Alapon

হাব্বারঃ যার নাম অজানা সবার...

বদর যুদ্ধে বন্দী হোন রাসুলুল্লাহর (ﷺ) জামাতা। তাকে মুক্তি দেয়ার সাথে শর্ত জুড়ে দেয়া হলো তিনি যেনো ফিরে গিয়ে রাসুলুল্লাহর (ﷺ) মেয়ে যাইনবকে (রা) মদিনায় পাঠান। যেই কথা সেই কাজ।

ফিরে এসে তিনি পাঠানোর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ভুল করে যাইনাবকে (রা) দিনের বেলা পাঠিয়ে দেন। এতে মক্কার নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ নামক এক ব্যক্তি বাঁধে দেয়ার সময় একটা তীর উটের দিকে ছুঁড়ে দেয়। এতে উট ভয় পেয়ে লাফ দেয় আর যাইনাব (রা) পিঠ থেকে পড়ে যান। এতে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।
মদিনায় আসেন যাইনাব (রা) কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ (সা) সাহাবীদেরকে একটা লিস্ট দিয়ে দেন যাদেরকে দেখা মাত্রই হত্যা করতে হবে। এই লিস্টে নাম ছিল হাব্বারিদের।
.
মক্কা বিজয়ের সময় সে দ্রুত রাসুলুল্লাহর (সা) কাছে যায় এবং প্রাণপণে প্রাণ ভিক্ষা চায়। রাসুলুল্লাহ (সা) অনেক ক্ষমাশীল, তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সে কালিমা পড়ে মুসলিম হয়ে যায়।
.
চার খলিফার আমলে বিশ্বের অর্ধেক কালিমার পতাকাতলে। মুসলিমরা ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীব্যাপী। দিন শেষে তখনকার প্রত্যেকটা মানুষ ছিল একজন দাঈ। তারা যেখানেই যেতেন দাওয়াত দিতেন এবং মানুষদেরকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসতেন।
.
রাজনৈতিক কারণে মুসলিমদের নৌবাহিনী তখনও ছিল না। যদিও ব্যবসাবাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তারা নৌযানে এদিক হতে ওদিক ঘুরে বেড়াতেন। মুয়াবিয়ার (রা) আমলে প্রথম নৌবাহিনী অফিশিয়ালি তৈরী করা হয়। এরই মধ্যে আরবের বাহিরের অঞ্চলের লোকেরাও ইসলাম ধর্মগ্রহণ শুরু করেছে। যার নেপথ্য ছিল মুসলিম ব্যবসায়ীরা।
.
আরব ভূমি ইসলামের ছায়াতলে আসলেও বাকি অঞ্চল তখনও অন্ধকারে। উমাইয়্যারা এদিকে দুর্দান্ত শাসন করছে। কিছু সংখ্যক মুসলিম তখন ব্যবসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় শ্রীলংকা ও এর আশেপাশের অঞ্চলে। সেখানে গিয়ে তারা ব্যাবসার পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করে। এতে অনেকেই তা গ্রহণ করে। এই পরিবারগুলোতেই আবার সেসকল মুসলিমরা বিয়ে করতেন এবং পরিবারের হাল ধরতেন।

এই লোকগুলো আরবে ফিরে আসেনি, সেখানেই মারা যায়। এতে করে পরিবার একাই হয়ে পড়ে বলা যায়। সেখানকার রাজা মুসলিমদের ব্যাপারে অবগত ছিল। তাই সে উমাইয়্যা খলিফাকে চিঠি দিয়ে জানালো সে মুসলিমদের সম্পদ মুসলিমদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে, এতে করে তাদের জীবন ভালোই কাটবে। মুসলিমরা বরাবর গ্রহণ করতে রাজী ছিল। একই সাথে অনেক উপঢৌকনও পাঠান।
.
সমুদ্র পথে যাত্রা করা যতটা না রোমাঞ্চকর ঠিক তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর! কোন দিক থেকে যে বিপদ চলে আসে তার ঠিকঠিকানা নেই। তখনই খবর আসলো সিন্ধ অঞ্চলের জলদস্যুরা জাহাজ হাইজেক করে মুসলিমদের নিয়ে গেছে।

