Alapon

মাজহাব মানার প্রয়োজনীয়তা এবং কিছু কথা...



এক ভাই প্রশ্ন করেছেন, আমি হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। জন্মের পর আমার মা-বাবা বললেন, আমি নাকি ‘হানাফী’। কিন্তু আমি জানি না হানাফী মাজহাব কী। এখন আমি কি করবো? মাজহাব মানবো, নাকি মানবো না?
.
প্রশ্নটি খুব গভীর একটা প্রশ্ন। আমি সহজে বুঝানোর চেষ্টা করবো, ইন শা আল্লাহ। একটা মাজহাব হলো আল্লাহর শরীয়ত বুঝার জন্য মানবিক প্রচেষ্টা (Human attempt)। কাদের প্রচেষ্টা? শ্রেষ্ঠ আলেম-উলামাদের প্রচেষ্টা। যেমন: ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আশ-শাফে’ঈ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (আল্লাহ সবার উপর রহম করুন)। তারা ছাড়াও আরো অনেকেই এই প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। একটা সময় ছিলো কমপক্ষে চল্লিশটি মাজহাব ছিলো। কিন্তু বর্তমানে চারটি সুন্নী মাজহাব সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, প্রচলিত।

ইদানীং একটা গ্রুপ বলে, ‘আমরা শুধুমাত্র কুরআন-হাদীস’ মেনে চলবো। এই স্লোগানটি সুন্দর, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাজহাবগুলোও তো কুরআন-হাদীস মানছে, তারা তো কুরআন-হাদীসের বাইরে গিয়ে মাজহাব তৈরি করেনি। আপনি যখন বলবেন, “আমি মাজহাবগুলো মানবো না, আমি সরাসরি কুরআন-হাদীস মানবো” তারমানে আপনি নিজেই আরেকটা মাজহাবের প্রবর্তন করলেন।

খুব সহজেই একটা বিষয় বলি। আপনি যদি কোনো শায়খকে, কোনো হুজুরকে কয়েকশো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন, তাহলে হুজুর/শায়খ কিন্তু একটা হাদীসের কিতাব খুলেই আপনার উত্তর দিতে পারবেন না। এটা সম্ভবও না।

মাজহাব কী করে? মাজহাব একটা প্যারামিটার সেট করে, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘প্যারাডাইম’ আরবীতে যাকে বলে ‘উসূল’। এই প্যারামিটার সেট করে মাজহাব নির্ধারণ করে, আমরা কিভাবে একটা হাদীস বুঝবো, কিভাবে পরস্পর বিসাদৃশ্যপূর্ণ হাদীসগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।

ইসলামের একটা বেসিক প্রশ্নও আপনি কিন্তু হাদীসের বই খুলে দিতে পারবেন না। আপনার দরকার একটা Systematic Framework. মাজহাব মূলত এই কাজটিই করে।

একটা উদাহরণ দেই। আপনি ওজু করবেন। ওজু কিভাবে করবেন? সেটার পদ্ধতি আপনি পাবেন কুরআনের সূরা মায়িদায়। আপনি মুখ ধৌত করবেন, হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবেন, মাথা মাছেহ করবেন, পা ধৌত করবেন [সূরা মায়িদা: ৫:৬]। খুব সহজে এটা আপনি কুরআন থেকেই জানতে পারবেন।

কিন্তু, যদি এমন হয়, কুরআনে যে ধারাবাহিকভাবে এগুলো করার কথা বলা হয়েছে আপনি সেই ধারাবাহিকভাবে না করে ব্যতিক্রম করলেন? ধরুন আপনি প্রথমেই মুখ না ধুয়ে মাথা মাছেহ করে ফেললেন? এখন কী হবে? আপনার ওজু কি ঠিক হবে নাকি হবে না?

এই প্রশ্নের উত্তরটি আপনি কুরআন-হাদীসের কোথাও পাবেন না। এখন আপনি দেখবেন, দুটো মাজহাব বলবে, “না, আপনার ওজু হয়নি। আপনাকে আবার ওজু করতে হবে। কারণ, কুরআনে যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই করতে হবে।”

দুটো মাজহাব বলবে, “হ্যাঁ, আপনার ওজু হয়ে যাবে। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সুন্নাহ, এটা কিন্তু ওয়াজিব না। ভুলে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করলে ওজু নষ্ট হবে না।” যেমন: আপনার মা আপনাকে বললেন, “ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আসো আর আমাকে এক গ্লাস পানি দাও।” আপনি কী করলেন, আগে আপনার মাকে পানি এক গ্লাস দিলেন, তারপর ছাদ থেকে কাপড় আনতে গেলেন। তারমানে আপনার দুটো কাজই হয়ে গেলো।

তারমানে, আপনি যদি ওজুতে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করেন তাহলে আপনার ওজু হবে কি হবে না এটা নিয়ে স্পষ্টভাবে কুরআন-হাদীসে কোনো নির্দেশনা পাবেন না। কুরআন-হাদীস ঘেঁটে আপনাকে এই নির্দেশনা জানিয়ে দিচ্ছেন মাজহাবের ইমামগণ।

আরেকটা সহজ উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি ওজু করতে গিয়ে মুখ ধোবার পর আপনার ফোন আসলো। ইমার্জেন্সি কল। আপনি আধঘন্টা ফোনে কথা বলে আবার ওয়াশরুমে ঢুকলেন। এখন আপনি কই থেকে শুরু করবেন, আগের হাত ধোবার পর থেকে নাকি নতুন করে আবার ওজু শুরু করবেন?

আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এর সমাধান, এর স্বপক্ষে কোনো হাদীস পাবেন না।

মাজহাব এই কাজগুলো করেছে। কুরআন-হাদীস থেকে ‘উসূল’ বের করেছে, প্যারাডাইম বের করেছে। মাজহাব কুরআন-হাদীসের বিপক্ষে নতুন কোনো মত দাঁড় করেনি। গতো চৌদ্দশো বছর ধরে পুরো মুসলিম উম্মাহ এই Systematic Method বা ‘উসূল’ ফলো করেছে, যাকে আমরা ‘মাজহাব’ বলি।

আরেকটা বিষয় আমি ক্লিয়ার করে নিই। মাজহাব মানা কিন্তু ওয়াজিব না। ‘ওয়াজিব’ শব্দটি অনেক জটিল একটা শব্দ। এর মানে হলো- আল্লাহ আপনাকে আদেশ দিয়েছেন এটা মানার জন্য। কিন্তু, এটা ঐতিহাসিক সত্য, আমাদের কমনসেন্স দিয়েই বুঝতে পারি, মাজহাব মানাটা হলো আমাদের দ্বীন মানাকে সহজ করার জন্য।

শেষকথা বলে নিই। মাজহাব মানার ক্ষেত্রে দুটো অপশন।

অপশন এক. আপনি হানাফী মাজহাব অনুসরণ করেন, আমার কাছে এসে যদি জিজ্ঞেস করেন, এই বিষয়ে হানাফী মাজহাবের ফতোয়া কী? তাহলে আমার না জানা থাকলে আমি হানাফী মাজহাবের ফতোয়া চেক করে আপনাকে এসে বলে দেবো, আপনি সেটা ফলো করবেন। এটা হলো একটা উত্তম সমাধান।

অপশন দুই. আপনি যেকোনো প্রশ্ন একজন আলেমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, সেই আলেম আপনাকে কুরআন-হাদীস ঘেঁটে উত্তর দিবে। সে কোন মাজহাবের আলোকে দিয়েছে এটা আপনার জানার দরকার নাই। কারণ, আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘তোমরা যদি না জানো তাহলে যে জানে তার কাছ থেকে জেনে নাও’।

আরেকদিন আরেকটা প্রশ্ন জানতে চাইলে আরেকজন শায়খকে জিজ্ঞেস করলেন, হয়ে গেলো। আপনি ফলো করলেন কাকে? একজন আলেমকে। তিনি হানাফী/শাফে’ঈ/মালিকী/হাম্বলী সেটা কোনো ব্যাপার না। হানাফীরটা ভালো নাকি শাফে’ঈরটা ভালো সেটা বিচার করার তো যোগ্যতাও আপনার নাই। তারমানে এই জায়গায় আপনি একজন আলেমকে মেনে নিলেই হলো।

এটা বুঝানোর জন্য আমি আরেকটা সহজ উদাহরণ দিই। আমি কোনো ডাক্তার নই। আমার অসুখ হলে আমি ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার তাঁর চিকিৎসাবিদ্যার আলোকে আমাকে ওষুধ দেন। ডাক্তার যখন ওষুধ দিলেন তখন কি আমি জিজ্ঞেস করি, এই ওষুধটি আপনি কোন বইয়ের আলোকে দিয়েছেন, রেফারেন্স দিন? নাহ, আমি এমন প্রশ্ন করি না। আমি মেডিকেলেই পড়িনি, আমি কিভাবে ডাক্তারকে এসব প্রশ্ন করবো।

আবার, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আমি তারচেয়ে ভালো কোনো ডাক্তার, অর্থাৎ আগে দেখিয়েছিলাম জেনারেল ডাক্তার, এখন দেখালাম ‘স্পেশালিস্ট’ ডাক্তারকে। তিনি বললেন, “আগেরটা একটু ভুল ছিলো, তুমি এটা মেনে চলো।” তখন আমি স্পেশালিস্ট ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মেনে নিলাম। এটাও ভালো।

কিন্তু, ভালো মতো শুনেন। ‘ফতোয়া শপিং’ করতে পারবেন না। এটা কিন্তু allow না। সহজ ফতোয়া মানার জন্য দশজন আলেমের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা অনুমোদিত না। যেমন ধরুন, আপনি দশজন ডাক্তারের কাছে গিয়ে দশটা প্রেসক্রিপশন জোগাড় করলেন। দশটা প্রেসক্রিপশনের মধ্যে যে প্রেসক্রিপশনের ওষুধের দাম সবচেয়ে কম সেটা কিনেন? নাহ, আপনি বরং সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে দামি ওষুধ কিনেন।

যখন আমাদের জীবনের প্রশ্ন আসে, তখন কিন্তু আমরা ডাক্তারদের ‘প্রেশক্রিপশন শপিং’ করি না, কিন্তু দ্বীনটা তো আমাদের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীনের বেলায় কেনো ফতোয়া শপিং করবো?

এজন্য আলেমগণ পরামর্শ দেন, ফতোয়া শপিং না করার। হয় আপনি একটা মাজহাব জেনেশুনে মানুন, অথবা কোনো আলেমকে মানুন।

-----
(লেখাটি ইয়াসির ক্বাদির ‘What If I was born in Hanafi Madhab without knowing what reality is’ –এর অনুবাদ)

#আরিফুল_ইসলাম

পঠিত : ৪৬২ বার

মন্তব্য: ০