Alapon

আমরা যে কারণে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই না...



এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইসলামের ভিত্তিতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির জন্য অসংখ্য মুসলিমের অন্তরে নিবিড় বাসনা রয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের মানসিক আবহাওয়ায় বহু শিক্ষিত লোকের কাছে এটাও প্রায় একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজনৈতিক জীবনে ধর্মের হস্তক্ষেপ উচিত নয়।

ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আর প্রগতিকে স্বতঃই অভিন্ন মনে করা হয়, ধর্মের আলোকে ব্যবহারিক রাজনীতি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে বিচার করার পরামর্শ মাত্রকেই সোজাসুজি প্রতিক্রিয়াশীল অথবা বড়োজোর অবাস্তব আদর্শবাদ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারেও আমাদের সমকালীন জীবনের আরও অনেক স্তরের মতোই পাশ্চাত্য চিন্তার প্রভাব সন্দেহাতীত।

পাশ্চাত্যের লোকেরা তাদের নিজস্ব কারণে ধর্ম সম্পর্কে (তাদের ধর্ম) নিরাশ হয়ে পড়েছেন এবং পৃথিবীর একটি বিশাল অংশে বর্তমানে যে নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তাতে আমরা এই হতাশারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। একটা নৈতিক বিধান- যা সমস্ত উচ্চতর ধর্মেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য, তারই মাপকাঠিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপকে বিচার না করে এই সব জাতি একমাত্র সময়ের প্রয়োজনের আলোকেই রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনা কর্তব্য বলে মনে করে। এবং যেহেতু সময়োপযোগিতার ধারণা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক দল, জাতি এবং সমাজে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, সেজন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর পরস্পরবিরোধী স্বার্থের প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, এ কথা সুস্পষ্ট যে, কোনো বিশেষ দল বা জাতির কাছে একান্ত ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে যা সময়োপযোগী বলে প্রতিভাত হয়, তা যেন অন্য দল বা জাতির কাছেও সময়োপযোগী বিবেচিত হবে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

এজন্যই মানুষ যদি তাদের কার্যকলাপকে আত্মনিরপেক্ষ নৈতিক বিবেচনার অধীন করতে সম্মত না হয়, তা হলে তাদের স্ব স্ব স্বার্থের মধ্যে কোনো না কোনো পর্যায়ে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং এই পারস্পরিক সংঘর্ষ যত বৃদ্ধি পাবে তাদের স্বার্থের বৈষম্যও ততই বৃদ্ধি পাবে, আর মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যায়ের এবং অন্যায়ের ধারণা অধিকতর পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠবে।

সংক্ষেপে, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ‘ভালো’ এবং ‘মন্দের’, ‘ন্যায়’ এবং ‘অন্যায়ের’ পার্থক্য নিরূপণের জন্য স্থায়ী কোনো আদর্শ বা মাপকাঠি নেই। সম্ভাব্য একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে ‘জাতির স্বার্থ’। কিন্তু নৈতিক মূল্যের কোনো আত্মনিরপেক্ষ মানদণ্ড না থাকায় বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এমনকি একটি জাতির মধ্যে বিভিন্ন দল জাতির পরম স্বার্থ কীসে নিহিত রয়েছে, সে সম্পর্কে ব্যাপক বিক্ষিপ্ত ধারণা পোষণ করতে পারে এবং সাধারণত তা করেও থাকে। একজন পুঁজিবাদী যেমন সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গেই বিশ্বাস করতে পারে যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্থলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সভ্যতা বিলুপ্ত হবে; তেমনই একজন সমাজতন্ত্রীও অনুরূপ আন্তরিকতার সঙ্গেই এই মত পোষণ করে যে, সভ্যতার স্থায়িত্ব নির্ভর করে পুঁজিবাদের উৎপাদন ও তার স্থলে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ওপর। মানুষের প্রতি কীরূপ আচরণ করা উচিত এবং কীরূপ আচরণ অনুচিত এ সম্পর্কে উভয় দলই তাদের নিজস্ব নীতিশাস্ত্রসম্মত মত দিতে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে তাদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে থাকে, যার ফল হচ্ছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা।