ক্ষোভে ফেঁটে পড়লেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ! রক্ত তখন তার মাথায় উঠে গেছে। মনে হচ্ছে যেন তিনি এই মুহূর্তে তাদের খেয়ে ফেলবেন। সিন্ধু এলাকার রাজার সাহায্য চাইলে সে এ ব্যপারে নাকচ করলে হাজ্জাজ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে যান। তিনি এবার সাম্রাজ্যে থাকা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের জড় করার হুকুম দিলেন রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।

তরুণ এক যুবক, দেখতে ফর্সা, টানটান চোখ, সিল্কি চুল যেন তার চুল থেকে মণিমুক্তা নামছে, লৌহ বর্ম পরনে, হাতে নাঙ্গা তলোওয়ার নিয়ে হাজির হলেন হাজ্জালের কাছে। কাঁধে হাত রেখে হাজ্জাজ তাকে সিদ্ধুকে বিজয় করা তার চাই চাই বলে নির্দেশ দেন।
তাগড়া যুবক যখন বেরিয়ে যাবেন, তখন ডাক দিয়ে বললেন, "কাসিম! দাহিরের রাজ্যে দাহির যেন জীবিত না থাকে!"

১৭ বছরের এই যুবককেকে সেনাপ্রধান করে হাজ্জাজ ৬ হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যসহ সিন্ধু প্রদেশ প্রেরণ করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম ইরানের পথ হয়ে মাকরানের মধ্যে দিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্দুর দেবল বন্দরে উপস্থিত হন। মুসলিমরা একের পর এক নগরী বিজয় করতে থাকে।

মুসলমানরা এবার সিন্ধু রাজা দাহিরের সম্মুখীন হন। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মুসলিমরা বিজয় অর্জন করে। সিন্ধু জয় করে এবার পাঞ্জাবের কিছু এলাকা নিজেদের করে নিয়ে মুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন।

সিন্ধু এবার চলে আসে উমাইয়াহ খলিফার অধীনে। এদিকে আব্বাসীদের সাথে যাব নদীর তীরে হেরে উমাইয়্যারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। সিন্ধুতে আব্বাসীদের এতো আকর্ষণ না থাকায় তারা এদিকে আর চোখ দেয়নি। এদিকে ঠিক তখনি সেখানে বসবাসরত আরব গোষ্ঠীর এক ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে। যার নাম উমার বিন আব্দুল আযিয আল-হাব্বারী। এই লোক হলো সেই লোকের প্রজন্ম যাকে রাসুলুল্লাহ (স) মক্কা বিজয়ের দিন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, সেই লোকটি নাম "হাব্বার"
মানসুরা ছিল সিন্ধুর রাজধানী। স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চল যদিও আব্বাসীদের অধীনে আছে বলে ঘোষণা দেয় তখন। মানসুরা ছিল অসাধারণ এক শহর, কী ছিল না এই শহরে! এখানে মানুষরা গেলে ফিরে আসতে চাইতো না। সুন্দর উদ্যান, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দুর্গ ইত্যাদি ছিল আকর্ষণীয়! নতুন এক সভ্যতা যেন সেখানে গড়ে উঠেছিল।

মুলতান নামক আরেক শহর ছিল। আব্বাসীদের আনুগত্য এই নগরীর গভর্নর হুট করে আব্বাসীদের থেকে ছিন্ন করে নিজেদেরকে ফাতেমী খিলাফাহর অধীনে থাকার ঘোষণা দেয় এবং তারা ইসমাঈলী শিয়া হয়ে যায়। এ কারণে সেই এলাকার সকলে সেই ফিরকার অনুসারী ছিল। সিন্ধুর নগরীগুলো হাব্বারীদ গোষ্ঠীর মানুষরা চালাতো। ভেঙ্গে ভেঙ্গে শাসন করায় তারা নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। নিজেদের ভেতরে তো দূরের কথা বহিরাগত আক্রমণ রুখে দেয়ার ক্ষমতাও ছিল না।

এক পক্ষের শক্তি কমলে আরেক পক্ষ জেগে উঠে। ঠিক তাই হলো, মাহমুদ গজনবী তাদের উপর আক্রমণ করলেন। একে একে সব নগরী বিজয় করে নিজের আওতাধীন করে নেন এবং নতুন করে সিন্ধু শাসনকার্য শুরু করে।
.
"কেউ অংহকার করে ইতিহাসে হারায়,
কেউ ক্ষমা পেয়ে, নাম কামায়!"

-ওয়াহিদুল হাদী

পঠিত : ৪৬৮ বার

মন্তব্য: ০