট কারচুপি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এমনকি নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদেরও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে জানায়, ইডব্লিউজি।

সবচেয়ে মজাদার বিষয় হলো দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টি প্রধান এইচ, এম এরশাদও নিজের ভোটটা দিতে পারেননি। তাদের এলাকাতেও বিনা ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৫ জানুয়ারীর নির্বাচন নিয়ে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ব্যাপক সমালোচনা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পরদিন (৬ জানুয়ারি) জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, গত কালের একপাক্ষিক এবং নিম্ন অংশগ্রহণের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণহানি এবং সহিংসতার ঘটনায় মহাসচিব দু:খিত। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, বিবাদমান দলগুলো কোনো ধরনের মতৈক্যে পৌছতে ব্যর্থ না হলে একটি শান্তিপূর্ণ, সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো। তিনি সকল পক্ষকে আত্মসম্বরণের চর্চা এবং প্রথমে ও অবশ্যই একটি শান্তিপূর্ণ এবং সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতের আহবান জানান,যাতে জনগণ সমাবেত হওয়া এবং বাক স্বাধীনতার অধিকার চর্চা করতে পারে। জনগণ এবং সম্পদের ওপর সহিংস আচরণ এবং আক্রমণ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

জাতিসংঘ মহাসচিব রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থপূর্ণ আলোচনা শুরু এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান। অংশগ্রহণমূলক, অহিংস, সমঝোতাপূর্ণ এবং আলোচনার নীতির ভিত্তিতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখতে জাতিসংঘের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ‘ব্যর্থ নির্বাচন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচনী সততা প্রকল্প (ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্ট-ইআইপি) নামের একটি বৈশ্বিক প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পটি পরিচালিত হয়।

২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বের ১০৭টি দেশের ১২৭টি নির্বাচনের ওপর করা জরিপের ভিত্তিতে তারা নির্বাচনী সততার ধারণা সূচকও (পারসেপশন অব ইলেক্টোরাল ইন্টেগ্রিটি-পিইআই) প্রকাশ করেছে। ওই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪তম। কোনো কোনো দেশে সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলাদা হিসাব করায় একাধিক নির্বাচন জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিএনপিসহ প্রধান দলগুলো নিরপেক্ষ নির্বাচনী সরকারব্যবস্থার দাবিতে ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক পর্যবেক্ষকই বলেছেন, সমকালীন নির্বাচনগুলোতে আন্তর্জাতিক মান পূরণের ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। তাঁদের মতে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা গেছে নির্বাচিত স্বৈরশাসনগুলোতে (ইলেক্টেড অটোক্রেসি)। দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার খোলস থাকলেও ওই সব নির্বাচনে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ব্যর্থ এসব নির্বাচনের ফলে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে ক্ষয় ধরে, ভোটার উপস্থিতি কমে যায় এবং সরকারের স্থিতিশীলতা দুর্বল হয়ে পড়ে।

জরিপের ফল অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ পাঁচটি নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে মিসর, মোজাম্বিক, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং বাহরাইনের নির্বাচন। সবচেয়ে ভালো পাঁচটি নির্বাচন হয়েছে লিথুয়ানিয়া, কোস্টারিকা, সুইডেন, স্লোভেনিয়া ও উরুগুয়েতে। সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সততার (ইন্টেগ্রিটি) বিচারে ৪২তম এবং কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ৪৫তম অবস্থানে দেখানো হয়েছে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত এই জরিপের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল অংশে অনেকগুলো ব্যর্থ নির্বাচন বড় ধরনের বিপদ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করা হয়। যেসব দেশের ব্যর্থ নির্বাচন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সবার আগে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ‘ফল হিসাবে ১৫৩টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, প্রধানত আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়।’ ওই নির্বাচনে কমপক্ষে ২১ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন আন্তর্জাতিক মান পূরণে কতটা সক্ষম হয়েছে, তা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যর্থ নির্বাচনগুলোর ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে ত্রুটি পুরো প্রক্রিয়াটির যেকোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে এবং তা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন দেশের নির্বাচন পর্যালোচনার ভিত্তিতে বলা হয়, প্রায়ই দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে খারাপ সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে প্রচারণার পর্যায়ে। এগুলো মূলত ঘটছে রাজনৈতিক অর্থায়ন ও সংবাদমাধ্যমে প্রচারণার ক্ষেত্রে। আর ভোটের দিনে অনিয়ম এবং ভোটের পর অনিয়ম ও অসাধুতা কমে আসছে।

নির্বাচন ও রাজনীতি বিষয়ে অন্তত ১০টি বইয়ের লেখক ও বিশেষজ্ঞ নরিস পিপার নেতৃত্বে পরিচালিত এ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি নির্বাচনের বিষয়ে গড়ে ৪০ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষক, বিশেষজ্ঞ বা নির্বাচনী কর্মকর্তার মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। সব দেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সব সময়ে সমান গুরুত্ব দেয় না এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরাজিত দল জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ তোলায় নির্বাচনের গুণমান যাচাই করা কঠিন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। নির্বাচনী সততা প্রকল্প দাবি করেছে, বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, সমন্বিত, নিয়মমাফিক এবং ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তাদের সূচকটি তৈরি হয়েছে। ৪৯টি বিষয়ের মান যাচাই করে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী নির্বাচনের মান মূল্যায়নের এই প্রকল্পটি কাজ শুরু করে ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে।

পঠিত : ২৪৭ বার

মন্তব্য: ০