এ সত্য আজ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কমিউনিজম, জাতীয় সমাজতন্ত্র, সামাজিক গণতন্ত্র ইত্যাদি সমসাময়িক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কোনোটিই এই বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলার অনুরূপ কিছুতে রূপান্তরিত করত সক্ষম হয়নি। একমাত্র এই কারণে যে, অবিমিশ্র নৈতিক মূল্যের আলোকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলিকে বিচার করে দেখার আন্তরিক চেষ্টা এদের কেউই করেনি। পক্ষান্তরে, এই ব্যবস্থাগুলোর প্রত্যেকটিরই ভালো-মন্দের ধারণার ভিত্তি হচ্ছে কোনো না কোনো শ্রেণি দল অথবা জাতির কল্পিত স্বার্থের ওপর- অন্য কথায়, বৈষয়িক ব্যাপারে মানুষের পরিবর্তনশীল (এবং আসলে নিয়ত পরিবর্তনশীল) পছন্দের ওপর।

আমাদের যদি মেনে নিতে হয় যে, এটা মানবিক ব্যাপারাদির একটা স্বাভাবিক এবং সেই হেতু ঈপ্সিত অবস্থা, তা হলে তাৎপর্যের দিক দিয়ে আমরা এ কথাই স্বীকার করে নেব যে, ‘উচিত’ এবং ‘অনুচিত’ কথা দুটোর নিজস্ব ও প্রকৃত কোনো অস্তিত্ব নেই, এগুলো সুবিধাজনক অলীক ধারণামাত্র- যা একান্তভাবে সময় এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থারই সৃষ্টি। এই চিন্তার যুক্তিসংগত পরিণতি এই যে, মানবজীবনে কোনো নৈতিক দায়িত্বের অস্তিত্ব অস্বীকার করা ছাড়া মানুষের পক্ষে গত্যন্তর থাকে না। কারণ, নৈতিক দায়িত্বকে অবিমিশ্র কিছু বলে ধারণা না করলে নৈতিক দায়িত্বের ধারণাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। যখনি আমরা স্বীকার করে নিই যে, উচিত-অনুচিত এবং ভালো-মন্দ সম্পর্কে আমাদের মত মানুষের তৈরি এবং সামাজিক প্রথা ও পরিবেশজাত পরিবর্তনীয় ধারণা মাত্র, তখন আর আমাদের কাজকর্মে এগুলোকে নির্ভরযোগ্য দিশারিরূপে আমরা হয়তো ব্যবহার করতে পারি না।

তাই ওই সব ব্যাপার-বিষয়াদির পরিকল্পনার বেলায় সমস্ত নৈতিক হেদায়াতকে ত্যাগ করতে এবং সম্পূর্ণভাবে সময়ের উপযোগিতার ওপর নির্ভর করতে ক্রমে ক্রমে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি। এটাই আবার দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দলের মধ্যে নিত্যবর্ধনশীল মতদ্বৈতের জন্ম দেয় এবং আল্লাহ কর্তৃক স্বেচ্ছাপ্রদত্ত মানবিক সুখের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস করে দেয়। আধুনিক জগতের সর্বত্র যে সুগভীর অশান্তি দৃশ্যমান, সম্ভবত এটাই তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা। যদি না এবং যতক্ষণ না কোনো জাতি বা সম্প্রদায় অন্তরচেতনা থেকে প্রকৃতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়, সে জাতি বা সম্প্রদায় সুখের সন্ধান পেতে পারে না। আর কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের পক্ষেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সত্যিকার ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভবপর নয়, যদি না সে মানবিক ব্যাপার-বিষয়াদির ক্ষেত্রে ‘ভালো’ কী ‘মন্দ’ কী সে সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে ঐকমত্য অর্জন করতে সমর্থ হয় এবং এই ধরনের ঐকমত্য সম্ভব নয়, যদি না একটা অবিমিশ্র চিরন্তন নৈতিক বিধান থেকে উদ্ভূত একটা নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে জাতি বা সমাজ একমত হয়। এ কথা বলা বাহুল্য যে, এই ধরনের বিধান এবং তার সঙ্গে, কোনো দলের অভ্যন্তরে দলের প্রত্যেকটি সদস্যকে বাধ্য করতে পারে এমন একটি নৈতিক বিধান সম্পর্কে ঐকমত্যের ভিত্তি শুধু ধর্ম থেকেই পাওয়া সম্ভব।

- * ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি বই থেকে

পঠিত : ১০০১ বার

মন্তব্য: ১

২০২২-০১-১৫ ১১:৫৮

User
কালো পাহাড় বঙ্গ

যে ব্যক্তি নিজেকে সেকুলার দাবি করে সে কি মুসলিম থাকতে পারে?

submit