Alapon

সুলতান উলুঘ বেগ ও সমরকন্দের মানমন্দির...



"আমি যেদিন ফের জেগে উঠবো, সেদিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!”
মোঙ্গল শাসনের ত্রাস পৃথিবীর বুকে পুনরায় নামিয়ে আনার প্রত্যয়ে আজীবন সংগ্রাম করে যাওয়া, হার না মানা বীর তৈমুর লঙ, তার কবরের ফলকে উল্লেখিত ঐতিহাসিক কথাটি লিখে রেখেছেন। আবারও ফিরে আসার সাবধান বাণী শুনিয়ে সচকিত করতে চেয়েছেন বিশ্ববাসীকে।

সেই তৈমুর লঙয়েরই নাতি ছিলেন উলুঘ বেগ, যার নামের অর্থ দাঁড়ায়, “মহান যুবরাজ”। তার প্রকৃত নাম ছিলো মুহাম্মদ তারাঘাই। তৈমুরের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দখল যায় পুত্র শাহরুখের কাছে। শাহরুখ, পুত্র উলুঘ বেগকে সমরকন্দের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

ধ্বংস, শোষণ এর মাধ্যমে ভূমি বিজিত করবার যে মিশনে নেমেছিলেন তৈমুর লঙ; পুত্র শাহরুখ এবং পৌত্র উলুঘ বেগ সেই পথে না চলে বরং গড়ার দিকে ই মনোনিবেশ করেন। এ শাসনামলে তিমুরীয় সাম্রাজ্য অর্থনীতি এবং বিজ্ঞানচর্চার এক স্বর্ণযুগ অতিক্রম করছিলো।
সুলতান উলুঘ বেগ। যিনি প্রথমে ছিলেন একজন গভর্নর, পরে উত্তরাধিকারসূত্রে হয়ে ওঠেন সুলতান। ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। জ্যোতির্বিদ্যা, ত্রিকোণমিতি, গোলকীয় জ্যামিতি সহ জ্ঞানের বিবিধ শাখার প্রতি তার ছিলো বিশেষ কৌতুহল। নতুন কে জানার, নতুন করে কিছু আবিষ্কার করবার উদগ্র বাসনা তাকে সর্বকালীন ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের সাধনা, বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চাই ছিল উলুঘ বেগের জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বিষয়।

শাসনক্ষমতা হাতে আসার পর সুলতান উলুঘ বেগ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রসারে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। সমরকন্দকে তিনি সাম্রাজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাইতেন। ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশ বিদেশের স্বনামধন্য জ্ঞানী ওস্তাদদের আমন্ত্রণ জানান সেখানে। বিশেষভাবে আনাতোলিয়া এবং পারস্য থেকে আসা জ্ঞানী শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়।

সমরকন্দের গভর্নর থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে সুলতানের আসনে আসীন হওয়া উলুঘ বেগ অসাধারণ সব অবদান রেখেছেন শিল্প, সাহিত্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে, শিক্ষার প্রসারে এবং জ্ঞানের বিস্তারে। তন্মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য কাজ ছিলো, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা মানমন্দির স্থাপন।

১৪২০ খ্রিস্টাব্দে সমরকন্দে তিনি একটি মানমন্দির (গ্রহ-নক্ষত্র-পর্যবেক্ষণিকা) ও একটি উচ্চতা মাপক যন্ত্র নির্মাণ করেন। বস্তুত উলুঘ বেগের পর জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা মধ্য-এশিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।(১)

গোলাকার তিনতলা একটি স্থাপনা, যার উচ্চতা ও ব্যাসের দৈর্ঘ্য ছিলো যথাক্রমে ৩০ মিটার ও ৪৬ মিটার। ৬০ মিটার দীর্ঘ বিশালাকৃতির একটি সেক্সট্যান্ট কে ঘিরে এ স্থাপনা তৈরি করা হয়।

সময়ের প্রকৃত পরিমাপ এবং নেভিগেশনের জন্য নক্ষত্রের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ই ছিলো এই অবজার্ভেটরি নির্মাণের মূল লক্ষ্য। যেটিকে বিভিন্ন স্কলারগণ মুসলিম বিশ্বের অন্যতম এবং মধ্য এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও নিখুঁত মানমন্দির হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি ১৪২৮ সালে ‘জিজে-গুরকানি’ নামক একটি নক্ষত্র-সূচি তৈরি করেন। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইংরেজ জ্যোতির্বিদ রয়েল ও পরে ইউরোপীয়রা ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার করেছিলেন। (২)

এটি অবস্থিত সমরকন্দের শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে চুপান-আতা সমভূমিতে, প্রাচীন আফ্রাসিয়াব শহরের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে। ১৯০৮ সালে রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্লাদিমির ভিয়াৎকিন এই গোলাকার ত্রিতল মানমন্দিরের ভিত এবং মর্মর পাথরের এক বৃহদাকার, ৩৬ মিটার, সেক্সট্যান্টের মাটিতে প্রোথিত অংশ খুঁড়ে বের করেন।

“ইবন মাসুদ, আল রুমী, আল কুশচি এবং আরও কয়েকজন জ্যোতির্বিদ এইখানে গবেষণা করিয়া ‘জিজ উলুগ বেগ’ নামে যে জ্যোতিষীয় তালিকা প্রণয়ন করেন, তাহাই জ্যোতিষে মুসলমানদের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান।” (৩)

এটি আদতে ছিল একটি স্টার ক্যাটালগ, ১০১৮টি তারার কো-অর্ডিনেটের সূক্ষ্ণ হিসেব সমেত। বলা হয়, টলেমির থেকেও এই ক্যাটালগ আরও বিস্তৃত এবং নির্ভুল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বয়ং উলুঘ বেগ অথবা তার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় একটি ইতিহাস গ্রন্থ। যার নাম- ‘তারিখ-ই-উলুস-ই-আরবায়া’। এই গ্রন্থে চেঙ্গিস খানের পূর্ব-পুরুষ ও তৈমুর পর্যন্ত তার উত্তর পুরুষের ধারাবাহিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়।
সাম্রাজ্য কখনোই স্থায়ী হয় না। আজ এই ভূমি যার দখলে, কয়েক দশক পরেই তার মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে কেবল কীর্তি, অবদান। যা মানুষকে শতকের পর শতক ধরে মানুষের হৃদয়ে জাগ্রত রাখতে সক্ষম।

১.(Encyclopedia of Islam, প্রথম খণ্ড, প্রথম সংস্করণ, নাল্লিনাে কর্তৃক লিখিত, ‘Astronomy’ শীর্ষক প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য)।
২.(ভি. ভি. বার্টহােণ্ড : Ulugl-beg-লন্ডন, ১৯৫৮)।
৩.(পৃষ্ঠা ১৫৩, বিজ্ঞানের ইতিহাস ২য় খণ্ড, সমরেন্দ্রনাথ সেন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স)

- সাবিহা সাবা

পঠিত : ৩৭৩ বার

মন্তব্য: ০